ছবিঃ ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
সনাতন বুড়ি
একচোখ ঝাপসা, আরেক চোখ বহুদূরের পাড়ি, শীর্ণ শরীরে শুকনো পাতার মতো জড়ানো বিবর্ণ শাড়ি, হাতে খানকয় ছিপ আর ঠোঁটের কোণায় বিড়ি, এই আমাদের সনাতন বুড়ি। আমাদের ভাটির দেশের মা বনবিবি'র মতো, দক্ষিণরায়ের মতো এইটিই বুড়ির মূর্তি। আমরা আকারে মানুষ, জাঁকিয়ে বসেছি মাটির ওপর। আমাদের খালি খাই খাই খাই। আমাদের শুধু সঞ্চয়ের লোভ, অধিকার করার উগ্র বাসনা। তাই আমাদের পদে পদে ভয়। এই আরশোলা, মাকড়সা, টিকটিকি! ওই বিষধর সাপ! ওই মথ, ওই প্রজাপতি! ওই আগাছা! মার মার সব কিছুকে মার! আধুনিক, উত্তরাধুনিক, গ্যাট চুক্তি, সবুজ বিপ্লব, জমিতে ভুরি ভুরি রাসায়নিক, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, সুপার সাইক্লোন, একের পর এক ধাক্কা মারতে মারতে আমাদের নাভিশ্বাস তুলে দিলো। সনাতন বুড়ি পাথরের মতো অবিচল রইলো৷ বাড়ির মানচিত্রটা আমার কাছে এইরকমঃ- বাড়ি, দক্ষিণের পুকুর, বটতলা, মাঠ, বাজারের রাস্তা, বাজার, নদী, ছেঁড়া ছেঁড়া জঙ্গল আর সনাতন বুড়ি। বুড়ি আমাদের মতো মানুষ নয় তাই তাকে বরাভয় দিয়েছেন প্রকৃতি। কতো বিষধর সাপ, বুড়ি তবু দিনেরাতে আদাড়ে বাদাড়ে বসে থাকে, চিন্তা নেই। দিনে ছিপ ফেলে, রাতে মাঝে মাঝে জাল। মাছ হলো কি হলোনা তার মাথাব্যাথা নেই। শ্রাবণের প্রবল বৃষ্টিতে দেখা যাবে কচুবনের ধারে নিভে যাওয়া বিড়ি ঠোঁটে বুড়ি জলের ওপর বসে আছে ছিপ হাতে। আর একজন মানুষের পক্ষেও এমনটা সম্ভব নয়। ইদানীং বয়সের ভারে একটু এদিক ওদিক। তাছাড়া জলে বাতাসে এতো বিষ! অসুস্থ না হয়ে যাবে কোথায়? তাইবলে বুড়ির কোনো "মধ্যবিত্তের রোগ" নেই। বুড়ো মারা গেছে সে "অনেক দিন আগে"র কথা। বুড়ি কারো কাছে হাত পাতেনি। গায়ে গতরে খেটে, গায়ে গতরে খেটে সে ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী সব পাললো। এই বৃদ্ধ বয়সে দু একবার তাকে কাঁদতে দেখেছি। ছেলে বৌমার প্রতি অভিমানে। কিন্তু একটুখানি কেঁদেই বুড়ি চুপ। চোখের জল মুছে সে দাঁড়িয়ে পড়ে, "আমি ঘর বানিতে টাকা দিছি"! বুড়ির মনে পড়ে যায়, তার তো কোথাও হাত পাতবার নেই, মাথা নোয়াবার নেই। আজ অবধি কতো পরিশ্রমের সব রোজগার! এখনো এই বয়সে সন্ধ্যে হলে বাজারে বসে বুড়ি। বাঁশের চুবড়িতে কলাপাতা রেখে তারওপর ছোলা মটর বত্রিশভাজা বিক্রি করে। শরীরে আগের জোর নেই কিন্তু তাবলে বুড়ির উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়নি। আসলে বুড়ি এদিককার স্বাধীনতার কথা জানে। বুড়ি জানে হাতে একটু টাকা রাখতে হয়। এদিকটা না দেখলে হবেনা। গঞ্জনা জুটবে, না খেয়েও মরতে হতে পারে। ক্রয়ক্ষমতাই তো ক্ষমতা এখন! বুড়ি বোঝে। এদিকটা না সামলালে চলবেনা, অরণ্যের জীবন তো আজ আর পাওয়া যাবেনা। তাই সে এটুকু করে। বাদবাকি সবসময় তুমি দেখো, বুড়ি আর প্রকৃতি। বুড়ি যেনো কথা বলে, "কীগো কেমন আছ তোমরা সবাই? আমার মন ভালো নেই। বাঁশবাগানে চ্যাং মাছ নেই। খালে শাল মাছ নেই। প্যাঁচার ডাক শুনতে পাইনা। শেয়ালরা কেউ নেই।"
মানুষের 'কথা' কি গো? কিসের কথা বলে মানুষ? চারিদিকে প্রয়োজনের বাইরে আর কিছু কথা আছে কি? আমরা তাই সহজে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। বুড়িও মানুষের দিক থেকে প্রায় নিঃসঙ্গ কিন্তু সে তার মাথা রাখবার কোল খুঁজে নিয়েছে। আমার কাছে বুড়ির এই দুদন্ড সংসারে থেকে আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার যে অনায়াস যাতায়াত, এ বড়ো ভালোলাগে। আমরা তো পারবোনা এমন। ঘরবাড়ির যুগ নাহলে বুড়ি নিশ্চিতভাবে কুটির বেঁধে জঙ্গলের ধারে থাকতো।
শেষবয়সে বুড়ি আরেক দায়িত্ব পেয়েছিলো। আমাদের গ্রামে সত্যপীরের পূজা হতো। মুসলিম পাড়ার এক ফকির তার ছেলে মেয়েকে নিয়ে প্রতি সোমবার এসে বটতলায় বসতেন। হিন্দু বাড়ির মায়েরা পায়ে রাঙা আলতা পরে, স্নান করে, পরিষ্কার ছাপা শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে কাঁসার থালায় কলা, সন্দেশ আর পিতলের ঘটিতে দুধ নিয়ে খালিপায়ে হেঁটে আসতেন পীরের থানে। সেইখানে বসে তারা মানত করতেন, পূজা দিতেন। পূজা মানে শুধু ইচ্ছাপূরণ নয়, মঙ্গলকামনা। মায়েরা অনেকসময় শুধু সকলের ভালো চাইতে মন্দিরে বা পীরের থানে যেতেন।
ফকির একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। মেয়েটি তার একটু অন্যরকম। ছেলেটি সবাইকে নিয়ে কোথায় যে চলে গেলো কেউ জানেনা। হয়ত কোনো রাজ্যে অভিবাসী শ্রমিক হয়ে চলে গেছে। আর ফিরবেনা। কেউ তাদের খবর তো বলতেই পারলোনা।
গ্রামপুজোর ছবি। দক্ষিণ শিবগঞ্জ, পাথরপ্রতিমা। ছবি -লেখক।
পীরের থানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এলাকার হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির উদযাপনটাও কোথাও হারিয়ে গেলো।
ফকিরের পরিবার চলে যাওয়ার পর বুড়ি এসে লেগেছিলো পূজায়! আজ ভেবে অবাক লাগে। বুড়িকে তো কেউ বলেনি। কেউ এর জন্যে তাকে টাকা দেয়নি। সে প্রতি সোমবার একা একা এসে পীরের থান ঝাঁটিয়ে ন্যাতা (আমরা বলি "ছঁচ" দেওয়া) দিয়ে পীরের গা ধুইয়ে একেকদিন পূজায় বসতো। পীরের বাহন ঘোড়া। আমাদের কুমোরপাড়ায় পীরের ঘোড়া বানানো হতো। সকলে পূজা করে ঘরে ফেরার সময় পীরের ঘোড়া নিয়ে যেতেন।
তারপর নাকি শরিকে শরিকে লড়াই হলো! তারা এসে বললো ওই ঢিপিটাকে আর রাখবেনা। আমি সেসময় গ্রামে ছিলাম না। সকলে চুপ করে দেখলো, কবেকার সত্যপীরের ঢিপি কয়েকজন জমির মালিক মিলে উপড়ে ফেললো।
বুড়ির দায়িত্ব লাঘব হলো!
তার কষ্ট হয়নি? মনখারাপ করেনি? একা একা বসে থেকে সে কি এই ব্যাথার কথা বলেনি জলের কাছে? কলমীর দামের কাছে? দুপুরে বাঁশের বাগানে সে তার ছিপটাকে নিছক এড়ে চুপ করে বসে কাটিয়ে দিয়েছে সন্ধ্যা অবধি। তখন সে নিশ্চয়ই সকলকে বলেছে, "পীরের ঢিপিটাকে আজ জমির শরিকেরা এসে উপড়ে ফেলে দিয়েছে।"
আমাদের কাছে এই বিষাদের মূল্য নেই। এই একটা ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। আমাদের সুন্দরবনের স্কুল কলেজে এইসব বিষয়ে এক লাইনেরও আলোচনা নেই। আমরা লজ্জিত, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী বুড়ি। তোমার জীবনকে ছুঁতে পারবো ততোবড়ো মই আমাদের কাছে নেই। কিন্তু যেভাবে পীরের থানকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হলো, তাতে যে ব্যাথা তুমি পেলে, এই ব্যাথা আমাদের সকলকে পেতে হবে একদিন।
ফকির চলে যাওয়ার পরে তুমি একা একা আমাদের ঐতিহ্যকে আদর যত্ন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলে বুড়ি। সেদিন বুঝিনি। একদিন, অনেক দেরী হলেও আমরা বুঝবো নিশ্চয়ই।
লোকে বলে মুসলমানের মানিক পীর আর হিন্দু'র সত্যনারায়ণ মিলিয়ে তৈরী হয়েছিলো এই সত্যপীর। কোথাও তাঁর কোনো মূর্তি নেই। শুধু ছোট্ট একটা পাথরের ঢিপি। আবার কালুরায়ের দাদা বড়খাঁ গাজীও এমন ঢিপিরূপে পূজিত হন। তার আকার একটু আলাদা।
আবার, আরেকটি গল্পের কথা মনে হয়। আঠারো ভাটির দেশে দক্ষিণরায় আর বড়খাঁ গাজীর 'দোস্তানি' ছিলো ভালো। কী যে হলো, ওই মাটির অধিকার নিয়ে লড়াই লেগে গেলো। গাজী ধর্মান্তরিত করার কাজেও লেগেছিলেন। জোর করে এক হিন্দু রাজকন্যাকে বিয়ে করাতে দক্ষিণরায় রেগে গিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন। ভাটিজুড়ে সে কী যুদ্ধ! কেউ কম যান না! যুদ্ধ করতে করতে গাজী দক্ষিণরায়ের বুকে আঘাত করতেই রায় মায়ার খেলা শুরু করলেন। মায়ারূপ ধারণ করে যুদ্ধ করতে লাগলেন। বড়খাঁ গাজী তখন খাঁড়ার কোপে রায়ের মায়ারূপের মাথা কেটে ফেললেন। সেইসময় ঈশ্বর আধা হিন্দু, আধা মুসলমান রূপে এসে সেই যুদ্ধ থামালেন। পল্লীকবি কৃষ্ণরামদাস তাঁর রায়মঙ্গলে লিখলেন,
"কবি কৃষ্ণরাম ভণে দুই সিংহ যেন রণে কারেনা করিহ অল্পবোধ।
শুন অপরূপ কথা ঈশ্বর আসিয়া তথা উত্তরিলা ভাংগিতে বিরোধ।।
অর্ধেক মাথায় কালা একভাগে চূড়াটালা বনমালা ছিলম্বিনী হাতে।
ধবল অর্ধেক কায় অংগনীল মেঘপ্রায় কোরাণ পুরাণ দুইহাতে।।
এইরূপ দরশণ পাইয়া সেই দুইজন ধরিয়া পড়িল দুই পায়।
তুলিয়া অখিলনাথ বুঝাইয়া হাতে হাত দুইজনে দোস্তানি পাতায়।"
যুদ্ধ থেমে যায়। আমাদের অস্থির মনও এইসব কথা পড়তে পড়তে শান্ত হয়। পীরের পূজায় মুসলিম ফকির আর হিন্দু ভক্ত থেকে ঈশ্বরের এই অপরূপ রূপ, 'রায়মঙ্গল' এর এই অমর কথা মনে পড়ে খুব।
আমরা কিছুই জানিনা বুড়ি। কিছুই আসলে পড়িনি। আমাদের জ্ঞান নেই। গতি নেই। নাহলে হয়তো বুঝতাম কবীরের কথা। "অনেক পুঁথি পড়লে তুমি, ভালোবাসার আড়াই অক্ষর পড়লেনা"
তাহলে কি পড়লে?
যে কাল একদিন হারিয়ে যাবে, উপড়ে ফেলা পীরের ঢিপির মতো যে সুন্দরবনও হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে, তার থেকে নতুনতর পৃথিবী ও অজেয় জীবনের জন্য বুড়ির এই জীবন, এই ছবি আমি এঁকে রাখলাম। আর কিছু আমার হাতে রইলোনা। একথা না লিখলে হয়তো আর কেউ লিখতোনা। এরপর আর কেউ জানতোওনা পীরের কথা, এ দরগার থাকা না থাকার কথা, বুড়ির মতো মানুষের কথা। এখন সময়ই একে এগিয়ে নিয়ে চলুক।
(পরের পর্বে- নটবর)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।