গ্রন্থ পরিচয় – উত্তরের আলোয় অচেনা ইউরোপ এবং পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি
দীর্ঘদিন আমরা ইংরেজদের দাসত্বে থাকলেও, আমাদের বাল্যে বিলেত অর্থাৎ ইংল্যাণ্ড সম্বন্ধে বেশ সমীহ জাগানো একটা ধারণা তৈরি করেছিলেন, আমাদের বিলেত-ফেরত ডাক্তার ও ব্যারিষ্টাররা। তাছাড়া ইউরোপের যে কটি দেশ সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল ছিল, সেগুলি হল, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি, স্পেন, গ্রীস ইত্যাদি। আরও কিছু দেশ যেমন, পোল্যাণ্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়াকে চিনতাম সে দেশের ডাকটিকিট সংগ্রহের সুবাদে। এখনও মনে আছে, পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরি এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার স্ট্যাম্পগুলি, ইংল্যাণ্ডের “মহারাণি” মার্কা একঘেয়ে স্ট্যাম্পগুলির তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং চিত্তাকর্ষক ছিল। আরেকটা দেশের নামও মনে আছে - “নিশীথ সূর্যের দেশ” নরওয়ে!
আলোচ্য গ্রন্থদুটি পড়া শেষ করে মনে হল, লেখকের হাত ধরে ইউরোপের ওই অচেনা-অজানা-অস্পষ্ট দেশগুলি থেকে এইমাত্র যেন ঘুরে এলাম।
প্রথম গ্রন্থঃ উত্তরের আলোয় অচেনা ইউরোপ
লেখকঃ হীরেন সিংহ রায়
প্রকাশকঃ দে পাবলিকেশন্স
প্রাপ্তিস্থানঃ আদি দে বুক স্টোর, দে বুক স্টোর, দে’জ পাবলিশিং, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩
এই গ্রন্থে তিনি নর্ডিক দেশগুলি - ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, আইসল্যাণ্ড, ফিনল্যাণ্ড এবং বাল্টিক দেশসমূহ এস্টোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন।
দ্বিতীয় গ্রন্থঃ পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি (প্রথম খণ্ড)
লেখকঃ হীরেন সিংহরায়
প্রকাশকঃ গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশন
প্রাপ্তিস্থানঃ
এই গ্রন্থে পূর্ব ইউরোপের যে কটি দেশের কথা তিনি শুনিয়েছেন, সেগুলি হল, পোল্যাণ্ড, পূর্ব জার্মানি, রাশিয়া।
লেখকের ইউরোপের প্রবাস-জীবন শুরু হয়েছিল স্টেট ব্যাংক অফ ইণ্ডিয়ার ফ্রাঙ্কফুর্ট অফিসে। সেখানে বছর তিনেক থাকার পর, যখন এসবিআই থেকে ঘরে ফেরার ডাকের প্রতীক্ষায় তিনি দিন গুনছেন। সেই সময়ে তাঁর জেগে উঠল মধ্যবিত্ত বাঙালীর চিরন্তন আশঙ্কা – পরে আবার ইউরোপ আসা হয় কি না হয়, এই দেশগুলি কী অচেনা অজানাই রয়ে যাবে চিরকাল? অতএব অনতিবিলম্বে ছোট একটি ব্যাগ, দিনগত পাপক্ষয় করার মতো কিছু মার্ক আর সুলভে উত্তর ইউরোপ ভ্রমণের “নর্ডিক পাস” পকেটে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। সেই নর্ডিক পাস দেখিয়ে ট্রেন, জাহাজ, নৌকা কিংবা বাসে যথেচ্ছা চড়া যেত। তদুপরি ওই দেশগুলিতে ভারতীয় পাসপোর্টের জন্যে ছিল ভিসাহীন অবারিত দ্বার। সালটা ১৯৮০। আজকের দিনে সেসব স্বপ্নবৎ।
এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত আধুনিক ট্যুর প্যাকেজ “একুশ দিনে ইউরোপ ভ্রমণ”-এর সঙ্গে একেবারেই মিলবে না। কারণ লেখক কোপেনহেগেন ঘুরেছেন সাইকেলে – যে সাইকেলে সে সময় ব্রেক থাকত না। তিনি ট্রেনে ফিনল্যাণ্ড থেকে কেমি হয়ে সুইডেন যাওয়ার পথে, হোটেলের খরচ বাঁচিয়ে রাত্রে নিখরচায় শান্তিতে ঘুমোনর জন্যে কেমি-কক্কলা-কক্কলা-কেমি জার্নি করেছিলেন। এবং কক্কলা স্টেশনের বন্ধ ওয়েটিং রুমে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলেন, স্টেশন মাস্টারের অনুমতি নিয়ে। দরিদ্র ভারতীয় সেই ছোকরা অভিযাত্রীর এমন আবদার স্টেশন মাস্টাররা মেনে নিয়েছিলেন সানন্দে, এবং বলেছিলেন, বিরল এই আবদারের কথা আজীবন তাঁরা শোনাবেন তাঁদের বন্ধু-বান্ধব ও পরিজনের কাছে!
এই ভ্রমণের বেশ কয়েক বছর পরে লেখক এই দেশগুলিতে বারবার ফিরে গিয়েছেন, তাঁর ব্যাঙ্কের কর্মসূত্রে। সেই সব যাত্রায় তিনি উড়োজাহাজে উড়েছেন, থেকেছেন বিলাসী হোটেলে, যত্রতত্র ঘুরেছেন বহুমূল্য বাহনে। তাঁর সঙ্গী হয়েছেন কর্মসূত্রে পরিচিত ঘনিষ্ঠ বিদেশী বন্ধুরা। যদিচ তাঁর মনে আর দৃষ্টিতে রয়ে গিয়েছিল সেই ছোকরা অভিযাত্রীর মতোই অকুণ্ঠ কৌতূহল ও সংবেদন।
কর্মসূত্রে এইধরনের ভ্রমণকে বাংলায় “রথদেখা-কলাবেচা” বলে। তিনি রথও যেমন দেখেছেন, তেমনি কলাও বেচেছেন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে। ব্যবসায়িক কর্মের নানান অভিজ্ঞতার সঙ্গে তিনি বর্ণনা করেছেন প্রত্যেকটি দেশের অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের কথা এবং বিশ্লেষণ করেছেন তার পিছনে নানান অসঙ্গতি অথবা দুর্নীতির কথা। ব্যাংকিং ব্যবসা এবং অর্থনীতিতে আমাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞানগম্যি না থাকলেও, কিছু আসে যায় না, তিনি অনায়াসে আমাদের পৌঁছে দিতে পারেন আপাত-অগম্য ধারণার কাছাকাছি।
ভলভো কারখানায় তিনি “ভলভো ৯৬০” মডেলের কার, টেস্ট ড্রাইভ করেছেন, সে কোম্পানির জনৈক বড়ো সায়েব ক্লাউসের সঙ্গে। বরফ ঢাকা পশ্চিম সুইডেনের নির্জন রাস্তায় ১০০ কিমি/ ঘণ্টা গতিবেগে চলতে থাকা গাড়িতে আচমকা ব্রেক কষেছেন, গাড়ির এবিএস - নিরাপত্তা চেক করার জন্যে। বিশ্বে সেই প্রথম এবিএস (এন্টি ব্রেকিং সিস্টেম) চালু করেছিল ভলভো। এরপর ওই কারখানাতেই তিনি ভলভো ট্রাক চালিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন, টেস্ট ট্র্যাকের সর্বেসর্বা স্টিগ। আশ্চর্য এই মানুষ স্টিগের সঙ্গে পরিচয়ে মুগ্ধ হয়েছেন লেখক এবং তাঁর সঙ্গে আমরাও।
হেলসিঙ্কির সরকারি অফিসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল পিরকো হলাপ্পার। তাঁর গ্রামের বাড়ি উত্তর ফিনল্যাণ্ডে, গ্রামের নাম পুওলাঙ্কা। পিরকো তাঁকে চিনিয়েছিলেন গ্রামীণ ফিনল্যাণ্ডের সংস্কৃতি আর পরিবেশ। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ আর গাছের সারিতে সাজানো শান্ত নিরিবিলি পুওলাঙ্কা গ্রাম। ফিনরা বাইরে জুতো ছেড়ে নিজেদের ঘরে ঢোকে! আপাত-তুচ্ছ এক সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে তিনি একাত্ম হয়ে পড়েন – কারণ এটি সনাতনী ভারতীয় সংস্কৃতিও বটে! অতি সভ্য ফরাসী, ইংরেজ, জার্মানদের সঙ্গে যা একেবারেই মেলে না।
পরে আরেকবার তিনি পিরকোর সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লেন ফিনল্যাণ্ডের উত্তর প্রান্তের দিকে – যেখানে আরও দুটি দেশের সঙ্গে তার মিলন ঘটেছে – রাশিয়া আর নরওয়ে। পৃথিবীর উত্তরতম বন্দর শহর রাশিয়ার মুরমানস্ক যাওয়ার পথে দেখা হয়ে যায় নরওয়ের দক্ষিণ সীমান্তের শেষ গ্রাম নাইডেন, আর উত্তর ফিনল্যাণ্ডের শেষ গ্রাম নাতামো। জনবিরল সেই যাত্রাপথের দুধারে তাঁদের সঙ্গী ছিল, অজস্র হ্রদ এবং নিরবচ্ছিন্ন সবুজ গাছের মিছিল...।
তাঁর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে আমরা এমনই অজস্র অভিজ্ঞতায় যেমন আশ্চর্য হই, ঋদ্ধ হই, তেমনই তিনি পরিচয় করিয়ে দেন প্রত্যেকটি দেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। দুর্বল দেশগুলির উপর সবল দেশগুলির, সহস্রাধিক বছরের অহংকারী আধিপত্য, সনাতন সংস্কৃতি ও সুপ্রাচীন ধর্মের বিলুপ্তি সাধন, প্রশাসনিক শোষণ...।
যাঁরা ইউরোপকে কাছ থেকে দেখেছেন এবং আমার মতো যাঁরা ইউরোপের সান্নিধ্যে কোনদিন না গিয়েও ইউরোপ সম্বন্ধে সবিশেষ কৌতূহলী, উভয়ের পক্ষেই এই গ্রন্থদুটি অবশ্যপাঠ্য। নিছক দেশ ভ্রমণ নয়, বরং প্রতিটি দেশের সঙ্গে আমাদের সার্বিক পরিচয় গড়ে তুলতে হীরেনবাবুর জাদু লেখনীর কোন বিকল্প নেই।