বেলা ১২-৩০একটু ভুল বলেছিলাম। আশ্রমের একটি ঘরেই ছবি আছে; খাবার ঘরে একটিই মাত্র ছবি – উঠোনে দুই পা মেলে বসে থাকা মায়ের ছবি, যেন ছেলেমেয়েদের খাওয়াচ্ছেন। ওই একটি ঘরেই একটিমাত্র মন্ত্রপাঠ করা হয় অন্নগ্রহণের আগে, রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যান্য সেন্টারের মতোই –
ওঁ ব্রহ্মার্পনং ব্রহ্মহবি ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মনাহুতম ।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম সমাধিনা।।
হরি ওঁ তৎ সৎ ।ব্রহ্মময় এই জগতের এক ধ্রুব বাণী।
বেলা ৩-৩০সাদা কুণ্ডলীর মতো আসছে ও। পায়ের দিক থেকে। যেভাবে ভেসে আসে বৃষ্টির মেঘ, ওইভাবে ও এসে আমার পা ধরলো। ছোবল মারার মতো। আমার পায়ের গোছ বেয়ে, হাঁটু জড়িয়ে ও উঠছে উপরে। মাটিতে কার্পেটের সঙ্গে লেগে থাকা আমার পায়ের কোনও অনুভূতি নেই আমার। ঊরু পেরিয়ে কোমর, নিঃসাড়। আমার বুকের ঠিক মাঝখানে সাদা আলোর তুলো বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ। ঘড়ির কাঁটার দিকে।
কোমরের উপরের আমি সজাগ। নিজের হাত, বুক, পেট, চোখের মধ্যেকার করকর, সব বুঝছি। বুকের মাঝে আলোর তুলোটা হারিয়ে যাচ্ছে মাঝেমাঝে। একটানা সোজা হয়ে বসে থাকায় প্রবল ব্যথা এবার পিঠ বেয়ে উঠছে। হেলান দিলাম দেওয়ালে। বাইরে এক মা শিশুকে বলছেন, "মনা, সোয়েটারটা পর!" বাবা বলছেন, "এবার কিন্তু খুব বকবো।" তারপর শিশুর কান্না। চোখ জোর করে চেপে বুজে রেখে আমার মন ফেরানোর চেষ্টা করি। সেই তুলো নেই আর। কেউ বুলিয়ে দিচ্ছে না তাকে।
আমার দুই ভুরুর মাঝে ঠাকুরের মুখ – অতিপরিচিত ধ্যানস্থ, সমাধিস্থ মুখ। চোখ অর্ধ-উন্মিলিত। ভুরুর মধ্যিখান থেকে ছবিটা নামিয়ে আনছি বুকে। হঠাৎ অন্ধকার। একবার মনে হলো, আমি কোথায় বসে আছি? বাড়ি। কলেজ যেতে হবে? না। লোহাঘাট রেস্ট হাউজ। আজ ভোর। এখনও বেরোই নি মায়াবতীর জন্য? হঠাৎ সজাগ। ধ্যান কক্ষ। ওই, ও আবার আসছে সাপের মতো, সাদা, আমার পা বেয়ে। একবার, এক মুহূর্ত, বা তার কম সময়ের জন্য মনে হলো আমি দ্বিতীয় একটা শরীরে আছি। চেনা, পরিচিত শরীর। কিন্তু আমি আমাকে যে শরীরে স্বাভাবিকভাবে দেখি, চিনি, সেই শরীরে আমি নেই।
নিস্তব্ধতা ভেঙে পাখিটা ডেকে ওঠে।
(অদ্বৈত আশ্রমের ধ্যানকক্ষে দুপুর ১টা থেকে ৩টে অব্দি, প্রায় দু ঘন্টা ধ্যান করলাম। ভাঙা ভাঙা, চার পাঁচবারের চেষ্টায়। আচ্ছন্ন যে সব ছবি এল, অনুভূতি এল, তার বেশিটাই লেখার মতো নয়। সামান্য যেটুকু লেখার, লিখলাম।)
রাত ১১টা, লোহাঘাট রেস্ট হাউজ
অদ্বৈত আশ্রম বড় নিরানন্দ, স্থবির, গম্ভীর। মনখারাপ হয়ে আছে। ঠাকুর-মা-স্বামীজীর আশ্রমে যে আনন্দ প্রতিনিয়ত স্ফুরিত হতে থাকে, তার কণা মাত্র পেলাম না এই আশ্রমে। জ্ঞান ও ধ্যান – নিরাকার ব্রহ্মের, এতেই নিবদ্ধ এই আশ্রমের দিনযাপন।
But I am not yet ready for Advaita. তার দর্শন, বিচার, প্রায়োগিকতা শুনতে-জানতে ভালো লাগে। কৌতূহলী করে। কিন্তু নিজের যাপনে, চলার পথে, নিজের খোঁজে নিরাকার ভাবতে পারি না এখনও। I need something, some form, someone to hold on to. জ্ঞান, ধ্যান নয়; ভক্তি, কর্ম আমায় আত্মীয়তায় বাঁধে। নৈর্ব্যক্তিক প্রজ্ঞা নয়; আনন্দ, গান, অশ্রু, উদ্দেশ্য আমাকে জীবন দেয়। বহুদিন ইচ্ছে ছিল, জ্ঞানপথ আস্বাদন করবো। লোভ ছিল সেই পথের। আজ, বাড়ি থেকে এতদূর এসে সেই ইচ্ছে, সেই লোভ ভাঙলো মনে হয়। মনখারাপ, তবু যিনি ভেঙেছেন, তিনিই জানেন কেন ভেঙেছেন। আমি শুধু বিশ্বাস করি, তিনি ভেঙেছেন যখন, কারণ আছে বলেই ভেঙেছেন; গড়বেন বলেই ভেঙেছেন।