অনিমেষবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বালিগঞ্জ প্লেসের রাস্তায় দাঁড়াতেই দেখি পায়ে পায়ে সন্ধ্যে নেমে এল। কাঁধে আমার সেই পাটের ব্যাগ। ব্যাগে নতুন বই। সুন্দরবনের নদী, সুন্দরবনের গল্পের বই। খুব গরম, তবু হাঁটবার রাস্তা বেছে নিই। হাঁটতে হাঁটতে আগামী কাজের কথা ভাবা যায়, গান তোলা যায়। কত গান আমার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই তোলা। সারাটাদিন নিঃশব্দে কেমন “সুন্দরবন” প্রসঙ্গে কেটে গেল। এমন কত দিনই গেছে, আরো ঢের যাবে। বেছে বেছে কেমন সুন্দরবনেই জন্ম হল! ওপেন হান্টিং গ্রাউন্ড! যেমন খুশি তার মানুষদেরকে ব্যবহার করা যায়, খেলা যায়, নাচানো যায় আর বনের মাছ, কাঁকড়া, মধু নিয়ে রমরমা করা যায়। ঠিক ঠিক জায়গায় মাখন দিলে প্রজেক্ট হাতে, কেল্লাফতে! প্রজেক্টের পর প্রজেক্ট। সুন্দরবন তবু...। ও না, পাকার রাস্তা, স্কুল, কলেজ, বড়ো বড়ো ব্রিজ কত কী হয়েছে! বসতে দিলে আবার শুতে চায়! আবার কত চাই বাবা? ঠিক ঠিক। ঠিকই। এই হয়েছে – তাই কত ভাগ্য!
তুমি ঠিক বলেছিলে, “সংসার করতে যোগ্যতা লাগে”। বাপরে বাপ! যোগ্যতা মানে! সেই ’২০ সাল থেকে লেগেছি। কখনো জিওলজি পড়তে হয়, কখনো জ্যোগ্রাফি, কখনো জুলজি, বোটানি তো কখনো চাষবাসের বই। আবার আজকাল জেনেটিক মরফোলজিও। আর সুন্দরবনী সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে আর বললাম না। এরকম নানাবিধ বিষয়ে ন্যূনতম পড়াশুনো না করলে সুন্দরবনে কাঙখিত কাজগুলো করতেই পারব না। কিন্তু এই পড়াশুনো করে রোজগার হবে কি? তা জানি না বাবা! আল্লা জানে! তবে এ সংসার সামলাতে যে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হবে, তা বেশ বুঝেছি।
অনিমেষবাবু ব্যাংকের চাকরিতে ঢুকেছিলেন ৩১৬ টাকা মাইনেয়। চাকরি করতে করতে বুঝলেন চাকরি আর সুন্দরবন একসঙ্গে হবে না। তাই VRS নিয়ে নিলেন। স্ত্রী মিতা-র আবদার ছিল তাকেও জঙ্গলের কাজে নিয়ে যেতে হবে। রাজযোটক! চুয়াল্লিশ বছর ধরে স্বামী-স্ত্রী মিলে সুন্দরবনে কী কী করেছেন, তা সময় বলবে, তবে এক্ষেত্রে বৌ-ভাগ্য ভাল বলতে হবে! একই কাজে আগ্রহী, একইরকম কষ্ট স্বীকার করে থাকতে পারবার মত জুড়ি খুব বেশি হয় কি? আমার জানা নেই।
রাস্তায় হাঁটি আর ভাবি সাফল্য দিয়ে মানুষ পরিচিতি পায়৷ সাফল্য কী? সাফল্য শব্দটার বয়স ও ব্যবহারের আধিক্য কতদিনের? একথা সুনীতিবাবু খুব সুন্দর করে বলতে পারতেন। সাংস্কৃতিকী-তে কী সুন্দর “ভালবাসা” শব্দটার উত্থান সম্পর্কে লিখেছিলেন।
সুন্দরবনে কাজ করা কী কঠিন! কিন্তু আমার মনে পড়ে অমলদা আর সোমদা-র মুখ। ছোটবেলার ইতিহাস বইতে আঁকা মানুষের মত। পরিচিত কর্মী ও সংগঠকদের মুখ।
আরো অনেক কথা বলার ছিল, ওই ভালমন্দ ইত্যাদি।
কী করে যেন ভুলে গেলাম। বোধহয় ভাল হল।
তবে স্মৃতি বিস্মৃতি পেরিয়ে হাঁটতে থাকব। আদিবাসীরা কাঁকড়ার পায়ের দাগে জমা পলি আঙুলে তুলে বলে দিতে পারে – কাঁকড়া খোলস ছাড়ার পরে কতবার জোয়ার হয়েছে। এই জোয়ার মেপেই নরম কাঁকড়া ধরা হয়৷ এসব কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে? আমরা শুধু ভাল কাঁকড়া বেচতে বা খেতে পারি! আমাদের দৌড় ওই অত অবধিই!
আরো যেন কত কী বলার ছিল – ও, গাঁটের কড়ির কথা – বেশ মজা লাগে কিন্তু – আমরা সকলে গাঁটের কড়ি দিয়ে কাজ করি। কে আবার আওয়াজ দেয়, “কী লাভ?”
আরেবাবারে, লাভ টাভ তোরা বুঝবিনে, তোরা ওই নিজেদের কাজকম্ম কর।
বরেন্দু মন্ডল সম্পাদিত ‘দ্বীপভূমি সুন্দরবন’ আর পরিমল ভাট্টাচার্য’র ‘ফিল্ডনোটস ফ্রম আ ওয়াটারবোর্ন ল্যান্ড’ কিনতে হবে। দাম বেশি। আসছে সপ্তাহে হয়ে যাবে। রোজগার এইখানে লাগবে। রোজগার নানাভাবে হতে পারে। একজন বলেছিল, একেকরাতে গান গাইলে পাঁচহাজার করে টাকা দেবে। যাইনি। গানকে খেপ-রোজগারের-কল হিসাবে দেখি না বলে৷
তবে কখনো সংগঠনের আর্থিক প্রয়োজনে যেতেই পারি। তাতে সমস্যা নেই।
শেষের দিকে কী যে বলার ছিল, তা ভুলে যাচ্ছি বারবার। ও, আজ নাকি আমার ডিটাচমেন্ট প্র্যাক্টিস করার প্রথম দিন?
আচ্ছা ঝোলা নিয়ে ঘুরলে কি জনতার ভিড়ে কিছু ভুল পার্সেপশন তৈরি হয়? তবে একথা ঠিক, যে জমিয়ে সংসার করতে গেলে যোগ্যতা লাগবে বটে!
এই নদীনালা, মাটি, কৃষি, জিওলজিকাল টাইম স্কেল, বিশ্বসাহিত্য, লোকসংস্কৃতির উপাদান, মহাকাব্য বটে! নিজেকে একেবারে ছোট্ট মাছি মনে হয়।
ও, আজ ২০১৩ সালের কথা মনে পড়ল। একটা স্বপ্নের কথা। মেলায় অনেক মানুষ। পোর্ট্রেটর শুধু ছবি আঁকছে। মানুষ একেবারে মুগ্ধ হয়ে পড়ছে৷ কিন্তু পোর্ট্রেটর কারো সঙ্গে কোনোদিন কোনোরকম সম্পর্কস্থাপন করতে পারবে না।
ভাল থেক। রোজগার হোক না হোক, এই কাজগুলো কিছু মানুষকে করে যেতে হবে। সরকার বলে কেউ নেই। ঠাকুর দেবতা সব ডিপ্লোম্যাট। সবেতেই তারা হাসে খালি!