এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বদ্দিবুড়ির  কমলা  ডায়েরি ৫

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ৩১ আগস্ট ২০২২ | ১০৬০ বার পঠিত
  • ঘুমপরীর আজ বেরোতে একটু দেরী হয়ে গেল। পবা ছোঁড়ার কাজে বেশ মন আছে কদিন, ওদের উঠোনটা ঝেড়েমুছে একদম তকতকে নীল করে রেখেছে। বিষ্টি বাদলা দু’'ভাইবোন তো সেই যে সহ্যাদ্রির মাথার কুঁড়েঘরটায় গিয়ে গুটিশুটি মেরে ঘুম দিয়েছে না, সে আর এখন ভাঙার জো- টি নেই। সেই কবে আরো দখিনে সাগরের বুকে গুরুগুরুরা সব বচ্ছরকার ঘুম ভেঙে উঠে বসবে তারপর এতখানি এসে তবে না বিষ্টি বাদলার ঘুম ভাঙাবে। আজ বরং ঘুমপরী একবার দেখে যাবে ওদের কুঁড়েটা, একটু ঝেড়েঝুড়ে ঠান্ডাটা ঠিকঠাক করে দেবে। দরকার হলে আরো দুই ঝিনুক করে ঘুম দিয়ে যাবে ওদের। থাক ঘুমোক বাচ্চাদুটো, জেগে উঠলে বড্ড হুটোপাটি দৌরাত্মি করে বেড়ায় বাছারা। সুজ্জিদাদু কখন ঘরে এসে হাত মুখ ধুয়ে লেবু দেওয়া নুনচিনির পানাটুকু খেয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। তাও দেখো তেপান্তর মাঠের পশ্চিমদিকটায় এখনও কেমন রঙচঙে হয়ে আছে। লাল কমলা নীল গোলাপী সোনালী সব রঙগুলো কেমন ঠ্যালাঠেলি করে খেলছে। আসলে উঠোনটা অমন ঝকঝকে নীল বলে ওরাও মনের আনন্দে খেলে চলেছে। এক্ষুণি নিশিদাদু এসে সব আলো নিভিয়ে অন্ধকার করে দেবেখনে।
    .
    তাড়াতাড়ি পা চালাতে গিয়েও একটু থমকে যায় ঘুমপরী। এত তাড়াতাড়ি গিয়ে করবেই বা কি! মনিষ্যিরা এখন তো আর নিশিদাদুর নিয়মকানুন মানেই না। কতরকমের ঝিলিমিলি আলো বের করেছে, এক এক জায়গায় গেলে মনে হয় সুজ্জিদাদুও হার মেনে যায় বুঝি বা! শশীজ্যেঠু অবশ্য বলে সুজ্জিদাদুর কাছে কেউ লাগে না, আর সুজ্জিদাদু চাইলেই আলোর তেজ অনেক বাড়িয়ে নিতে পারে, মানুষ এখনও ওটা পারে না। কিন্তু সুজ্জিদাদু তো নিয়মে বাঁধা। নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনও কাজ তাকে দিয়ে কেউ করাতে পেরেছে কোনওদিন? সে অবশ্য শশীজেঠুও তাই। কিন্তু মনিষ্যিদের অত নিয়মকানুনের বালাই নেই। ওরা নিয়ম ভেঙেচুরে বাহাদুরি করে। আবার একদল এসে নতুন নিয়ম বানায় আবার ভাঙে ... এইই চলছে সেই কোন অদ্যিকাল থেকে। সাতপাঁচ ভেবে 'আয় ঘুমু যায় ঘুমু' ঘটটা তুলে নিয়ে বারদুয়ারে এসে 'মনচাউনি'কে খেয়াল রাখতে বলে বেরিয়ে পড়ে ঘুমপরী। বিষ্টি-বাদলার কুঁড়েটা ঠিকঠাক করে পরী ভাবে আজ বরং টুক করে হিমবন্তর দিক থেকে আগে ঘুরে আসা যাক, পরে অন্য দিকগুলোতে যাবেখন। শহর বাজারে মনিষ্যিদের চোখে ঘুম নামতে এখনও দেরী আছে খানিক।
    .
    হিমবন্তর কাছাকাছি এসে সৃষ্টির সাথে দেখা হয়ে গেল, সৃষ্টির মুখটা কেমন অন্ধকার হয়ে রয়েছে!। 'কী হোল লা ছিষ্টি? অমন আঁধারপানা মুখ করে আছিস ক্যানো?' সৃষ্টি উত্তর না দিয়ে তড়বড়িয়ে ঢাল বেয়ে নেমে যায় ঐ কিছুগ্রামের দিকে। অবাক হয়ে ক'পা এগোতেই হিমকুন্ডের পাশ থেকে কেমন দুলে দুলে টেনে টেনে এগিয়ে আসে স্থিতি। জিগ্যেস করে 'ঘুমদিদি তুমি সবকটা মনিষ্যিরে একদম ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারো না গো?'উত্তরের অপেক্ষা না করেই অমন যে শান্ত স্থিতি সেও পাইনের ডাল ধরে দুটো দোল খেয়ে হুউশ করে নেমে গেল মিছুবাসার মাঝখানটিতে। এদের সব আজ হল কি! ভাবতে ভাবতে হিমাহ্রদের দিকে এগোয় ঘুমপরী। হ্রদের বরখ সব ভাঙে নি এখনও, জায়গায় জায়গায় সাদা জমাট বরখ আর ফাঁকে ফাঁকে টলটলে জল, তাতে কালচে নীল আকাশখানার ছেঁয়া পড়েছে। হিমাহ্রদের নৈঋত কোণে লয়'কে দেখা যাচ্ছে। এক নিমিষে সামনে আসতে না আসতেই লয় সমস্ত ঘাসপাতা, ছোটখাট গাছগাছালি ইঁদুর ভোঁদড় উপড়ে নিয়ে চলতে লাগল হিমারণ্যর দিকে। সে কি চলা -- শোঁও শোঁও করে শব্দ উঠল দশ দিকে, সেই টানেই পরীও এসে হাজির হিমারণ্যের মুখটায়।
    .
    হিমারণ্যের সামনে দিকটায়, ঐ যেখানে কুয়াশা একদম ঘন হয়ে নেমেআসছে, সেইখেনটায় পরী দেখে এক অন্যমানুষ। সে ঠিক গাঁয়েরও নয় শহরেরও নয়। তার পোশাক আশাক কেমন যাযাবরের মতন। উস্কোখুস্কো চুলে ধুলোপড়া চিটচিটে জামাকাপড়ে সে কেবলই ডাকছে 'ও খুকী খুকীরে ও ও ও খুকীইই তোর মা যে বসে আছে। ওরে ও ও খুকীঈঈঈ।" পরী ভাবল একটু থেমে জিগ্যেস করবে নাকি কোথায় গেছে ওর খুকী? কেমন দেখতে সে? লয় কিন্তু তখনও তুমূল টানে টেনে চলেছে --- পরী পারলই না থামতে। হুড়মুড় করে এসে পড়ল জঙ্গলের ভেতরে একদম একটা মন্দিরের দাওয়ায়। লয়ের টানে হুড়মুড় করে ধ্বসে গেল সামনের থাম দেয়াল। আর অমনি দেখে একটা সরু সিঁড়ি নেমে গেছে কোন সে পাতালে। অনেক নীচ থেকে আসছে আলো একটু একটু। আবছা অন্ধকারে সিঁড়ির পাশে ও কে?? লয় হঠাৎই থেমে গেছে, চারদিক নিঃঝুম ঝিঁঝিগুলোও লুকিয়েছে কোন গর্তে। পরী নেমে আসে নীচে। একটা ছোট্ট খুকী যেন ... যেন খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকি! ওর গায়ে জামাকাপড় কিচ্ছুটি নেই। ছোট্ট পুতুলটাকে কারা যেন ছিঁড়েখুঁড়ে রেখে গেছে -- ছোট ছোট পা দুটো কেমন বেঁকেচুরে দুইপাশে ছড়িয়ে আছে --- কোমরের নীচে থেকে উরুসন্ধি বেয়ে জমে আছে চাপ চাপ রক্ত --- কালো আঁশটে দুষিত -- খুকীটা নড়তে চেষ্টা করছে পারছে না --- মুখটা বাঁধা --- ঘুমপরী খুকীর বুকে কান পেতে, ঠোঁটে কান পেতে কি যেন বুঝে নেয় --- কোঁচড় থেকে সাবধানে বের করে আনে 'আয় ঘুমু যায় ঘুমু' ঘটটা, ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে ঘোরাতে ঘোরাতে ঘটের মুখটা খুকীর আধখোলা চোখের উপর ধরে -- প্যাঁচের পর প্যাঁচ দেয় আর গবগবিয়ে বেরিয়ে আসে কালো গভীর ঘুম --- খুকীর চোখ বুজে যায় পুরোপুরি -- ঘুমপরী থামে না প্যাঁচ ঘোরাতেই থাকে --- খুকী একেবারে চুপ হয়ে যায়, থির হয়ে যায়, নিঃঝুম হয়ে যায়।
    ঘুমপরী মুখ তুলে দেখে নিশিদাদু এতক্ষণে সব আলো নিভিয়ে দিয়েছে। কোথা থেকে সমস্ত আকাশ বাতাস তিন ভুবন জুড়ে হা হা করে সাতজন্মের হাহাকার উঠে আসছে ... ছেয়ে ফেলছে জগৎ সংসার।

    (২০১৮তে আসিফার মুখটা কিছুতেই ভুলতে না পেরে লিখেছিলাম। শেষ খবর দেখেছিলাম আসিফার খুনীরা জামিনে মুক্ত হয়েছিল। তারপর তাদের কী হয়েছে তা আর চোখে পড়ে নি। বৃথাই লিখি #JusticeForAsifa) 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ৩১ আগস্ট ২০২২ | ১০৬০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2601:448:c400:9fe0:2107:955d:4c73:***:*** | ৩১ আগস্ট ২০২২ ১৯:৪২511533
  • এই লেখার মন্তব্য কী হয় জানিনা। একরাশ মনখারাপ, ভয়, আরো কিছু স্ট্রং খারাপলাগা অনুভূতিতে মন ভরে গেলো (তাদের নাম আমার জানা নেই)।
  • Krishna Malik (Pal ) | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৬:০৮511604
  • কিছু বলা যায় না এই লেখায়
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন