৯।
বাড়ি ফিরে আরেক প্রস্থ ঝামেলা। ফ্ল্যাটবাড়ির দরজায়ই বিজনবাবু। সব্য তখনও গাড়ি থেকে নামেনি, ভালো করে নাকি পার্ক করছে। সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে শমিতা, তখনই বিজনবাবু। সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। বয়স্ক মানুষ, ওদিকের ফ্ল্যাটে থাকেন। খুব যে দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা হয়, তা নয়। কিন্তু আজ শমিতাকে দেখে কীরকম আশ্বস্ত হন মনে হয়। - আপনি বাড়ি ছিলেননা না?
শমিতা বলে, না, এই তো ফিরছি।
- ও। আসলে আমি একটু গিয়েছিলাম।
- কোথায়?
- আপনাদের ফ্ল্যাটে। আপনারা কেউই ছিলেননা না?
শমিতা একটু অবাক হয়ে বলে, এই সময় তো কোনোদিনই আমরা থাকিনা।
- সে তো জানি। বিজনবাবু চিন্তিত গলায় বলেন। - আসলে ওদিকে একটা আওয়াজ পেলাম। ভাবলাম চোর-ডাকাত নাকি। একবার নক করে দেখি। যা দিনকাল।
আর দিন পেলনা, নক করার। কিন্তু শমিতা কিছু বলার আগেই পিছন থেকে সব্য বলে ওঠে, ওঃ, বেড়াল-টেড়াল হবে। গাড়ি পার্ক করে চলে এসেছে।
বিজনবাবু একটু সন্দিগ্ধ চোখে সব্যর দিকে তাকান। এ কোন চিড়িয়া? - আমাদের বন্ধু। শমিতা আলাপ করিয়ে দেয়। - মানে মনির বন্ধু।
বিজনবাবু একটা দায়সারা নমস্কার করেন। তারপর আস্তে আস্তে বলেন, বেড়াল? কিন্তু ভিতরে টিভির আওয়াজ পেলাম তো।
শমিতা বলে, ওহো। তাহলে চালিয়ে রেখে চলে গেছি মনে হয়।
- আমিও তাই ভাবলাম। বিজনবাবু আস্তে আস্তে বলেন। - বাইরে থেকে তালা দেওয়া। তবু একবার নক করে দেখলাম। কিন্তু নক করতেই টিভি বন্ধ হয়ে গেল।
- এই রে। বলে শমিতা। স্বতস্ফূর্ত ভাবেই। ওইটাই মুখে চলে আসে।
- ফিউজ-টিউজ গেলে ঠিক আছে। পিছন থেকে বলে সব্য। - নইলে, বড় ধাক্কা। আজকাল তো টিভি কেউ সারায় টারায়না।
বিজনবাবুর কানে কিছু ঢোকে বলে মনে হয়না। তিনি একই রকম চিন্তান্বিত ভাবে বলেন, - তারপর আমি মনি মনি বলে দুবার ডাকলাম। একটা গলার আওয়াজও পেলাম মনে হল।
তালা বন্ধ দরজায় কে আবার নক করে রে বাবা। এ তো আচ্ছা জ্বালাতন। শমিতা কী বলবে বুঝতে পারেনা। সব্য গলায় বিস্ময় ফুটিয়ে বলে, গলার আওয়াজ?
- বাড়ি নেই, বলল মনে হল। শিওর না। টিভির মতো জোরে নয়।
- ভিতর থেকে এল?
- কী জানি। তাই তো মনে হল। বিজনবাবু খুবই চিন্তায় পড়েছেন, বোঝা যায়। - আমি সঙ্গে যাব? যদি কেউ থাকে, তো দেখা উচিত তো।
- না না, ওসব কিছু না। সব্য তড়বড়িয়ে উত্তর দেয়। - তাছাড়া আমি আছি তো। চিন্তা করবেন না।
বিজনবাবু একটু মাপেন সব্যকে। ফাঁকা ফ্ল্যাটে দুপুরবেলা বরের বন্ধু। এমনিই সন্দেহজনক। তারপর বলেন, - ঠিক আছে। মানে, বিরক্ত করতে চাইনি কিন্তু।
শমিতা খুবই বিব্রত হয়ে বলে, আরে না না। আমরা আসলে একটু বেরোতাম। আসুননা একটু পরে। চা খেয়ে যাবেন। মনিও চলে আসবে।
বিজনবাবু আরও অবাক হয়ে যান। - বেরোচ্ছেন? দেখা যাচ্ছে, এই ঢুকছে দুজনে। - না, ঠিক আছে, আমাকে একটু দোকানেও যেতে হবে। তারপর কিছু একটা মনে করে, আবার শমিতার দিকে তাকান। - ও, আমি আসলে যে জন্য গিয়েছিলাম ... মানে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?
আবার কী? শমিতা বলে, - হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন না।
- এখানেই বলব? স্পষ্টতই সমস্যাটা সব্যকে নিয়ে। নইলে চারদিকে আর কোনো লোক নেই।
- হ্যাঁ হ্যাঁ, ও মনির খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বলতেই পারেন।
- নাঃ থাক। পরেই আসব।
ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাচ্ছে। সব্য বলে, আমি এগোচ্ছি। কথা বলে নাও না। সমস্যা কী?
সব্য সিঁড়ি ভেঙে ওঠে। বিজনবাবু কছে এসে গলা নামিয়ে বলেন, - আসলে কী জানেন? পুলিশ এসেছিল।
এবার শমিতা সত্যিই চমকে ওঠে। আবার পুলিশ? - আমাদের ঘরে?
- না না। আমার কাছে। তবে আপনাদের খোঁজ করছিল। অন্য ফ্ল্যাটেও গিয়েছিল মনে হয়।
এটা কি অন্য কিছু কেস? না মনি? শমিতা নার্ভাস হয়ে বলে, - কিছু জিজ্ঞাসা করছিল?
- সেরকম কিছু না। সন্দেহজনক কিছু দেখেছি কিনা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার। বলল, চারদিকে দেখছেনই তো কত কিছু হচ্ছে। বোমা, সন্ত্রাস। আমি কিছু মাথামুন্ডু বুঝিনি। তারপর আপনাদের ঘরে গেলাম খবর দিতে। গিয়ে ... কিছু কি হয়েছে নাকি বলুন তো? মানে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স টায়োলেন্স?
উফ, এর মধ্যে আবার ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স। - এই না না। শমিতা তাড়াতাড়ি বলে - মনিকে তো জানেনই।
- সে তো জানিই। কিন্তু। বিজনবাবু ঘাড় নাড়িয়ে নাছোড় গলায় বলেন। - তাহলে পুলিশ এল কেন?
শমিতা ভেবে চলে, মনি আরও কিছু কান্ড ঘটিয়েছে কিনা। - আমিও তো তাই ভাবছি। খুবই অগোছালোভাবে বলে।
বিজনবাবু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শমিতাকে দেখেন। - আপনি কিছু জানেননা? স্পষ্টতই উনি ঠিক বিশ্বাস করছেননা।
শমিতা মরীয়া হয়ে বলে, কী জানব বলুন?
- এ তো মহা সমস্যা। বিজনবাবু বিড়বিড় করেন। - পুলিশে ছুঁলে...
শমিতা চুপ করে থাকে। - যাক। বিজনবাবু বলেন। - আমাকে আবার একটু দোকানে যেতে হবে।
বিজনবাবু দরজা দিয়ে বেরোন। শমিতা অপেক্ষা করে। তারপর দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠে। সব্য দাঁড়িয়ে। বেশিদূর ওঠেনি। শমিতা নার্ভাস হয়ে বলে, শুনলে?
- কিছুটা।
- এবার কিছু একটা করতে হবে। যা পার কর। আমি জানিনা।
- আরে দরজাটা খোলো তো আগে।
শমিতা তালা-চাবি খুলে ঢোকে। প্রথমে চাবি খুঁজে পায়না। তারপর ভুল চাবি ঢোকায়। তারপর দরজা খোলে। হুড়মুড়িয়ে ঢুকে, দরজা বন্ধ করতে করতে চিৎকার করে, - মনি, মনি।
- আরে আস্তে। বলে সব্য।
মনি ধীরগতিতে ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সব্য বলে, এই চল চল ভিতরে চল।
শমিতা জুতো খুলে ছুঁড়ে দেয় দরজার একদিকে। ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে সোফার উপর। তারপর দুমদাম করে ঢোকে ঘরে। - এগুলো কী? টিভি চালিয়ে বসে ছিলে কেন?
- কী করব তাহলে সারাদিন?
- চালিয়েই যদি ছিলে, বন্ধ করলে কেন? আর নিজের গলায় বলেছ, মনি বাড়ি নেই? এটা কি হাস্যকৌতুক হচ্ছে?
- দরজায় বাইরে থেকে তালা দিতে কে বলেছিল?
সব্য গোলাবারুদ সামলাতে বলে, আরে আস্তে, আস্তে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
শুনে শমিতার আরও রাগ হয়ে যায়। - কী ঠিক হয়ে যাবে? ওদিকে পুলিশ, এদিকে পাড়াপ্রতিবেশী, মধ্যিখানে ইনি। আমি কি শখ করে তালা দিয়ে গিয়েছিলাম? এইটুকু কো-অপারেট না করলে কীকরে হবে?
বলেই চুপ করে যায়। কারণ, ঠিক এই মোক্ষম সময়ে ফোন বাজে। আবার। উফ, এ যেন দমকল বাহিনীর কন্ট্রোল রুম। কৃষ্ণকলি। না ধরে উপায় নেই। শমিতা রেগে মেগে ফোন ধরে বলে, তোর আবার কী?
কৃষ্ণকলি অবাক হয়ে বলে, আবার কী হয়েছে? আগের দিন...
- আগের দিন কিছু হয়নি। আমি কিছু জানিনা।
সব্য শমিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মনিকে বলে - এই একটু কফি খাওয়া না। বৌটা খেটেখুটে এল। মাথাটা ঠান্ডা করা।
শমিতা ফোন ধরেই বলে, কী? আমার মাথা গরম?
ওপাশ থেকে কৃষ্ণকলি বলে, আরে কী হয়েছে? সব্যদার গলা পেলাম।
- আমি জানিনা।
সব্য মনিকে এক ঠেলা মারে। - যা না। তারপর শমিতাকে বলে, ফোনটা দাও।
শমিতা বাধ্য মেয়ের মতো ফোন দেয় হাতে। তারপর ধপ করে বসে পড়ে। সব্য মনিকে আর এক ঠেলা মেরে বলে, - আর আমার জন্যও এক কাপ আনিস। তারপর ফোন ধরে, - কী কৃষ্ণাসুন্দরী?
ওপাশ থেকে কৃষ্ণকলির উচ্ছল কণ্ঠস্বর শোনা যায়, - বুঝলে কীকরে আমি?
- আমি সব বুঝি বাওয়া।
- কিন্তু। শমিদির কী হল আবার?
- আরেঃ। ভরাট গলায় বলে সব্য। - শমির একটু স্ট্রেস যাচ্ছে, আর কিছু হয়নি। পরে ফোন করবে। ঠিক আছে?
কৃষ্ণকলি বলে, শিওর তো?
- একদম। এখন রাখি? তোর আমার প্রেমালাপটা তো এখানে করা যাবেনা। পেন্ডিং রইল।
উল্টোদিকে কৃষ্ণকলি হেসে ওঠে। শমিতা ততক্ষণে আবার উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দু হাত তুলে চুল ঠিক করছে। অকারণেই। সব্য তাকাতে, হতাশ ভাবে বলে, আমি জানিনা সব্য। এটা সারবে কীকরে।
সব্য আলতো করে পিঠে হাত দেয়। - বোসো। বোসোওও।
শমিতা আবার বসে পড়ে। চুল ঠিক করে। হাতের নখ খোঁটে। সব্য একটা সিগারেট ধরায়। - কী রে। জোরে জোরে বলে। - তোর কফি হল?
মনি কফির দুটো কাপ নিয়ে ঢোকে। পাশের টেবিলে রাখে একটা। অন্যটা সব্য হাত বাড়িয়ে নেয়।
সব্য কফির কাপ নিতে নিতে বলে, শোন, কেসটা ক্রমশ জন্ডিস হচ্ছে বুঝছিস তো?
মনি তাকিয়ে থাকে।
- সেটা তোর দোষ না। তুই জেনেবুঝে করিসনি। অসুস্থ লোক এসব করে ফেলে। কিন্তু তোর দোষ কোনটা জানিস তো?
মনি ঘাবড়ে গিয়ে বলে, কী?
- অসুস্থটা সারানোর চেষ্টা না করা।
- আর কী করব? গেলাম তো থেরাপিস্টের কাছে।
- উফ। আচ্ছা। সব্য হাত-পা নেড়ে বলে। - ওসব বাদ দে। এমনি একটা লোকের বৌ অসুস্থ হলে কী করত? তারকেশ্বরে গিয়ে জল ঢেলে আসত। মায়ের থানে গিয়ে হত্যে দিত। পাগলের মতো করত।
মনি অবাক হয়ে বলে, আমাকে তারকেশ্বর যেতে বলছিস?
- আরে ধুর। বলছি, সেই ড্রাইভটা তোর নেই। তুই মরীয়া নোস।
মনি চুপ করে থাকে থাকে। বিষণ্ণ গরুর মতো করুণ মুখ করে।
- কী হল?
- কী করব সেটা বলবি তো। কাঁদো কাঁদো গলায় মনি বলে। - আমার কি ভালো লাগছে নাকি? বেরোতে ভয় করে। ওদিকে পুলিশ। ইটস নট হেল্পিং।
সব্য গম্ভীর ভাবে বলে, শোন। সমস্যাটা হল, ভয়। এই তো। সেটা কাটানোর প্রচুর উপায় আছে। তোকে দুটো জায়গায় আমি পাঠাব। আমিও সঙ্গে যাব দরকার হলে। সব ইনহিবিশন ঝেড়ে ফেলে যেতে হবে। সব রকম চেষ্টাই তো করতে হবে। যাবি তো?
মনি করুণ মুখে তাকিয়ে থাকে।
১০।
জ্যোতিষীর চেম্বারটা অবিকল মনোবিদের ঘরের মতো। একই রকম নেমপ্লেট। শ্রী জ্যোতিষার্ণব অমৃতানন্দ ব্রহ্মচারী। বিএ এলএলবি। কেবল এখানে একজন কেতাদুরস্ত মহিলা সহকারীও আছেন সঙ্গে - জ্যোতিষ মনে হয় সমষ্টিগত ব্যাপার। জ্যোতিষার্ণবের ভারিক্কি চেহারা। দাড়ি-টাড়ি নেই। ক্লিন শেভন। কপালে তিলক। গলায় রুদ্রাক্ষ। টেবিলের পিছনে একটা গদী আঁটা চেয়ারে বসে। যেতেই খুব খাতির করেন। আসেন আসেন সোব্যোদা। হিন্দি ঘেঁষা উচ্চারণে।
টেবিলের সামনে তিনটে চেয়ার। পিছনে একটা সাদা বোর্ড। বোর্ডে কী করে কে জানে। সব্য মনিকে বলে, বোস বোস।
- চা, কফি, না ঠান্ডা? জ্যোতিষার্ণব সহাস্য মুখে জিজ্ঞাসা করেন।
- আরে ধুর। সব্য বলে। - ওসব ছাড়।
- তা বোললে হোবে? এই দুটো ঠান্ডা নিয়ে এসো তো। দাদা এতোদিন পোরে এলেন।
সহকারী উঠে যায়। সুন্দরী মেয়েটাকে দিয়ে এই কাজ করায়?
জ্যোতিষার্ণব মনির দিকে তাকান। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। - আমার এসিস্টেন্ট সোব কাজেই পোটু। অলরাউন্ডার। হা হা।
থটরিডার নাকি? মনি চুপ করে থাকে। - দাদার কাছে আপনার কেসটা সুনলাম। জ্যোতিষার্ণব বলেন। - আসোলে বেপারটা হোলো, আপনার ব্রেনে লিং আর ধর্মের কানেকসনটা একটু ঘেঁটে গেছে।
লিং জিনিসটা কী মনি বুঝতে পারেনা। সব্য বলে, লিঙ্গ লিঙ্গ।
- হাঁ হাঁ। জ্যোতিষার্ণব বলেন। ওই হোলো। চিন্তা কোরবেন না, ওরকম হয়। আমার কাছে একজন লেডি এসেছিলেন, তাঁর বর আর পরপুরুসের কানেকসনটা ঘেঁটে গিয়েছিল। সেও কিওর হয়ে গেছে।
- পরপুরুষকে বর ভাবতো? কেলো তো রে।
- ওরকম না দাদা। খুব সিক্ষিত লেডি। কিন্তু মাঝে মাঝে উনি আর নিজের বরকে চিনতে পারতেন না। তখন কেউ বাড়ি এলেই চা-টা বানিয়ে পাসে বোসে পোরতেন। একবার তো সোসুরকেও ওগো এদিকে এসো বলে ডাকছিলেন। বাড়ির লোক ভাবল মাথায় ভূত। কিন্তু ভূত কি আর সোত্যি হয়? ওনার কানেকসনটা ঘেঁটে গিয়েছিল। সব বরই তো পুরুস। কিন্তু সোব পুরুসই বর নয়। এইটা উল্টো হোয়ে গিয়েছিল। এইরকম হয়েছিল। জ্যোতিষার্ণব হাতে একটা মার্কার তুলে পিছনের বোর্ডে একটা ভেন ডায়াগ্রাম আঁকেন। বোর্ডের সুফলটা এবার বোঝা যায়। ঠিক যেন সংখ্যাতত্ত্বের ক্লাস। আঁকা শেষ করে ভিতরের গোল্লাটার দিকে আঙুল তুলে বলেন - আমি বোললাম আপনার এই গোলটা মিসিং আছে। রোজ সোকালে উঠে এটা ইমাজিন কোরবেন।
- তাতেই মিটে গেল?
- ওতেই হয় দাদা। আংটি বাংটি সোব মোনের জোর বাড়ায়। আসোল তো মেডিটেশন।
সব্য বলে, বাব্বাহ।
জ্যোতিষার্ণব একটা মধুর হাস্য দেন। এ আর এমনকি ব্যাপার, টাইপ। - ওসোব ছাড়েন দাদা। একটা জিনিস দেখাই। আরে ঠান্ডা কোই?
বলা মাত্র সহকারী দরজা খুলে ঢোকে। হাতে দুটো গ্লাসে কালো পানীয়। মিষ্টি হাসিটি ফাউ।
- নিন নিন। ঠান্ডা খেতে খেতে দেখুন। এই, ওই দিকের ড্রয়ারে একটা ছোবি আছে, কাল প্রিন্ট কোরে রেখেছি, বার কোরোতো।
লোকটা নিজেই বার করতে পারত। কিন্তু জ্যোতিষীদের কায়িক পরিশ্রমে সম্ভবত বারণ আছে। সহকারী ড্রয়ার খুলে ছবি বার করে। তারপর এক পাশে সাবধান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জ্যোতিষার্ণব দেখেও দেখেননা। - আপনার সমোস্যাটা কী জানেন মোনিবাবু? আপনি লিং এর উপরে যে চামড়া, তার সোঙ্গে ধোর্মোকে ইকুয়েট কোরছেন। কিন্তু ধোর্মো থোড়ি চামড়ায় থাকে। ও তো হৃদয়ে থাকে। হৃদয় বলতেই আবেশে চোখ বুজে আসে জ্যোতিষার্ণবের। সুর করে বলেন - হৃদমাঝারে রাখবো ছেড়ে দিবোনা। ছেড়ে দিবোনা। ছেড়ে দিইইবোনা। দাও দাও, ওনাকে দাও, ওনাকে দাও। শেষ কথাটা সহকারীকে। সে ছবিখানা বাড়িয়ে দেয়।
- দেখুন, কীসের ছবি বলুন তো?
মনি ভালো করে ছবিটা দেখে। সাদা মতো আখাম্বা কী একটা। - জানিনা, মিসাইলের মতো দেখতে।
- অ্যাঁ? সব্যও মুখ বাড়িয়ে দেখে। - মিসাইলের পাশে ত্রিশূল? অবশ্য, আজকাল তো নারকেল ফারকেল ফাটিয়ে রকেট লঞ্চ করে।
- আরে দাদা। জ্যোতিষার্ণব হাসেন। - ওটা অমরনাথের লিং আছে।
- ও বাবা, এইরকম নাকি?
- দ্যাখেন দ্যাখেন, কী স্মুথ হচ্ছে। প্রোকৃতির কী আশ্চর্য বেপার।
- ওরে, বলে কিরে? সব্য হাত জোড় করে ফেলে। - তুই না জ্যোতিষী? শিবলিঙ্গ প্রকৃতির সৃষ্টি? তোকে তো এবার সিডিশন দিয়ে দেবে রে। হাতে আংটি ফাংটি পর।
- ওসব তো বাইরে বোলবো দাদা। মিটিং ভিটিং হোলে বোরোবাজারে গিয়ে। জ্যোতিষার্ণবও সহাস্য বদনে বলেন। - আপনার-আমার মোধ্যে কীসের পোলিটিক্স। তারপর মনির দিকে তাকিয়ে, - দেখেন দেখেন দাদা। আপনার জন্যই এনেছি। হাই রেজলিউসন প্রিন্ট।
মনি কিছু মাথা মুন্ডু বোঝেনা। - দেখলাম তো। আপনার পয়েন্টটা কি?
- পয়েন্ট হল এই, জ্যোতিষার্ণব মাথা দুলিয়ে বলেন, - ভালো করে দ্যাখেন, পুরো স্মুদ। কাউকে বোলতে সুনেছেন, এটা মুসলিম লিং আছে?
- কী মুশকিল, এটা তো মূর্তি। মানুষের হলে...
- আরে দাদা, লাখো-লাখো লোক লাইন দিয়ে এই লিং দেখতে যায়। একটা লোককে পয়েন্ট আউট করতে দেখেছেন? কেউ তো কোরবে। আসোলে ওটাই আপনার মিসকনসেপশন। ওভাবে লিং দিয়ে কেউ বিচার করেনা। না হিন্দুরা না মুসলিমরা।
কী অদ্ভুত কথা। মনি বলে, আরে, দাঙ্গা ফাঙ্গার সময়...
- দাঙ্গার সোমোয় থোড়ি লিং চেক কোরে। কে কোন লোকালিটি, কার কী কারবার, সোব আগে থেকে জানা থাকে। হিটম্যানরা চুপচাপ খুন কোরে আসে। কার ওতো টাইম আছে বোলুন তো, ধোরে ধোরে চেক কোরবে।
কী আত্মবিশ্বাস রে ভাই। - আপনি এত কনফিডেন্টলি বলছেন কীকরে?
- সে কোথা বাদ দিন। জ্যোতিষার্ণব আবার হাসেন। - আপনি আপনার বেপারটায় কনসেন্ট্রেট করুন। আপনি সেওরাফুলি গেছেন?
- কোথায়?
- ব্যারাকপুর থেকে গঙ্গা পেরিয়ে।
- না।
- তারোকেসসর?
- না, কেন?
- এবার শ্রাবণমাসে ঘুরে আসুন একবার। লাখো লাখো লোক সেওড়াফুলি থেকে জল তুলে হেঁটে হেঁটে বাবার লিং এ ঢেলে আসে। রাস্তায় জলসোত্রো আছে। ডিজে-বিজে হয়। ডান্স ফান্স কোরে। কাউকে বোলতে সুনেছেন, তারোকেসসোরের লিং কেনো স্মুদ? চামড়া গেলো কোথা?
কী আশ্চর্য কথা। মনি বলে, আরে, বললাম তো, ভগবানের ছাড় আছে।
- দাদা, সোবার ছাড় আছে। আপনারও। প্রোবলেমটা তো আপনার মাথায়। ওটা চোলে গেলেই, সোব ঠিক।
মনি এরও একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু সব্য মাঝ রাস্তায় থামিয়ে বলে, এই, এই। তুই তোর প্রবলেমটা ঠিক করতে চাস কিনা?
জ্যোতিষার্ণব বিগলিত হয়ে বলেন, না না উনি তো ঠিকই বোলছেন সোব্যোদা।
ঠিকই যখন বলছে, তখন মনি আর তর্কটা করে কীকরে। চুপ করে যায়। জ্যোতিষার্ণব আরও বিগলিত হয়ে বলেন, দাদা, জানি, আপনি এডুকেটেড লোক আছেন। এসোব জ্যোতিষ ওতিষে বিসোয়াস কোরেন না। কিন্তু এসেই যখন পোরেছেন, তোখোন, ছোটো ভাইয়ের একটা কোথা সুনবেন?
- বলুন।
- আপনি অমরনাথের ছোবিটা নিয়ে যান। রোজ সামনে নিয়ে একটু মেডিটেট কোরবেন। টেকনিকটা আমার অ্যাসিস্টেন্ট সিখিয়ে দেবে। কঠিন কিছু না, ব্রিদ ইন, ব্রিদ আউট। আপনি খালি মোনে মোনে ভাববেন, হিন্দু লিং এইরকম। আর ছোবিটা ভাববেন। পনেরো দিন দশ মিনিট কোরে করুন। উপোকার না পেলে, এই ভাইকে এসে বোলবেন। ভাই নাকে খোত দেবে।
- এই, থাক থাক। সব্য বলে। - ড্রামাবাজি করিসনা। শেখাবে টা কোথায়?
জ্যোতিষার্ণব বলেন - ওই তো পাসের ঘোরে।
মনিকে এখন মেডিটেশন শিখতে পাশের ঘরে যেতে হবে? সব্যঃ ঠেলা মেরে বলে, যা যা। আরে প্রবলেমটা তোর। দেখই না। সুন্দরী সহকারী বলে, আসুন না। ভয়ের কিচ্ছু নেই। আমি তো আছি।
মনি উঠে পড়ে চেয়ার থেকে। জ্যোতিষার্ণব পিছন থেকে বলেন, - ব্রিদ ইন, ব্রিদ আউট।
১১।
অফিস থেকে বেরিয়ে অসহ্য লাগে শমিতার। কিন্তু সঙ্গে আবার কৃষ্ণকলি। নিজেই আসতে বলেছে। কালকে যা কেলো হল একটা। - কালকের ব্যাপারটা, বুঝলি... শমিতা বলে।
- ও কোনো ব্যাপার না। তুমি আগে মনিদার খবরটা নাও।
শমিতা রাস্তায় এসে উদ্বিগ্ন মুখে ফোন নিয়ে ফোন করে। সব্যকে। ওপাশে যথারীতি ফূর্তিবাজের মতো গলা। - আজকের অপারেশন সুসম্পন্ন।
- ও কিছু বলল?
- কে মনি? একটু গাঁইগুঁই করছিল। আমি বললাম, প্রবলেমটা তোর, ইনিশিয়েটিভ তোর হতে হবে। ব্যস সব শান্ত। একদম বাড়িতে শান্টিং করে দিয়ে এসেছি। চাবিটা নেবে?
- না না। ও তো ডুপ্লিকেট। আপাতত তোমার কাছেই থাক। আর তোমাকে কে যে কী বলে ধন্যবাদ...
- কিছু বলে দেওয়া যাবেনা বস। সব মিটে যাক, পার্টি ফার্টি হবে, মদ-মাংস হবে। মেয়েছেলেটা বললাম না, বৌ ক্যালাবে।
শমিতা হেসে ফেলে। - আমার জানো, একটু খুঁতখুঁত করছিল। একদম জ্যোতিষী? কিন্তু ...
ফোন রেখে দেখে কৃষ্ণকলিও হাসছে। নিজের ফোন দেখতে দেখতে।
- হাসছিস কেন?
- সত্যি, জ্যোতিষী...
শমিতা একটু রক্ষণাত্মক হয়ে বলে, আর কীই বা করার ছিল।
- তুমি আর কী করবে। এ তো পরিষ্কার সব্যদার প্ল্যান। সিগনেচার একদম।
শমিতা একটু বিরক্ত হয়ে বলে - সব্যই বা কী করবে।
- বাব্বা। কৃষ্ণকলি আরও একটু হেসে বলে, কী প্রোটেক্টিভ। ফোন রেখে যা একটা স্মাইল দিলে না?
শমিতা টের পায় মাথাটা গরম হতে শুরু করেছে আবার। - আমি প্রোটেক্টিভ? আর তুই কি?
- উফ, আবারও সেই। তোমার মাথায় কী ঢুকেছে কে জানে।
- আমার মাথায়? শমিতা প্রচন্ড রেগে বলে। - আমার মাথায় কিছু ঢোকেনি। এই সব কিছুর মধ্যে শর্মিলা ফোন করে করে পাগল করে দিল।
কৃষ্ণকলি এবার কুলকুল করে হাসতে থাকে। - অ্যাঁ? আমাকে নিয়ে? তোমরা কি সবাই মিলে পাগল হয়ে গেছ?
এইটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, না? শমিতা একটু থমকে যায়। তারপর কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে বলে, সরি। সরি। সরি। আমার যে কী হয়েছে...
কৃষ্ণকলি ফিচেল হেসে বলে, জেলাসি হতে পারে কিন্তু। যা স্মাইলটা দিলে। পুরো রাধার কী হইল অন্তরে ব্যথা।
এ তো কোনো ভদ্রতা সভ্যতারই ধার ধারেনা। একটা লোক দুঃখপ্রকাশ করল, তাকে কেউ এইভাবে বলে। শমিতা আবার পুরোনো রাগে ফিরে গিয়ে বলে, - মানে?
কৃষ্ণকলি হাতের ফোন দেখতে-দেখতে বলে, - ওয়ান এইট টু থ্রি।
- মানে?
- ট্যাক্সির নম্বর। পৌঁছে গেছে বলছে। দেখ তো।
ট্যাক্সি আবার কোথা থেকে এল? বুক করেছে? - কখন আবার বুক করলি?
- এই তো, যখন প্রেমালাপ করছিলে। ওই যে।
ট্যাক্সিতে দুজনের বেশ ভাবসাব হয়ে যায়। ট্যাক্সিওয়ালা একজন বিহারি লোক। পৃথিবীর সব ব্যাপারেই তাঁর অসীম কৌতুহল। আর দিদিদের জিজ্ঞাসা করে চলেন। খালি বাজারের মোড়ে এসে তিনি বলেন, দিদি গলিতে না ঢুকলে কোনো অসুবিধে আছে? শমিতা বলে, নাঃ, ছেড়ে দিন। ওইটুকু হেঁটে নেব। ট্যাক্সি থেকে নেমে দুজনে হাঁটতে থাকে। একই রাস্তা, একই দেয়াল। শমিতা আড়চোখে দেখে, একজন হিসি করছে। চেনা ভঙ্গীতে। নাঃ ওদিকে দেখবেনা। শমিতা গতি বাড়িয়ে দেয়।
- আরে দৌড়চ্ছ কেন?
- মনি একা আছে। বাড়িতে।
এতক্ষণও তো একাই ছিল। হঠাৎ এইটুকু তাড়াতাড়ি গিয়ে কী লাভ কে জানে। কিন্তু কৃষ্ণকলি সেসব প্রশ্ন আর করেনা। দুজনে দ্রুতগতিতে হেঁটে এলাকাটা পেরিয়ে যায়।
ফ্ল্যাটবাড়ির সিঁড়িতে উঠেই আবার আপদ। আবার বিজনবাবু। দেখে আবার সেই আশ্বস্ত হবার ভঙ্গীতে বলেন - আপনি ছিলেননা না?
শমিতা একটু বিরক্ত হয়েই বলে, না। এই তো ফিরছি।
- ও। আপনার বন্ধু এসেছিলেন।
- জানি।
- ও। আসলে আমি একটা আওয়াজ পেয়ে ভাবলাম, কে। দেখলাম, উনি আর মনিবাবু।
এ কী রে ভাই। এরকম হ্যাজাচ্ছে কেন। - আসলে, আমার একটু তাড়া আছে...
- না না, সে ঠিক আছে। বিজনবাবুও আস্তে আস্তে বলেন। - আমাকেও দোকানে যেতে হবে। পরে বলব তাহলে।
এ তো আচ্ছা ঝামেলা। - আরে বলে নিন না। বলে শমিতা। - অত তাড়াও কিছু নেই।
বিজনবাবু একটু ইতস্তত করে বলেন, - একটু গিয়েছিলাম আর কী। আপনাদের ফ্ল্যাটে।
মানে? - কেউ তো নেই। ওদের তো আবার বেরোনোর কথা। কিছু কি দরকার ছিল?
- না, সে ঠিক আছে। দরকার তেমন নেই। দুজনে এলেন। গেলেন একজন। আমি ভাবলাম, যাই সায়েববাবুর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি। অনেকদিন দেখা হয়নি। গিয়ে দেখি তালা বন্ধ। ভাবছি, আমি কি কিছু ভুল দেখলাম। তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করলাম আর কি। মানে সব ঠিকঠাক তো?
শমিতার পিত্তিটা চটে যায়। - একদম চিন্তা করবেননা। শনি-রবিবার করে আসুননা একবার। দেখে যাবেন।
বিজনবাবু একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। - না না। সে ঠিক আছে। পাড়াপ্রতিবেশীর খোঁজ নিই। পুরোনো অভ্যেস। কিছু মনে করবেননা।
শমিতা বলে, ঠিক আছে তাহলে? বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে।
বিজনঃ হ্যাঁ হ্যাঁ। আমাকে আবার একটু দোকানে যেতে হবে। দরজায় চাবি ঘোরানোর সময় কৃষ্ণকলি ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে - পুলিশ নাকি?
শমিতা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, সর্ট অফ।
১২।
বাড়িতে আবার টিভি চলছে। শমিতা আজকেও চিৎকার করে - মনি, মনি।
মনি আজকেও আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
- টিভি চালিয়ে রেখেছ কেন?
- কী করব তবে বসে বসে?
শমিতা আজকেও জুতো খুলে ছুঁড়ে ফেলে ঘরের একদিকে। ব্যাগ ছুঁড়ে দেয় আরেক দিকে। কৃষ্ণকলি অবাক হয়ে বলে, আরে কী হয়েছে?
- কী হয়েছে? ওই লোকটা, বাইরে যাকে দেখলি, নজরে রেখেছে, শুনতেই তো পেলি। কী গোলমাল পাকাবে কে জানে?
মনি ওপাশ থেকে তেরিয়া ভাবে বলে, - আমার বাড়িতে আমি টিভি চালিয়েছি, ও কী করবে?
- কী করবে? এই থানা, পুলিশ। হাজিরা দেওয়া। এসব হবে ভেবেছিলে? এর পরে কপালে কী নাচছে কে জানে? যদি খবর দেয়?
- কাকে খবর দেবে?
আজকের গোলাবারুদ সামলানোর দায়িত্ব কৃষ্ণকলির। সে বলে, উফ তোমরা থামো একটু।
তাতে অবশ্য লাভ বিশেষ হয়না। মনি গলা উঁচিয়ে বলতে থাকে, আমি আমার বাড়িতে বসে ফোন করতে পারবনা। টিভি দেখতে পারবনা। কে কোথায় খবর দিয়ে দেবে। এইটা নাকি গণতন্ত্র।
- গণতন্ত্র? যেখানে যা খুশি একটা লেকচার ঝেড়ে দিতে পারলেই হল না? পুলিশকে সামলানোর সময় এইসব ডায়লগ কোথায় ছিল?
কৃষ্ণকলি শমিতাকে ধরে বলে - শমিদি। শমিদি। একটু থামো। এরকম করে কোনো কিছু সমাধান হবে কি?
সে তো সব্বাই জানে। কিন্তু নিজের জীবনে ঘটলে তবে বোঝা যায় কত ধানে কত চাল। ওরকম বাইরে থেকে জ্ঞান যে কেউ দিতে পারে। শমিতা দুমদুম করে ভিতরে ঢুকে যায়।
কৃষ্ণকলি বলে, মনিদা। বোসো না।
মনি বসে। কৃষ্ণকলিও। মনি ঠ্যাটার মতো বলে, - আমি আর যাবনা।
কৃষ্ণকলি হেসে বলে, বাড়িতেই বসে থাকবে? থাকো না।
- তুই জানিস, এরা আমাকে নিয়ে কী শুরু করেছে? মনি উচ্চস্বরে বলতে থাকে। - শমি আর সব্য? আজ একটা জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলাম। জ্যোতিষী। জাস্ট ভাব।
- আরে আমিও ঠিক এই কথাই বলছিলাম।
- কোনো লাভ হল? ওরা শুনবেনা। ওরা যা করে, তাই ঠিক।
এগুলো সবই গলা উঁচিয়ে বলা। যাতে শমিতা শুনতে পায়। শমিতাও কি ছেড়ে দেবে? ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সজোরে বলে, না। তুমি যা কর, তাইই ঠিক। যেমন নানা মহিলাকে ফোন।
- উফ, তোমরা থামবে? নাকি আমাকে বাফার হয়ে সারা রাত থেকে যেতে হবে?
শমিতা একবার জ্বলন্ত চোখে তাকায়। তারপর আবার ঘরে ঢুকে যায়। কৃষ্ণকলি জুলজুল করে দেখে। তারপর বলে - উফ।
হ্যাঁ, এইটুকুতেই উফ। আমার জীবনটা যাপন করতে হলে বুঝতিস।
- দেখো মনিদা। এবার কৃষ্ণকলিও জোরে জোরে বলে। - ওদের দোষ দিয়ে কী হবে, সমস্যাটা তো ওদেরও ঘাড়ে এসে পড়েছে। যা পারছে, তাই করছে।
- আমি এনে ফেলেছি? আমার দোষ?
- দেখো, তোমার দোষ কিনা জানিনা। আমরা সবাই মনে করি, যে, তুমি একটু বেশি ভাবছ। তুমি তো এমনিতে খুবই সেন্সিবল। কত পড়াশুনো। আমরা সবাই শ্রদ্ধা করি। সেটাই হয়েছে সমস্যা। তোমার সমস্ত পান্ডিত্য দিয়ে তুমি তোমার মনে হওয়াটা জাস্টিফাই করে যাচ্ছ।
- বেশ তো। মনি তেরিয়া ভাবে বলে। - আমার দোষ। কনসিকোয়েন্সও তাহলে আমিই নেব। আমি আর ওদের পাগলামিতে যাবনা।
কৃষ্ণকলি এবার সোফার উপর পা তুলে বসে। আরাম করে। হেলান দিয়ে আধশোওয়া হয়। তারপর বলে, - সে যেওনা। নিজে নিজেই বুঝে ফেললে তো খুবই ভালো। কিন্তু আজকে তাহলে বাইরে শোবে।
এটার আবার কী মানে? মনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। কৃষ্ণকলি এবার হেসে হেসে বলে, - তোমরা দুজনে দুজনের মাথা ফাটিয়ে ফেলবে তো। আমি তাই থেকে যাচ্ছি রাত্রে। পরপুরুষের সঙ্গে এক ঘরে থাকব নাকি?
সায়েব এবার একটু হাসি-হাসি মুখে তাকায়। কৃষ্ণকলি বলে, চিন্তা কোরোনা। ভালো বালিশ দেব একটা।
এইসব আহ্লাদি শুনতে শুনতে ভিতরের ঘর থেকে শমিতা ভাবে, একটা লোক, এত গুছিয়ে কথা বলছে। কথার পিঠে কথা সাজাচ্ছে। যুক্তির উত্তরে যুক্তিও দিচ্ছে। সে এই সোজা ব্যাপারটা বোঝেনা, যে, লিঙ্গের উপর চামড়াটা জুড়ে দেওয়া যাবেনা? সম্ভব সেটা? নাকি পুরোটাই শোধ তুলছে? কীসের শোধ? কী কারণে, কোথাও কিছু নেই, এইসব এসে পড়ল ঘাড়ে? চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে শমিতার।
১৩।
হাসপাতাল। মনি অবাক হয়ে দেখে, ডাক্তারের চেম্বার অবিকল জ্যোতিষার্ণবের চেম্বারের মতো। দরজায় নেমপ্লেটঃ শ্রী বিভূতিভূষণ গুঁই। এফআরসিএস (লন্ডন), এমডি। ভিতরেও টেবিল। গদি আঁটা চেয়ার। খালি বোর্ডটা নেই, আর সুন্দরী সহকারীর অভাব। তাছাড়া সবই এক। বিভূতিবাবুও ক্লিন শেভন। হাস্যোজ্জ্বল। বয়স অবশ্য একটু বেশি। মনিকে দেখেই তিনি বলে ওঠেন, বুঝেছি, ইনিই মনি। মনি যেমনই হোক, মনি যে তেমনই না বুঝবে কে? কীরকম মজা আছে ব্যাপারটায় না? হা হা।
সব্য দাঁত বার করে বলে, মনি, দেখ তোর লাইনেরই লোক। বিভূতিদা একটু সাহিত্য টাহিত্য করেন। মনিরও কিন্তু পড়াশুনো বিইইস্তর।
- সাহিত্য না, সাহিত্য না, সাহিত্যরচনা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। একটু কাব্য, শাস্ত্র, অলঙ্কার এইসব চর্চা করি আরকি। বিভূতি বাবু ঘাড় নাড়িয়ে বলেন, এই যে ধরুন মনি মনি মনি বললাম, এইটা একটা অলঙ্কার। যমক অলঙ্কার। একই শব্দ একাধিক বার ব্যবহার করা হয়, আলাদা অর্থ। বলে কিন্তু কোনো সাহিত্য রচনা করলামনা। যদিও আপনি সাহিত্যে এটা ব্যবহার করতেই পারেন। বোঝাতে পারলাম?
উফ। পারেও বটে। মনি গোঁজ হয়ে থাকে। সব্য বলে, কীরে?
মনি কিছু বলেনা। একটু হাসির ভঙ্গী করে। সব্য বলে, আসলে, এই সমস্যাটা নিয়ে একটু উতলা হয়ে আছে তো...
- না না, সে বটেই, সে তো বটেই। বিভূতিবাবু আবার ঘাড় নাড়ান। - ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি। দেখুন লিঙ্গতে একটা সমস্যা হয়। ডাক্তারি লিঙ্গোতে। এই দেখো, আবার অলঙ্কার প্রয়োগ করলাম।
সব্য খুব উৎসাহিত হয়ে বলে, এটাও যম?
- যম নয়, যমক। হা হা। কিন্তু এটা তা নয়। দুবার বললাম ঠিকই, কিন্তু সেটা বোঝানোর জন্য। একবারই বলার কথা, দ্ব্যর্থবোধক। সেক্ষেত্রে এটা হবে শ্লেষ।
- সে তো ব্যঙ্গ করা।
- এক্ষেত্রে নয়, এক্ষেত্রে নয়। হা হা। এসো না একদিন মামনিকে নিয়ে। জমিয়ে সবটা বুঝিয়ে দেব। আরও কত কিছু আছে।
সব্য মাথা নাড়ে। অবশ্যই অবশ্যই। তা আর বলতে। এই দুটোই মিলিয়ে মিশিয়ে।
- কিন্তু মামনির আগে মনি । ওঁর ব্যাপারটা আগে দেখা যাক। সমস্যাটার নাম হল ফাইমোসিস। অর্থাৎ কিনা লিঙ্গের উপর প্রয়োজনাতিরিক্ত চামড়া। ব্যাপারটা বুঝলেন?
এই কঠিন সন্ধি সমাসে সব্য অবিভূত হয়ে পড়ে। কেটে কেটে বলে - প্র য়ো জ না তি রি ক্ তো।
- শুধু তাই না, আসল ফোকাল পয়েন্টটা হল, সমস্যা। এটা একটা সমস্যা। কেন সমস্যা? যৌন সংসর্গের সময় কী হয়? ধরুন একটা কলার খোসা একটু খানি ছাড়ানো আছে। একটা ছোট্টো ফুটোয় সেটা ঢোকাতে গেলেন। এবার খোসাটা বাকিটা খুলে আসবে। কলাটাও স্বচ্ছন্দে ঢুকে যাবে ভিতরে। এবার ধরুন, যদি কলার খোসাটা আটকানো থাকে। তাহলে ব্যাপারটা স্মুদ তো হবেই না। আটকে যাবে। টানাটানাটানিতে ব্যথা হবে। ঢোকানোই যাবেনা। বহু লোকের এই সমস্যাটা আছে। কত বড় সমস্যা ভাবতেও পারবেননা। এমনকি ডিভোর্স অবধি গড়ায়।
- অ্যাঁ? যদিও পুরোটাই মনিকে বলা, কিন্তু ঘাবড়ে সব্যই যায়। - একদম ডিভোর্স?
- গড়াবেনা? যৌনসুখ তো বিবাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। হা হা হা। না দিতে পারলে কী হবে?
- সে তো বটেই। ঠিক যেন বাধ্য পড়ুয়া।
- যা হোক, সমস্যা যখন আছে, সমাধানও আছে। কী সেই সমাধান? এবার উনি সব্যকে বোঝাতে থাকেন। বোঝাই যাচ্ছে, আর তুমি তো জানই, সার্জারি। আমরা আছি সেই জন্য। লোকে আসে, মেজর কিছু না। আমরা কুচ করে কেটে দিই। ব্যস। দুদিনে সব সমস্যার সমাধান। আমার ধারণা, একসময় এটা ল্যাজের মতোই খসে যেত। এখন অবশ্য যাবেনা। কারণ আমরা প্রজননের সুবিধে করে দিই। ফলে সিলেকশন প্রেশারটা নেই। কিন্তু। মনির দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বলে, - আপনি ব্যাপারটা বুঝলেন?
মনি বোকার মতো বলে, - কী?
- আরে চামড়া। ওই চামড়াটাই সমস্যা। আপনার সেই সমস্যাটা নেই। যাদের আছে, সমস্যাটা তাদের। আপনার না। আপনি সমস্যামুক্ত। হা হা হা।
তা হবেও বা। মনি তাকিয়ে থাকে।
- এটা যে কী বিরাট সমস্যা, আপনারা বাইরের লোকেরা টেরও পাবেননা। পুরুষদের এইসব সমস্যা নিয়ে তো বাইরে কথা বলা যায়না। কিন্তু ধরুন, ভারত সরকার যদি আজ আইন করে দেয়, যে, সব পুরুষকে প্যান্ট খুলে ঘুরতে হবে।
সব্য বলে, - অ্যাঁ?
- হা হা হা। ব্যাপারটা দৃষ্টিনন্দন হবেনা, কিন্তু ধর দিল। সব্যকে বলেন ডাক্তার। তারপর মনির দিকে তাকিয়ে, - আমার ধারণা, রাস্তার অর্ধেক লোকের আপনি দেখতে পাবেন, চামড়াটা নেই। আমি অবশ্য সংখ্যাতত্ত্বের লোক না। আন্দাজে বলছি। আমাদের তো রোজই অপারেশন থাকে। প্যাকেজও আছে। এক রাত্রি থাকতে হয়। অল ইনক্লুসিভ। বাইরে ঝোলানো নেই অবশ্য। লোকে লজ্জা পাবে। বুঝলেন ব্যাপারটা?
সব্য একটা গুঁতো দিয়ে বলে, বুঝলি?
মনি বলে, হ্যাঁ। লোকে লজ্জা পাবে।
- না না, ওটা না। ওটা তো স্বতঃসিদ্ধ। হা হা হা। বুঝতে হবে যেটা, সেটা হল সমস্যাটা আপনার না। কোনো প্রশ্ন থাকলে বলুন। আপনি লজ্জা পাবেননা। ডাক্তার আর উকিলের কাছে...
মনি বসে থাকে। মাথায় একটা প্রশ্ন আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা জিজ্ঞাসা করা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারেনা।
সব্য বলে, কোনো প্রশ্ন আছে?
মনি একটু ইতস্তত করে।
- কর না।
ঠিক আছে। তাই হোক। - আচ্ছা, বলে মনি, আপনারা চামড়াটা তো কেটে দেন।
- হ্যাঁ, তা দিই।
- সোজা অপারেশন বললেন তো।
- খুবই সোজা।
- আচ্ছা, কাটতে যখন পারেন। মনি থেমে থেমে বলে, - জুড়ে দিতে পারেন না?
বিভূতিবাবু থমকে যান। এরকম প্রশ্ন আশা করছিলেননা, বোঝাই যায়। কিন্তু হাজার হলেও বিজ্ঞানসাধক। অল্পে দমে যাননা। একটু দম নিয়ে বলেন, - দেখুন, কাটা তো খুবই সোজা। কিন্তু জোড়া কি আর অত সোজা? ধরুন, হাত কেটে বাদ দেওয়া যায়, কিন্তু জোড়া কি সোজা? এ কি আর মর্জিনা আবদাল্লার গল্প? এটা অবশ্য অত কঠিন না...
- তাহলে জোড়া যায়?
- ওটা প্লাস্টিক সার্জারির আওতায় পড়ে। কোনো সার্জেন করেছেন বলে শুনিনি যদিও।
মনি বলে, নাঃ। আমিও শুনিনি।
বিভূতিবাবু এইটুকু বিরতিতেই আবার নিজের ফর্মে ফিরে যান। - কিন্তু আপনি জোর করে আবার ল্যাজ লাগাতে যাবেনই বা কেন? হা হা হা। সমস্যা তো আপনার না, যাদের ল্যাজ আছে, তাদের।
- নাঃ। বলে মনি। - আর চেষ্টা করবনা। এইভাবেই থাকতে হবে।
১৪।
কিছুতেই ঝগড়া করবনা। ভাবতে ভাবতে হাঁটে শমিতা। আজ পুরো একা। কে জানে কেন, রাস্তাঘাটও ফাঁকা। দেয়ালের ধারে কেউ হিসি করছেনা। এমনকি সিঁড়িতেও বিজনবাবু নেই। ফাঁকা ফাঁকা। শমিতা ফ্ল্যাটের তালা খুলে ভিতরে ঢোকে। তারপর মধুর স্বরে বলে - মনি।
মনি আজ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
- আজ কী হল?
- হল। একটা শব্দে উত্তর শেষ করে মনি আবার রান্নাঘরের দিকে এগোয়।
- আর কিছু বলবেনা?
- আবার কী? জানই তো সব।
- তাতে কী? তোমার কাছ থেকে তো শুনিনি।
মনি দাঁড়িয়ে থাকে। একলা ঘোড়ার মতো। শমিতা একটু দুঃখের গলায় বলে, আগে তো এক লাইনের কিছু হলে, দেড় ঘন্টা ধরে বলতে।
মনি বলে, রান্না বসিয়েছি।
- শুনতে না চাইলেও বলতে।
- আসছি।
মনি গুটি গুটি পায়ে এগোয়। রান্নাঘরে ঢোকে।
- সরি মনি।
রান্নাঘরে মাইক্রোওয়েভ চালানোর আওয়াজ পাওয়া যায়। শমিতা জোরে জোরে বলে, আই অ্যাম সঅঅরি।
মনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। - ঠিক আছে।
- শুধু ঠিক আছে?
- আপাতত। ঠিকই আছে।
- শোনো না।
- কী।
- আমি ভাবছিলাম...
কিন্তু কী ভাবছিল আর জানা হয়না। কারণ রান্নাঘরে দুম করে একটা শব্দ হয়। প্রচন্ড জোরে বিস্ফোরণের মতো। শমিতা চমকে উঠে বলে, কী হল?
মনি দৌড়ে রান্নাঘরে ঢোকে। শমিতা পিছন পিছন। মাইক্রোওয়েভ থেকে ধোঁওয়া বেরোচ্ছে। মনি আমতা আমতা করে বলে, মাইক্রোওয়েভ।
- কী বসিয়েছিলে?
- ডিম সেদ্ধ।
- উফ তোমাকে বলেছি না, তিরিশ সেকেন্ডের বেশি ডিম যেন না থাকে। তাহলেই বার্সট করবে।
- তুমিই তো ডাকলে।
- আরে। শমিতা বলে। আমি জানব কী করে ডিম।
- জিজ্ঞাসা করনি তো, কী রান্না।
এরকম অকারণে দোষারোপ করলে তো ঝামেলা। শমিতা বলে - কী মুশকিল। তুমি কেয়ারলেস হবে, আর দোষটা আমার?
- না ডাকলে যেতামনা তো।
নাঃ এটা হ্যাবিটে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। শমিতার এবার রাগ হতে শুরু করে। তুমি যা খুশি করবে, তার হ্যাপা আমাকে নিতে হবে। আর দোষটাও আমার। দিস ইজ গ্যাসলাইটিং।
- আমি আরেকটা কিনে আনব।
- আর পয়সা? মাইক্রোওয়েভ কিনতে পয়সা লাগেনা? তিন মাস ধরে তো উইদাউট পে বসে আছ। ইলেকট্রিক বিল, এসির খরচ, ইন্টারনেট, তার উপরে এই।
মনি একটু থমকে যায়। তারপর অদ্ভুত একটা আওয়াজ বার করে গলায়, এরকম গলা এর আগে শোনেনি শমিতা, এই এত বছরের পরিচিতিতে। - তুমি আমাকে বসে খাবার খোঁটা দিচ্ছ?
- তুমি আমাকে দোষারোপ করছ না?
মনি ক্যাবিনেটের দরজা খোলে। একটা কাপ বার করে। তারপর সেই অদ্ভুত গলায় বলে - খোঁটা দিচ্ছ? নাও। এইটা খোঁটার নামে। তারপর, কোথাও কিছু নেই, রান্না ঘরের মেঝেতে কাপটা জোরে ছুঁড়ে মারে। ভয়ংকর জোরে একটা শব্দ হয়। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে পোর্সিলিনের টুকরো।
শমিতা হাঁ করে দেখে। এ জিনিস এর আগে কখনও হয়নি এই বাড়িয়ে। মনি শান্ত ভাবে আরেকটা কাপ বার করে। - এইটা তোমাদের চিকিৎসার নামে। বলে সেটাকেও আছড়ে মারে মেঝেতে। দুনিয়ার যাবতীয় রাগ যেন কাপের উপরে দিয়ে ওগরাচ্ছে। তারপর আরেকটা কাপ বার করে। এইটা...
ঠিক এই সময় টিং করে একটা শব্দ হয় বাইরে। বেল। আবার কেউ এসেছে।
শমিতা তীক্ষ্ণ গলায় বলে, - কী হল? হাতে ধরে আছ কেন? ভাঙো।
টিং করে আবার বেল বাজে। শমিতা বলে - আবার দেখো পুলিশ এল কিনা। নতুন কী করেছ কে জানে।
- আমি কিছু করিনি। আমি তালাবন্ধ থাকি। তারপর দরজার দিকে গলা উঁচিয়ে জোরে জোরে বলে - আমি বাড়িতে নেই। বাড়ি তালাবন্ধ।
নাঃ এই নাটকের কোনো মানে নেই। বাড়িতে একটা পাগল আছে বলে তো সবাই পাগল না। শমিতা হুড়মুড়িয়ে দৌড় দেয় দরজার দিকে। কোনো কাপে বোধহয় জল ছিল। পা পিছলে যায়। পড়তে পড়তে সামলে নেয়। কিন্তু রান্নাঘরের দরজায় একটা জোরে ঠোকা খায় কপালে। এক হাতে কপাল চেপে ধরে দরজায় যায়। খটখট করে ছিটকিনি নামিয়ে দরজা খোলে। উফ। অসহ্য। আবার বিজনবাবু।
শমিতা কী বলবে বুঝতে পারেনা। বিজনবাবু আস্তে আস্তে বলেন - একটা জোরে আওয়াজ পেলাম। কিছু কি হয়েছে?
শমিতা কপাল থেকে হাত নামায়। কালশিটে পড়ে গেছে নির্ঘাত। বিজনবাবু হাঁ করে দেখেন। শমিতা তীক্ষ্ণ গলায় বলে - আপনি কি ওঁত পেতে থাকেন? আড়ি পাতেন?
- না না। ছি ছি। যদি কিছু দরকার লাগে, তাই। বিজনবাবু খুবই লজ্জিত মুখে বলেন। - মনিবাবু আছেন?
- আপনাকে কি ডেকেছে মনি? যদি কিছু লাগে নিশ্চয়ই জানাব। ততক্ষণ বিরক্ত না করলেই খুশি হব।
মুখের উপরেই দরজা বন্ধ করে দেয় শমিতা। তারপর ঘুরে আসে। মনিও বসার ঘরে। চেয়ারে এসে বসেছে। শমিতা সামনে গিয়ে বসে। মুখোমুখি। কেউ কিছু বলেনা, বলার নেই। দুজনে খানিকক্ষণ বসে থাকে। তারপর শমিতাই নীরবতা ভাঙে। - মনি। আমি আর পারছিনা। সত্যি।
- এটা ঠিক হলনা। মনি বিড়বিড় করে বলে।
- আমার দোষ? আবার?
- তুমি। মনি বলে। - তুমি কি আমার থেকে মুক্তি চাইছ?
শমিতা কিছু একটা কথা বলতে গিয়েও থেমে যায়। কী হবে। আবার সেই একই জিনিস শুরু হবে।
দুজনে আবার চুপচাপ বসে থাকে। মুখোমুখি। বেশ খানিকক্ষণ। এবার নীরবতা ভাঙে মনি - শমি। একটা কথা বলি?
- বল।
- এখন যদি এখানে থাকো, তো আমরা আবার এইসবই করব।
- তো কী করব।
- তার চেয়ে তুমি আজ রাতটা থেকোনা। একটু শর্মিলার বাড়ি থেকে ঘুরে এসো।
- চলে যেতে বলছ?
- নাঃ। জাস্ট একটা রাত্রি। আরও ঝগড়া করে কী হবে।
- ও।
- আমিই যেতাম। কিন্তু আমার তো বেরোনো বারণ।
শমিতা কী বলবে বুঝে পায়না। ভুল কিছু তো বলছে না। - আর। মনি বলে। এইসব ফালতু ডাক্তার-টাক্তার দেখিয়ে লাভ নেই। ওসব বাদ দাও।
- বাদ দিয়ে কী করবে?
- আমি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাব। সুস্থ হব। তারপর আবার গোড়া থেকে শুরু করা যাবে।
শমিতার কীরকম একটা ভোঁতা ভোঁতা লাগে। কে জানে, ঠিকই বলছে হয়তো। হলে ভালই। চেয়ার থেকে উঠে পড়ে। রান্নাঘরের দিকে যায়। ওঃ ওখানে তো ঢোকা যাবেনা। মনি পা না কেটে কীকরে বেরোলো কে জানে। নাকি কেটেও গেছে? জানার ইচ্ছেও হয়না। শোবার ঘরে ঢোকে। আলমারি খুলে স্বয়ংক্রিয়ের মতো কটা জামাকাপড় বার করে। একটা ব্যাগে ভরে।
ঘর থেকে যখন বেরিয়ে আসে, তখনও মনি ওই একই ভাবে বসে। একটুও নড়েনি। শমিতা বলে, চললাম।
মনি বসে বসেই বলে, তালা দিয়ে যেও।
১৫।
শমিতা এলোমেলো হাঁটে। রাস্তা দিয়ে যেমন হাঁটে মাতালরা। আলুথালু, অগোছালো। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে নিচে। বিজনবাবুর আর কোনো চিহ্ন নেই। খুবই খারাপ ব্যবহার করা হল, কিন্তু সেই নিয়ে কোনো অনুতাপ বোধ করেনা। বলতে হয়েছে, বলে দিয়েছে। জলের মতো গায়ের উপর দিয়ে চলে গেছে। খতম।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে নিচে। সেখানে আবারও জনতার সাম্রাজ্য। রাস্তা একই আছে, কেবল এই এইটুকু সময়েই ভরে গেছে মানুষে। শমিতা টলমলে পায়ে হাঁটে। কিচ্ছু খেয়াল না করে। লোকে ধাক্কা দিলে দেবে। সামনে একজন লোক পড়ে, কিন্তু সে ধাক্কা দেয়না। পাশ কাটিয়ে চলে যায়। একটু অবাক চোখে দেখে। মহিলাদের তো এভাবে হাঁটার কথা না। কিন্তু ওসবে কিছু এসে যায়না। যা ভাবে ভাবুক।
মোড় ঘুরতেই দেয়াল। সেখানে যথারীতি একজন হিসি করছে। শমিতা একটু এগোতেই পাশে আরেকজনও এসে দাঁড়ায়। একদম গা ঘেঁষে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত কাছাকাছি? ভিজে যাবে তো। গেলে যাক। গোল্লায় যাক, জাহান্নমে যাক যেখানে খুশি যাক।
শমিতা একই ভাবে হাঁটতে থাকে। কিচ্ছু খেয়াল না করে। আশ্চর্য, কেউ ধাক্কা দেয়না। দুজন লোক পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কী অদ্ভুত। তিন নম্বর আরেকটা লোক অবশ্য সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু সেও খুব বিনয়ের সঙ্গে বলে - নমস্কার।
কী দাবী এর?
- চিনতে পারেননি না?
শমিতা সোজা সাপ্টা বলে - নাঃ।
- ওই সেদিন আপনাদের বাড়িতে কল সারতে গেলাম।
- ও।
- পুরো জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। এবার চিনতে পেরেছেন?
ওঃ সেই লোকটা। এই একই কথা রোজ রোজ বলতে এর ক্লান্ত লাগেনা? শমিতা বলে, কিছু বলবেন?
লোকটা বিগলিত হেসে বলে, আপনাদের কি পাইপ ফেটে গেছে?
শমিতা একটু অবাক হয়। - হ্যাঁ?
- আওয়াজ পেলাম একটা।
বাড়িতে কি অ্যাটম বোম ফেটেছে নাকি। - ও। বলে শমিতা।
- সারাতে হবে কিছু?
- না। কিছু হয়নি।
- ঠিক আছে ম্যাডাম। লোকটা বিনীত ভাবে বলে - দরকার লাগলে ডাকবেন।
কীসের দরকার, কার পাইপ। শমিতা কথা না বাড়িয়ে লোকটাকে টপকে চলে যায়। সামনে বাজারের মোড়। কটা কমবয়সী ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। চেঁচামেচি করছে। জীবনে কী ফূর্তি, এখন কয়েকঘন্টা এখানে থাকবে, গজল্লা পাকাবে। সামনে দিয়ে একটা মেয়ে চলে যায়। খুব কায়দা করে হেঁটে। যুবসমাজে চাঞ্চল্য পড়ে যায় তাই দেখে। কেউ চুল ঠিক করে, কেউ তাকিয়ে থাকে। শমিতা চোখের কোনা দিয়ে দেখে। আনন্দ করুক, এই তো বেঁচে নেবার সময়। শমিতা ব্যাগ থেকে ফোন বার করে। শর্মিলাকে একটা ফোন করতে হবে।
শর্মিলা আবার হাঁপাতে হাঁপাতে ফোন ধরে। হ্যালোঃ। সারাদিনই জিম করছে কিনা কে জানে। কী করবে ভালো ফিগার বানিয়ে। থাকার মধ্যে তো সব্য। যাগ্গে যা খুশি করুক। শমিতা সোজাসুজি বলে - শোন তোদের বাড়ি একটু যাচ্ছি।
এই টুকুতেই শর্মিলা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। - কী হয়েছে?
- রাতে থাকব।
শর্মিলা আরও উদ্বিগ্ন হয়ে বলে - আরে কেন? কী হয়েছে?
- থাকা যাবে কি? আজ রাতটা?
- আরেঃ। তা কেন যাবেনা। কিন্তু হয়েছে টা কী।
- কিছু হয়নি বললে থাকতে দিবিনা?
এতক্ষণে শর্মিলা নিরস্ত হয়। অবশেষে। শমিতা বলে - রাখি?
- শোন না।
আবার কী? - বল।
শর্মিলা একটু ইতস্তত করে বলে, একটা কথা বলব? রেগে যাবিনা?
শমিতা বলে, - না। কৃষ্ণকলি আর সব্যর মধ্যে কিছু চলছেনা।
- আরেঃ তা না। উফ। বলছিলাম আমি একটু বাবার বাড়ি এসেছি।
- তাতে আমি রাগব কেন?
- আজ ফেরা যাবেনা। কিন্তু তুই যা, সব্যকে বলে দিচ্ছি। কিন্তু ফিরবনা বললে আবার রেগে যাবি কিনা বুঝতে পারছিনা, তাই।
আর সময় পেলনা বাপের বাড়ি যাবার। অবশ্য, শমিতা ভেবে দেখে, ভালই হয়েছে। নইলে সারাক্ষণ জেরা করে করে প্রাণ ওষ্ঠাগত করে দিত। এখন সত্যিই একটু সাহচর্য পেলে ভালো হয়। কিন্তু সেটা শর্মিলার না। ফলে এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারেনা।
শমিতা ফোন রেখে হাঁটতে থাকে। বাস স্ট্যান্ডের দিকে। কয়েকজন অফিস-ফেরতা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারা ঘুরেও দেখেনা। নিজেদের বসকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। মানে নিন্দে করতে। শমিতা তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভালই লাগে অপরিচিত একজনের নিন্দে শুনতে। সারাদিন মদ টেনে টেনে লোকটা নাকি ভুঁড়ি বাগিয়েছে। বেশিদিন বাঁচবেনা, হার্ট অ্যাটাকে টেঁসে যাবে। গেলেই মঙ্গল, কোম্পানিটা বেঁচে যাবে। পৃথিবীরও নিশ্চয়ই উপকার হবে, কিন্তু সেটা নিশ্চিত করে জানা যায়না। কারণ এরা কেউ টুদিপয়েন্ট না, এই অবধি শুনতেই বাস এসে যায়। শমিতা ধীরে সুস্থে ওঠে। ভালই ভিড়। একটা লোক পাছায় লিঙ্গ ঠেকায়। এতক্ষণে শমিতা একটু আশ্বস্ত হয়। যাক, পৃথিবীটা পুরো বদলে যায়নি এই ক ঘন্টায়।
১৬।
কপালটা শুধু ফোলেইনি, কেটেও গেছে। ডেটল লাগাতে চিড়বিড় করে জ্বলে যায়। শমিতা বলে - উফ।
- আলতুসি একেবারে। হয়ে গেছে। সব্য তুলোটা তুলে নেয়। হেঁটে গিয়ে ফেলে আসে। যত্ন করে শিশিটা রাখে যথাস্থানে। তারপর সোফায় বসতে বসতে বলে- কী হয়েছে, জিজ্ঞাসা করবনা। সে জেরা একবার হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।
শমিতা আবছা করে হাসে।
- হিস্ট্রিতে আমার এমনিও কোনো ইন্টারেস্ট নেই অবশ্য। আমি হলাম হিলার। চাঙ্গা করি।
শমিতা কিছু বলেনা।
- খাওয়া দাওয়া লাগবে তো? নাকি হয়ে গেছে?
- খেতে ইচ্ছে করছেনা সব্য।
- বেশ। সব্য কোনো তর্কের দিকেই যায়না। - তাহলে। একটু মাল খাবে?
- মাল?
- আমি বাবা তোমাদের মতো ড্রিঙ্কস টিঙ্কস বলতে পারিনা। মাল মানে মাল। সব্য একটু চোখ টেপে। - একটু ব্র্যান্ডি ট্যান্ডি। চাঙ্গা লাগবে। হুইস্কি চাইলেও দিতে পারি।
এই অবস্থায় কেউ এরকম করে কথা বলতে পারে, ভাবা যায়না। কিন্তু ওই জন্যই সব্য। শর্মিলার সংবেদনশীলতার চেয়ে এ ঢের ভালো। ওরে তোর কী হল রে, তোর বরের নুনুতে সমস্যা, তুই আর বাঁচবি কী নিয়ে রে। শমিতা আবার একটু আবছা হাসে।
- তা বলে ভেবোনা, মাল খাইয়ে আমি ইন্টু মিন্টু করব।
- ধুর। শমিতা এবার সত্যিই হাসে।
- না না। ধুর না। আমি লোকটা অবশ্য ভালো না। এবং তুমি অবশ্যই আমার ডার্লিং। কিন্তু ঠিক সেইজন্যই কিছু করা যাবেনা, বুঝলে? ব্রিচ অফ ট্রাস্ট হয়ে যাবে।
উফ। পারেও বটে। এবার স্পষ্ট করেই হেসে ফেলে। কী বলা যায় একে? - দাও একটু।
- কী দেব?
- তোমার চয়েস।
সব্য উঠে মদ ঢালাঢালি করে। দুটো গ্লাস বানায়। একটা শমিতার হাতে দেয়। অন্যটা নিজে নিয়ে বসে। শমিতা গ্লাসে একটা চুমুক দেয়। তারপর তাকিয়ে থাকে। কাচের গ্লাসে ঠান্ডা তরল। মনির কথা মনে পড়ে। এ সবই কেমন মাথার উপর দিয়ে জলের মতো চলে যাচ্ছে, কিন্তু মনি এখন বন্ধ ঘরে। একা।
- দেখো। সব্যও একটা চুমুক দিয়ে একই ভঙ্গীতে বলে। - জোরে জোরেও ভাবতে পারো। আমার কোনো নৈতিক আপত্তি নেই।
- ভাবছি। শমিতা মাথা তোলে। - চলে এলাম।
- হ্যাঁ। সব্য মাথা নাড়িয়ে বলে। - আমি কনফার্ম করছি।
- মনিটা একা আছে।
- এটা শিওর না। যদি না অন্য কাউকে জুটিয়ে ফেলে, হ্যাঁ, তাহলে বোধহয় একাই আছে।
শমিতা আবার একটু হাসে। - উফ। ওসব কিছু হয়নি।
সব্য বসে বসে একটু ঘাড় দোলায়। কিরকম কথা বলা পুতুলের মতো। কে যেন দম দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। দূর থেকে দিব্যি লাগে দেখতে। - দেখো। কী হয়েছে জানিনা, তবে আনএক্সপেক্টেড কিছু না।
এটা আবার কী কথা? বর বাড়িতে তালাবন্ধ আর শমিতা এখানে বসে। - আনএক্সপেক্টেড না?
- নাঃ। সব্য একই ভঙ্গীতে বলে। - একেবারেই না। ওকে তো শক থেরাপি দেওয়া হয়েছে। আজকের ডাক্তারটা তো বিশেষ করে। এরপরে একটু রাগবে, জিনিসপত্র ছুঁড়বে, এসব করবেনা?
শমিতা এবার সত্যিই চমকে যায়, ঘোরটা তাতে একটু কাটে। জিনিসপত্র ছোঁড়াটা জানল কীকরে? অন্তর্যামী নাকি?
- সর্ট অফ। সব্য বলে। - অবতার বলতে পারো। কিন্তু জীবনানন্দ টাইপ। জীবদ্দশায় স্বীকৃতি পাবনা।
শমিতা শুনে হাসে। সত্যিই হাসি আসছে।
- আরে একটু ফাটাফাটি হয়েছে তো? যা হয়েছে ভালই হয়েছে। কাল থেকে সব নর্মালসির দিকে আসবে। আর সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে অবশ্যই যেতে বোলো। ব্যস।
- বলছ?
- আমি না। একজন যুগাবতার বলছেন। নাও এবার আরেকটা চুমুক মারো। ওটা হাতে ধরে থাকার জন্য দেওয়া হয়নি।
শমিতা চুমুক দেয়। অনেকটা। এবার সত্যিই একটু ধাতস্থ লাগছে। শরীর যদিও ছেড়ে আসছে। কিন্তু হাল্কা লাগছে। আগের মতো বোদা, অনুভূতিশূন্য ব্যাপারটা আর নেই।
- আচ্ছা একটা কথা বল। শমিতা বলে।
- কী।
- এই ডাক্তারের ব্যাপারটা। এটা তোমার মাথায় এল কীকরে?
সব্য গম্ভীর ভাবে বলে - কানেকশন। কানেকশন বস।
- না না। মাথায় এল কীকরে। এত সব জানলে কীকরে? আমি তো কিছুই জানতামনা।
- সেটা তো ঠিকই আছে। ইয়ে, মানে লিঙ্গ টিঙ্গ আরকি, ওসব তো ইন থিং না। জেন্ডার স্টাডিজে পড়ায়না। জানবে কীকরে?
শমিতার হঠাৎই কীকরম পালকের মতো হাল্কা লাগে। হাসতে হাসতে বলে, আচ্ছা। তাহলে তুমি জানলে কীকরে?
- এইটা একটু অসভ্য কথা হয়ে যাবে। গভীর রাতে একলা মহিলাদের সামনে বলার মতো না।
- থাক থাক। বলো।
সব্য নির্বিকার মুখে বলে, - আমারও তো নুনু কাটা। ওই বিভূতিদার কাছ থেকে। আমি জানবনা?
- মানে? শর্মিলা তো ...
- কী বলবে? আমার বরের নুনু কাটা? লোকলজ্জায় বলেনি, তোমরা আওয়াজ ফাওয়াজ দেবে। নইলে জানে তো বিলক্ষণ। তোমার সঙ্গে এখনও ততটা ঘনিষ্ঠতা হয়নি, হলে তুমিও জানবে।
- ধ্যাত। এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু।
- তাহলে গান শোনো। বাঁড়া হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুনিলনা তো কেহ। রোদ্দুর রায়ের গান।
শমিতা আরও হাসে। কিন্তু এটা কি একটু সীমানা টপকানো হয়ে যাচ্ছে? - থামো থামো। শমিতা প্রসঙ্গ ঘোরায়। - কিন্তু তুমি এইটা মনিকে বললে না কেন?
- কী? তুইও কাটা, আমিও কাটা? আজ বললাম তো। ডোজের তো একটা সময় থাকবে। ঠিক সময় দিয়েছি, ঠিক রেজাল্ট হবে।
শমিতা হাসে। হাসতে থাকে। কোনো পুরুষের সঙ্গে এইসব কথা বলবে, এবং শুনে হাসবে, সারা জীবনে ভেবেছে? হাসতে গিয়ে কপাল টনটন করে। শমিতা বিষয় একদম বদলে ফেলে। - আচ্ছা, এটায় তো ব্যথা কমার কথা। এখনও টনটন করছে কেন? কপালটা?
- কারণ, এটা মদ। পেনকিলার না। একটু বরফ ঘষতে পারো। দাঁড়াও।
সব্য উঠে যায়। ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে। একটা কাপড়ে জড়ায়। শমিতা এই কর্মকান্ড দেখতে থাকে আগ্রহ নিয়ে। যেন রকেট বানানো হচ্ছে।
- এই নাও। কাপড়ে জড়ানো গোপন রকেটটা এনে দেয় সব্য। - ঘষো।
শমিতা মাথায় ঠক করে দেয়। ব্যথা লাগে। - উফ।
- আরে ওইভাবে না। সব্য বলে। - তুমি এরকম একটা ঢ্যাঁড়োশ হলে কীকরে? দাও।
সব্য কাপড়ের পুঁটলিটা নিজের হাতে নেয়। - এদিকে এসো।
শমিতা একটু এগিয়ে আসে। সব্যও পাশে বসে পড়ে। তারপর যত্ন করে কপালে বরফ লাগায়। শমিতার আরাম লাগে। চোখের সামনে চওড়া একটা কাঁধ। এলিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। একবার পিঠে হাত রাখলেই হেলান দিয়ে দিতে পারে। আঃ, শমিতা ভাবে। ব্যাপারটা তাহলে এইরকম। ঠিক করছিনা, লোকে বোঝে ঠিকই, কিন্তু তার পরেও করে ফেলে। এবং কান্ডজ্ঞান খুবই থাকে। যেমন এই মুহূর্তেই শমিতার মনির কথা মনে পড়ে। মায়া হয়। এবং এই চওড়া কাঁধে হেলান দিতেও।
সব্য অবশ্য পিঠে হাত রাখেনা। একবার চোখের দিকে তাকায়। তারপর বলে, - নাও এবার নিজেই পারবে। বলে সরে বসে একটু।
শমিতা কপালে বরফ লাগায়। এখনও আরাম লাগে খুব। সব্য বলে, রাত হল। চলো। তোমাকে শোবার জায়গাটা দেখিয়ে দিই।
শমিতা বাধ্য মেয়ের মতো উঠে পড়ে। পাশের ঘরে যায়।
- বালিশ টালিশ দেখে নাও। আর এই যে এখানে চাদর। যদি লাগে। আর দরকার পড়লে ডেকো।
- সব ঠিক আছে। চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে শমিতার।
- গুডনাইট। আলো নিভিয়ে দিলাম।
শমিতা একটু জড়ানো গলায় বলে, - সব ঠিক হয়ে যাবে, না সব্য?
- একদম। দরজা বন্ধ করে দিই?
শমিতা জড়িয়ে জড়িয়ে বলে, কাল সক্কালবেলায় ডেকে দেবে?
- হুঁ।
- আমি মনির কাছে যাব।
সব্য হা হা করে হেসে ওঠে। তারপর দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যায়।
১৭।
সেইভাবে ঘুমোয় শমিতা, যেভাবে একমাত্র চূড়ান্ত অবসাদগ্রস্ত অথবা ভীষণ সুখী কোনো মানুষ ঘুমোতে পারে। অঘোরে। রাস্তার আওয়াজে যখন ঘুম ভাঙে, বেলা হয়ে গেছে। ঘরে ফটফটে আলো। পর্দা সরানো। সব্য কি ঢুকে সরিয়েছে? কে জানে। কটা বাজে? ধড়মড়িয়ে উঠে ফোন দেখে শমিতা। প্রায় নটা। তিনটে মিসড কল। শর্মিলার। কাল ফোন করতে পারেনি ভয়ে, আজ পুষিয়ে নিচ্ছে। সে ঠিক আছে, কিন্তু ফোনের আওয়াজেও ঘুম ভাঙেনি কেন? শমিতা ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে ওঠে। কাল রাত্রে কান্ডজ্ঞান ছিলনা, কিন্তু আজ তো দিনের আলো, তাই হুড়ুম ধাড়ুম করে বেরিয়ে পড়ার আগে একবার ঘুরে আয়নার দিকে তাকায়। জামাকাপড় ঠিক তো? চুলটা একটু হাত দিয়ে টেনে ঠিক করে নেয়। তারপর দরজা খোলে।
রান্নাঘরে ঠং ঠং আওয়াজ। সব্য বেরিয়ে আসে। গলায় আবার একটা সাদা রঙের রাঁধুনির অ্যাপ্রন লাগিয়েছে। কায়দার চূড়ান্ত। শমিতা হাসে। - ডাকলেনা তো?
- তাড়ার কী আছে? সব্য বলে। - শনিবার তো। শর্মিলা আসবে একটু পরে। একদম দেখা করে যেও।
- না না। শমিতা বলে। - আগেই যাব। মনি একলা আছে।
- ঠিক আছে। ব্রেকফাস্ট রেডি।
হাতিঘোড়া কিছু না। সব্য ওমলেট বানিয়েছে। আর কড়া টোস্ট। ঝাঁঝালো গোলমরিচ ছড়িয়ে দেয় উপরে। কামড়ালে কড়কড় আওয়াজ হয়। ঝালঝাল লাগে।
- দুধ খাবে?
শমিতা হেসে ফেলে। - আমাকে বাচ্চা পেয়েছ?
সব্য কিছু একটা জুৎসই জবাব দিতে যায়, কিন্তু বাড়িতে বেল বাজে। কাজের মাসি উপস্থিত। সব্য দরজা খোলে। মহিলা ভিতরে ঢুকে শমিতাকে গোলগোল চোখ করে দেখেন। ব্যাপারটা কী। জিজ্ঞাসা করলেই ল্যাটা চুকে যেত। কিন্তু বাড়ির পুরুষ মানুষের কাছে এইসব নিয়ে কৌতুহল প্রকাশে বাধা আছে। তাই তিনি টেবিলের উপর খাবার-দাবার দেখেন। - দাদা। তুমিই সব করলে?
সব্য নিজের অ্যাপ্রণে হাত বোলায়। হাসে। কেমন দিলাম, হাবভাব।
- একটু তো অপেক্ষা করতে পারতে। আমি তো এসেই গেলাম।
- ও ঠিক আছে। সব্য অ্যাপ্রনে হাত বোলাতে বোলাতে বলে। - এ তো কিছুই না, আমাকে বললে বিয়েবাড়ির ভোজ রেঁধে দেব।
সবাই হাসে। শমিতাও। মহিলা একটু রসিকতা, একটু প্রশংসার ভঙ্গীতে বলেন - দাদা পুরো জিনিয়াস।
আবার এক দফা হাসি। কিন্তু শমিতা উঠে পড়ে। এটা গজল্লার সময় না। মনি একলা আছে। আদৌ কিছু খেয়েছে কিনা কে জানে। কাজের লোকও ফিরে যাবে। দরজা বন্ধ। শমিতা ঘরে গিয়ে চটপট জামাকাপড় বদলায়। বাথরুমে গিয়ে চুল টুলও ঠিক করে আঁচড়ে নেয়। তারপর ব্যাগ হাতে বাইরে আসে। সব্য বলে - বেরোচ্ছ? আমি পৌঁছে দেব? এমনিতে এসব প্রশ্নের ধার ধারেনা। কিন্তু আজ বলছে, তার মানে এই, যে, ব্যক্তিগত পরিসর দেওয়া হচ্ছে। মিয়া-বিবির ব্যাপারটা এবার একান্তে নিজেদেরই সামলাতে হবে। একান্ত যদি না শমিতা চায়, যে, সব্যও থাকুক।
- নাঃ। বলে শমিতা। বাসে চলে যাব।
- দুগ্গা দুগ্গা। বলে সব্য। - কী খবর জানিও। অবশ্য...
- কী?
- একটু বাদেই তোমার ফোন দমকলের মতো বাজতে শুরু করবে। এখনও করেনি কেন কে জানে।
- করেছে তো। শমিতা হাসে। - ধরা হয়নি। পরে করব। বলে দিও একটু।
সব্য দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে বেরোয় শমিতা। হেঁটে নিচে। তারপর রাস্তা দিয়ে মোড়ের দিকে। এই পাড়াটা দিনের বেলায় কীরকম অন্যরকম লাগে। চারদিক আলোয় ঝকঝক করছে। বাস স্টপেজের মাথায় নিয়ন সাইন। যেতেই একটা চকচকে বাস। এমনিতে এক ঘন্টা দাঁড়িয়েও পাওয়া যায়না, আজ একদম সঙ্গে সঙ্গে। পক্ষীরাজের মতো সামনে এসে দাঁড়ায়, দরজা খুলে যায়, সামনে হাস্যমুখ কন্ডাক্টার। - আসুন। বলেন তিনি। কলকাতা শহরের হল টা কী?
বাসের ভিতর গান চলছে গমগম করে, একদম ফাঁকা। শনিবার, সে কথা ঠিক। তা বলে এইরকম? এ তো গড়ের মাঠ। শমিতা দু-তিনটে সারি পেরিয়ে একটা সিট পছন্দ করে। জানলার ধারে। পিছন-পিছন কন্ডাক্টর আসেন।
- কতদূর?
- কালিকাপুর।
- ওঃ সে তো শেষপ্রান্তে।
বলে ভদ্রলোক ফিক করে হাসেন। এতে হাসির কী হল কে জানে? শমিতা অবাক হয়ে তাকায়।
- নানা কিছু না। কন্ডাক্টর একটু লজ্জা পেয়ে বলেন - কালিকাপুর। কীরকম রাজকাপুরের মতো শুনতে না?
এরকম রসিক কন্ডাক্টর সারা জীবনে দেখেনি শমিতা। ভদ্রলোক টিকিট কেটে বলেন, যাই। একলা একলা বাস চালাচ্ছে। ড্রাইভারের দিকে আঙুল তুলে আবার ফিক করে হেসে দেন।
শমিতার মনির কথা মনে পড়ে। বসে বসে গান শোনে। এফএম চলছে। হিন্দি বাংলা মেশানো এক খিচুড়ি ভাষায়। মাঝেমধ্যে গান হচ্ছে। বাইরে রৌদ্রকরোজ্জ্বল কলকাতা। জানলা খুলে দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু উপায় নেই। শমিতা শহর দেখে বন্ধ জানলার এপার থেকে। ফুটপাথে ছোটোবড়ো ক্রেতাবিক্রেতা। ধর্মতলার মোড়ে লেনদেন লেনদেন লেনিন। বাস চলে কালিকাপুরের দিকে।
১৮।
প্রথম খটকাটা লাগে বাস থেকে নেমে। সেই বাজারের মোড়, সেই সব্জিওয়ালারা, কিন্তু কীরকম আলাদা যেন। দু-একটা ছেলে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করে কথা বলছে। কোনো উচ্ছলতা নেই। শমিতা হাঁটতে থাকে। সেই পুরোনো রাস্তা। দেয়াল। কিন্তু হিসি করার কেউ নেই। দু-একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, তারা দেয়ালের দিকে পিছন ফিরে। শমিতাকে ভালো করে মাপে। রাস্তা দিয়ে তিনজন কাজের মেয়ে চলে যায়। শমিতার দিকে তাকায়। একটু বিচিত্র ভাবে। শমিতার অদ্ভুত লাগে।
শমিতা দ্রুতগতিতে হাঁটতে থাকে যায়, বাড়ির দিকে। লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একটু একটু করে। যেন দূরে মেলা বসেছে। বা ফুটবল খেলা ভেঙেছে। লোকে ফিরছে, আর শমিতা চলেছে মাঠের দিকে। খেলা ফেরত দর্শকরা উল্টোদিকে হাঁটা এই মহিলাকে দেখে। কেউ কেউ হাঁ করে তাকায়। রাস্তার ধারে চায়ের দোকান। গজল্লা বসেছে। কিন্তু লোক একটু বেশি যেন। একজন আঙুল তুলে দেখায়। শমিতার দিকে।
শমিতার অস্বস্তি হয়। দূরে ফ্ল্যাটবাড়ির মোড়। সেখানে সত্যিই একটা জটলা। কিছু কি হল তবে? কয়েকখানা গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে। বেখাপ্পাভাবে। শমিতা আরও জোরে হাঁটতে থাকে। জটলা ক্রমশ কাছে আসে। একজন সেখান থেকে ঘুরে তাকায়। চেনা-চেনা লাগে। ওঃ সেই লোকটা, যে নাকি পাইপ সারায়। সে উত্তেজিতভাবে হাত নেড়ে শমিতাকে আঙুল উঁচিয়ে দেখায়। জটলা ভেঙে একটা মেয়ে বেরিয়ে আসে। তার পিছনে একটা লোক। মেয়েটার হাতে একটা লাঠির মতো কী। লোকটার ঘাড়ে, ক্যামেরা। ক্যামেরা? কেন?
মেয়েটা দৌড়ে আসে। লাঠি না, ওটা সেই লম্বা মাইক্রোফোন। কী যেন বলে, বুম। সে সিধে শমিতার দিকেই আসে। পিছনে ক্যামেরা হাতে ছেলেটা। একদম কাছাকাছি। শমিতার দিকে বুম তাক করে মেয়েটা নাটকীয় কায়দায় বলে, আপনি কি কিছু বলবেন?
কী বলবে? কেন বলবে? শমিতা অবাক হয়ে বলে, কী নিয়ে?
টিভির মেয়েটা বলে, - আপনার হাজব্যান্ডকে নিয়ে।
জটলা ভেঙে আরও দু-একজন বেরিয়ে আসে। বিজনবাবু। পাশের জনও চেনা। ঠিক। থানার ওসি। বিজনবাবু ওসিকে কিছু একটা বলেন । তিনিও দৌড়ে আসেন এদিকে। - সরুন সরুন। ওসি বলেন। - এখান থেকে যান। পরে কথা বলবেন।
শমিতার মাথায় কিছু ঢোকেনা। - কী হয়েছে?
ওসি ঠেলে শমিতাকে সরিয়ে আনে। একটু ফাঁকায়। - আমার কিছু করার নেই ম্যাডাম। অনেক উঁচু তলার ডিসিশন।
শমিতার ফোন বাজে। শর্মিলা। যথারীতি মোক্ষম সময়। শমিতা কেটে দেয়। - কিন্তু কী হয়েছে?
আবার ফোন বাজে। আবার শর্মিলা। ওসি বলেন, ধরে নিন ম্যাডাম। তারপর বলছি।
শমিতা কেটে দিতে যায়। তারপর কী ভেবে ধরে।
ওপাশ থেকে শর্মিলা চিৎকার করে, - কী হয়েছে? এসব কী?
সেটাই তো শমিতারও প্রশ্ন। - কী হয়েছে? কী?
শর্মিলা হাঁউমাউ করে কীসব বলতে থাকে। - টিভিতে দেখাচ্ছে। এরপর কিচ্ছু বোঝা যায়না। পিছনে হাঁই হাঁই করে টিভি চলছে। শব্দ শোনা যায়। শর্মিলার কোনো কথা বোঝা যায়না। শমিতা ফোন রেখে দেয়। শর্মিলা চিৎকার করে বলে, রেখে দিল। তাতে অবশ্য বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়না। কারণ, সবটাই দেখা যায় টিভিতে। আজ আর কিছুই ব্যক্তিগত নেই। দেখা যায় মুখ ঢাকা অবস্থায় মনিকে কয়েকজন গাট্টাগোট্টা লোক গাড়িতে তুলছে। জ্যান্ত ছবি না, রেকর্ডিং। পিছনে সংবাদপাঠিকা গলা সপ্তমে তুলে চেঁচাচ্ছেন।
- খাস কলকাতা শহর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সন্দেহজনক সন্ত্রাসবাদীকে। খোদ কলকাতা পুলিশের নাকের ডগায় বসে চলছিল ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি। পুলিশ সব জেনেও কিচ্ছু করেনি। ফাঁস হল চক্রান্ত। তদন্তকারীরা বলছেন, এলাকাবাসীদের সহযোগিতাতেই সাফল্য। দেখুন।
টিভিতে এক অফিসারকে দেখা যায়। সাধারণ ড্রেসে। হিন্দি মেশানো বাংলায় কথা বলেন তিনি।
- পুলিশের কাছ থেকে আমরা কোনো খোবোর পাইনি। লোকাল লোকেরা জানান যে ওনেকদিন ধোরেই লোকটি সোন্দেহোজোনোক আচোরোণ কোরছিলো। বাড়ির বাইরে থেকে তালাবন্ধো কোরে চোলতো বিস্ফোরোক তৈয়ারি। ওরা গোতোকাল একটা বিস্ফোরোণ ঘোটিয়ে ফেলে ফ্ল্যাটের ভিতোরে। তারপোর খোবোর আসে আমাদের কাছে। তোদোন্তোকারী টিম গিয়ে দেখে, দোরজায় তালাবোন্ধো। তালা ভেঙে ঢুকে গ্রেপ্তার কোরা হয়। দেশোদ্রোহিতার জোন্যো আমরা গ্রেপ্তার কোরেছি। চার্জশিট পোরে দেওয়া হোবে। ডিটেল তোখোনই জানতে পারবেন।
পাঠিকা সজোরে বলেন- শুনতে পেলেন, যে পুলিশের কাছে কোনো খবর ছিলনা। সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং সুরক্ষা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে এই ঘটনা। এই শহরে আপনি কি নিরাপদ? ঘটনাস্থলেই আছেন আমাদের সংবাদদাতা আত্রেয়ী। আত্রেয়ী, শুনতে পাচ্ছ?
সংবাদদাতা মেয়েটিকে দেখা যায়, যে একটু আগে দৌড়ে এসেছিল।
- পাচ্ছি অজন্তাদি।
- একটু জানাও কী চলছে ওখানে।
- এখান থেকে আমরা যা খবর পেয়েছি, সেটা হল, দেশদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এই এলাকার বাসিন্দা মনিরুল ইসলামকে। অনেকদিন ধরেই তিনি সন্দেহজনক নানা কার্যকলাপে জড়িত ছিলেন। প্রতিবেশীরা দেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন এখানে উপস্থিত আছেন। আপনার নাম?
টিভিতে এবার বিজনবাবুকে দেখা যায়। - বিজন ভট্টাচার্য।
- একটু বলুন, কী দেখেছিলেন।
- খুব সন্দেহজনক ব্যাপার ম্যাডাম। বিজনবাবু আস্তে আস্তে বলেন। - দেখতাম দরজায় তালাবন্ধ, কিন্তু ভিতরে কী সব হচ্ছে। পুলিশ আসত। কিন্তু কিছু করতনা। কালকে দুম করে একটা বিরাট বিস্ফোরণ হল। আমি ভয় পেয়ে হেল্পলাইনে ফোন করলাম। ওরা বোধহয় পুলিশে খবর নিয়ে দেখল।
- পুলিশ তো কিছু জানতনা বললেন।
- না না। জানত তো বটেই। আসতও। কিন্তু কিছু করেনি। আমরাই কিছু জানতামনা। এখন তো দেখছি এই।
- শুনতে পেলে অজন্তাদি, পুলিশ জানত, কিন্তু কিছু করেনি।
সংবাদপাঠিকা ওদিক থেকে গলা তুলে বলেন, - ভয়ানক ব্যাপার। ভয়ানক ব্যাপার। আর কিছু আত্রেয়ী?
- মনিরুলের স্ত্রী একটু আগে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু কোনো মন্তব্য করেননি। রতনদা ক্যামেরাটা একটু ওই দিকে ঘোরাও।
ক্যামেরায় দেখা যায় শমিতাকে। রাস্তার পাশে। হাতে ফোন। পাশে ওসি। - একদম এই রাস্তা দিয়ে নিয়ে এসে গাড়িতে তোলা হয় মনিরুলকে। আর ঠিক সেই রাস্তা দিয়েই পাঁচ মিনিট পরে এসে উপস্থিত হন তাঁর স্ত্রী।
ওসি কিছু একটা বলেন শমিতাকে। সে ধপ করে রাস্তায় বসে পড়ে। মুখ ঢেকে। - কিন্তু তিনি কিছু বলতে চাননি। পাশে দেখছেন স্থানীয় থানার ওসিকে। ওসি মনিরুলের পরিবারের সঙ্গে আছেন।
সংবাদপাঠিকা তৃপ্ত স্বরে বলেন, - মারাত্মক অভিযোগ। মারাত্মক অভিযোগ। পুলিশ জানত কিন্তু কিছু করেনি। ওসি এখনও মনিরুলের পরিবারের সঙ্গে। মনিরুলের স্ত্রী কিছু বলতে নারাজ। আত্রেয়ী তুমি সঙ্গে থাক।
- ধন্যবাদ অজন্তাদি।
ক্লোজ আপে দেখা যায় শমিতাকে। মুখ ঢেকে।
পাঠিকাঃ আমাদের স্টুডিওয় উপস্থিত আছেন, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ...
টিভির পর্দা জুড়ে মুখ ঢাকা শমিতার ক্লোজ আপ। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞর গুরুত্বপূর্ণ মতামতের আগে ঘটনাস্থল থেকে এই শেষ শট।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।