২০২০ মনে আছে? সেই সে বছর, যখন প্রথমে 'গো করোনা, গো' মন্ত্রের মহানাদে, তারপর থালা-বাটি থেকে শুরু করে, পতঞ্জলির করোনিল হয়ে, শেষে পিএম কেয়ার ফাণ্ডের অদৃশ্য টাকা দিয়ে আমরা তীব্র বেগে করোনা তাড়ালাম? মনে নেই? সেই যে গো, কত লাশ গঙ্গায় ভাসলো, কত চিতা জ্বললো রাস্তায়?
সেই বছর, অসংখ্য ফোটোশ্যুটের ফাঁকে, গাড়ি গাড়ি মানুষের মৃত্যু জাস্ট পাত্তা না দিয়ে চা(লু)সম্রাট যখন 'মন কি বাত(কর্ম)' করছিলেন, তার ফাঁকেই কোনো এক সময় টুক করে দাবি পেশ করে এসেছিলেন — রামমন্দির এমনভাবে বানানো হোক, যেন ঠিক রামনবমীর দিন রামলালার মূর্তির মাথায় সূর্যের আলো এসে পড়ে। [১]
বানরসেনা তো সেই আদ্যিকাল থেকেই একইরকম। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। যেমন বলা, তেমন কাজ। কিন্তু করবে কে? কেন — শেয়ালের অভাব নাকি? Council for Scientific and Industrial Research (CSIR) — যাঁরা বহু বছর ধরে রিসার্চারদের স্কলারশিপ দেন আর যাঁদের দেশজোড়া অনেক ইন্সটিটিউট আছে — তাঁরা পেলেন এই মহান ব্রতের দায়িত্ব। মূর্তির সামনে যেন ভক্তরা ভগবানকে থ্রি-ডি-তে দেখতে পায়, এমন দাবিও করা হলো। তৎক্ষণাৎ দায়িত্ব পেয়ে গেলো Department of Science and Technology (DST)।
কত মহৎ কাজ, ভাবুন একবার! সারা পৃথিবী যখন বিজ্ঞানে আরো বেশি করে গবেষণার গুরুত্ব বুঝছে হাড়ে হাড়ে — বুঝছে কেন গোড়ার রিসার্চে গলদ (পড়ুন ফান্ডের অভাব) থাকলে ভ্যাক্সিন কেন, অক্সিজেনও ঠিক সময়ে পাওয়া যায় না; যখন পাশের দেশ চিন হু হু করে টাকা ঢালছে রিসার্চে, ভারতের থেকে অন্তত কয়েকগুণ বেশি টাকা পাওয়ায় ছেলেমেয়েরা ভিড় করছে সেখানে — ঠিক তখন, আমাদের পুরো মনোযোগ গরুতে, দুধে, ল্যাজে, গোবরে। আর কিছুটা পৌরাণিক গল্পের চরিত্রপূজায়।
নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, এই এদ্দিন পরে আবার পুরোনো কাসুন্দি কেন ঘাঁটতে বসলাম? বলছি। সেই কাজ এদ্দিনে CSIR সেরে এনেছে। তাদের ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে গর্বভরে স্ট্যাটাস দিয়েছে, কীভাবে CSIR-এর বিজ্ঞানীরা হাতেনাতে দেখিয়েছেন, ২০২৪ সালের রামনবমীতে মূর্তির মাথায় সূর্যালোক পড়বে। [২]
জানেন কি, কত গোপনে এদ্দিন ধরে কাজ হয়েছে এ নিয়ে? জটিল সমস্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানের অঙ্ক কষে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বুদ্ধি খাটিয়ে, তবেই না করা গেছে মন্ত্রীমশাইয়ের খামখেয়ালের সমাধান! ব্যাঙ্গালোরের Indian Institute of Astrophysics (IIA), আর পুনের Inter-University Centre for Astronomy and Astrophysics-র পাকা মাথাদের আর জনতার ট্যাক্সের টাকা কাজে লাগিয়ে এই অসাধ্য সাধন হয়েছে। একমাত্র মহুয়া মৈত্র নিন্দে করে বলেছেন, তাঁর কোনো বিজ্ঞানী বন্ধু নাকি মন্তব্য করেছেন — “বৈজ্ঞানিক হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে লজ্জা করে”।
কেন? লজ্জা কীসের?
সুপ্রিমো আবেগঘন স্বগতোক্তি করবেন, আর সেই আবেগ-থরোথরো শব্দক'টি নিয়ে ভক্তরা ছুটে মরবে দিগ্বিদিক — এমন তো আমার দেশের দৈনিক ঘটনা! এই তো সেদিন, নরেন আমাদের বলে বসলেন, ভারত নাকি Mother of Democracy! অমনই, দেশের উচ্চশিক্ষার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা UGC গ্রামে-টেলিগ্রামে বার্তা রটিয়ে দিলেন — এবার থেকে এইটিকে থিম ধরে, সর্বত্র বক্তৃতার আয়োজন করতে হবে। [৩]
আমাদের মনে থাকে না তো, তাই এ প্রসঙ্গে আবার একবার মনে করাই — USA-র জিডিপির মোট ৩.৪% গবেষণা-খাতে খরচ হয় (মাথাপিছু ১৮০০ ডলার)। এই একই খরচ চিনের ক্ষেত্রে ২.৪% (মাথাপিছু ৩২৫ ডলার)। উন্নতিশীল দেশগুলো, যেমন ব্রাজিল (মাথাপিছু ১৭৩ ডলার) বা দক্ষিণ আফ্রিকাও (মাথাপিছু ১০৫ ডলার) এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই।
ভারতের কত? জিডিপির ০.৭% (মাথাপিছু ৪৩ ডলার)। হ্যাঁ, ঠিক পড়েছেন, ১%ও নয়। [৪]
সরকারবাহাদুর বিজ্ঞানের প্রসারে ঠিক কতটা নিবেদিতপ্রাণ, তার মাপ পেতে আরও একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ দিই। এই বছরই ঘোষণা হয়েছে — পরীক্ষাগারের যন্ত্রপাতির ওপর ট্যাক্সের যে ছাড় ছিলো, তা তুলে নেওয়া হলো। অর্থাৎ যে ট্যাক্স ছিলো ৫%, তা এখন বেড়ে হলো ১৮%। তাতে কী ক্ষতি?
ধরুন, এই নিয়মের ঠিক আগে ১৫ লক্ষ টাকার যন্ত্র কিনতে হবে বলে ১৬লক্ষ টাকা চেয়ে প্রোজেক্ট লিখেছেন (কারণ ৭৫০০০ হল ট্যাক্স), আর ভয়াবহ সৌভাগ্যের কারণে পুরোটাই মঞ্জুর হলো (প্রায় কখনোই হয় না) — আপনি তাও যন্ত্রটা কিনতে পারবেন না। কারণ এবার আপনাকে ১৬-র ওপরে আরও ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হবে, যা আর আপনার কাছে নেই। [৫]
দুঃখ করবেন না। আপনার গবেষণায় না হোক, রাম, ছাগল, গরু, দুধ, আর্যরা বিদেশি কিনা, Curcumin (হলুদের মধ্যে থাকা যৌগ) কতটা ভালো — কোনো না কোনো মারকাটারি ফিল্ডে আপনার ট্যাক্সের টাকা খরচ হচ্ছে। রিসার্চ যদি না-ও হয়, অন্তত IIT খড়্গপুরের Indian Knowledge System এর নামে করা মিউজিয়ামে (কতগুলো অতি-চর্বিত, ঘোলাটে, সেকেলে আর ফাঁকা কথা লেখা ফলক যেখানে লাগানো আছে) অন্তত টাকাটা খরচ হচ্ছে। নিদেন, পিথাগোরাস তাঁর আইডিয়া ভারত থেকেই পেয়েছিলেন, বায়োলজিতে পঞ্চভূত — এসব প্রচার করতেও তো পয়সা লাগে, না? [৬]
এমনটাই হওয়ার কথা ছিলো। ঠিক এইরকম। কালচক্র ঘুরে চলেছে, কিন্তু গীতা-বর্ণিত অবিনশ্বর আত্মার মতোই অক্ষয় আমাদের সংস্কৃতি। ১৯২৭-এর মার্চ মাসে আম্বেদকরের নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রের মাহাড়-এর পানীয় জলের ট্যাঙ্ক থেকে জল খেয়ে দলে দলে দলিতরা সত্যাগ্রহ করেছিলেন। ফল? "ঢি-ঢি পড়ে যায় — “অচ্ছুৎরা জল খেয়ে জল নোংরা করেছে”। ব্রাহ্মণদের বিধান অনুসারে সেই ‘নোংরা’ জলকে পরিষ্কার করতে কী করা হয়? ১০৮ ঘড়া গোবর ও গোমূত্রের মিশ্রণ সেই জলে ঢালা হয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে — 'জল এবার পবিত্র'।" [৭]
এই গত সপ্তাহের ঘটনা — কর্ণাটকের এক গ্রামে, বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে এক দলিত মহিলা উচ্চবর্ণের খাওয়ার জলের ট্যাপ থেকে জল খেয়েছিলেন। ক্ষোভের চোটে গোটা ট্যাঙ্ক খালি করে, গোমূত্র ঢেলে পরিষ্কার করা হয়েছে। [৮]
এদেশে মহামারী, ভূমিকম্প, খরা, বন্যা, বিশ্বের উষ্ণায়ন — এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে, আর কিছুদিন পর থালাবাটি ছাড়া আর কিছু থাকবে বলে মনে হয়?
শুধু ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠানোর কথাটা মাথায় রাখবেন।
[১] ২০২০ তে মোদির ঘোষণা (ডেকান হেরাল্ড)
[২] ২০২২ এর CSIR-এর ঘোষণা (ডেকান হেরাল্ড)
[৩] Mother of Democracy নিয়ে UGC-র ঘোষণা (দ্য ওয়্যার)
[৪] গবেষণা-খাতে নানা দেশের জিডিপি (টাইমস অফ ইন্ডিয়া)
[৫] জিএসটি-র প্রকোপ (দ্য প্রিন্ট)
[৬] খড়্গপুর আইআইটি আর IKS (দ্য প্রিন্ট)
[৭] আম্বেদকরকে নিয়ে এই ব্লগের আগের লেখা (গুরু)
[৮] গোমূত্র নিয়ে খবর (এনডিটিভি)