
গবেষণা খুব গম্ভীর একটা শব্দ। পদার্থবিদ্যাও তাই। ‘কণা পদার্থবিদ্যায় গবেষণা’ শুনলে তাই কম্প দিয়ে জ্বর আসা খুব অস্বাভাবিক নয়। আমার আজকের কাজ হল, সেই আপাত-ভীতিটা কাটিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা, যে এই বিষয় নিয়ে উঁচু ক্লাসের পড়াশুনো, গবেষণা – করব কেন?
আগে ভাবা যাক, গবেষণা কেন? পাঁচজনে পাঁচরকম বলবেন, তোমরাও নিজেরা পরে নিজেদের মত করে ভাবার চেষ্টা করতে পারো – আমি শুধু আমার যা মনে হয় বলি। শিশু হোক বা বৃদ্ধ, প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের মনে নানা সময়ে নানা বিষয়ের প্রশ্ন আসতেই থাকে: সুকুমার রায়ের “... কেমন করে চাটনি বানায়, কেমন করে পোলাও করে...” থেকে শুরু করে, আকাশের সবচেয়ে টিমটিমে তারাটা আমাদের থেকে কত দূরে, কাচ কেন স্বচ্ছ, ধাতু কেন তড়িৎ-পরিবহণ করে – এ ধরনের প্রশ্ন হয়ে, জীবনের মানে কি, এই মহাবিশ্ব কি করে তৈরি হল – অবধি, প্রশ্নের শেষ নেই। অনেকেই শুধু প্রশ্নটা ভেবেই শান্ত হয় না, জিজ্ঞেস করে ফেলে। কিছু বছর আগে, আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন প্রশ্ন করতে হলে বাড়ির বা স্কুলের বড়দের জিজ্ঞেস করা ছাড়া অন্য রাস্তা ছিল না। অদ্রীশ বর্ধন এমনই নানা প্রশ্নের উত্তর সাজিয়ে একটি বই লিখেছিলেন – ‘আমার মা সব জানে’।
ইন্টারনেটের যুগে, এখন, সে সব প্রশ্ন গুছিয়ে লিখে ফেলতে পারলেই, গুগলের মত কেউ তার উত্তর দিয়ে দেয় – প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর। ঠিক ‘সব’ কী? না। এখনও, প্রতিদিন, প্রতিটি বিষয়ে মানুষের মনে শত শত এমন প্রশ্ন জাগছে, যার উত্তর কেউ জানে না। এমন কি, এমন অনেক প্রশ্ন, যা আগে কেউ কখনো করেনি। এর উত্তর তো গুগলের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়! যেমন ধরো, গত বছরের জানুয়ারি মাসে যদি তুমি গুগল করতে, কোভিড-১৯-এর ভ্যাক্সিন কি করে বানানো যায়, তবে উত্তর পেতে না। কিন্তু, সেই সময়েও, একদল মানুষ শুধু প্রশ্নটি করেই ক্ষান্ত হননি – নিজেদের পড়াশুনো, বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে, দিনরাত পরিশ্রম করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন – তারই সুফল হিসেবে আজ আমরা কোভিডের টিকা পাচ্ছি। এঁরাই গবেষক। গবেষণা হল, সেই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা, যার উত্তর কারুর জানা নেই।
স্বভাবতই, এই সব প্রশ্ন অধিকাংশ সময়েই খুব কঠিন হয়। সহজ হলে তো তার উত্তর আর অজানা থাকত না, তাই না? এদের উত্তর দিতে তাই অনেক পড়াশুনো করতে হয় – যা আসলে মোটেই কঠিন কাজ নয়। কোনো বিষয়ে কৌতূহল থাকলে তা নিয়ে পড়াশুনো করাটা কঠিন নয়, আনন্দের। আমি নিশ্চিত, তুমি এমন দু’জনকে চেনো, যাদের একজন ক্রিকেটের সমস্ত শুকনো সংখ্যাতত্ত্ব মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর একজনের সে সব শুনলেই ক্লান্তি আসে। কিন্তু কিছু কিছু প্রশ্ন এতটাই গভীর, এতই বিশাল তার পরিধি – যে তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেও ভিড় করে আসে আরও হাজারটা প্রশ্ন (কম করেও) – যারা নিজেরাও প্রায় ততটাই গভীর। সেইসব প্রশ্ন-পিতামহ তখন জন্ম দেয় এক-একটি গবেষণার বিষয়ের।
এমনই একটি প্রশ্ন হল, “কি দিয়ে সমস্ত কিছু তৈরি?” – যার উত্তর দিতে গিয়ে আরও অনেক বিষয়ের মত তৈরি হয়েছে কণা-পদার্থবিদ্যা (Particle Physics)। অণু-পরমাণুর কথা তোমরা সবাই জানো। আধুনিক কণা পদার্থবিদ্যার একটি অংশ, যাকে High-Energy Physics-ও বলে – এর কাজ হলো অণু-পরমাণুরও ভিতরের কণাদের (sub-atomic particles) নিয়ে প্রশ্ন করে, তার উত্তর খুঁজে বের করা।
এইসব বিটকেল প্রশ্ন, যাদের উত্তর ঘরে বসে, গালে হাত দিয়ে, ভেবে বের করা অসম্ভব – পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হয় – তাদের থেকে জন্মানো বিষয়গুলোকে বলে বিজ্ঞান। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা – এইসব বিষয়ে পড়াশুনো করলে তাই তোমাদের ল্যাবরেটরিতে গিয়ে হাতেনাতে অনেককিছু করে দেখতে হয়। এখন গোলমাল হল, ‘এর ভেতরে কি আছে’-ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রায় সব সময়েই উল্লিখিত জিনিসটি ভেঙে ফেলতে হয়। ইউটিউবে ‘What’s Inside’ নামের একটা চ্যানেলই আছে, বাপ-বেটার বানানো – যারা এই কাজটি করে থাকে। এদের দেখলেই বোঝা যায় – যাকে ভাঙতে চাই, তাকে হাতুড়ি, ছুরি, কাটারি – এমন কিছু একটা দিয়ে গুঁতো, ধাক্কা – কোনোরকম আঘাত না করলে ভাঙা সম্ভব নয়, এমনকি কতটা জোরে আঘাত করা উচিত, সেটাও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এখন, উদ্দিষ্ট বস্তুটি যদি সাব-অ্যাটমিক কণা হয়? তাকে গুঁতোবো কি দিয়ে, কিভাবে?
সহজ উত্তর, আর একটি তেমনই কণা দিয়ে! দুটো গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষও তো আসলে একরকমের গুঁতোই, তাই না? আর তেমন জোরে গুঁতোলে, গাড়ির অভ্যন্তরের মাল-মশলাও দেখতে পাওয়া সম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, যদি পর্যাপ্ত শক্তি দিয়ে যুযুধান দুই কণাকে গুঁড়িয়েও ফেলি, ছিটকে আসা টুকরো-টাকরা দেখে কি আর বোঝা সম্ভব, তারা কণার মধ্যে কেমন করে বাস করছিল, কোন অদৃশ্য বলের প্রভাবে নিজেদের মধ্যে বেঁধে-বেঁধে ছিল? আরও মুশকিল – কণারা এতই ছোট, যে ঠিক মত তাক না করতে পারলে, দুটো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার মুখোমুখি সংঘর্ষ দেখতে রাত ভোর হয়ে যেতে পারে। এইখানে, আমাদের কিছু সুবিধে আছে। চাইলেও, প্রতি মুহূর্তে কোটি কোটি গাড়ি তৈরি করা সম্ভব নয়, কিন্তু কণাদের সম্ভব। বিশাল সংখ্যক কণার ঝাঁক তৈরি করে নিখুঁতভাবে বারংবার তাদের একই রাস্তায় মুখোমুখি চালালে, অল্পকিছু কণা গুঁতো খেতেই পারে।
ঠিক এমনটাই হয় ইউরোপের Large Hadron Collider (LHC)-এ। বেশি বর্ণনায় যাচ্ছি না, গুগল করে দেখে নিও, কি প্রকাণ্ড সেই মহাযজ্ঞ, ঠিক কত মানুষ তাতে কাজ করেন, আর কত খরচ হয় এই জিনিস চালাতে (একটা আন্দাজ – এই অর্থের পরিমাণ এতটাই বেশি, যে কোন এক-দু’টি দেশের পক্ষেও এর খরচ চালানো সম্ভব নয়)। এখানে, অসংখ্য বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে (তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ের – অত বড় একটা যন্ত্র চালাতে ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের সমস্ত শাখা – সবাইকে দরকার) প্রতি সেকেন্ডে ১০০ বিলিয়ন প্রোটনকে (হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস) ২৫ মিলিয়ন বার একই সরু রাস্তায় ঘোরানো হয়। তা-ও, কণারা এতই ছোট, যে প্রতি সেকেন্ডে মাত্র ৫ থেকে ৫০টি কণার ধাক্কা লাগে (বলা ভাল, আমরা সে ধাক্কা টের পাই)। টানা বহুক্ষণ ধরে এই ব্যাপার চালালে, আর সমস্ত কণা-অ্যাক্সিডেন্টের নথি জোগাড় করে রাখতে থাকলে, একসময় আমরা আন্দাজ পেতে থাকি, আসলে কি চলছে কণাদের অঙ্গরাজ্যে। এই সব কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের বলি experimentalist। এরপর দুনিয়া জুড়ে গবেষকরা সে সমস্ত তথ্য দেখে, আরও ভেবে, পড়াশুনো করে, নিজেদের আন্দাজ সবাইকে লিখে জানান। এঁদের বলে theorist। তাঁদের এইসব আন্দাজ (গালভরা নাম hypothesis) যেমন এক্সপেরিমেন্টালিস্টদের পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা দেয়, তেমনই, আরও কিছু নির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করে, যা ওই বিশেষ আন্দাজটির নিজস্ব। এইসব ব্যাখ্যা দেওয়া, ভবিষ্যদ্বাণী করা – এ সমস্ত কাজ করেন কিছু phenomenologist। সেইসব দেখে, এক্সপেরিমেন্টালিস্টরা আবার ফিরে গিয়ে, কখনো আরো পরীক্ষা চালিয়ে, কখনো পরীক্ষা-পদ্ধতি সামান্য বদলে, কখনো বিশেষ কোন কণার আচরণের প্রতি তীব্র নজর রেখে – ঝালিয়ে দেখেন কোন আন্দাজটির ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কত। সেই ফলাফল ঘোষণা হলে আবার এই সমস্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।
এত কিছু শোনার পর তোমাদের মনে হতেই পারে – সবই বুঝলাম, কিন্তু এ সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমাদের সমাজের, সভ্যতার কি লাভ? কোভিড-১৯-এর ভ্যাক্সিন বানানো তো ভাল ব্যাপার, কিন্তু কণাদের অন্তরের কথা জেনে কি ‘লাভ’? উত্তরে প্রথমে বলি, মহাবিশ্ব-রহস্যের সুলুক-সন্ধান নিজেই এক মহৎ উদ্যোগ। কবে, কখন, সেই সন্ধান থেকেই আমরা অন্য কোন সমস্যার সমাধান পাবো – কেউই জানি না। যে সমস্ত বিজ্ঞানী কম্পিউটারে সার্স-কভ-২ এর আকার-প্রকার চালিয়ে সবাইকে জানিয়েছেন, যাঁরা ল্যাবে ভ্যাক্সিন বানিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশ এই মহামারীর আগে ঠিক কি করছিলেন বলো দেখি? এরকমই নানা আপাত-অর্বাচীন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন। সেই চেষ্টার সময় তাঁরা ভাবেননি, কিভাবে মানব-সমাজের কাজে লাগা যায়। যখন দুর্দিন এল, তাঁদের অধীত বিদ্যার ওপর ভর করেই আমরা যুঝতে পারলাম ব্যাধির সঙ্গে, বুঝতে পারলাম কিভাবে নিজেদের বাঁচানো যায়।
তোমরা কি জানতে, কণা-পদার্থবিদ্যার এক্সপেরিমেন্টের এই পীঠস্থান, LHC – যে সংস্থার, সেখানেই, এমনই এক এক্সপেরিমেন্টের প্রয়োজনে বিভিন্ন কম্পিউটারের মধ্যে যোগাযোগের যে কাঠামো বানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা, আজ তারই বিপুলাকার রূপটিকে আমরা ইন্টারনেট বলে জানি?
dc | 2401:4900:1cd1:a862:a07c:584:6b6:***:*** | ২৮ আগস্ট ২০২২ ০৯:১৭511430