

একচোখ ঝাপসা, আরেক চোখ বহুদূরের পাড়ি, শীর্ণ শরীরে শুকনো পাতার মতো জড়ানো বিবর্ণ শাড়ি, হাতে খানকয় ছিপ আর ঠোঁটের কোণায় বিড়ি, এই আমাদের সনাতন বুড়ি। আমাদের ভাটির দেশের মা বনবিবি'র মতো, দক্ষিণরায়ের মতো এইটিই বুড়ির মূর্তি। আমরা আকারে মানুষ, জাঁকিয়ে বসেছি মাটির ওপর। আমাদের খালি খাই খাই খাই। আমাদের শুধু সঞ্চয়ের লোভ, অধিকার করার উগ্র বাসনা। তাই আমাদের পদে পদে ভয়। এই আরশোলা, মাকড়সা, টিকটিকি! ওই বিষধর সাপ! ওই মথ, ওই প্রজাপতি! ওই আগাছা! মার মার সব কিছুকে মার! আধুনিক, উত্তরাধুনিক, গ্যাট চুক্তি, সবুজ বিপ্লব, জমিতে ভুরি ভুরি রাসায়নিক, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, সুপার সাইক্লোন, একের পর এক ধাক্কা মারতে মারতে আমাদের নাভিশ্বাস তুলে দিলো। সনাতন বুড়ি পাথরের মতো অবিচল রইলো৷ বাড়ির মানচিত্রটা আমার কাছে এইরকমঃ- বাড়ি, দক্ষিণের পুকুর, বটতলা, মাঠ, বাজারের রাস্তা, বাজার, নদী, ছেঁড়া ছেঁড়া জঙ্গল আর সনাতন বুড়ি। বুড়ি আমাদের মতো মানুষ নয় তাই তাকে বরাভয় দিয়েছেন প্রকৃতি। কতো বিষধর সাপ, বুড়ি তবু দিনেরাতে আদাড়ে বাদাড়ে বসে থাকে, চিন্তা নেই। দিনে ছিপ ফেলে, রাতে মাঝে মাঝে জাল। মাছ হলো কি হলোনা তার মাথাব্যাথা নেই। শ্রাবণের প্রবল বৃষ্টিতে দেখা যাবে কচুবনের ধারে নিভে যাওয়া বিড়ি ঠোঁটে বুড়ি জলের ওপর বসে আছে ছিপ হাতে। আর একজন মানুষের পক্ষেও এমনটা সম্ভব নয়। ইদানীং বয়সের ভারে একটু এদিক ওদিক। তাছাড়া জলে বাতাসে এতো বিষ! অসুস্থ না হয়ে যাবে কোথায়? তাইবলে বুড়ির কোনো "মধ্যবিত্তের রোগ" নেই। বুড়ো মারা গেছে সে "অনেক দিন আগে"র কথা। বুড়ি কারো কাছে হাত পাতেনি। গায়ে গতরে খেটে, গায়ে গতরে খেটে সে ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী সব পাললো। এই বৃদ্ধ বয়সে দু একবার তাকে কাঁদতে দেখেছি। ছেলে বৌমার প্রতি অভিমানে। কিন্তু একটুখানি কেঁদেই বুড়ি চুপ। চোখের জল মুছে সে দাঁড়িয়ে পড়ে, "আমি ঘর বানিতে টাকা দিছি"! বুড়ির মনে পড়ে যায়, তার তো কোথাও হাত পাতবার নেই, মাথা নোয়াবার নেই। আজ অবধি কতো পরিশ্রমের সব রোজগার! এখনো এই বয়সে সন্ধ্যে হলে বাজারে বসে বুড়ি। বাঁশের চুবড়িতে কলাপাতা রেখে তারওপর ছোলা মটর বত্রিশভাজা বিক্রি করে। শরীরে আগের জোর নেই কিন্তু তাবলে বুড়ির উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়নি। আসলে বুড়ি এদিককার স্বাধীনতার কথা জানে। বুড়ি জানে হাতে একটু টাকা রাখতে হয়। এদিকটা না দেখলে হবেনা। গঞ্জনা জুটবে, না খেয়েও মরতে হতে পারে। ক্রয়ক্ষমতাই তো ক্ষমতা এখন! বুড়ি বোঝে। এদিকটা না সামলালে চলবেনা, অরণ্যের জীবন তো আজ আর পাওয়া যাবেনা। তাই সে এটুকু করে। বাদবাকি সবসময় তুমি দেখো, বুড়ি আর প্রকৃতি। বুড়ি যেনো কথা বলে, "কীগো কেমন আছ তোমরা সবাই? আমার মন ভালো নেই। বাঁশবাগানে চ্যাং মাছ নেই। খালে শাল মাছ নেই। প্যাঁচার ডাক শুনতে পাইনা। শেয়ালরা কেউ নেই।"
মানুষের 'কথা' কি গো? কিসের কথা বলে মানুষ? চারিদিকে প্রয়োজনের বাইরে আর কিছু কথা আছে কি? আমরা তাই সহজে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। বুড়িও মানুষের দিক থেকে প্রায় নিঃসঙ্গ কিন্তু সে তার মাথা রাখবার কোল খুঁজে নিয়েছে। আমার কাছে বুড়ির এই দুদন্ড সংসারে থেকে আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার যে অনায়াস যাতায়াত, এ বড়ো ভালোলাগে। আমরা তো পারবোনা এমন। ঘরবাড়ির যুগ নাহলে বুড়ি নিশ্চিতভাবে কুটির বেঁধে জঙ্গলের ধারে থাকতো।
শেষবয়সে বুড়ি আরেক দায়িত্ব পেয়েছিলো। আমাদের গ্রামে সত্যপীরের পূজা হতো। মুসলিম পাড়ার এক ফকির তার ছেলে মেয়েকে নিয়ে প্রতি সোমবার এসে বটতলায় বসতেন। হিন্দু বাড়ির মায়েরা পায়ে রাঙা আলতা পরে, স্নান করে, পরিষ্কার ছাপা শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে কাঁসার থালায় কলা, সন্দেশ আর পিতলের ঘটিতে দুধ নিয়ে খালিপায়ে হেঁটে আসতেন পীরের থানে। সেইখানে বসে তারা মানত করতেন, পূজা দিতেন। পূজা মানে শুধু ইচ্ছাপূরণ নয়, মঙ্গলকামনা। মায়েরা অনেকসময় শুধু সকলের ভালো চাইতে মন্দিরে বা পীরের থানে যেতেন।
ফকির একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। মেয়েটি তার একটু অন্যরকম। ছেলেটি সবাইকে নিয়ে কোথায় যে চলে গেলো কেউ জানেনা। হয়ত কোনো রাজ্যে অভিবাসী শ্রমিক হয়ে চলে গেছে। আর ফিরবেনা। কেউ তাদের খবর তো বলতেই পারলোনা।
Abhyu | 97.8.***.*** | ১২ জুন ২০২২ ০১:০৪508846
aranya | 2601:84:4600:5410:95ac:7efa:b0c2:***:*** | ১২ জুন ২০২২ ০৯:০৯508875
kk | 174.53.***.*** | ১২ জুন ২০২২ ২২:১২508942
Sijarul hoque | 2401:4900:3a0f:1864:a59f:b898:7bae:***:*** | ১৩ জুন ২০২২ ০০:৫৯508950
নীলাঞ্জন মিশ্র | 103.42.***.*** | ১৫ জুন ২০২২ ২৩:৪৮509046
R | 2409:4060:2e97:5e49::9e09:***:*** | ২৭ জুন ২০২২ ১১:১৭509440