মিশেল ফুকো তাঁর হিস্টরি অফ সেক্সুয়ালিটিতে বলেছেন, যে, সবাই যতই জানুক – একটা দেশের ধনী, ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার জন্য তার জনবলই মূল কথা, “One of the great innovations in the techniques of power in the eighteenth century was the emergence of ‘population’ as an economic and political problem”. আরও বললেন, “this was the first time that a society has affirmed, in a constant way, that its future and its fortune were tied not only to the number and the uprightness of its citizen, to their marriage rules and family organization, but to the manner in which every individual made use of his sex.” সেই সময়ের দাবী ছিল জন্মহারের বৃদ্ধি, অতএব যে যৌনতা প্রজাবৃদ্ধি করে না, তাতে রাষ্ট্রের, এবং রাস্ট্রের বকলমে ধর্মের কীই বা প্রয়োজন? অতএব তার উপর হাজার বিধিনিষেধ আনো, এমত আচরণকে অস্বাভাবিক বলে দাগিয়ে দাও, আর পুত্রার্থে যৌনতার পূজারী যারা, তাদের মনে এই তথাকথিত নিষ্ফল যৌনতার মানুষদের প্রতি ভয়, ঘৃণা জাগিয়ে তোল। যে সমকামিতা মোটেই আজকের কথা না – এমনকি মেসোলিথিক যুগের গুহাচিত্রেও যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় – খামোকা তাকে ঘিরে একটা বিদ্বেষবোধ তৈরি করা হল মানুষের ক্ষমতালিপ্সার কারণে।
তৈরি হল হোমোফোবিয়া। বিশেষ করে পাশ্চাত্য জগতে। আর তাদের থেকে এই ধারণা ছড়িয়ে পড়ে তাদের বিভিন্ন কলোনিতে। এই সেদিন অবধিও হোমোফোবিয়াই ছিল একমাত্র সত্য। হোমোফোবিয়ার ফলে সমকামী মানুষেরা নিজেদের যৌন চেতনা লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হতেন। হোমোফোবিয়া শেখাত সমকামিতা আসলে মানসিক অসুখ। এইরকম আরও কত কী! আর এইসবে বিশ্বাস করেই এই পৃথিবীর কত মানুষ নিশ্চিন্তে জীবন কাটিয়ে গেছেন। সব দেশেই। শুধু কি আর সাধারণ মানুষ? এই সব যারা বলতেন, তাঁরাও তো অনেকেই সেই সময়ের নিরিখে সব জ্ঞানী-গুণী মানুষ! আর শুধু তো তাই না, অনেক সময় সেই সব অর্ধপক্ক জ্ঞানের ভিত্তিতে সমকামীদের চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলার চেষ্টাও করা হত। জঘন্য এক পাওয়ার-প্লে।
তবু পাথরের দেওয়ালেও ফাটল ধরে। একটা সময় সত্যিকারের চেষ্টা শুরু হল সমকামিতাকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বোঝার। সেই চেষ্টা এখনও চলছে। এটা মোটামুটি বোঝা গেছে, যে, সমকামিতা কোন ১ + ১ = ২ গোত্রের ব্যাপার না, বিবিধ বিষয়ের জটিল টানাপোড়েনে সমকামিতা তৈরি হয়। ঠিক কিসের সঙ্গে কী – কোন অনুপাতে মিশে যে রামধনুর কোন রংটি তৈরি করে, সেটাই বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছেন সবাই। আর দশটা গ্রোইং বিষয়ের মতনই এই জানা বোঝাগুলোও ক্রমশ বদলাচ্ছে। এরই কিছু কিছু তত্ত্ব নিয়ে সুদীপ্ত পাল লিখেছেন “সমকামিতা ও বিবর্তন”। সহজ কথায়, দেশজ বিস্তারে। ছোট্ট চটি বই। মাত্র তিনটি পরিচ্ছেদ। প্রথম পরিচ্ছেদের আলোচনার বিষয় অস্বার্থপর জিন। এখানে সুদীপ্ত দেখিয়েছেন, কীভাবে সরাসরি বংশবৃদ্ধিতে অংশ না নিয়েও সমকামিতা বিবর্তনের ধারায় টিকে থাকে। পরের পরিচ্ছেদে সমকামিতার জীববিজ্ঞানসম্মত সম্ভাব্য কয়েকটি ব্যাখার কথা তুলে ধরা হয়েছে। আর তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক দেখিয়েছেন মানুষের জেন্ডার আইডেন্টিটি শুধুই শারীরবৃত্তীয় নয়, আইডেন্টিটিবোধের আসল অবস্থান মস্তিষ্কে আর সেই পুরোটা ভাল করে বোঝার অভাবে কীভাবে জীবনে বিপর্যয় ঘনিয়ে আসে।
বাংলাভাষায় জনসাধারণের জন্য বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয় নিয়ে আলোচনা একেবারেই চোখে পড়ে না। সেই দিক দিয়ে সুদীপ্তর এই চেষ্টা খুবই প্রশংসার দাবী রাখে। আর সেই সঙ্গে বলতে হবে সুদীপ্তর সহজ করে বোঝানোর বিষয়টিও। সেই কাজটা দেখলে যতই সহজ মনে হোক, আসলে তো সেটা মোটেই সহজ না। এবং সেই বোঝানোর কাছে সুদীপ্ত যে ধরণের ঘটনার সাহায্যে তাদের ব্যাখ্যা করেছেন, তা পড়ার ইচ্ছে বাড়ায়।
তবে এই বইটি সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনার দিক দিয়ে একটু অগোছালো বলে মনে হয়েছে। তিনটে অধ্যায় মিলিয়ে কিছু তত্ত্ব, কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্বন্ধে জানা অবশ্যই একটা বড় পাওয়া, তবু একটা যেন পরিষ্কার ছবি ফুটে উঠল না। মানছি যে বিজ্ঞানের নিজের কাছেই ছবিটা এখনও পুরো পরিষ্কার নয়, এবং বিশেষত সমকামিতা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষার কিছু অসুবিধার কথা সুদীপ্ত নিজেই আলোচনা করেছেন, তবু একটা বই এর কাছে আরও খানিকটা সামগ্রিকতার, আরও কিছুটা পারিপাট্যের দাবী থাকে। বিশেষত দ্বিতীয় পরিচ্ছেদটি পড়তে গিয়ে বার বার আরও জানতে ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু বড়ই সংক্ষিপ্ত। বিশুদ্ধ জীবনবিজ্ঞানের গবেষণাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে অন্য যেসব বিষয়গুলো বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে, যেমন ধরা যাক পরিবেশগত প্রভাব বা সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যা ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি নিয়েও যদি আরও কিছু আলোচনা শোনা যেত! তাই ভবিষ্যতে আরও একটি বিশদ গ্রন্থের আশা রইল।