আগেই শুনেছিলাম আইজলে ট্যাক্সীভাড়া বেশ বেশি আর কোনওরকম দরাদরি চলে না। যা চার্টে লেখা আছে সেটাই দিতে হবে, বেশিও নয় কমও না। তো সেটা একরকম নিশ্চিন্তির ব্যপার। সর্বদা ‘এই বুঝি ঠকে গেলাম রে’ ভেবে ভেবে চলতে হয় না। তো সেই রাত্তিরবেলা রাস্তা পেরিয়ে দেখলাম একটা বড়সড় হোটেলের সামনে একখানা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে, মাথার হলদে আলো নেভানো। শুনেছিলাম গমনেচ্ছু ট্যাক্সিরা মাথায় হলদে আলো জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইতস্তত করে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই সারথি তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে এসে আমাকে দেখালেন হোটেলের দরজা পেরিয়ে ফুটপাথের পাশে আরেকখানা ট্যাক্সি, মাথায় হলদে আলো জ্বালানো। একগাল হেসে বললেন ‘আমি যাবো না। ওই যে ওই গাড়ি যাবে।‘
সেই ট্যাক্সির সামনে পৌঁছে দেখি ড্রাইভারসায়েব থুত্থড়ে বুড়ো, চুল তো বটেই ভ্রুযুগলও ধবধবে সাদা, যাকে বলে লোলচর্ম বৃদ্ধ। খটকা লাগল ইনি এই রাত্রে, রাস্তায় এত এত গাড়ির মধ্যে চালিয়ে নিতে পারবেন তো? তিনি ততক্ষণে সামনের পেছনের দুটো দরজাই খুলে দিয়েছেন। ব্যাগ তুলে বসে গন্তব্য বলতেই চালিয়ে দিলেন এবং চমৎকার চালালেন। গাড়ির উপরে নিয়ন্ত্রণ, গতিবেগ ইত্যাদি কোথায়ও কোনও অসুবিধে হল না। মনে মনে লজ্জিত হলাম, চেহারা দেখেই ধারণা করে নেবার অশ্লীল অভ্যেস থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারি নি দেখছি। মূল রাস্তা ছেড়ে একটা হাল্কা চড়াইওলা অ্যাঁকাব্যাঁকা গলিপথে ঢুকে খানিক এগোতেই দেখি শিবসাগরের ভদ্রলোক হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন।
বলেছিলেন বটে ট্যুরিস্ট লজ ছাড়িয়ে আরো খানিক গিয়ে ওঁর অফিস এবং থাকার জায়গা। আমাকেও প্রস্তাব দিয়েছিলেন সুমোর ফিরতিপথে গলিপথের মুখে নেমে ৩০০-৪০০ মিটার মত হেঁটেই যেতে, ট্যাক্সিভাড়া বাঁচবে। কিন্তু ওই ৭ ঘন্টা চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে বসে থেকে আমার আর ব্যাগপত্তর নিয়ে হাঁটার ক্ষমতা ছিল না। রাত দশটায় ট্যুরিস্ট লজে পৌঁছে দেখি সামনের বড় গেট বন্ধ তবে পাশে একটা ছোট দরজা খোলা আর বাইরে আলো জ্বলছে। প্রথমে বাইরে থেকে একটু চেঁচামেচি করে সাড়া না পেয়ে ভেতরের উঠোনে ঢুকলাম। বারান্দার কাছে গিয়ে একবার ডাকতেই চৌকিদারমশাই বেরোলেন। ট্যাক্সিভাড়া ২০০/- টাকা। তারপর আর কি, মালপত্তর নামিয়ে খাতায় সই করে ঘরে চললাম।
এই চাতলাং ট্যুরিস্ট লজের বাড়িটা তেমন পুরানো নয়, ১৯৮৬ তে তৈরী। কিন্তু গঠিন সেই ইংরেজ আমলের বাংলোগুলোর মত, কি মস্ত মস্ত বারান্দা, চওড়া চওড়া সিঁড়ি, বড়সড় ঘর, পরিস্কার বড়সড় বাথরুম। খাবার তো পাওয়া যাবে না জানি, জল পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে বারান্দায় অ্যাকোয়াগার্ড দেখিয়ে দিলেন। ঘরে জগ আছে, গিয়ে ভরে আনতে হবে। দরজা বন্ধ করে ব্যালকনি খুলেই দেখি নানা রঙের আলোয় ঝলমলে আইজল শহর সেই কোন দূরের পাহাড় থেকে সামনের রাস্তাটা অবধি লুটিয়ে আছে। যতদূর চোখ যায় অবারিত খোলা। আরাম করে স্নান করে ব্যাগ থেকে কেক বের করে খেয়ে কম্বলের তলায়। অনসাইট ট্রিপগুলো বাদে রাস্তায় রাস্তায় সাড়ে আঠেরো ঘন্টা কাটানো আজকের দিনটাই জীবনে দীর্ঘতম সময় রাস্তায় কাটানো। সেই একবার গ্যাংটক থেকে লাচেন এগারো ঘন্টা আর তারপরে পুণে থেকে দুধসাগর যাত্রা ছিল সাড়ে তেরো ঘন্টা মত।
ঘুম ভাঙল পরেরদিন সকাল সাড়ে নটা। দশটায় ব্রেকফাস্ট দেওয়া বন্ধ করে এরা তাই প্রথমেই কফি পাঠাতে বলে ধীরেসুস্থে বিছানা ছাড়লাম। এদিকে বাইরে দেখি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে মিনিট পাঁচেকের জন্য থামলেও আবার ঝেঁপে আসতে লাগল, এত বৃষ্টির মধ্যে বেরোন সম্ভবই না, তাই গল্পের বই হাতে বারান্দার পাশে বসে বসেই বাকী সকালটুকু কাটাতে হল। রিসেপশনে খোঁজ করে জানা গেল ট্যুরিস্ট লজের সামনের রাস্তা ধরে একটু এগোলেই একটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড আছে।রিসেপশনিস্ট মেয়েটি, নাম বলল মেইসে (Meisek), কলেজে পড়ার সাথে পার্টটাইম চাকরি করে, সপ্তাহে এক কি কেউ ছুটিতে থাকলে দুইদিন বসে। স্ট্যান্ড থেকে চেনাজানা ট্যাক্সি ডেকে দেবে কিনা জিগ্যেস করল।
কিন্তু আগেরদিন অত কান্ড করে এসে আমার তখন উৎসাহ তুঙ্গে, ভাবলাম দেখি তো বেরিয়ে তারপর দেখা যাবে। তা তৈরী হয়েই বসে ছিলাম দেড়টা নাগাদ যখন দেখলাম প্রায় কুড়ি মিনিট হল বৃষ্টি থেমে বেশ রোদ্দুর উঠে গেছে তখন বেরিয়েই পড়লাম। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে কোন ট্যাক্সি নেই, খানিক দাঁড়িয়ে আবার হাঁটা। বেশ খানিকটা এগিয়ে একটা খালি ট্যাক্সি আসছে দেখে দাঁড় করাতে বলল হ্যাঁ যাব তবে স্ট্যান্ডে আসুন ওখান থেকেই ছাড়ব। যাব্বাবা আবার ফেরত স্ট্যান্ডে। আর ইনি ‘ইয়েস ইংলিশ’ বললেন বটে কিন্তু সে ইংরিজি মোটামুটি অল্প কয়েকটা কাজ চালানো শব্দেই সীমাবদ্ধ। তা দুপুরের খাওয়া হয় নি, প্রথম গন্তব্য কোনো বাজার। মার্কেট শব্দটা ইনি বুঝলেন বটে কিন্তু রেস্টুরেন্ট শব্দটা আর কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারলাম না।
ভাবলাম যাক মার্কেটে তো যাই সেখানে নিশ্চয় খাবার দাবারের দোকানপাট থাকবে। কিন্তু হায় অধিকাংশ দোকানই বন্ধ। একটা বইয়ের দোকান খোলা পেয়ে খানিক ঘাঁটাঘাটি করে একটা বই কিনলাম,পছন্দমত ম্যাপ পেলাম না সেখানে। আর খান দুই হ্যান্ডিক্রাফটস, ট্রাডিশনাল মিজো ড্রেস ইত্যাদির দোকান পাওয়া গেল। সেখানেও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে পরবর্তী গন্তব্য সলোমন’স টেম্পল। নামে টেম্পল হলেও এটা মিজোরামের সর্ববৃহৎ চার্চ। খুব একটা পুরানোঅ না, ১৯৮৪ নাগাদ তৈরী। তবে দেখতে সুন্দর। মেন হলে ২০০০ লোক আর চার্চের চত্বরে ১০০০০ লোক ধরানোর ব্যবস্থা আছে। চারপাশের বাগানে নানারকম ফুল ও ফলের গাছ, মূলত পাখি বা কাঠবেড়ালিদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা যাতে হয় সেরকম বিবেচনা করেই গাছ লাগানো।
সলোমন’স টেম্পলে পৌঁছে দেখি চার্চের মূল কক্ষ বন্ধ আর বাইরের চওড়া বারান্দার একপাশে কোন এক সংস্থার উদ্যোগে রক্তদান শিবির হচ্ছে। অগত্যা বাইরেই কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার রওনা। এখানে দর্শকদের জন্য যে খাবার দোকান আছে সেটাও আজ বন্ধ। ভাগ্যিস ব্যাগে চাট্টি বিস্কুট কেক ছিল। পরবর্তী গন্তব্য জোখ্ওয়া ফলকন গ্রাম।মিজো জীবনযাপন ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে সরকার থেকে এই গ্রাম তৈরী করে পর্যটকদের জন্য খুলে দিয়েছে। ড্রাইভারসায়েবের মতে সেখানে যেতে ২৫ কিমি ও ফিরতে ২৭ কিমি পথ, সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আমি গুগলে দেখেছি আইজলের কেন্দ্র থেকে ১৮ কিলোমিতার দূরত্ব। ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে অনেক কিছু বলেন, কিছুই প্রায় বুঝি না ‘ডার্ক’ ছাড়া।
গোলাপী রডোডেনড্রন সম্ভবত অন্ধকার হয়ে যাবে বলতে চাইছেন, দুইপক্ষেই খানিক হাত পা নাড়িয়ে বোঝানোর চেষ্টা করার পরে উনি রওনা হলেন। সেখানে পৌঁছোতে বাজল ৪.৪০। রাস্তা থেকে অল্প একটু ঢালু চড়াই উঠে ফলকন গ্রাম। ঢোকার টিকিট ৪০/-টাকা জনপিছু। গাড়ি থেকে নামা অবধি একটি বছর সতেরো আঠেরোর ছেলে সঙ্গ ধরেছে, সারথিমশাই ওকে বলেছেন আমাকে নিয়ে গেইয়ে ভেতরে দেখিয়ে আনতে। বেশ কথা, তা এ এখানকার গাইড নাকি? বলে না এখন ছুটি তাই একটু ‘এঞ্জয়’ করতে এসেছে। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে সে ছেলেই দেখায় জওলবুক -ডর্মিটারি গোছের থাকার ব্যবস্থা, গ্রামপ্রধানের বাড়ি, কর্মকারের বাড়ি ইত্যাদি। লোকজন থাকে না, প্রদর্শনীর মত সাজানো আস্ত গ্রাম।
জওলবুক বা ডর্মিটরি
মিজো গ্রামপ্রধানের বাড়ি
কামারবাড়ি
জাটিঙ্গাতেও এরকম দেখে এলাম তো দুদিন আগেই। ছেলেটি সব দেখিয়ে টেখিয়ে কাছে ঘনিয়ে এসে বলে ‘গুড বিয়ার। ওয়ান্না এঞ্জয়?’ সে ছোকরা নিজে বেশ পানটান করে এসেছে তা গন্ধেই বুঝি। নাকমুখ কুঁচকে বলি নাহ একদম না। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, মাছি তাড়ানোর মত হাত নেড়ে সরে আসি। কোন স্কুল থেকে এসেছে পানেরো কুড়িজান বাচ্চা বাচ্চা মেয়ে। ছুটির দিনের এক্সকার্শান। এখন ফিরে যাবে। ওরাই নিয়ে চলে টিকিট কাউন্টারের পাশের পাকা বাড়িটায়। ওটাই জোখ্ওয়া অর্থাৎ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। দোতলা বাড়ির একতলার হলে কিছু ছেলেমেয়ে মিউজিক প্লেয়ারে গান চালিয়ে নাচ অভ্যাস করছে। স্কুলের বাচ্চাগুলো গিয়ে যোগ দেয় ওদের সাথে। কাউন্টার বন্ধ করে ভারপ্রাপ্ত কর্মী এসে জানান এবারে বন্ধ করতে হবে।
ট্যুরিস্ট লজে ফিরতে ফিরতে অন্ধকার ঘোর হয়ে যায়। সারথিমশাই প্রায় মিনিট দশেকের চেষ্টায় নানা অঙ্ক টঙ্ক কষে জানান ২৭০০/-টাকা হয়েছে, মিটিয়ে ঘরে পৌঁছে শুনি পাশের দুই ঘরে বেশ কিছু বাঙালি এসেছেন, কথাবার্তাইয় বুঝি গৌহাটি থেকে আসছেন। নৈশাহারের জন্য রান্নাঘরে ফোন করে পর্ক ফ্রায়েডরাইসের কথা বলায় শুনি পর্ক ফুরিয়ে গেছে। মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর বাই অর্ডার করার মিনিট দুয়েকের মধ্যেই রান্নাঘর থেকে ফোন করে বলে না একপ্লেট ফ্রায়েড রাইসের মত পর্ক হয়ে যাবে, করে দেব? হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই, আবার জিগায়! বাই হল গিয়ে মিজোরামের সিগনেচার ডিশ। নানারকম তরকারি আর শাক দিয়ে ঢিমেআঁচে বানানো স্ট্যু। ফ্রায়েডরাইসের উপরে সরু করে কুচানো বাঁধাকপি ছড়ানো।
বাই ,পর্ক ফ্রায়েডরাইস ফ্রায়েডরাইসে গার্নিশ করেছে কাঁচা বাঁধাকপি দিয়ে! তাজ্জব হয়ে বাঁধাকপির জাল সরিয়ে দেখি তার নীচে একস্তর সরু সরু ঝুড়িভাজা গোছের কিছু একটা। বাই মোটামুটি অন্যতম প্রধান পদ মিজো ক্যুইজিনে, কিছু অপরিচিত মশলা দেওয়া ছিল চিনতে পারিনি, স্বাস্থ্যকর এই খাবারটা খেতেও ভাল বেশ। পাশের দুই ঘরের বাসিন্দারা আজই বিকেলের দিকে এসে পৌঁছেছেন। এঁরা এখন বেরোবেন রাতের আইজল দেখতে। কথায় কথায় জানা যায় একজন কোন্নগরের বাসিন্দা, যদিও এখন কুচবিহারে থাকেন কর্মসুত্রে। আরেকজনের মেয়ে সম্প্রতি করমসূত্রে পুণেবাসিনী হয়েছে।
আলাপ জমতে দেরী হয় না। বাকীরা কেউ গৌহাটি কেউ ডিমাপুর থেকে এসেছেন, মোট ৮ জনের দল। এঁরা কেউই সেই হাফলঙের সহযাত্রীদের মত গাঁকগাঁকে নন, বলাই বাহুল্য। আর শুধু কালকের দিনটা আইজলে, দেখা যাক কদ্দুর কী দেখে ওঠা যায়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।