কুঁদলি/কুঁদরি/তলি, নোনা এইসব ছিল প্রান্তিক মানুষ, কুড়ানিদের খাবার। এখানে ওখানে যারা অস্থায়ী সংসার পেতে থাকত। কয়েকজন বা একা। চট বা মাদুরে জড়ান সংসার পাতত, মাটির ছোট উনুন তুলে কদিন রেঁধে বেড়ে খেত, আবার চলে যেত। হাট থেকে কুড়ানো সবজি ফল, ছাঁট। এখান ওখান থেকে সংগ্রহ করা মেটে আলু, ডুমুর, ওল, নোনা, কচু, হরেক রকম শাক, গুগলি, কাঁকড়া এসব দিয়ে তাদের খাবার তৈরি হতো। ভাতে ভাত সেদ্ধ অথবা সব মিলিয়ে একটা ঝোল। বাবার স্মৃতিতে বারবার এক "পালান বুড়া"র কথা ভেসে আসে। পালান বুড়াকে আমি দেখিনি। আমি তার থাকবার জায়গায় খেলেছি। ততদিনে পালান বুড়া আর নেই। এখন সেই মাটির বালিকা বিদ্যালয়ও নেই। অথচ ষোলো বছর আগে বাবার বর্ণনা আমার চোখের সামনে পালান বুড়াকে ফুটিয়ে তুলছে। ওই তো পালান বুড়া ঝিমঝিম বৃষ্টির দুপুরে বালিকা বিদ্যালয়ের গুহার মত মাটির ফটকের এক কোণায় বসে চাল ডাল শাক পাতা ছাঁট সবজি সব মিলিয়ে মিশিয়ে রান্না বসিয়েছেন।
আজ হঠাৎ বিজ্ঞানীরা বলছেন এইসব uncultivated food এর পুষ্টিগুণ অপরিসীম।
জিজ্ঞেস করবে, নীলাঞ্জন কেন জেগে আছো? মনখারাপ নিয়ে জেগে আছি। যে মনখারাপের কোনো মূল্য এই উত্তরাধুনিক পৃথিবীতে আর নেই।
আজ যখন খাদ্যের অসমবন্টনে তিষ্ঠোনো দায়। আজ যখন ঘরে ঘরে রোগের কোনো বয়স নাই। অনেক দেরী হলেও আমরা নড়েচড়ে বসছি।
তবে আজ খুব মনে পড়ছে কুঁদরির কথা। একদিন তাকে আমরা অনেকেই খাইনি। কুড়ানিরা খেত। বর্ণ হিন্দু বাড়ির ছেলেমেয়ে আমরা ভাবতাম এগুলো বুঝি আমাদের ঘরে খেতে নেই। বাজারেও কেউ বিক্রি করতনা তলি। পেকে টুকটুকে লাল হয়ে গেলে পাখিরা খেত। আমার লোভ লাগতো, না জানি কতো মিষ্টি! কেউ কেউ বলতো ওগুলো নাকি বিষ। শৈশবে তাই জিভে জল এলেও তলিতে মুখ দিতে পারিনি।
একদিন হঠাৎ তলি বাজারে এলো। আজ তার কুইন্টাল কুইন্টাল বিক্রি। কোনো রোগ নাই, পোকা নাই, যত্ন নাই, বিনিয়োগ নাই। বন্যা হয়ে গেলো। তাবড় তাবড় সব্জিরা গেলো হেজে। ঘরে ঘরে শীর্ণ তলিলতা এদিকে ওদিকে বেড়ে শয়ে শয়ে তলি ফলিয়ে বলল, "নাও আমাদের খাও। চচ্চড়ি, ভাজা, সেদ্ধ যা পারো। যাও কিছু হিংচা, কলমি, কুলেখাড়া তুলে আনো। দেখো কিছু ছাঁটি কুচো বা চাপড়া চিংড়ি পাও কিনা। মাটির মালসা বসাও। আজ অল্প তেলে আমাকে রাঁধো শুধু শুধু অথবা শাক চিংড়ি দিয়ে। এক তরকারিতেই অনেক রকম পুষ্টি পাবে। খাও দুটো পেট ভরে খাও।"
না আমি কোনো উপসংহার টানতে চাইনা। আধুনিকতার চাপে যা হারিয়ে গেছে যাক। আজ কুড়ানিদের খাবার বাজারে স্বীকৃত। আমি খুশি! যদিও কুঁদরি/কুঁদলি/তলির তাতে কিছু এসে যায়না। সে তার মত করে লতিয়ে উঠবে খড়ের চালে, জড়িয়ে ধরবে কলাগাছকে। আমাদেরকে খাওয়াবে, পাখিদেরকে খাওয়াবে। আমার জিভে মাসির রাঁধা তলিচচ্চড়ির স্বাদ। কোন সুদূর থেকে পালান বুড়া, মণি, শাকতুলুনি সন্তোষী বুড়ি দের কথা আজ কয়েক দশক পার করে আমার মনে একের পর এক, ট্যাপিস্ট্রির মত সাজানো হয়ে চলেছে।
এই পৃথিবীর সমস্ত অকৃষিজাত খাবারকে আমি প্রণাম করি।