এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সাদিক হোসেনের 'ভারতবর্ষ' উপন্যাসের আলোচনা

    PURUSATTAM SINGHA লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৬৫ বার পঠিত
  • সমকালীন ভারতের গেরুয়া রাজনীতি যে আখ্যানের চালক
    পুরুষোত্তম সিংহ

    আদ্যন্ত রাজনৈতিক বয়ান গড়ে তুলেছেন সাদিক হোসেন হোসেন ‘ভারতবর্ষ’ (২০২৪) উপন্যাসে। বহুত্ববাদের দেশ ভারতে রাষ্ট্রশক্তি বলপ্রদত্ত নিজস্ব ধর্মকে কীভাবে কেন্দ্রে রেখে অন্যধর্মসহ বিরোধী জনমতকে পরাজিত করতে বদ্ধপরিকর তার গোপন পাঠ আখ্যানকে বহুমুখী সত্যে ভাসিয়েছে। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে জয়ী রাষ্ট্রপ্রধানেরও নির্দিষ্ট ধর্মের ঊর্ধ্বে মানবিক হওয়া প্রয়োজন। অথচ আজকের প্রধানমন্ত্রী ধর্ম নিরপেক্ষতার বদলে ধর্মের বেশে ভেল্কি নাচন দেখাচ্ছেন। পুরো জোকার সুলভ আচরণ করে, ধর্মীয় গোঁড়ামি দ্বারা দেশকে যেমন ধ্বংস করছে তেমনি দেশের সুমহান ঐতিহ্য, সম্প্রীতিকে ধ্বংস করছে। এই ভাঙনকালে একজন লেখক কী করবেন? সাদিক হোসেন এই ভাঙনের ফাঁকফোকর যেমন আবিষ্কার করেন তেমনি সময়ের জঘন্য রাজনীতিকে ব্যক্ত করে চলেন। জটিল সময়ের ভাষ্যকে নানাবীক্ষণে ভাসমান করেছেন লেখক। সংখ্যালঘুর আজ নানাদিকে সংকট। সেইসঙ্গে আছে রাজনীতির জঘন্য খেলা। রাজনীতির বিদ্ধেষ ক্রমেই মানুষকে গ্রাস করছে। মানুষ ক্রমেই ধর্মীয় বিদ্ধেষে মেতে আছে। গীতা, কোরান, মহাভারত আমাদের বিদ্বেষ শেখায়নি। মানুষ যদি ধর্মপ্রাণই হয় তবুও ধর্মের মূলে তো বিদ্বেষ, হানাহানি রক্তপাত নেই। তবে এই নারকীয়তা কেন? ক্ষমতার স্বার্থে ধর্মের কূপমণ্ডুকতাকে রাজনৈতিক নেতারা ব্যবহার করছে। বিদ্বেষের বীজ দ্বারা বেকারত্ব ঢাকা হচ্ছে। এ আখ্যানে পর্বে পর্বে নানা এপিসোড আছে। চরিত্র, ঘটনা, অপেক্ষা মূল বিষয় সময়ের বহুমাত্রিক সংকট। নৈরাজ্যবাদ, ধর্মতন্ত্র, ক্ষমতাতত্ত্ব ও রাষ্ট্রযন্ত্র ভারতের সুমহান ঐতিহ্যকে কীভাবে ধ্বংস করছে তার তলদেশের সংবাদ আবিষ্কার। সংঘশক্তি কীভাবে ক্ষমতার মসনদ দখল করে আছে, তার ছলনাজাল, বিবিধ ভেকধারী বৃত্তান্ত আখ্যানকে সময়ের জীবন্ত ভাষ্যে পরিণত করেছে। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জয়ের আগে যে রীতিমতো যাত্রাপালা যা একজন রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে ন্যক্কারজনক এবং তীব্র ঘৃণার তাই করে ভক্তমণ্ডলীর হৃদয় জয় করেছেন। ভারতসম্রাটের বদলে ‘হিন্দুহৃদয়সম্রাট’, একাধিক মেটাফোরে চাড্ডিপন্থীদের ভেকধারী ভূমিকা সংখ্যালঘুকে খতম করার গোপন আঁতাত ও বুদ্ধিজীবীদের কব্জা করে ঘোর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দেশের যাত্রাকে লেখক চিহ্নিত করে চলেন। সীমান্ত, বৈদেশিক শক্তি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বিরোধীদের কোলাহল, রাষ্ট্রনেতাদের কোনো পাত্তা না দিয়েই একনায়কতন্ত্রে পার্টি ও দেশকে নিয়ন্ত্রণ যা জনগণের পক্ষে ভয়ংকর ক্ষতিকারক তার জটিল বিন্যাস আখ্যানকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

    বর্তমান ভারতের ধর্মতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রই এ আখ্যানের মূল সুর। সেই একনায়কতান্ত্রিক শক্তির বোড়ে, সৈনিক, মন্ত্রীদের বিবিধ সংকেত আখ্যানে বিরাজ করেছে। ভারতের মূল সমস্যা রাষ্ট্রশক্তির ধর্ম। ভারতের বদলে হিন্দুহৃদয়রাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রী নানা কৌশলে সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছেন। রাষ্ট্র নিজের শক্তিকে জনগণের সামনে স্বচ্ছ রাখতে বুদ্ধিজীবী, শিল্পপতি, মিডিয়া সকলকে হাতে রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী শপথ নিচ্ছেন অথচ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রাজনীতির মোকাবিলায় মানুষ খুন হচ্ছে। অভুক্ত অনাহারী শিশুর আত্মপরিচয় নির্মিত হচ্ছে প্যান্ট খুলে লিঙ্গ দেখে। পদ্মপাতা, পাখি রূপকে সূক্ষ্ম শ্লেষ, ব্যঙ্গ রেখে লেখক প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটনে এগিয়ে যান। বয়ানে পাই—
    “মাধবজি বিরক্ত হলেন, আমি কেন আপনাদের বোঝাতে পারছি না যে পলিটিক্সের সঙ্গে মর‌্যালিটির কোনও সম্পর্ক নেই। সততার মতো জঘন্য পলিসি কিছু হতে পারে না। তবু আমরা পলিটিক্সে রয়েছি কারণ আমরা রুল করতে চাইছি। আমরা রুল করতে চাইছি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। আর সেই উদ্দেশ্যটিকে পূরণের জন্য যেকোনও স্যাক্রিফাইসে তৈরি।” (ভারতবর্ষ, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০২৪, মন্দাস, পৃ. ৩৯)

    শাসকের একটিই উদ্দেশ্য হিন্দুরাষ্ট্র। প্রকৃত উন্নয়ন নেই, লাগামছাড়া বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান দাম বৃদ্ধি, সরকারি চাকরি শূন্য। গোটা দেশ পুঁজিবাদের কাছে মাথা বিক্রি করে দিচ্ছে। পুঁজিবাদের শিল্পপতি দেশের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে। ভোটার যেন হাতের পুতুল। রাষ্ট্রনায়কের সূক্ষ্ম পরিকল্পনা মুসলিম নাশ ও হিন্দু রাষ্ট্র সাধনা। সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। সেই জটিল রাজনীতিকে লেখক জরুরি বিশ্লেষণে ধরেছেন। ‘আনন্দমঠ’এর সন্ন্যাসীরাও যজ্ঞ তন্ত্র, মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েও দেশমুক্তিতে সামিল। যে সন্তান দেশকে ভালোবাসে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর, দেশের মুক্তির সোপানে অঙ্গিকারবদ্ধ দেশ তারই। তার কোনো ধর্ম হয় না, জাতি হয় না। পুণ্যভূমির সন্ধান মানবপথিকরা করে গেছেন। মাধব গোলওয়ালকর নিজেও পুণ্যভূমির স্বপ্ন দেখেছিলেন—
    “মুচকি হাসলেন মাধব গোলওয়ালক। বললেন, স্মৃতি-বিস্মৃতির বিবাদটা বোধহয় আপনার কল্পনার। আমি পুণ্যভূমিকে কেন্দ্রে রেখেই রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছিলাম। পুণ্যভূমি বলতে যারা অন্য ভূগোল বোঝে, তারা বেরিয়ে যাক না। নিজেদের পুণ্যভূমিতে যাক। রাষ্ট্র তো সাময়িক বোঝাপড়া। সেটাকে টিকিয়ে রাখতে পারে একমাত্র পুণ্যভূমির প্রতি আনুগত্য। এই আনুগত্য থেকে তৈরি হতে চলেছে নতুন জাতিসত্তা।” (তদেব, পৃ. ৪৫)

    অথচ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। ইতিহাসকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। জনজীবনের মিথকে বিকৃত করা হয়েছে। মানুষের স্মৃতিসত্তাকে অস্বীকার করা হয়েছে। অখণ্ডসত্তাকে খণ্ড করে পৃথক মূল্যবোধে বিভাজননীতিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে। বিশ্বায়নের উত্তর আধুনিক যুগে উন্নত রাষ্ট্র পরিকল্পনায় যখন নতুন জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠা জরুরি ছিল তখন ধর্মনীতিতে বিভাজন যেন কলঙ্ক রাষ্ট্রের জন্ম দিচ্ছে। ভারতের সুমহান ঐতিহ্য, একাধিক দার্শনিক মত যেখানে এতকাল ধরে পাশাপাশি ছিল, মতের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও পাশাপাশি সহাবস্থান বজায় রেখেছিল সেখানে এই একুশ শতকের কোন অন্ধকারে গেল দেশ। সভ্য রাষ্ট্র, উন্নত রাষ্ট্র, মানবিক রাষ্ট্রের বদলে কেবলই অন্ধকার। সেই অন্ধকারের কারণ, ভাঙনবেলাকে চিহ্নিত করেছে এ আখ্যান।

    ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যতত্ত্ব কোথায় আর কোন ভারতের স্বরূপ সন্ধানে গেরুয়া রাজনীতি চলেছে—দুইয়ের তফাত আবিষ্কার আখ্যানকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। ত্যাগ, বৈরাগ্যের দেশে কেন ক্ষমতা দখলের জন্য হিংসা ছড়ানো হচ্ছে। যদি হিন্দু সাম্রাজ্যই অবধারিত নিয়তি হয় তবে তার ঐতিহ্যগত ভিত্তি কোথায়? গীতার তত্ত্বকথা, অর্জুন-কৃষ্ণের সংলাপ তো হিংসার কথা বলেনি। ওসমানের ডায়েরির অংশ, যশোবন্তের গীতাক্ত ধর্মের স্মরণ, মাধব গোলওয়ালকরের ক্লেদ, স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্য দিয়ে আখ্যান ভারতআত্মাকে সন্ধান করে চলে। ভারতআত্মা কোথায় ছিল আর কোথায় এসে পৌঁছেছে। মা কী ছিলেন আর কী হইয়াছেন। প্রধানমন্ত্রীর শপথের আগে ভারততীর্থের গান গাওয়া হয়, কিন্তু পরেই আসে পদ্মের জটিল কাব্যময় ভাষ্য। লেখক একাধিক রূপকে, মেটাফোরে যন্ত্রণাকীর্ণ ভারতের জটিল আত্মাকে স্পর্শ করতে চান। ত্যাগ বৈরাগ্যের দেশ ভারততীর্থকে কারা কীভাবে কুলষিত করছে তার স্বরূপ বড় ব্যঞ্জনাময় হয়ে ধরা দিয়েছে। কখনো কাফকার ডায়েরি, গীতের ধর্ম, মুসলিম নাশ, সংঘশক্তির কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব, আধিপত্যের ধর্ম প্রতিষ্ঠায় কুযুক্তি, মনস্তাত্ত্বিক বিবাদ নিয়ে সময়ের জটিল ভাষ্যের রোমন্থন আখ্যানকে একুশ শতকের কালবেলায় মূল্যবান করে তুলেছে।

    ভারতীয় রাজনীতির জটিল জালকে ব্যক্ত করতে উদগ্রীব হয়েছে এ আখ্যান। বহুস্তরে বিভক্ত রাজনীতির ঘোলাজল কোন খাত থেকে কীভাবে কোনদিকে বয়ে চলে তার দ্বান্দ্বিক অভিমুখ আখ্যানকে তীব্র করে তুলেছে। খতম, প্রেম, যৌনতা, প্রধানমন্ত্রীর ঢপকীর্তন, ওয়েসিসের ভূমিকা, গণহত্যা, কমিউনিস্ট পার্টির বাস্তবহীন তাত্ত্বিক ভূমিকা আখ্যানকে বহুমাত্রিক সুরে বাজিয়েছে। জাতিসত্তা, সংস্কৃতি আলাদা। জাতিসত্তার সংমিশ্রণে নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলন জার্মানি দেখাতে পেরেছিল। জাতি ও সংস্কৃতির মূলে গিয়ে বিবাদের সূত্রগুলিকে দূর করে ঐক্যবদ্ধ করে তোলাই আধুনিকতার অন্যতম লক্ষণ। অথচ দেশ চলেছে অদ্ভুত গাধার পিঠে। কর্মসংস্থান, অভেদনীতি, সম্প্রীতি, মিলনের বদলে প্রধানমন্ত্রী নাটক করে দর্শকদের ভোলাচ্ছেন। দর্শক কিসে খুশি হতে পারে সেই সেন্টিমেন্টাল আবেগ প্রয়োগ করে দেশবাসীর মন জয় করতে চাইছেন অথচ হিংসা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাস্যরস থেকে বীভৎসরস হয়ে অদ্ভুত রসে পরিণত করে প্রধানমন্ত্রী মহেশভাইয়ের ছলনাচরিত রচিত হয়ে চলেছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গোলকধাঁধায় মানুষকে বিভ্রান্ত করার নানা প্রবণতার রহস্য আখ্যানে উঁকি দেয়—
    “গাঙ্গুবন মাধব গোলওয়ালকরের দিকে তাকালেন। মাধব গোলওয়ালকর ডাঃ রায়ের দিকে। ডাঃ রায় পরে জানিয়েছিলেন, আসলে প্রধানমন্ত্রী নির্মাণ করতে গেলে মানুষটিকে ঘিরে তো বিভিন্ন ন্যারেটিভ গড়ে ওঠে। সেই ন্যারেটিভের সঙ্গে অনেকেই নিজেকে একাত্মা করে ফেলেন।
    —তা বলে ফিকশন আর রিয়েলিটির তফাত গুলিয়ে ফেলবেন!” (তদেব, পৃ. ৭৪)

    আখ্যানে নানা তাত্ত্বিক পরিসর রয়েছে। তা ভেসে গেছে অজস্র রূপকে। উত্তর আধুনিক রাজনীতির জটিল ক্যানভাস আখ্যানের গোত্র নির্ধারক হয়ে উঠেছে। ইতিহাসের গলিপথ দিয়ে বাস্তবের সূত্র ব্যক্ত এবং দৃঢ় বাস্তবকে প্রত্যাখ্যান করতে কখনো মিথ, ইতিহাস, রূপকে ভেসে যাওয়া আখ্যানের সমান্তরাল পাঠকে যেমন ভেঙে দেয় তেমনি কেন্দ্রচ্যুত হয়ে কেন্দ্রে ফিরে আসে। যৌনতা, অ্যাবসার্ড, ফিকশান, রিয়ালিটির তারতম্য, বাস্তব, বানানো বাস্তব, তীব্র বাস্তবকে আক্রমণ এবং বাস্তবের ভিতর গড়ে ওঠা একাধিক নিপুণ বাস্তবের গ্রহণ-প্রত্যাখ্যান পাঠ আখ্যানকে সময়ের দলিল করে তোলে। সাদিক হোসেন মেধাবী লেখক। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলিতে—‘সম্মোহন’(২০০৯), ‘গিয়াস আলির প্রেম ও তার নিজস্ব সময়’ (২০১৪),  ‘রিফিউজি ক্যাম্প’ (২০১৭) ও ‘হারুর মহাভারত’ (২০১৯) সে পরিচয় পাওয়া যাবে। তিনি কেন্দ্রীয় রাজনীতিকে নির্মাণ করেছেন ধর্ম, জাতিতত্ত্ব, ক্ষমতার ভাষ্যে। ক্ষমতা নিজের বলপ্রদত্ত শক্তি দ্বারা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। নানা প্রবণতা নিয়ে, নানা সংগঠন, মিডিয়া নিয়ে রিয়ালিটিকে অস্বীকার করে ভুল বাস্তবে দেশকে চালিত করছে। যা ক্রমেই হিংসা, বিভেদের জন্ম দিচ্ছে। লেখক সেই বিভ্রান্ত প্রবণতাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে চলেন। প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পিত ভারত এক আর বর্তমান ভারতের চিত্র আরেক। অনাহারে, অর্ধহারে, বেশ্যাগিরিতে পেটভাত রোজগার চলছে। অখণ্ড ভারত গঠনে বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করলে চিন আক্রমণ করছে। বিদেশের কোম্পানি তাদের বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী দলীয় কর্মীদের বক্তব্য শুনতে নারাজ। সম্পূর্ণ ভুল প্রক্রিয়ায় দেশ এগিয়ে চলেছে। সমূহ ক্ষতি, সর্বনাশের যজ্ঞের মধ্য দিয়ে যে যাত্রা যা দেশকে ক্রমেই বিপদে ফেলছে তার ক্ষমতাতাত্ত্বিক রসদ ও রাজনৈতিক জটিল বয়ান আখ্যানকে বিবিধ সুরে তরান্বিত করেছে। অখণ্ড দেশের স্বার্থে সে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যা শত শত সেনার মৃত্যুর জন্য অনিবার্য। মানবপথিক মাধব গোলওয়ালকর যে স্বপ্ন দেখেছিল তা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। স্বপ্নসেতু যেন প্রধানমন্ত্রী একাই ভেঙে দিচ্ছেন। সে নিজেই প্রধানমন্ত্রীকে খুনের পরিকল্পনা করে। যে ঘোষণা দেশকে বিপন্ন করে, দেশের সন্তানকে নাশ করে তা তিনি মেনে নিতে পারেননি—
    “মাধবজি যেন নিজের মনেই বলতে থাকলেন, আমার স্বপ্ন ছিল পুণ্যভূমিকে রক্ষা করার। একটিই জাতি নির্মাণের স্বপ্ন ছিল। এই স্বপ্নের পেছনে আমি সারাজীবন ছুটে বেরিয়েছি। সংসারধর্ম পালন করিনি। এমনকি নিজের ছেলেকেও বলি দিয়েছি। আমি জানি নিজের ছেলের মৃত্যু হলে বাবার মনের ভেতর কী ঘটে। আপনার তো একটা ছেলে নয়। পুরো সেনাবাহিনীর জওয়ানরাই আপনার ছেলে।” (তদেব, পৃ. ৯৬)

    সাদিক হোসেন সময়ের রাজনীতিকে তীব্র ব্যঙ্গে আঘাত করেছেন। রূপক, শ্লেষে সময়ের জঘন্য রাজনীতিকে যেমন কষাঘাত করেছেন তেমনি বাস্তবকে আক্রমণ করে বাস্তবের ভিতরের বহুমুখী বাস্তবকে স্পষ্ট করেছেন। প্রতীয়মান বাস্তবের ভিতরে বিভ্রান্ত বাস্তব কীভাবে খেলা করে, স্মৃতি-বিস্মৃতির ভিতর দিয়ে মগজ ধোলাইয়ের মেকি বাস্তব কীভাবে সর্বস্ব গ্রাস করে তার মনচিত্র, মানচিত্র আখ্যানকে তীব্র করে তুলেছে। যৌনতা, স্মৃতিবিভ্রম, অ্যাবসার্ড, অন্ধকারের ভারত, সংগঠিত হিংসা, বিদ্ধেষের মধ্য দিয়ে অতীত রোমন্থন থেকে পুণ্যভূমি কীভাবে দূষিত নালায় পরিণত হচ্ছে তার জরুরি পাঠ আখ্যানকে সময়ের উপকণ্ঠে পৌঁছে দিয়েছে। বর্তমান ভারত আত্মার খোঁজ আছে এ আখ্যানে। আজকের ভারততীর্থের কলরব, কলরোল কোন ভিত্তিহীন বাস্তবের উপর দাঁড়িয়ে আছে তার অদূরদর্শী পরিণাম কোন ভয়ানক ক্ষতের জন্ম দিতে পারে তার মেধাবী বয়ান আখ্যানকে পুণ্যভূমির দলিল করে তুলেছে।

    তারিখ : ৩১/১২/২০২৪
    পুরুষোত্তম সিংহ। ঘোষপাড়া, সুভাষগঞ্জ, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর। ৭৩৩১২৩। ৬২৯৭৪৫৮৫৯১।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাপাঙ্গুল | 182.69.***.*** | ২১ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:২৮540747
  • আলোচনা ভাল লাগল। সাদিক হোসেন ছোটগল্প যত ভাল লেখেন উপন্যাস ততটা ভাল লিখতে পারেন না। 
  • Pk | 49.207.***.*** | ২১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:২১540751
  • "গীতা, কোরান, মহাভারত আমাদের বিদ্বেষ শেখায়নি" - আহা, সমৃদ্ধ হলেম
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন