পাথরপ্রতিমায় এনড্রিন এলো আশি'র দশকে। শুরুতেই, কাল বিভাজনের সুবিধার্থে এন্ড্রিনকে রাখা হলো। একটা বিষ আসার আগে কি ছিলো, পরে কি হলো এবং অন্যান্য সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা আলোচনা করবে এই প্রবন্ধ। আশির দশকের আগে মূলত এক ফসলের চাষ হতো সুন্দরবনে। আমন মরশুমের ধান। আবাদী জমিও কম ছিলো। তবে অকৃষিজাত খাবার পাওয়া যেতো প্রচুর। এখনো যায়। চালটা থাকলে তার সঙ্গে খালবিলের মাছ, শাক, বাগানের সবজি এসব করে ভালো খাবার হতো। মাছের তো অগাধ বৈচিত্র্য। নোনা মাছ, মিষ্টি মাছ। মিষ্টি জলের সাদা ও কালো মাছ। ধানের ক্ষেতে জিওল মাছ ও চিংড়ি। তখন বৃষ্টি হতো প্রচুর। বাজ পড়তো কম। একবার বৃষ্টি মানে মাঠ ঘাট ভরা। ধানতলা ফেলতো কেউ কেউ বৈশাখে৷ একে কাঁকড়িতলা বলা হতো৷ এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কাঁকড়িতলা অতীতের গল্প। অনেকে জানেওনা। প্রথম কালবৈশাখীর পরে সরাসরি ধানের বীজ মাঠের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেওয়া হতো। আর সেচ বলতে তেকোণা টিনের হাতযন্ত্র আর তালডোঙা। সারাদিন মানুষে কাজ করতো। তারপর ধান বাদে অন্যান্য চাষের একটা প্রবণতা ধীরে ধীরে দেখা গেলো। আবাদ বাড়লো। অন্যান্য চাষের প্রবণতা খারাপ বলা যায়না। শুরুর দিকে বাজারে বেচবার জন্য বাণিজ্যিক চাষ শুরু হলো শাক সবজির, তুলাও আনা হয়েছিলো কিন্তু সম্ভবত বিপণন আর পরিকল্পনার অভাবে সে বন্ধ হয়ে যায়। এরকম নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে ধানের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক ভাবে সব্জি ও অন্যান্য মরশুমের চাষ শুরু হলো।
এসময়ে খাবারের মানচিত্র কিরকম?
মাছঃ- রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবোস, বাটা, পুকুরের ট্যাংরা, পুঁটি, সরপুঁটি, মৌরলা, শিঙি, মাগুর, শাল, শোল, বাসা, চ্যাং, পাঁকাল, বান, চাঁদা, খলসি, কুচে সহ নদীর নানারকম মাঠ।
এসবের নানারকম তরকারি হতো৷ আর কেনার ধারণা খুবই কম ছিলো। ধরা হতো বেশি। এখনও হয় তবে কম। আর ছোটবেলায় দেখতাম কার্তিকদাদু ঝাঁকায় করে মাছ বিক্রি করতেন। তখন এই ছিলো৷ তারপর বছর দশেক হলো মাছের নিলাম, ডাক আরম্ভ হয়েছে এবং প্রচুর ওষুধ প্রয়োগে বাণিজ্যিক মাছচাষ বেড়েছে। খাওয়ার চেয়ে বেচার প্রবণতা বেড়েছে। এক পিস গলদা চিংড়ি হাতে নিয়ে বেচে দিতে দেখেছি প্রায়ই। কারণ ক্যাশ টাকা চাই। ক্যাশ একটা যুগের নাম হতে পারে, সত্য ত্রেতা দ্বাপর এর মতো ক্যাশযুগ।
তারপর একদিকে চাষে প্রচুর বিষের ব্যবহার আর অন্যদিকে ঝড় বন্যার ফ্রিকোয়েন্সি বাড়তে থাকায় চ্যাং, বাসা, শাল, খলসি, সরপুঁটি ও জিওল রা প্রায় বিদায় নিলো। পুরানো কিছু পুকুরে কোনোরকমে বেঁচে আছে। মাগুরের দেশী জাত খুঁজে পাওয়া কঠিন। জমিদারী যুগে পুকুরের অন্য সম্মান ছিলো তার অন্যতম কারণ পুকুরের জল পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখন সে কাল গেছে। পুকুরের প্রতি খুব অবহেলা। পুকুর আগে পুরো সেচে দিতোনা। আর দিলেও হাপা করে কালো মাছ রেখে দিতো। এমন করে পুকুর সংস্কার করতো যে জলের মান নষ্ট হতোনা। এখন সেসব জ্ঞান গেছে। দিকে দিকে মেশিন। হাতে সময় কম। শ্রমিক কম। সবুজ বিপ্লবের পর থেকে কৃষিকে অলাভজনক করে তোলা হয়েছে বলে যুবসমাজের অনেকাংশের প্রবল অনীহা তাছাড়া শহর কর্তৃক সংজ্ঞায়িত একধরণের জীবন আছে অর্থাৎ জীবন মানে Set A, Set B, Set C এরকম আর কি। আর যে যার মুরোদ বুঝে একেকটা সেটে সেঁধিয়ে যাওয়া।
ধান ভানতে আবার সেই শিবের গীত!
ডাল বলতে তখন অড়হর, বিউলি, খেসারি আর মুগ ছিলো। পরের দিকে এসব প্রায় উঠে গিয়ে পড়ে রইলো মুগ, বাজারে এলো মুসুর। মুসুর নিয়ে আবার নানা বিতর্ক। এসব থেকে অনেক কিছু আন্দাজ করা যায়। একটা বিরাট শক্তি বাজারটাকে পাল্টানোর চেষ্টা করছে।
শাক আমাদের সম্পদ, কাঁচা সেদ্ধ ভাজা চচ্চড়ি ঝোল তার কতোরকম ব্যবহার। চাষের বালাই নেই, এদিকে ওদিকে শুষনি, কলমী, হিংচা, গিমা, কুলেখাড়া, শ্বেতফুলকা, পিড়িং, থানকুনি সহ আরো কতো, সব নাম লেখা যাচ্ছেনা। দুবেলার আহারে এরা ছিলো। এখন ঘাসমারা বিষে একটু এদিক ওদিক হয়ে যায় তবে সত্যি বলতে কি সবার বিষ মারার পয়সা নেই বলে শাক ভালোই টিকে আছে।
এছাড়া সব্জী তো প্রায় সবই হয়। মাটির জান প্রচুর। হাল্কা নোনা এঁটেল মাটি। আমরা ফল হিসেবে এমনিই পাই তাল, নারকেল, খেজুর, আম, জাম, কাঁঠাল, সবেদা, পেয়ারা বিভিন্ন রকম কুল, ডালিম, জামরুল ইত্যাদি। কিছু জলজ ফল যেমন পানিফল, ভেটুক এসব আছে।
এইভাবে খাবার বিষয়টা বৈচিত্র্যময় ছিলো এবং একটু চাকরি করা ভদ্রঘর (তাও তাদের অনেকেরই পুকুর থাকতো) ছাড়া বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন সংগ্রহকারী। ডুমুর কি আর চাষ করতে হয়? এরকম অনেক কিছু চাষ করতে হয়না। এদিক ওদিক থেকে এনে রান্না করতে হয়৷
এইভাবে চলতে চলতে ওই বিষ আর হাইব্রিড বীজ এলো। সীতাশাল, রূপশাল, ট্যাংরাশাল, চিনিকানি, হ্যামিল্টন, বগড়া, নাঙলমুড়া এদের চাহিদা কমে উঠে এলো উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ। নাঙলমুড়া আর নেই বোধহয়। ছোট দৈর্ঘ্যের ধান, একটু উঁচু জমিতে হত, চমৎকার নুন সহ্য করতে পারতো। মোটা চাল হতো। এখন বেশিরভাগ ওই দুধের সর হয় আমনে। বোরোতে হাইব্রিড, চাপান সার দিয়ে। সেসব সম্পর্কে জানতে মাঝে মাঝে আগ্রহ হয়না৷
ধানক্ষেতে বিষ, তরমুজের ক্ষেতে বিষ, শাকসব্জীতে বিষ বলে মাঝে মাঝে গবাদি পশুর মড়ক লাগতো। তরমুজের খেতে গাছ খেয়ে গরু মারা যেতো। বিষ ছাড়াও ব্যাপক ফলন হতো তরমুজের। দেশী ও হাইব্রিড দুই জাতই ছিলো। দেশী কিছু এখনো ধুঁকে ধুঁকে আছে কিন্তু উৎপাদন ওই দাম পাওয়া যায়না বলে একরকম বন্ধই হয়ে গেলো।
এদিকে হয়েছে কি সুন্দরবনের নদী খাঁড়িতে গঙ্গা ভাগীরথী হুগলি নদীর মিষ্টি জলের প্রবাহ কমে কমে হয়েছে প্রায় ১০%। এতো নোনা জলে লবণাম্বু উদ্ভিদের পাতা পর্যন্ত হলুদ হয়ে যাচ্ছে। এইরকম নোনাজল যখন ভেতরে ঢুকে আসছে তখন বহু জায়গায় দু তিনবছর আর চাষই হচ্ছেনা। তখনই ওই কেরালা তামিলনাড়ু গুজরাট ইত্যাদি। আবার চাষ হলেও নুনের কারণে সমস্যা হচ্ছে। এদিকে প্রাকৃতিক ভাবে নির্বাচিত স্থানীয় জাতগুলি প্রায় নেই। বড়ো সমস্যা। কৃষকরা এখন বুঝছেন।
বীজ ধরে রাখার সংস্কৃতিটা নেই বললেই চলে। চাষ তো "কালচার"। দেশের অধিকাংশ পার্ব্বণই আসলে কৃষিকেন্দ্রিক। ক্যাশযুগে স্বাভাবিকভাবেই মাটি ও কৃষির সঙ্গে সেই সম্পর্কটা নেই। তার আরেকটা কারণ সার বিষ ও ক্যাশ ক্রপিং এর বিজ্ঞাপন বড়ো বেশি এদিকে উল্টোদিকের বিকল্প খুব কম। আমাদের হাতে টিভি রেডিওর মতো প্রচারও নেই। যা করতে হবে একদম সশরীরে ঘুরে ঘুরে।
এইভাবে সার বিষ হাইব্রিড এর কাল বেয়ে আর তার সঙ্গে লাগাতার প্রাকৃতিক দুর্যোগ পেরিয়ে এখন যা অবস্থা তাতে ক্রপ সাইকেল নিয়ে ভাবতে হচ্ছে কারণ আমন ধান এর মরশুম এক দেড় মাস করে পিছিয়ে যাচ্ছে। অনেক জমি নোনা হয়ে যাওয়ার কারণে চাষ করা যাচ্ছেনা। জমি খুঁড়ে ভেড়ি হয়ে যাচ্ছে। তাতে স্থানীয় অর্থনীতির লাভ নেই। এ অনেক আলোচনা। এখানে প্রয়োজন নেই।
যে অভাবগুলি দেখা গেলো তা হলো সমবায় এখানে বাঁধাবন্ধকী বা ব্যাংক এর মতো একটি প্রতিষ্ঠান। গ্রামীণ কৃষক ঐক্য শূন্য। এবং সেই কারণে কৃষকদের দল গড়ে একদল কৃষিকাজ, একদল কৃষিজ ফসলের প্রক্রিয়াকরণ ও আরেকদল বিপণন এটা না করতে পারবার ফলে ওই ধানের বস্তা বেচেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বাকি সবজি থেকে শুরু ডিম মাংস সবেতেই লস। পুরোটাকে একটা সিস্টেমে আনতে খাটনি ও পেশাদারিত্ব লাগে। একদিকে আবার অতিরিক্ত দারিদ্র্যের ফলে কৃষক ঝুঁকিও নিতে পারেন না। সরকারী খাতায় দক্ষিণ ২৪ পরগণায় চারটি স্টোরেজ। এখানে অন্তত আটটা স্টোরেজ হওয়া উচিত। বিরাট জনসংখ্যা সুন্দরবনের। কমবেশি ৪৫ লাখ মানুষ। সাগর, পাথর, নামখানা, কাকদ্বীপ এর কৃষিজ পণ্য দূরের রাজ্যের কোল্ড স্টোরেজে গিয়ে আবার ফেরত আসে। এটা কোনো সিস্টেম নয়। এতে কার্বন ফুটপ্রিন্ট থেকে খরচ সবই বেড়ে যায়। আলু, লংকা পিঁয়াজের মতো এরকম কৃষিজ উৎপাদন এখানেই রাখা প্রয়োজন। বর্ধমানের স্টোরে নয়৷ আর চাই সবরকম উৎপাদনের প্রসেসিং এর ধারণা।
উদাহরণ দেখা যাক, একটা লেবুর ক্ষেত এর উৎপাদন থেকে লেবুর রস, লেবুর আচার, খোসা থেকে লেবু পাউডার (বাসন মাজার জন্য) ও বীজ থেকে চারা করে নার্সারী হতে পারে। কিন্তু শুধু লেবু বেচে কি হবে?
চাষীদের দল থাকবে। একদল উৎপাদন করবেন বাকিরা প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন দেখবেন। তবে এসবের সঙ্গে সঙ্গে কিছু পুঁথিগত চর্চাও চাই যেমন ভালো ভালো বই পড়া, কৃষিসংক্রান্ত আলোচনা আছে যেখানে, এককথায় এতে চিন্তন বাড়ে, একটা এক্সপোজার পাওয়া যায়। একসঙ্গে বসে কাজের কথা বলা, বীজ বিনিময় এসব কাজেরও খুব প্রয়োজন আছে মানবসম্পদ সমবায় গড়বার জন্য।
আসলে এই লেখায় আলগোছে আমি চেষ্টা করেছি একটা সময়কে ধরবার।
আমাদের কাজ বলতে, ঝড়বন্যার তাৎক্ষণিক যেসব কার্যক্রম তা বাদেও কৃষি ও পশুপালন নিয়ে। পাঠশালা, মহিলা সমিতি ওসবের কথা এখানে আর লিখছিনা তবে কৃষির ক্ষেত্রে ফার্মার্স ক্লাব গড়ে, যা লিখেছি যা বলতে চেয়েছি তা করার চেষ্টা করছি। এর জন্য ব্যাপক যোগদান, নিরলস শ্রম চাই। সেটাও একরকম শূন্য থেকে শুরু করতে হচ্ছে। স্থানীয় জাত সংরক্ষণ, বীজ ও জৈব সার স্বনির্ভরতা, পশুপালনের খরচ প্রায় শূন্য করে ফেলা ও এসবকিছুর সঙ্গে অকৃষিজাত যা যা আছে তাকে যত্ন করে রক্ষা করে, বাড়িয়ে নিয়ে তার কিছুটা বিপণনের চেষ্টা করা। যেমন সুন্দরবনের গুড়, সুন্দরবনের মধু। সবকিছুর সঙ্গেই আঞ্চলিক প্রাকৃতিক বিশেষত্ব মিশে আছে।
এই জটিল, বিভ্রান্তিকর, reductionist ও ভয়াবহ লোভ এর কালে এইসব কাজে কর্মীর সংখ্যা খুব কম হয়। এই অল্প কর্মী নিয়ে সব লড়াই সামাল দেওয়া যায়না তবু আশার কথা আছে অনেক। অনেক মানুষই এসব বোঝেন কিন্তু মাথার ওপর দারিদ্র্যের বোঝা নিয়ে বেরিয়ে আসতে সাহস পান না। দেখি আমরা সকলে মিলে বেরিয়ে এসে কিছু করতে পারি কিনা। ইয়াসে যে ক্ষতি হয়েছে সে কথা খুব বেশি মানুষ জানেন না। এখনো অনেকের ঘর নেই, অনেকের পুকুরে এখনো নোনাজল তবু এরই মধ্যে যারা সুস্থায়ী কৃষির লড়াই জারি রেখে ধান পান সব্জী ফল ফলিয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে, নিজেরা খেয়ে একটা সুস্থ সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবো।
আমাদের এখনকার লক্ষ্যঃ-
১) দেশী বীজ ও জৈব সার স্বনির্ভরতা।
২) সবরকমের প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত স্থানীয় জাতের লতাগুল্ম, বৃক্ষ, শাকসব্জী সংরক্ষণ ও পরিবর্ধন।
৩) কৃষি গ্রন্থাগার গড়ে সেখানে লাগাতার কৃষকসভা করে কৃষকদেরকে নানারকম অভিজ্ঞতার সুযোগ করে দেওয়া(গ্রামের বাইরেও তাঁরা এখন যাচ্ছেন)
৪) জিওল মাছেদের জন্য "অভয়পুকুর" ও তাদের সংখ্যা বাড়ানো।
৫) বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ও সেচে মাটির নীচের জল কম ব্যবহার করা।
৬) গ্রামের মেয়েদের চাষের বিষয়ে আরো উৎসাহিত করা।
৭) বাচ্চাদেরকে জানাতে চাওয়া যে থালার খাবার কোথা থেকে কিভাবে আসে। এই মর্মে আমরা কাজ শুরু করেছি।
৮) যা কিছু উৎপন্ন হবে তার সঠিক প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণনের ব্যবস্থা করা এবং উৎপাদকরা যাতে ন্যায্য মূল্য পান তা নিশ্চিত করা।