নারায়ণ শিকারী নামকরা গাজন শিল্পী। দশগাঁয়ের লোক তাকে চেনে। কিন্তু নারায়ণকে খেলো মদে। পেটে অপারেশন হলো। নারায়ণ বসে পড়লো ঘরে। নারায়ণের বউ খুব খাটিয়ে৷ সে তার স্বামীকে ঠিক বাঁচিয়ে তুললো। ঘটনাচক্রে সোমদা চাষের কাজে গেলো সেই গ্রামে। নারায়ণদের বিঘা তিনেক জমি আর তিনখানা পুকুর। সোমদা তিন বিঘা জমি আর তিনটে পুকুরের মূল্য খুব ভালো বোঝে। তাদের তিনটে পুকুর সোমদা নিজের হাতে গড়ে দিলো। দুটো পরিষ্কার পুকুরে পোনা মাছ আর ময়লা পুকুরটায় পাঙাস আর রূপচাঁদ। সোমদার নিদান মেনে নারায়ণ নারায়ণী মৎস্যসেবা করতে লাগলেন৷
তারপর ...
মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সোমদা দুইমাসাধিক কাল হাসপাতালে ভর্তি। কতো জেলা থেকে কৃষক, সংগঠক, কর্মকর্তারা সোমদাকে দেখতে আসেন। এখন আগের চেয়ে ভালো৷ রোজ ফোন আসে। কখনো জেলেরা ফোন করে,কখনো পাথর সাগর নামখানা কুলপী ব্লকের কৃষকরা, সোমদা যে অঞ্চলে একবার কাজ করে এসেছে, তারা সকলে খোঁজ নেয়।
একদিন নারায়ণ ফোন করে।
"স্যার, ভাবতে পারবেন না এত মাছ হয়েছে! রান্নাপুজোর দিন থেকে মাছ বিক্রি শুরু করেছি। পাড়া প্রতিবেশী জানতে চাইছে এত মাছ হচ্ছে কীকরে?
আপনি সুস্থ হয়ে আসুন৷ আমরা অপেক্ষা করবো। আপনাকে এক লাখ টাকা দেবো৷ আমার ক্ষেত খামার পুকুর সব সাজিয়ে দেবেন।"
শুনি আর ভাবি, সোমদা বিভিন্ন ব্লকে কিষাণ কিষাণীদের জন্য যে ব্যবস্থা করে দেয়(কৃষি প্রশিক্ষণ, ফার্ম ডিজাইন) তাতে তাদের যা রোজগার হয় সোমদার বেতন তার চেয়েও কম।
অথচ যে একাগ্রতা, সততা ও শ্রম দিয়ে সোমদা কাজ করেন তাতে তাঁর মাস মাইনে মোট দিনের হিসেবে হওয়া উচিত কমপক্ষে ৩০,০০০ টাকা৷
সোমদা এসব হিসেব করে চলেনা। পাথরপ্রতিমা ব্লকের প্রান্তিক জেলেদের নিয়ে যে সংগঠন গড়ার চেষ্টা করেছে তার জন্য কি সোমদা পয়সা পাবে? এক কানা কড়িও পাবেনা৷ অথচ সোমদা কাজ করে যাচ্ছে৷
অনেক প্রকারের মধ্যবিত্ত আছে। তাদের মধ্যে এককথায় "প্রগ্রেসিভ" ক্যাটেগরি বাদ দিলে আরো কয়েকটা ক্যাটেগরি দেখা যায় যেমনঃ-
নিজের ও পরিবারের সদস্যদের চাকরি নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করে গর্ব করা মধ্যবিত্ত, গায়ের রঙ ও বর্ণ নিয়ে মানুষকে অপমান করা দু একটা ডিগ্রী পাশ করা মধ্যবিত্ত, ছেলেমেয়েকে দামী স্কুলে পড়িয়ে পড়ার খরচ শোনানো মধ্যবিত্ত, ছা-পোষা মধ্যবিত্ত, পাড়ার 'বড়লোক'দের গা ঘেঁষে থাকতে চাওয়া মধ্যবিত্ত,অন্যের আলোয় আলোকিত হতে চাওয়া মধ্যবিত্ত, শুধু নিজেরটুকু যোগাড় করাকেই জীবনের মোক্ষ বলে জানা মধ্যবিত্ত ইত্যাদি।
এই প্রতিটা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে একটা অদৃশ্য ক্ষমতা আছে। সৌন্দর্য্য, প্রেম, যৌনতা, ভালোবাসা, জীবন, কাজ সবকিছুকে এরা তাদের অভাবনীয় হতাশা, আলস্য ও ঈর্ষা দিয়ে বাঁধতে চায়। কিন্তু তা হয় চিত হয়ে শুয়ে তারাদের দিকে থুতু ছুঁড়বার মতো ঘটনা।
তারা যখন গোক্ষুরের জল থেকে মুখ তুলে গ্যাঙ গ্যাঙ করে তাদের মতো হওয়ার কথা বলে তখন ইচ্ছে করে, তাদেরকে সোমদার জীবনের কথা বলি।
কিছু হোক বা না হোক।
সোমদা ভালো থাকলে অনেক কিষাণ কিষাণী ভালো থাকবে। অনেক মানুষের মঙ্গল হবে।