উঠোনে দুই সবেদাগাছ। অজাতশত্রু ও সমবয়েসী। ফল পাকলে দিনের বেলা বুলবুলি, টিয়া, চড়াইয়ের মেলা, রাতে বাদুড়ের চরকি। ছাদের ওপর ফলাহারী গন্ধগোকুলের ঘ্রাণময় দৌড়াদৌড়ি। ফল মানে এত ফল, এত ফল, এত বড় বড় এত মিষ্টি, জিভের তো শ্রেণী হয় না, আমরা বামুন, চাঁড়াল, কাহার, বাগদি, দুলে, মোচলমান, বোষ্টুম-বোষ্টুমী – সবাই মিলে দু’হাত ভরে খাই। পাকা সবেদার টসটসে মিষ্টি রসে সুগন্ধে আমাদের নাকমুখ ভরে ওঠে। ঘন অন্ধকারে একেকদিন সুবাসে চমকে উঠে মনে হয় কে যেন খোলা হাওয়ায় গেলাসে ঢেলে দিচ্ছে RUM। সম্পর্কে এ গাছদু’টি আমাদের মায়ের পেটেরই ভাইবোন। সমাজ পুরুষতান্ত্রিক বলে শিশু আর নারীদের কথা সংসারে চলে না খুব। তাছাড়া মানুষও এমন গেরোয় ফেঁসেছে, যে ঘর না বাঁধলে আওয়াছাল ছাওয়াল রাখবে কী আর খাবে কী। কাজু, ডালিম, লেবুরা তাই ঘরের সময় বিদেয় নিল। উপযোগিতাবাদের চেয়ে ডালিমের ফল সুন্দর পাতা সুন্দর, কাজুর কমলা ফলটি সুন্দর, কাঁঠাল পাতা সুন্দর, কলাগাছ নয়নাভিরাম, দুর্ধর্ষ গ্ল্যামারাস লতাগুল্ম আর আশ্চর্য, গাছে একা একা তাদের ফল পেকে ওঠা। তারা অনেকে হারিয়ে গেছে। তাদের বদলে আমরা এই আওয়াল ছাওয়ালরা বড় হয়েছি। এখন আমার খাট-বিছানা-বালিশ জুড়ে ডালিমের গন্ধ, আমার ঠোঁট ভেজা সেই ডালিমের রসে, আমার সমস্ত ঘিরে সেইসব মৃত গাছেদের আত্মা। আমাদের কারো ওপর তাদের রাগ নেই। তারা কেবল তাদের সন্ততিদের হাত ধরে আমাদের চৌহদ্দিতে এসে বলছে, “রাখো রাখো”, আমরা রেখেছি। বাড়ির পুরুষদের বয়েস হলে তাঁরা থিতিয়ে যান। মানবিকতার হেরফের আছে বলে সুবিধে। তাদের কারো কারো মনে ডালিম নেই কে বললে? সেখানে হাত রাখি, গোপাল ভট্টাচার্য্য, সালিম আলির কথা বলি। প্রতিদিন যে “আমি কিছুই জানি না” – এ কথা অনুভব করি তা বলি, নেরুদার কবিতা শোনাই। এমন করে পুরুষ, নারী সব লিঙ্গপরিচয় ছেড়ে মাটি মাটি হয়ে আসে। আমার মায়ের পেটের ভাই এই দুই সাপোডিলা থেকে গেল। একে কখনো আমরা জড়াই, কখনো পাখি চুমো খায়, কখনো হনু বিরতি নেয়, কখনো শুঁয়োপোকা তাদের গুটি পূর্ববর্তী সম্মেলনে আসে। আমরা কোনোদিন একটা টোকা পর্যন্ত মারিনি। আমার এ দুই ভাইবোন এই আটাশ বছরে একটা মুহূর্তের জন্য রোগগ্রস্ত হয়নি। নদীর নোনাজল এদের আয়লা আম্পান ইয়াসে খেতে পারেনি। আম্পানে এরা দু’জনে কেবল ভেঙে গিয়েছিল খুব। আমাদের কারো কারো কান্না পেয়েছিল। ভাইবোন কি মরে যাবে? আমরা একবয়েসী। ক’দিন পরে দু’জনেরই বুকের ওপর নতুন কচি ডাল বেরিয়েছে। শরতের আকাশে মাথা উঁচু করে দু’জন বলল, “আমরা আছি রে আছি”। বুলবুলি এল, টিয়া এল, চড়াই এল। ঠাট্টা করে গেল। নেড়ু নেড়ু বলে। গাছের মাথায় ততদিনে কোঁকড়ানো চুলের মতো সবুজের অনিবার্য স্পর্ধা মাথা ঝাঁকিয়ে উঠছে। এই তো একবছর হয়নি, আমার অজাতশত্রু বোন, আমার অজাতশত্রু ভাই পূর্ণ মেজাজে ডালপালা মেলে ধরেছে। তাদের পাতা ঝরে পড়ছে। পাতাগুলো ঝাঁটিয়ে রাখা হচ্ছে তাদেরই ছায়ার নীচে মাটিতে। এছাড়া মাটিকে আচ্ছাদিত করে আছে কিছু প্যারা ঘাস, লজ্জাবতী, দুর্ব্বো। ভাইয়ের গায়ে লতিয়ে উঠছে অপরাজিতা। ঝরাপাতা বাদামী থেকে কালো হয়ে উঠেছে। ঘাস-পাতা-গুল্ম আচ্ছাদিত মাটি রসে টইটম্বুর। সেখানে প্রতিনিয়ত মাননীয় মিলিপেড, সেন্টিপেড, কেঁচো, শামুক, পিঁপড়ে ও অন্যান্য (আমার নাম না জানা) পোকাদের চলাফেরা। তারাই তো মাটির স্বাস্থ্য, মসৃণতা এইসব বজায় রাখবেন – যাতে মাটি গ্যালন গ্যালন জল ধরে রাখতে পারে তার পেটের ভেতরে। আর ফুল-পাতা-ঘাস যা ঝরে পড়বে সবাইকে জারিয়ে করে দেবে মাটির খাবার। মাটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। একবার পাতার আস্তরণ সরিয়ে তাদেরকে দেখি। এইভাবে ছায়া আর ঘাস ঢাকা মাটির তলা থেকে পাতার আগা অবধি হয় একটা আস্ত পৃথিবী। এভাবে একটিমাত্র গাছতলায় যদি খুঁজি, গাছের কাছে যদি জিজ্ঞেস করি, কী গো, তোমার ইতিহাস কী, যদি তাকে দেখতে পাই শুনতে পাই আমরা জানবো প্রকৃতি কী, প্রকৃতির সহযোগিতা কী, একে অন্যের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কটি কী। সম্পর্কটি কত মজবুত আর নির্বিষ, যে আবহাওয়ার পরিবর্তন সত্ত্বেও, নোনা খাওয়া সত্ত্বেও আমাদের অসংখ্য ভাইবোনেরা রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েনি। আমরা ফল খাব, ভাত খাব, রুটি খাব, মধু খাব – সব ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের ওই সাভেজির কথাটি রাখতেই হবে মনে, “শ্রদ্ধাশীল হও আর বিনেপয়সার ভোজ খাও”।
মায়ের পেট থেকে জন্মেই দেখি গরুর বাঁটভরা দুধ, গাছপাকা কলা, রক্তিম রসভরা ডালিম, কলকে ফুলে ফোঁটা ফোঁটা মিষ্টি রস, মিষ্টি খেজুর কুল, শিলাকুল, ছোট বড় কাঁচাপাকা আম, বেগনিরঙা প্রাণহরা জাম, তাদের ঘ্রাণ, তাদের ছায়া। আধকাপ মাটিতে যে ব্যাকটিরিয়া থাকে তা মানুষের চেয়ে সংখ্যায় বেশি। তারা কি আম জাম খায়? তারা আমা জাম বানাতে সাহায্য করে যায়। আমরা খাই। আমরা ভোক্তা। অতএব, এস, বৃক্ষের কাছে, গুল্মের কাছে, ঘাসের কাছে, পতঙ্গ কীটের কাছে – নত, নত হয়ে থাকি।