পৌষের মাঠে দাঁড়িয়ে অজপালক। গাঁয়ের লোকে স্বরূপ বলে ডাকে। এইমাত্র আপনারাও জানলেন। দেখা হলে ডাকবেন, "স্বরূপ"। কিন্তু এই ছবিতে আমি দেখছি ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সেই মানুষটাকে, যিনি একদিন একটা ছাগল হাতে করে কুটিরে ফিরবেন। ছাগল গৃহপালিত পশু হয়ে উঠবে। সেই একই সময়ে মানুষ রুটি বানিয়ে খেতে শিখবে। সেদিনের ওই মানুষের মনে আজকের বাজারের ধারণা ছিল না। আমাদের মত এরকম টাকা ভিত্তিক শ্রেণীও ছিল না নিশ্চয়ই। কিন্তু এই যে মানুষ একেকটা জায়গা দখল করে কৃষিকাজ পশুপালন শুরু করছে, গোলায় ফসল তুলছে, এর মধ্যে ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হচ্ছিলো ক্ষমতার রাজনীতি, শ্রেণী ও বর্ণবৈষম্যের বীজ। কিন্তু ওই ছাগল পালক কি তা জানতেন? স্বরূপও, ৩০২২ বছর আগের ওই মানুষটাকে তো চেনেনা। এই দুই না জানার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট পুঁজিবাদী বাজার। যেখানে সারা পৃথিবীর কেন্দ্র অতি ক্ষুদ্র আর প্রান্তিক হল বৃহৎ। এমনিও, বৃত্তের কেন্দ্র আর পরিধিও এরকমই না? তাহলে বৃত্ত কি শুধু জ্যামিতি না কোনো " mode of expression", কোনো ভবিষ্যৎবাণী নাকি কারোর নিঃশব্দ প্রতিবাদ? অভিশাপ? বৃত্তের নিরীহ সংজ্ঞা, সাতে পাঁচে না থাকা স্কুলে এসব আলোচনার অবকাশ নেই।
যাইহোক, ও তো স্বরূপ। সেই কথায় ফিরে আসি। এ হল আমাদের স্বরূপ। স্বরূপ বাজারে হাঁসের ডিমের দাম পায়নি। বাজারের স্বরূপ তার জানা নেই। জানার কথা নয়। এই না জানা তার খুব ক্ষতি করলেও অপরাধ তার একার নয়। স্বরূপের হাঁস মরে গেছে, সাদা মাছ সব মরে গেছে বন্যায়। কই স্বরূপকে দেখে আপনাদের তা মনে হচ্ছে? শ্রমের রঙ সাদা হয় কিনা জানিনা। কালো ধলো সবতো বলে জেনেটিক। কিন্তু এত বেশি মানুষ এত কম মানুষের হাতে অত্যাচারিত শোষিত যে শ্রমজীবী মানুষকে আমরা অনেকে হয়তো কালো বা বাদামী রঙে দেখতে ভালোবাসি। পাথর-কোঁদা ডেভিডের রঙ সাদা হলেও, কীজানি মিকেলেঞ্জেলো হয়তো কালো পাথর পান নি। যাইহোক একে বায়াস ভাববেন না। আমার ভালোলাগে এই রোদেপোড়া ভাঙাচোরা বাদামী মুখ। যারা বারবার ধাক্কা খাচ্ছে হাত পা ভাঙছে, যাদের ঘর পুড়ে যাচ্ছে তবু যারা বাঁচবার চেষ্টা করছে, করেই যাচ্ছে। এবছর আয়ু ক্ষয় করে নারীপুরুষেরা মিলে ঘর গড়লে পরের বছর বন্যায় তা ডুবে যায়। খাট বিছানা গিয়ে ওঠে মাঠে। স্বরূপের ডাকফার্মে আশানুরূপ সাফল্য আসেনি, বাজারে সে ভালোভাবে বিক্রি করতে পারেনি ডিম। যে বাজার থেকে সে বেশি দামে ফিড কিনেছিল সেই একই বাজার তার ডিম কিনে নিয়েছে কম দামে, শহরে অনেক দামে বেচবে বলে। স্বরূপের পরিকল্পনা ভালো ছিল। পুকুরের ওপর ফার্ম করায় মাছ তার ভালোই বেড়েছিল। কিন্তু নোনাজল ঢুকে সব মরে গেলো।
অথচ প্রথম দিনের কৃষকসভাতে কী সপ্রতিভ স্বরূপ! কী প্রবল তার উৎসাহ! শেখবার উৎসাহ, জানবার খিদে অনেক শ্রম করবার শপথ। আমাদের নতুন কাজ শুরু হচ্ছে শুনে সে আবার কয়েকটি দিশি ছাগল কিনে এনেছে (বিদেশি ও সংকর আগ্রাসনের বাজারে এখন দিশি দিশি বলে পায়ের তলার মাটি ঠিক রাখতে হয়)। আর খুঁজছে ঘাস, দানাশস্য কোথায় পাওয়া যাবে। কবে থেকে গ্রামে তার চাষ শুরু হবে। হবে তো। অসীম সেইসব ঘাস আর দানার খবর আনতে গেছে। আমরা সবাই কৃষিজমিতে পশুখাদ্য চাষ করবো। যাদের সে সুযোগ নেই তারাও পশুখাদ্য এখান থেকেই সংগ্রহ করবে। আমরা এই তিরিশ জন কৃষক, সাধ্যমতো গুছিয়ে নিচ্ছি লড়াইয়ের সমস্ত রসদ। এ বাজারকে আগামীকালই তো ফেলে দিতে পারবেনা কেউ। তার আগে অনেক পথ পেরোনো বাকি। সবার আগে পেট ভরা খাবার চাই। দুদণ্ড অবসর চাই। যে অবসরে আমরা ভাববো বাজারের কথা। আমরা মাটিতে ছবি এঁকে ছায়ায় বসে বাজার সম্পর্কিত পড়াশুনো করবো। আর ঠিক করবো সারা পৃথিবীর কৃষকদের কিকরে একত্র করে ফেলা যায়।
৩০২২ বছর আগের সেই ছাগল পালকের সঙ্গে স্বরূপের কি দেখা হবে?
হবে। স্বরূপ, আমি, আমরা সবাই এই বাজার এই বিরাট সময়রেখা পেরিয়ে ঠিক তার সঙ্গে দেখা করতে যাবো। ঋতু পরিবর্তনের পুতুলনাচ পেরিয়ে এখন একটু শুকনো দিন। আমাদের অনেক কাজের দিন।
আমরা পৃথিবীর, পৃথিবী সবার। যেদিকে যত আছো চাষি এক হও এক হও।