দাগ
প্রেসার কুকারের সিটি বাজে।
একটুখানি ডাল বেরিয়ে এসে
ঢাকনার উপরে একটা দাগ হয়ে যায়
দাগটা হলদেটে
বাসন ধুতে গিয়ে ঘষে ঘষে
দাগটা তুলবার চেষ্টা করি।
উঠে যাবে ।
ভারতবর্ষের ম্যাপের মত দেখতে
একটা ত্রিভুজাকৃতি দাগ।
আমার দেশের মত দেখতে…
আমি ঘষতে থাকি
দাগটার উপর।
দেশটাতে সবাই
খুব বেশি কিছু চায়নি।
দুবেলা একবাটি ডাল
সঙ্গে ভাত কিম্বা রুটি।
এটুকু পেলেই…
দাগটা উঠছে না।
হয়তো দাগটা ফিকে হয়ে যাবে
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
একটু খাদ্য চেয়েছিল অনেকেই
দেশটার চেহারা … দাগটা
প্রেসার কুকারে
পাত্রের ভিতরে চাপ বাড়ে
সিটি বাজবার আগে
দেশটার ভিতরেও
অসহ্য চাপ নানা দিকে
চাপ বাড়ছে
দেশটার মাটি
আমাদের ধরে রেখেছে এতদিন
যদি হঠাৎ ফেটে পড়ে
প্রচন্ড চাপ
দাগটা ঘষে ঘষে তুলে…
সব ভুলে থাকতে চাইছি
প্রচন্ড বিস্মৃতির নিচে
আমরা ভুলতে চাইছি
চাপ বেড়ে চলেছে
বৃষ্টি থেমে গেছে
বৃষ্টি থেমে গেছে।
দ্বিধাহীন আকাশের গায়ে লেগে আছে-
কিছু সংলাপ। অমন থাকেই;
ওরা মন্ত্র হয়ে ওঠার চেষ্টায় ছিল।
তারপর এমনকি…
যুদ্ধও থেমে গিয়েছে সেখানে কবেই।
সাল তারিখ লেখার প্রয়োজন নেই
সময়ভেদী রণক্ষেত্রের মাটিতে
কিছু বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে তবু।
অভিশাপ লেগে আছে
অসমাপ্ত কিছু সংলাপের মত।
তবু ভালো, কিছু সবুজ ধীরে
জড়িয়ে নেবে রান্নাঘরের দরজা-জানালা।
বহুকাল আগে ওখানেই কেউ
পিঁড়ে পেতে খেয়েছিল ভাত।
তারপর কিছু মানুষ ডেকে নিয়ে যায়
কোন অচেনা আকাশের দিকে।
বৃষ্টির অসমাপ্ত সংলাপের মত…
মানচিত্র
মানচিত্রের খোঁজে ছিল এক পথিক
বিষাদরেখার সীমানা ছিল কি দেশে?
সাকিন কোথায়, নেই কোন কিছু ঠিক
মাটি গেছে বুঝি বন্যার জলে ভেসে।
নদীটি কবেই গিয়েছে হারিয়ে তার
নীল রেখা দিয়ে ম্যাপে আঁকা যাবে জল?
নাকি তার তীরে নতুন যুদ্ধ ঘাঁটি
শান্তির ডানা মেলে ধরবার ছল।
অরণ্য আছে কোন পাহাড়ের কোলে?
সবুজ তুলিতে শিল্পীরা এঁকে রাখে।
পাহাড়ের নিচে শরণার্থীর শিবির
সেসব কি আর মানচিত্রেতে থাকে?
শ্মশান কোথাও দেখানো তো নেই তবু
পথিক দেখেছে পথে পথে জ্বলে চিতা
প্রলয়ের নেশা দেশের শিকড়ে কাঁপে,
পথের চিহ্নে আঁকা রেখা বুঝি বৃথা।
মানচিত্রটা খুঁজছে পথিক আজো
যেন ঈশ্বর খুঁজছে ভক্তজন
ভালোবাসা মাখা তুলি দিয়ে মুছে দেবে
বিষাদরেখার কাঁটাতার বিভাজন।
শিবির
সন্ধে হয়ে আসছিল। প্রায়ই সোনাকাকা সন্ধের পর-
নিজের থেকে ঘরে ফিরত না। ডেকে আনতে হত।
টিলার পেছনে ঘাসজমিতে বসে বসে অন্ধকারে
মাটির গন্ধ শুঁকতো।
তারপর মাথা নাড়তো। সেদিন সন্ধের পরেও-
ওই জায়গাতেই বসেছিল সোনাকাকা।
ডাকতে গেলে ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে-
আমাকে চুপ করতে বলে, তারপর তর্জনী তুলে-
দেখায় গর্তে বর্ষার জমা জলে ব্যাঙ্গাচিদের উল্লাস।
ফিসফিস করে বলতে থাকে, ‘দ্যাখ,
দ্যাখ, অগোরও থাকনের বাসা আছে। আমাগোর নাই।
আমাগো জমি নাই, সাঁতরানের নদী নাই।
সেই মাটির গন্ধ নাই। কিসু নাই’।
তারপর থেকে প্রতি ভাদ্র মাসে সন্ধেবেলায়,
সোনাকাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে
ঈশ্বরকে শাপ-শাপান্ত করতো-- ‘আমাগোর সব,
সব কাইড়া নিলেন। দেইখ্যেন একদিন এই ধরাধাম
ছাইয়া যাইব-অনে উদ্বাস্তু-শিবিরে। তখন আপনে
কুনখানে পলাইবেন ভগবান, কন দেহি?’
সোনাকাকা ফিরতে চেয়েছিল নিজের মাটিতে।
শিকড়ের টানে। পারেনি।
কিন্তু তার অভিশাপ ধীরে ধীরে ফলে যাচ্ছে, আমি দেখতে পাচ্ছি।
সন্ধে হয়ে আসছে। ভগবান, আপনি কোন শিবিরে আশ্রয় নেবেন?
বিভাজন
ভাগ করে দেবো সব দুইটি মেরুতে।
ভাগাভাগি হয়ে যাবে পোশাকে ও সাজে
এক হও এভাবেই, বৈচিত্র্য মুছে দাও।
বৈচিত্র্য অসুখ এক, বুঝে নাও সখা।
ভাগ হয়ে যাও সব মানে মানে
ভাগ হয়ে যাও মনে
সাদা কালো মেরুতে মেরুতে
ভালো মন্দ পেরোতে পেরোতে
ভাগ হও
ভিন্ন হও
এভাবেই মেরুতে যেতে যেতে
সভ্যতা মুকুট পরাবে জেনো ভাইসব।
মেরুতে জমেছে সাদা
উত্তরে দক্ষিণে
তুষারের স্তর জমে জমে
হিমযুগ নেমে এসে শান্তি শান্তি
সাদা সাদা মেরু মেরু
নিরক্ষ রেখা জুড়ে মরুবালুরাশি পুড়ে কালো।
সাদা আর কালো
আর কোনো রং নেই আদর্শ বিশ্বের কাছে
সবুজ বনানী, হলুদ লাল কমলা নীল ফুল,
নদীর স্রোতের বহমান নানা রং, আকাশের মেঘের রং
অতীত
মেরু জেগে থাকে
মরা পৃথিবীর গায়ে।