বাঙালি মন চিরকালই উড়ু উড়ু। “মন চল যাই নিজ নিকেতনে”—এ তত্ত্ব মনে থাকলেও, “দেখব এবার জগৎটকে” তত্ত্বেই বিশ্বাসী বাঙালি। ব্যতিক্রম আমিও নই। জীবনের অনেকটা পথ হাঁটা হয়ে গেল পাথেয় হিসেবে ভ্রমণস্মৃতি সততই সুখের। ছোটপুত্রের নতুন চাকরির সুবাদে ঔরঙ্গাবাদ যাত্রা হল।
রওয়ানা থেকেই মনে হচ্ছিল অজন্তা-ইলোরার কথা। করোনা আবহে সে ইচ্ছা মনেই দমন করে রেখেছিলাম, কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখলাম করোনার প্রকোপ খুবই কম। অত্যুৎসাহী ইচ্ছেরই জয় হল। বাহন কী হবে — বাস, ট্রেন না ট্যাক্সি? ভিতু মন সায় দিল ট্যাক্সিতে। ঔরঙ্গাবাদ-অজন্তা দূরত্ব ১০৯ কিমি। ট্যাক্সি পাওয়া গেল, সকালে বেড়িয়ে রাতে ফেরা। এসি ডিজায়ার গাড়ি, বেশ আরামপ্রদ। সকাল ৮টায় রওনা হলাম। শিল্লোড পর্যন্ত রাস্তা বেশ ভালো, তারপর বেশ কিছুটা ভাঙাচোরা। বালাপুর থেকে রাস্তা আবার ভালো। বালাপুরেই একটি হোটেলে প্রথম থামা হল। একটু বিশ্রাম, চা ইত্যাদি পর্ব সেরে পুনর্যাত্রা। শুনে এসেছিলাম—এই সময়টা খুব গরম থাকে, কিন্তু হাল্কা মেঘলা এবং ঠান্ডা-ঠান্ডা ব্যাপার থাকায় এসি চালাতে হয়নি। অজন্তা গুহার প্রায় ৮/১০ কিমি আগের পথ—নামেই জাতীয় পথ—ভেঙেচুরে একেবারে ফুটিফাটা পাহাড়ি রাস্তা। ঝাঁকুনি ও ধুলোর চোটে একেবারে জেরবার, ভাগ্যিস এসি ছিল, ফলে কাচ সব তুলে দিয়ে স্বস্তি। বিশাল বিশাল ১৬ চাকার ট্রাক এন্তার যাচ্ছে বিপজ্জনকভাবে নাচতে নাচতে—গন্তব্য নাসিক হয়ে মুম্বাই। বেশ খানিকটা পাহাড়ি পথ পার হয়ে একটা বেশ উঁচু জায়গায় এসে পৌঁছলাম। আমাদের চালক রমেশ দেখাল—বেশ খানিকটা নিচে আরো একটা টিলার পাশে অজন্তা গুহার প্রবেশপথ।
এবার নামার পালা। সেই চাঁদের পিঠের মত রাস্তা ধরে হোঁচট খেতে খেতে অবশেষে এসে পৌঁছলাম সেই প্রবেশদ্বারে, মহারাষ্ট্র পর্যটন বিভাগের টোল সেন্টারে। মাথাপিছু সামান্যই টোল দিতে হল ওই সংরক্ষিত অঞ্চলে প্রবেশের মূল্য হিসেবে। সামনেই একটি খোলা জায়গা—বেশ গোছানো, অনেক দোকান পাট, হালকা খাবারের দোকান এবং কার পার্কিং। ড্রাইভার রমেশ জানাল—গাড়ি এই পর্যন্তই, এরপর পর্যটন দপ্তরেরে বাসে দু/আড়াই কিমি পথ গুহামুখ পর্যন্ত। করোনার কারণে খুব বেশি পর্যটকের ভিড় হবে না অনুমান করেছিলাম, কিন্তু বাসের অপেক্ষায় পর্যটকেদের লাইন দীর্ঘ হতে শুরু করল। একটু পরেই বাসে উঠলাম, প্রায় ৫০-৬০ জন। মাস্ক নেই—এমন সংখ্যা প্রায় ৩০, ফলে গা ঘেঁষে বসলেও কেউ কিছু বললো না। আমার কাছে বসা একজনকে মাস্কের কথা বলতেই সহাস্যে হিন্দিতে বললেন, “করোনা তো চল বৈঠা..”। এত সচেতন মানুষেরাই করোনাকে শুধু চলতে দিয়েছে নয়, বৈঠতেও দিয়েছে।
কণ্ডাক্টর জানাল—ওই পাহাড়ি পথের পেছনেই অজন্তা গুহা। জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ি পথে খুব বেশি চড়াই উতরাই নেই, পাকদণ্ডি-ও কম। বাঁদিকে ওয়াঘুর নদীর পাশে পাশে চলা, অপূর্ব নিসর্গ! এই নদীর উৎপত্তিস্থলও অজন্তা। বাসে চাপার আগেই রমেশভাই-এর পরিচিত এক গাইডের খোঁজ হল, মাঝবয়সী অনিল। সেও বাসে আমাদের সহযাত্রী। জানালা দিয়ে একটা পাহাড়ি জঙ্গলের সোঁদা গন্ধ, আমার খুব চেনা। এসে নামলাম পর্যটন দপ্তরের সুশোভিত পর্যর্টনকেন্দ্রে। অনেকটা জুড়ে খুব সাজানো-গোছানো ব্যাপার – souvenior counter, পানীয় জল এবং ক্যান্টিনের সু-বন্দোবস্ত। একেবারে বিজন এই প্রদেশে এসবের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। করোনার কারণেই কর্মচারীর স্বল্পতা চোখে পড়ল।
অনিল ভাইয়ের নির্দেশনায় হাঁটা শুরু হল। ওয়ঘুর নদীর ওপর বেইলি ব্রিজ পার হয়ে এবার ওঠার পালা। এই পর্বতাংশটি পশ্চিমঘাট পর্বতের ইন্ধাগিরি রেঞ্জের অংশ। গ্রানাইট পাথরের অশ্বখুরাকৃতি এই অংশটি কেটে তৈরি হয়েছিল সুপ্রাচীন এই গুহামালা। নদীতল থেকে প্রায় ৫০ মিটার উচ্চতায় গুহাগুলির অবস্থান।
এবার চড়াই ভাঙার পালা। সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম—আমাদের গাইড অনিলভাই-এর শ্বাসটানের কষ্ট আছে। জিজ্ঞেস করায় বলল, “ও কিছু নয়, আমার অনেকদিনের সঙ্গী”। অনুরোধ করলাম ধীরে চড়াই উঠতে, খুব খারাপ লাগছিল দেখে—এত কষ্ট সহ্য স্রেফ পেটের তাগিদে। ওকে রাজি করালাম, যে, সবটা ওর হাঁটার প্রয়োজন নেই। সবিনয়ে উত্তর দিল, “আপনার মত বোধ তো সবার নেই। কষ্ট করছি যতদিন পারি, দুটো মেয়ের বিয়ে বাকি আছে স্যার। আমার জন্য বিঠঠলজীর কাছে প্রার্থণা করুন, যেন এটুকু করে যেতে পারি”। ইতোমধ্যে উঠে এসেছি ৯ নং গুহামুখে। কিছু অসম্পূর্ণ গুহা সমেত এখানে মোট ৩৩টি গুহা ছিল। এই গুহামালার সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় ২৪৬ ফুট দেওয়াল কেটে এবং ভেতরে চিত্রিত হয়েছিল অমূল্য চিত্রাবলী—যার বিষয়বস্তু ছিল মূলত জাতকের গল্পের মধ্য দিয়ে সিদ্ধার্থের গৌতম বুদ্ধ হয়ে ওঠার ক্রমপর্যায় এবং আনুষঙ্গিক গল্পগাথার চিত্রায়ন।
এই গুহামালার নির্মাণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষদের সাধনা এবং জ্ঞানান্বেষণের উপযুক্ত স্থানই শুধু ছিল না—উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে অনুমান করা যায় বৌদ্ধসাধকদের বর্ষাকালীন আশ্রয়স্থল, তীর্থযাত্রী ও বনিকদের বিশ্রামস্থল হিসেবেও ব্যবহৃত হত এই গুহার কিছু অংশ।
চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েনসাং-এর বর্ণনায় এই গুহামালার উল্লেখ আছে। সপ্তম শতাব্দীর পর থেকেই বৌদ্ধধর্মের প্রাসঙ্গিকতা ক্ষীণ হয়ে আসে, ফলে অজন্তার গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে। ইসলামিক অভ্যুত্থানের পর এই শিল্পসম্পদ সম্পূর্ণ ঢেকে যায় গভীর জঙ্গলে এবং অনাদৃত পড়ে থাকে প্রায় ১১০০ বছর, ফলে গুহার ভেতরকার অমূল্য চিত্রমালার ক্ষতিসাধন শুরু হয় তখন থেকেই। গুপ্তধনের মত এই সম্পদের পুনরাবিষ্কার ঘটেছিল হঠাৎই, ১৮১৯ সালে এক ইংরেজ সামরিক ক্যাপ্টেন জন স্মিথ বাঘ শিকারের নেশায় পৌঁছে গেছিলেন গভীর জঙ্গলে ঢাকা অজন্তা গুহামালার উত্তরদিকের এক পাহাড়ের মাথায়। ওয়াঘুর নদীর অন্য পারে স্মিথ লক্ষ্য করলেন—জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে অস্পষ্ট এক গুহার আভাস। উৎসাহী স্মিথ স্থানীয় এক কিশোরকে সঙ্গী করে চললেন গুহামুখের অন্বেষণে। নদীর অপর পারের দুর্গম জঙ্গলের অনেকটা পার হয়ে আবিষ্কার করলেন সেই অনাদৃত সম্পদ। ধীরে ধীরে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল এর খবর এবং ১৯৮৩-তে অজন্তা গুহামালা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পেল।
পশ্চিমের ভকতকা রাজবংশের পরাক্রমশালী রাজা হরিসেনের (৪৮০ – ৫১০ খৃঃ) পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ অনেকগুলি গুহা রূপ পেয়েছিল। মূলত জ্ঞানান্বেষণ ও সাধনার জন্যই নির্জন প্রকৃতির মাঝে গুহামালার নির্মাণ শুরু হয় এবং এই দুরূহ শিল্পকর্ম শেষ হয় দুটি পর্যায়ে—প্রথমটি সাতবাহন বংশের রাজত্বকালে, অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব ২য় শতক থেকে তিনশো খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। ২য় পর্ব আনুমানিক ৪র্থ শতক থেকে ৭ম শতক পর্যন্ত। অজন্তায় প্রাপ্ত এক শিলালিপিতে হরিসেনের মন্ত্রী বরাহদেব উল্লেখ করেছেন ১৬, ১৭ এবং ১৯ নম্বর গুহার খনন, নির্মাণ এবং চিত্রায়ন হয়েছিল হরিসেনের পৃষ্ঠপোষকতায়। গুহাগুলির ২য় পর্বের নির্মাণক্রমের সামান্য বিস্তারে যাওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না, কারণ এই সুদীর্ঘ নির্মাণকাল আবর্তিত হয়েছিল বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে। মূলত বৌদ্ধধর্মাদর্শে নির্মিত চিত্রমালা ও ভাস্কর্যের সঙ্গে হিন্দু ভাবধারার কিছুটা মেলবন্ধন ঘটেছিল ফলে জিজ্ঞাসু মনে এর উৎস সন্ধান হতেই পারে। অজন্তা-বিষয়ক গবেষক ও ইতিহাসবিদ ওয়াল্টার স্মিথের মতে—শুরুতে অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব ১ম শতক থেকে ১ম খৃষ্টাব্দের মধ্যে নির্মিত বেশ কিছু গুহা অসমাপ্ত অবস্থায় থেকে যায় এবং প্রায় ৩০০ বছর পর ভকতকা রাজবংশজ হরিসেনের উদ্যোগে নির্মাণ ও পুনর্নিমাণ কাজ শুরু হয়। মন্ত্রী বরাহদেব ও উপেন্দ্রগুপ্তের ওপর সেই দায়িত্ব বর্তায়। ১ নং গুহা হরিসেনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং ১৭ থেকে ২০ নং গুহা উপগুপ্তের উদ্যোগে নির্মিত হয়।
রাজনৈতিক উত্থান-পতন সত্ত্বেও নির্মাণকার্য চলে হরিসেনের মৃত্যু পর্যন্ত (৪৭৭ খৃঃ)। ৪৭৮ থেকে ৪৮০ খৃঃ—এইসময় পূর্বতন পৃষ্ঠপোষকদের অভাবে বিক্ষিপ্তভাবে অনেকেই গুহানির্মাণে যোগ দেন, যাঁদের মধ্যে বেশ কিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসীও ছিলেন।
পরবর্তীতে রাষ্ট্রকুট রাজবংশের হাত ধরে (৭ম থেকে ৮ম শতাব্দী) গুহা নির্মাণ ও সংস্কারের কাজের প্রমাণ পাওয়া যায় ২৬ নং গুহামুখের উৎকীর্ণ লিপিতে ফলে অজন্তা গুহামালার ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত সংস্কার ইত্যাদি হয়েছিল—তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
অজন্তা গুহামালা নির্মাণের সময়কালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য সত্ত্বেও হিন্দু দেবদেবীর অনেকেই স্থান পেয়েছেন বৌদ্ধধর্মাদর্শে শুধু নয়, তাঁরা পূজিতও হন। ভারতীয় সনাতন ভাবধারায় এই মেলবন্ধন এক বিশেষ স্থান পেয়ে এসেছে সেই সময় থেকেই। ভকতকা বংশজ শাসকেরা হিন্দুধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও গুহাগুলির নির্মাণ ও সংস্কার কাজে উদ্যোগী হয়েছিলেন। বরাহদেবের উৎসাহে গুহামালায় বেশ কিছু হিন্দু দেবদেবী ও প্রতীক দেয়ালচিত্রে স্থান পেয়েছে। রাষ্ট্রকুট শাসকেরা প্রথম পর্যায়ে হিন্দুমতাবলম্বী হলেও, পরবর্তীতে জৈন মতাবলম্বী হয়ে পড়েন, ফলে হিন্দু ও জৈন ধর্মের এক মিশ্র শিল্পকর্মের তাঁরা কাণ্ডারি হয়ে উঠলেন, যা রূপ পেয়েছে ইলোরা গুহামালায়।
এবারে গুহামালার কিছুটা বর্ণনে না গেলে পাঠকমনের অনেক জিজ্ঞাসাই অনুক্ত রয়ে যাবে, তাই বিশেষ কটি গুহার সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্তে যাওয়ার আগে বলে রাখি—অজন্তা গুহামালার মধ্যে ১৬টিতে গুহাচিত্র আছে, তার মধ্যে গুহা ১, ২, ১৬, ১৭ এবং ১৯ নং-এ অনবদ্য গুহাচিত্র রয়েছে। পাথর কেটে ভাস্কর্যকলা উল্লেখনীয় ভাবে আছে ১, ৪, ১৭, ১৯, ২৪ ও ২৬ নং গুহাতে।
প্রার্থনা বা ধর্মীয় আলোচনা-কক্ষগুলিকে বলা হয় চৈত্য। বাস-কক্ষগুলিকে বলা হয় বিহার। ৮, ৯, ১০, ১২, ১৩ ও ৩০ নং গুহাগুলি সবচেয়ে প্রাচীন এবং নির্মাণকাল ১ম পর্যায়ে অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব ২য় শতক থেকে ২০০খৃঃ। এই পর্যায়ের গুহানির্মাণে হীনযান দর্শনের প্রতিফলন ও ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শতকে নির্মিত গুহাগুলিতে মহাযান ভাবধারার প্রভাব লক্ষণীয়।
গুহা ১: ৩৬মি X ২৮মি দৈর্ঘ্য-প্রস্থের এই গুহাটির প্রবেশমুখ থেকে ভেতর পর্যন্ত অনেকগুলি সারিবদ্ধ স্তম্ভ এবং দু-পাশে দুটি লম্বা ফাঁকা প্রকোষ্ঠের দেয়ালে এবং স্তম্ভের গায়ে চিত্রিত সেই অমূল্য চিত্রন, মূলত গৌতম বুদ্ধের পূর্বজন্ম বা জাতকের গল্পমালা অঙ্কিত। গুহার শেষ প্রান্তে রয়েছে বুদ্ধের “ধর্মচক্র প্রবর্ত্তনা” মুদ্রায় একটি বিশাল মূর্তি, তাকে ঘিরে রয়েছে পাঁচ প্রধান শিষ্য। বাঁদিকের দেওয়ালে চিত্রিত শিবী রাজা ও পায়রার গল্প। মাঝামাঝি একটি স্তম্ভে খোদিত চারটি হরিণ মূর্তি। বিভিন্ন অবস্থানে থাকলেও তার মাথা একটাই। নিরীক্ষণ করলে মনে হবে মাথাটি প্রতিটি হরিণেরই স্বতন্ত্র অস্তিত্বে। এমন শিল্পকর্ম চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। আর একটু বাঁ-দিকেই রয়েছে সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধ হয়ে ওঠার মুহুর্তের চিত্র, পাশেই চিত্রিত “মারা” বা শয়তানের প্রতিরূপ, যে গৌতমের বোধিপ্রাপ্তির পথে বিভিন্নরূপে বাধার সৃষ্টি করেছিল। ডানদিকের দেয়ালে চিত্রিত “শ্রাবস্তির বিস্ময়” সেই রূপ যেখানে বুদ্ধ শতরূপে নানান ভঙ্গিমায়।
গুহার পেছনের দেওয়ালের মাঝামাঝি কুঠুরির বাঁদিকে চিত্রিত অজন্তা-খ্যাত সেই ছবি “বোধিসত্ত্ব পদ্মপাণি”। এর দৃষ্টি অধ্যাত্মভাবে আনত এবং তার ডানহাতে একটি পদ্ম। এর ঠিক পাশেই তার শ্যামাঙ্গী স্ত্রী এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক ভাবসম্পন্ন মুখ। এর ডানদিকে বানর ও পেখম শোভিত ময়ূরের অপূর্ব চিত্র। বোধিসত্ত্বের অন্য পাশে আরো একটি বিখ্যাত চিত্র “বোধিসত্ত্ব বজ্রপাণি”-র দিকে কোনো এক রাজা ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছেন। দীর্ঘ অযত্নে ছবিগুলি অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে।
গুহা ২: এই গুহার বিশেষত্ব স্তম্ভ, দেওয়াল ও ছাদে অঙ্কিত চিত্রমালা। এই গুহাচিত্রগুলো অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায়, যদিও কালপ্রবাহের ছাপ স্পষ্ট। নারীমুখ-চিত্রণ এই গুহাচিত্রের বিশেষত্ব। আনুমানিক ৪৬০ খৃষ্টাব্দে এর নির্মাণ ও চিত্রণের কাজ শুরু হয়, শেষ হয় ৪৭৫ থেকে ৪৭৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যে। সম্ভবত রাজা হরিসেনের কোনো আত্মীয়া বা আশ্রিতার উদ্যোগে এই গুহাটি রূপ পায়। ভেতরের বিশাল স্তম্ভের গায়ে খোদিত ও চিত্রিত অপূর্ব সব রূপ। দেওয়াল এবং ছাদে চিত্রিত রূপগুলিই বেশি চোখে পড়বে।
নারীমূর্তির বিভিন্ন চিত্র ও খোদিত রূপের পাশেই একঝাঁক উড়ন্ত হাঁসের অপূর্ব ভঙ্গিমা। গুহার বাঁদিকের দেওয়ালে চিত্রিত বুদ্ধের জাতকপর্বে শেষ আবির্ভাবের ফ্রেস্কো। ডানদিকের দেওয়ালে চিত্রিত এক নারীর প্রতি এক রাজার উদ্যত তরবারি ও অসহায় নারীর ভয়ার্ত ক্ষমাপ্রার্থনা।
গুহা ৩: এটি একটি অসম্পূর্ণ গুহা। অনুমান করা হয় রাজা হরিসেনের মৃত্যুর পর এর নির্মাণকার্য থেমে যায়।
গুহা ৪: ২৪টি স্তম্ভ শোভিত এই বিহারটি সবচেয়ে বড়। এটির নির্মাণ কোনো রাজা বা অমাত্যের উদ্যোগে নয়, বরং কোনো এক ধনাঢ্য বৌদ্ধ ভক্তের উদ্যোগে এটি রূপ পায়—এমনটাই অনুমান করা হয়। গুহার পেছনের অংশে রয়েছে প্রচারক বুদ্ধের এক বিশাল মূর্তি ও মানানসই ভাবে দু-দিকে দুটি বোধিসত্ত্বের ভাস্কর্য। নির্মাণকালে ছাদের কিছুটা অংশ ভেঙে পড়ায় হলঘরটির রূপ কিছুটা অসম্পূর্ণ। তবে প্রবেশদ্বারের ঠিক ডানদিকে ভক্ত-পরিবৃত বোধিসত্ত্ব এবং ঠিক পাশেই খোদিত এক নারী ও পুরুষের ভয়ার্ত পলায়নরূপ, সামনে এক মত্ত হস্তী। আর একটি ছবি না বললেই নয়—বৃক্ষকান্ডে হেলান দেওয়া এক অপরূপ নারী, পাশে কাঠবেড়ালি।
গুহা ৫: একটু উঠে এসে অসমাপ্ত এই গুহাটির দ্বারমুখে কিছু নারীমূর্তির ভাস্কর্য।
গুহা ৬: এটি একটি দ্বিতল বিহার। দুটি তলাতেই বড় দুটি হল। নিচের তলার দেওয়ালে অনেক ছবি, তার মধ্যে শ্রাবস্তীর অলৌকিক ঘটনাবলি এবং সেই শয়তান মারার প্রলোভনের ছবি। দ্বিতলটি অসম্পূর্ণ তবে গুহামুখের ভাস্কর্য অনবদ্য।
গুহা ৭: অষ্টভূজ স্তম্ভ সম্বলিত গুহাটি বৌদ্ধ মঠ। ভেতরে ৮টি কুঠুরি রয়েছে—যা ছিল সন্ন্যাসীদের বাসস্থল। ভেতরের একটি প্রকোষ্ঠে রয়েছে ২৫টি বিভিন্ন মুদ্রায় ধ্যানস্থ বুদ্ধের ভাস্কর্য। দ্বারদেশে রয়েছে মকর-পরিবৃতা এক নারী।
গুহা ৮: ৮টি প্রকোষ্ঠ সম্বলিত আর একটি অসম্পূর্ণ গুহা—প্রথম পর্যায়ে নির্মিত। দেওয়ালে কিছু চিত্রের আভাসমাত্র, বাকি কালের গর্ভে বিলীন।
গুহা ৯: এটি চৈত্য বা প্রার্থনাগার। এর প্রবেশমুখটি, আমাদের মনে অজন্তা-গুহামুখ সম্পর্কে যে ধারণা আছে, ঠিক তার অনুরূপ। পাথর গেঁথে আর্চ এবং মাঝে কাঠের ফ্রেম, সেটি পরিমার্জনা করে কাঠের ফ্রেমে কাচ বসানো হয়েছে। ভেতরের প্রার্থনা-হলে ২৩টি পিলার রয়েছে, শেষ প্রান্তে একটি স্তূপ ও চারপাশে প্রদক্ষিণ-পথ করা রয়েছে। স্তম্ভগুলির ওপরদিকে এবং পিছনের দেওয়ালে অনেকগুলি গুহাচিত্র—যার মধ্যে রয়েছে বুদ্ধ ও তাঁর পাশে পদ্মপাণি ও বজ্রপাণি। তার পাশেই রয়েছে উপঢৌকন হাতে ভক্তের দল। অন্যান্য দেওয়ালে রয়েছে জাতকমালার চিত্রণ।
গুহা ১০: এটিতেও একটি স্তম্ভ, স্তূপ ও প্রার্থনাকক্ষ। প্রবেশ মুখের উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায়—এটির নির্মাণকাল খৃঃপূঃ ২য় শতক। স্তূপ বরাবর ৩৯টি অষ্টভূজ স্তম্ভ রয়েছে। ৩নং স্তম্ভের উল্টোদিকে রয়েছে সমকালীন জীবনের চালচিত্র, যা থেকে সেই সময়কার বস্ত্র ব্যবহার, অলঙ্কার, কেশবিন্যাস, ইত্যাদির পরিচয় পাওয়া যায়। এই গুহাটিই ইংরেজ সেনাবাহিনীর জন স্মিথের প্রথম চোখে পড়ে।
গুহা ১১: এটি একটি চৈত্য এবং ১০ নং গুহার মতোই। দেওয়াল, স্তম্ভ এবং ছাদে বেশ কিছু অমূল্য চিত্রমালার আভাস, যা অধিকাংশই নষ্ট প্রায় এবং খুব একটা মর্মোদ্ধারের মত অবস্থায় নেই। যেটুকু উদ্ধার করা গেল, তার মধ্যে পদ্মপাণি, প্রার্থনারত দম্পতি, একজোড়া বড় পাখি ও কিছু নারীমূর্তি। গুহায় উপবিষ্ট বুদ্ধের চারপাশে প্রদক্ষিণপথ এই গুহাটি পর্যন্তই দেখলাম, তারপর আর নেই।
গুহা ১২: হীনযান আদর্শে নির্মিত এটি একটি বিহার—যার মধ্যে রয়েছে ১২টি প্রকোষ্ঠ—যা হয়তো শিক্ষার্থী বা সন্ন্যাসীদের থাকার জায়গা। এখানেই দেখলাম প্রকোষ্ঠের ভেতর পাথর কেটে দুটি করে শোওয়ার জায়গা—যদিও গুহাটির প্রবেশদ্বার সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেছে।
গুহা ১৩: ঠিক গুহা ১২র মতো, তবে এটি এখন আর্কিওলজিকাল সার্ভের কাজে লাগছে।
গুহা ১৪: একটি অসম্পূর্ণ গুহা। একটু এগিয়ে পেলাম ৮টি কক্ষ যুক্ত ১৫ নং গুহা। এটিতে ধ্যানস্থ বুদ্ধমূর্তি রয়েছে—তার দু-পাশে ৮টি কক্ষ। প্রবেশদ্বারে খোদিত রয়েছে—পায়রা শস্যদানা খুঁটে খাচ্ছে। এর পাশেই তিনটি মাত্র কক্ষ যুক্ত সবচেয়ে ছোট গুহা ১৫A। কিছুটা এগিয়ে পেলাম গুহা ১৬: এর সামনে থেকে একটি দীর্ঘ সিঁড়ি নদী পর্যন্ত নেমে গেছে যেটি সম্ভবত এই গুহামালার প্রবেশমুখ ছিল। প্রবেশদ্বারে দুটি বিশাল হাতির ভাস্কর্য। এটির নির্মাণ করিয়েছিলেন রাজা হরিসেনের অমাত্য বরাহদেব। ধর্মে হিন্দু হয়েও গৌতম বুদ্ধের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধায় তিনি এটিকে রূপ দেন। গুহার ভিতর বারান্দার বাইরের দিকটায় বাঁদিকে একটি লিপি উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন ববরাহদেব, সময়টা ৬ষ্ঠ শতক। মর্মোদ্ধার করলে যা দাঁড়াবে—তা মোটামুটি হল, “সমগ্র বিশ্ব অবস্থান করুক দুঃখমুক্ত, নিঃশঙ্ক ও নীরোগ অবস্থায় এবং বুদ্ধের প্রদর্শিত পথই হোক মানুষের মার্গদর্শক”। এই গুহাটি বাকি সব গুহা থেকে বেশ আলাদা এবং মহাযান মতাদর্শে নির্মিত। এর নির্মাণশৈলী অনেক পরিণত। আয়তাকার মূল হলঘরটিতে অনেকগুলি অষ্টভুজাকৃতি স্তম্ভ—যার গা জুড়ে শুধু নয়, দেওয়াল এবং ছাদ জুড়ে চিত্রিত অনেক ছবি। গুহার প্রান্তে উপবিষ্ট বুদ্ধের এক অপূর্ব মূর্তি।
(পরের সংখ্যায় সমাপ্য)
ছবি - লেখক