৬০-র দশক। ইতালির অর্থনীতিতে জোয়ার আসে এই সময়। উত্তর ইতালিতে তৈরি হয় সেই সময়ের বিচারে ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং। অন্যদিকে ইতালির দক্ষিণ ভাগে ক্যালাব্রিয়ান অন্তঃভূমিতে এই সময়ই একদল স্পিলিওলজিস্ট অভিযান চালান বিফুর্তোর অতলে। আবিষ্কৃত হয় ইউরোপের গভীরতম গুহা! ইতালির চলচ্চিত্র পরিচালক মাইকেলেঞ্জেলো ফ্র্যামার্টিনো(১৯৬৮-) স্পিলিওলজিস্টদের এই অভিযানকে কেন্দ্র করে ২০২১ সালে তৈরি করেছেন 'ইল বুকো' বা 'দি হোল'। বলা-বাহুল্য ছবিটির প্রেক্ষাপট ৬১-র ইতালি অর্থাৎ ছবিটি একটি পিরিয়ড ছবি। এই গুহাটি লাইমস্টোনের অর্থাৎ গুহাটির একটা বিশাল ভূতাত্ত্বিক সময় পরিসীমা আছে যা প্রকৃত-প্রস্তাবে বর্তমানের চোখে পৃথিবীর দীর্ঘ ইতিহাসের এক অফস্ক্রিন উপস্থিতি। ভেনিসে ছবিটি প্রদর্শিত হওয়ার পড়ে একটি সাক্ষাৎকারে ফ্র্যামার্টিনো জানান, তিনি মনে করেন মানুষের কাছে চলচ্চিত্রের সবথেকে আকর্ষণীয় ও অভিনব ব্যাপার হল অফস্ক্রিন উপস্থিতি বা অফস্ক্রিন স্পেসের যথোপযুক্ত প্রয়োগ। এর থেকে বোঝা যায় ক্যালাব্রিয়ান অন্তঃভূমির ঐ গুহাকে কেন তিনি বেছে নিয়েছিলেন ছবির বিষয় হিসেবে। কিন্তু শুধু তাই নয়।
পলিনো মালভূমির এই অঞ্চল নৈসর্গিক। সাদাকালো দূরদর্শন ততদিনে এসে গেছে কিন্তু দূরদর্শন এই অঞ্চলের মানুষকে প্রদান করেছে মৌনতা। শুঁড়িখানায় দিনের শেষে বৃদ্ধেরা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে হাসা-হাসি করে। ভূপ্রকৃতি অপূর্ব, এখানে প্রকৃতই মেঘ গাভীর মত চড়ে। বোঝা যায় এখানকার মানুষের জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির তখনও বিচ্ছেদ ঘটেনি। বহু সুপ্রাচীন একটি জনজাতি যেন তাদের অনাসক্ত ও অনাড়ম্বর জীবন নিয়ে আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ। যীশুর শায়িত মূর্তির পাশ দিয়ে প্রার্থনা গৃহে প্রবেশ করে মানুষ। সমস্ত পরিবেশটি অত্যন্ত নির্মল। ছবির শুরুর দৃশ্যে কালো পর্দা ধীরে ধীরে সাদা হলে দেখতে পাই একটি গুহার মুখ, গরুর গলার ঘণ্টার ধ্বনি ভেসে আসে, দুটি গরুকে একটু পড়ে ঐ গুহা-মুখে দেখতে পাওয়া যায়। গরুর গলার ঘণ্টার ধ্বনি পলিনো মালভূমির বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বারে বারে শোনা যায় , দূর থেকে ভেসে আসা গরুর গলার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয় পর্বত গাত্রে - "সঞ্জীব চাটুজ্যের মতে এই শব্দটার মধ্যে একটা বিষণ্ণতার ভাব আছে" (অরণ্যের দিনরাত্রি(১৯৭০)), ফ্র্যামার্টিনো ছবির মুড নির্মাণে অভিনব ভাবে ব্যবহার করেছেন শব্দগুলোকে। ছোট্ট এই জনগোষ্ঠীতে বাইরের কারোর তেমন পা পড়েছে বলে মনে হয় না। শুরুর দৃশ্যের ঠিক পরেই অশীতিপর এক মেষপালকের সাক্ষাৎ পাই । মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে দূরে মালভূমিতে চড়ে বেড়ানো পশুদের উদ্দেশ্যে বার্তা প্রেরণ করেন তিনি। পরিচালক এই বৃদ্ধকে পলিনো মালভূমির নীরব ইতিহাস-দ্রষ্টা ও ভূমিপুত্র হিসেবে প্রতিভাত করতে চেয়েছেন। বিফুর্তোর অতলের ভূতাত্ত্বিক বিশাল টাইম-ফ্রেম যা মানুষের শুধু নয় পৃথিবীর ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে, পরিচালক যুগপৎ তার প্রতি-তুলনায় ও তার সমান্তরালে ধীরে ধীরে দাঁড় করিয়েছেন এই বৃদ্ধকে। কিন্তু প্রতি-তুলনার চলচ্চিত্রীয় ব্যবহার আছে আরও দুটি জায়গায়। শুরুর বৃদ্ধ মেষপালকের দৃশ্যটির পরেই একটি দৃশ্য আছে যেখানে ক্যামেরা একটি হাইরাইজের গা বেয়ে উপরে উঠে যেতে থাকে! মাইকেলেঞ্জেলো আন্তোনিয়নির(১৯১২-২০০৭) ১৯৬১ সালের ছবি 'লা নত্তে'র বিখ্যাত শুরুর দৃশ্যটিও এরকমই ছিল। আন্তোনিয়নি নগর-আধুনিকতাকে নীরবে প্রতিবিম্বিত করেছিলেন, কারণ এই নৈঃশব্দ্যকে এলিয়ানেশনের বা একাকীত্বের প্রতীক করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। ফ্র্যামার্টিনো ব্যতিরেকে শুধুমাত্র এই দৃশ্যটিতেই সরব অর্থাৎ শুধুমাত্র এই দৃশ্যেই সংলাপ আছে, গোটা ছবিটিতে আর একটিও সংলাপ নেই। দুই সাংবাদিক ক্রেনে করে বিল্ডিঙের উপরে উঠতে উঠতে পরিচয় দিতে থাকেন বিল্ডিংয়ের ভিতরে দেখতে পাওয়া অফিস কর্মীদের। ফ্র্যামার্টিনো এই ঊর্ধ্বগতিকে ইতালির তৎকালীন অৰ্থনৈতিক উন্নতির প্রতীকে যেমন দেখেছেন একই সঙ্গে পরবর্তী শান্ত ক্যালাব্রিয়ান অন্তঃভূমির গুহা-অভিযানের অতলে যাওয়ার প্রতি-তুলনাকে করতে চেয়েছেন জোরালো। আরেকদিকে চলচ্চিত্র যদি আলোর শিল্প হয় অর্থাৎ চলচ্চিত্রে কালো পর্দা সাদা থাকাই যদি রেওয়াজ হয়, তাহলে এ-ছবি কিন্তু বহুলাংশেই প্রতি-চলচ্চিত্র! কারণ আলো এ-ছবিতে যথেষ্ট কম, বিশেষত গুহা-অভিযানের দীর্ঘ অংশে পরিচালক তথ্যচিত্রের ধাঁচে উন্মুক্ত করেছেন অচেনা ও অন্ধকারে ঢাকা চুনাপাথর ও জল। হলিউডের অ্যাডভেঞ্চার ছবির মতন অভিযানকারীদের কষ্ট ও প্রতিকূলতার স্পেক্টাক্যাল তৈরিতে ফ্র্যামার্টিনোর কোনো আগ্রহ নেই, বরং অভিযানকারীদের সংজ্ঞাবহ অঙ্গে ধরা দেওয়া অনাবিষ্কৃত গুহার প্রতিকৃতিতেই তিনি বিশেষ আগ্রহী। নির্মাণ নয় প্রদর্শন - গুহা-অভিযানের পর্বটি জুড়ে আছে এই মনোভাব। তাই এই ছবির শরীরে লেগেছে তথ্যচিত্রের মেজাজ। কিন্তু ছবিটি ইউরোপের গভীরতম গুহা সম্পর্কিত কেবল একটি তথ্যচিত্র নয়।
ঐ অঞ্চলের মানুষদের কাছে স্পিলিওলজিস্টদের দলটি একপ্রকার অলক্ষিতই থেকে গিয়েছিল, কেবলমাত্র ঐ অশীতিপর মেষপালক পাহাড়ের উপর থেকে বসে দেখতে পান ওদের। নিরুদ্রূপ এই অঞ্চলে ও মেষপালকের জীবনে, এরা উপদ্রব হিসেবে দেখা দিল কিনা কে জানে! কি হল মেষপালকের! একদিন তাঁর খচ্চরটি বাড়ি ফিরে এলো কিন্তু তিনি ফিরলেন না! বাড়ির লোকজন খোঁজ করে দেখেন তিনি অসুস্থ অবস্থায় পড়ে আছেন পর্বত-গাত্রে! ধরাধরি করে বাড়িতে আনা হয়। এরপর আর সুস্থ হন নি। স্পিলিওলজিস্টদের গুহা-অভিযানের সমান্তরালে পরিচালক বুনে গেছেন বৃদ্ধের অন্তিম দিনগুলিকে। ম্যাগাজিনের একটি পাতা ছিঁড়ে তাতে আগুন ধরিয়ে অতলে নিক্ষেপ করা হয় সম্ভবত অক্সিজেনের উপস্থিতি পরিমাপ করার জন্য। পতনশীল পোড়া পাতাটির নিভুনিভু আগুনে রহস্যময় গুহাটি অল্প-অল্প প্রতিভাত হতে থাকে। ছবির সময়কালকে প্রত্যয়যোগ্য করার অভিপ্রায় পাতার অর্ধেক না-পোড়া অংশে পরিচালক রেখে দেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী আমিতোরে ফানফানির ছবি! অভিনব ব্যাপার হল স্পিলিওলজিস্টরা গুহার যত গভীরে যেতে থাকে, বৃদ্ধ মেষপালকের শরীর তত খারাপ হতে থাকে! ছবিটির মৌলিকতা ও মাহাত্ম্য হল বাহ্যত দুটি অসংলগ্ন ঘটনার মধ্যে অপূর্ব-ভাবে একধরণের নিগূঢ় বা মিস্টিক যোগসূত্র স্থাপন করা যা প্রদর্শনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আবেদন রাখে মানুষের কাল্পনিক পরিসরে। ফ্রেডরিখ নিটশের(১৮৪৪-১৯০০) টিউরিনের ঘোড়ার কথা আমরা জানি। একটি ঘোড়াকে বেত খেতে দেখে কি হল নিটশের! ঘোড়াটির গলা জড়িয়ে ধরে শোকে তিনি পাগল হয়ে গেলেন, এই অসুস্থতা তাঁর আর সারে নি! মানুষের ক্ষেত্রে বিশেষত অতিস্পর্ষকাতর মানুষদের ক্ষেত্রে এরকম অদ্ভুত ও ব্যতিক্রমী ঘটনা তো ঘটে। হাঙ্গেরির পরিচালক বেলা টারের(১৯৫৫-) অসামান্য ছবি 'টিউরিন হর্স'(২০১১)-এ বিধৃত হয়েছে এই ঘটনা। বৃদ্ধ মেষপালক ও পলিনো মালভূমি যদি একে-অপরের প্রতীক হয় তাহলে বিফুর্তোর অতলে স্পিলিওলজিস্টদের অনুপ্রবেশ কি বৃদ্ধের হৃদযন্ত্রে তথাকথিত সভ্য মানুষের অতর্কিত হামলার রূপক? আন্দ্রেই তারকভস্কির(১৯৩২-১৯৮৬) 'স্টকার'(১৯৭৯)-এ যেমন আছে - একটি অনাবিষ্কৃত নৈসর্গিক জায়গার যাবতীয় নির্মলতাকে ধ্বস্ত করার জন্য একজন তথাকথিত সভ্য মানুষের উপস্থিতিই যথেষ্ট! কিন্তু মানুষের হৃদয় কোথায় থাকে? হৃদযন্ত্রে? মস্তিষ্কে? নাকি অন্য কোথাও? এ প্রশ্নের মীমাংসা সম্ভবত আজও হয় নি। ভারতীয় দর্শন বলবে এই হৃদয়ই তো হল অবিনাশী আত্মা যার অবস্থান শরীর ও মনের বাইরে (ভারতীয় দর্শনের কিছু ধারায় মনও শরীরেরই অংশ)। ফ্র্যামার্টিনো কি সেই দার্শনিক অবস্থান থেকেই দেখান - যখন অভিযানকারীরা গুহার গভীরতম প্রদেশ ছুঁলো, ঠিক তখনই মৃত্যু হল বৃদ্ধের! বিশুদ্ধ খ্রিষ্টানিটি কিন্তু আত্মাকে সচেতন বা অচেতন মনের পরিসরেই ভেবেছে, তাকে অতিক্রম করেনি। যার জন্য হাঙ্গেরির ইলদিকো এনিয়েদির(১৯৫৫-) ২০১৭ সালের ছবি 'অন বডি অ্যান্ড সোল'-এ সোল-র প্রতিনিধিত্ব করে স্বপ্ন, যা ভারতীয় দর্শনের দৃষ্টিতে খানিক হাস্যকরই ঠেকবে হয়ত। রবি ঠাকুরের(১৮৬১-১৯৪১) নাথ বা প্রভু যেমন আসলে কাব্যলক্ষ্মী, ব্যক্তিগত ঈশ্বর নন - ফ্র্যামার্টিনোর এও কি তাহলে অতীন্দ্রিয়তার মোড়কে নিখাদ একধরণের নান্দনিক সৌন্দর্য তৈরির প্রচেষ্টা? ছবির অন্তিম দৃশ্যে কুহকী কুয়াশার আস্তরণে পলিনো মালভূমি জুড়ে মৃত মেষপালক ডাক ভেসে বেড়াতে থাকে! journey to the center of the earth-র এই গল্প শেষাবধি journey to the center of the soul-র ভাবনায় বাঙময় হয়ে ওঠে। 'দি হোল' অসামান্য। শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও চলতে থাকে ছবিটির অনুরণন ও আসতে থাকে নতুন ভাবনা।
ছবিটির ট্রেলার
ইটালিয়ান কনস্যুলেটের উদ্যোগে গত ১২ থেকে ১৪ই অক্টোবর নিউ এমপ্যায়ারে দেখানো হল সে দেশের একগুচ্ছ সমকালীন ছবি। চলচ্চিত্রের আদি রূপ অর্থাৎ শুধুমাত্র দৃশ্য ও শব্দের কাছে প্রণত 'দি হোল' দেখে এলাম সেখানে।