

অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন সত্তা তাজমহলের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে, ঠিক যেমন মুঘলদের ধমনীতে ছিল বেশ কয়েকটি জাতিপরিচয়ের সমন্বয়। তাজমহল যিনি তৈরি করিয়েছিলেন সেই বাদশা শাহজাহান তিন-চতুর্থাংশ রাজপুত আর এক চতুর্থাংশ তুর্কি। নেহাতই এদেশে কেউ মাতৃপরিচয়কে বংশপরিচয় বলে মানেনা। শাহজাহানও হয়তো মানতেন না, কিন্তু তাঁর মাতা এবং পিতামহী দুজনেই হিন্দু রাজপুত।
দেখা যাক তাজমহলের কী কী পরিচয় আছে- উপর থেকে নিচ অবধি-
- সবার উপরে আছে তমগা (মুঘল সাম্রজ্যের সীল)- তমগা হল ইসলামপূর্ব তুর্কো-মোঙ্গল সংস্কৃতির অঙ্গ। তবে এই তমগায় খোদাই করা আছে আল্লাহ।
- তার নিচে আছে চাঁদ- ইসলামের প্রতীক।
- তার নিচে তিনটি কলস, আমলক, উল্টোনো পদ্মফুল- হিন্দু শিল্পরীতির প্রভাব। হিন্দুমন্দিরের আমলক-কলস অনেকটাই বৌদ্ধস্তূপের ছত্র ও যষ্টির অনুকরণ।
- তার নিচে গম্বুজ- রোমান প্রযুক্তি- এসেছে ইরান মারফত।
- তার চারধারে ছত্রী- ভারতীয় সংযোজন- তাদের মাথায়ও কলস, আমলক, পদ্মফুল।
- তার নিচে যা আছে সেটা অনেকটাই ইরানের সফবীয় রাজবংশের শিল্পরীতির অনুপ্রেরণা। তবে মূল গম্বুজের চারিদিকে ছোট ছোট ছত্রী ইরানের শিল্পরীতিতে দেখা যায় না, এটি হিন্দু মন্দিরের উরুশৃঙ্গের ধারণার অনুকরণ হতে পারে।
- আছে ট্রু আর্চ ব্যবহার করে অনেকগুলি দরজা- আড়াই হাজার বছর পুরোনো রোমান প্রযুক্তি- এসেছে ইরান ঘুরে।
- প্রতিটা আর্চের উপরে আছে ইসলামিক ফ্লোরাল মোটিফ।
- মূল দরজাকে ঘিরে আরবি ভাষায় ক্যালিগ্রাফি- কুর'আনের পংক্তি।
- সবার নিচে তাজমহলের সামনে রয়েছে- চারবাগ- পারসিক স্বর্গোদ্যান।
তার নিচে আর কিছু নেই। কোনো মন্দিরের অবশেষের প্রমাণ কেউ পায়নি। আর রাজা জয়সিংহের কাছ থেকে জমিটা কেনা হয়েছিল চারটা হাভেলির বদলে - সেটাও কোনো রহস্যাবৃত জিনিস নয়। আর পাঁচটা জমি কেনাবেচার মত এটা নথিবদ্ধ আছে আব্দুল হামিদ কাদরির লেখা 'পাদশাহনামা' গ্রন্থে।
এই আমলক, কলস, উল্টোনো পদ্মফুল- হিন্দু শিল্পরীতির প্রভাবগুলো কিন্তু মুঘল আমলের অনেক আগে থেকেই ভারতীয় মুসলিম শিল্পে দেখা যায়। সৈয়দ ও লোদী বংশের সমাধিসৌধগুলোতে এদের দেখা পাওয়া যায়। বরং সেইযুগের কিছু হিন্দু প্রভাব, যেমন মকরতোরণ তাজমহলে নেই। মকরতোরণ হল দরজার উপরে দুদিকে মকরের মত দেখতে ভাস্কর্য যা হিন্দু মন্দিরে বহুপ্রচলিত।
ভারতীয় গম্বুজের সূচনা ত্রয়োদশ শতকে বলবনের সমাধির মাধ্যমে। প্রথমে অর্ধগোলক আকৃতি থেকে শুরু করে, ইউরোপীয় গম্বুজগুলি একটু সঙ্কুচিত হয়ে মোচার আকৃতি নেয়, কিন্তু ভারতীয় এবং রাশিয়ান গম্বুজগুলি তাদের মধ্যদেশকে কিছুটা স্ফীত করে পেঁয়াজের আকার ধারণ করে । হয়তো এই পেঁয়াজের আকারটা আসলে পদ্মের আকৃতি। মন্দিরের ছাদ থেকে ঝুলানো পাথরের বা পোড়ামাটির তৈরি উল্টানো পদ্ম এর অনুপ্রেরণা হতে পারে।
তাজমহলকে শুধু শাহজাহানের সৃষ্টি বললে এর সঙ্গে যুক্ত ডিজাইনার, আর্কিটেক্ট আর ইঞ্জিনিয়ারদের অবজ্ঞা করা হবে। তাঁদের ব্যাপারেও জানা যাক। সব মিলিয়ে ৩৭ জন ডিজাইনার এবং আর্কিটেক্টের নাম মুঘল সরকারি নথি থেকে পাওয়া যায় যাঁরা তাজমহলের প্রধান স্থপতিদের মধ্যে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন-
- ইসমাইল আফান্দি (ওরফে ইসমাইল খান) যিনি তুরস্কের অটোমান সম্রাটদের জন্য কাজ করতেন, তাজমহলের গম্বুজের ডিজাইনার ছিলেন। তবে পেয়াঁজ আকৃতির গম্বুজ তুরস্কে দেখা যায় না, অতএব বিভিন্ন স্থানীয় গম্বুজ যেমন এলাহাবাদের খুসরো বাগে অবস্থিত নিসার বেগমের মকবরা দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হয়ে থাকতে পারেন।
- লাহোরের উস্তাদ ইসা এবং পারস্যের ইসা মুহাম্মদ এফেন্দি: প্রধান আর্কিটেকচারাল ডিজাইনার
- কাজিম খান, লাহোরের একজন স্বর্ণকার যিনি তামগা কলস এগুলি নির্মাণ করেছিলেন;
- চিরঞ্জিলাল, দিল্লির একজন কারিগর, প্রধান মোজাইসিস্ট ছিলেন অর্থাৎ মোজাইকের কাজগুলো পরিচালনা করেছিলেন;
- ইরানের শিরাজের আমানত খান, মাস্টার ক্যালিগ্রাফার যার স্বাক্ষর তাজ গেটওয়েতে খোদাই করা আছে;
- মুলতানের মহম্মদ হানিফ ছিলেন প্রধান রাজমিস্ত্রি;
- ইরানের শিরাজের মুকরিমত খান এবং মীর আব্দুল করিম ছিলেন প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ও প্রশাসক।
আর ছিল কুড়ি হাজার অবধি শ্রমিক, যাদের বেশিরভাগই ভারতীয়, তবে উপমহাদেশের অনেক দূর প্রান্ত যেমন বেলুচিস্তান আর দক্ষিণ ভারত থেকে অনেককে আনা হয়েছিল। বেলুচিরা পাথর কাটার কাজ করত। আবার অনেক ক্যালিগ্রাফার এসেছিল দূর সিরিয়া থেকে। রাজদরবারের অনেক ইতালীয় শিল্পী তত্ত্বাবধান করেছিলেন পাথরের উপর যে ফ্লোরাল মোটিফ বানানো হয়েছিল তাদের। এর ফলে অনেক ইউরোপীয় জড়িবুটির গাছের মোটিফ এবং ইতালীয় মোটিফের প্রভাব তাজমহলে পাওয়া যায়।
মুঘল বংশলতিকায় ফেরা যাক। শাহজাহানের মা এবং পিতামহী উভয়েই রাজপুত পরিবার থেকে এসেছিলেন। আকবরকে একজন apostate (যে ইসলাম ত্যাগ করে) বলাই যায় কারণ তিনি নূতন ধর্ম দীন-ই-ইলাহী শুরু করেছিলেন, এবং এই অপরাধের জন্য আধুনিক সৌদি আরব বা ইরানের মতো অনেক গোঁড়া মুসলিম দেশে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে, অন্ততঃ একজন সাধারণ মানুষ ধর্মত্যাগী হলে! এমনকি শাসকদের ক্ষেত্রেও ধর্মত্যাগ মানে হল অভিজাতদের বিদ্রোহের মুখোমুখি হওয়া। সমসাময়িক ঐতিহাসিক বদাউনি আকবরকে সমালোচনা করেছিলেন প্রাসাদে তাঁর হিন্দু স্ত্রীদের সাথে হোম এবং অন্যান্য হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান করার জন্য। আকবর পেয়াঁজ রসুন আর গোমাংস খাওয়া বন্ধ করেছেন এমন দাবি করেছিলেন বদাউনি। অর্থাৎ সিনেমায় যে আমরা আকবরকে জন্মাষ্টমী পালন করতে দেখি তা আগাগোড়া কল্পনা নয়- তার যে কিছু ভিত্তি আছে সেটা সমসাময়িক ঐতিহাসিক বদাউনি কিছুটা সমালোচনার আকারে হলেও নথিবদ্ধ করে গেছেন।
জাহাঙ্গীরকে কিছু খ্রিস্টান মিশনারী নাস্তিক হিসাবে চিহ্নিত করেছিল তাঁকে ধর্মান্তরিত করার অনেক ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর। নাস্তিক না হলেও যুক্তিবাদীর দলে হয়তো তাঁকে রাখা যায়। মুসলিম রাজাদের মূর্তিশিল্পহীন জগতে তিনি এমন এক ব্যক্তি যিনি মানবরূপের চিত্রাঙ্কনের বহুল পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। ইউরোপীয় শৈলীর চিত্রকলা তাঁর প্রিয় ছিল। চিত্রকলার দুর্দান্ত সংগ্রহ তাঁর কাছে ছিল, যা গোঁড়া মুসলিম মানদণ্ড অনুসারে অপরাধ। তাঁর নির্দয়তাও প্রায় সব ধর্মের মানুষের দিকে একই পরিমাণে লক্ষিত হয়।
মুঘল রাজপুত্র এবং তাদের স্ত্রীদের সাধারনত প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নাম পরিবর্তন করা হত। এমন নামকরণ হত যাতে প্রতিফলিত হয় যে তারা "বিশ্ব" শাসন করছে। তাই জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, আলমগীর প্রভৃতি নাম। আকবর যখন তাঁর প্রধান হিন্দু স্ত্রীর জন্য একটি মুসলিম নাম বেছে নিয়েছিলেন, সেটি ছিল মরিয়ম-উজ-জামানি (সমসাময়িক বিশ্বের মাতা মেরি)। জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় স্ত্রী মানবতীকে একটি অনুরূপ নাম দেওয়া হয়েছিল তবে নূতন নামটিও হিন্দু নামই ছিল - জগৎগোঁসাই (বিশ্বের গোস্বামী)। তিনি ছিলেন জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী এবং শাহজাহানের মা। জাহাঙ্গীরের প্রথম তিনজন স্ত্রী ছিলেন সবাই হিন্দু।
সুতরাং তুর্কি পিতৃক্রম, হিন্দু মাতৃক্রম, ইসলামিক বিশ্বাস, পারস্যের ভাষা, ভারত ও ইরানের স্থপতিদের অবদান, এবং সবচেয়ে বড় কথা ভারতীয় সাংস্কৃতিক পরিচয়- সবই মুঘল শিল্প ও সংস্কৃতিতে একত্রিত হয়েছিল। তাই তাজমহলে আলাদা করে কোনো লুকিয়ে থাকা হিন্দু ইতিহাস খোঁজাটা হাস্যকর। যা আছে দৃশ্যমানভাবেই আছে।
dc | 2401:4900:1cd1:80c4:89a6:fd66:2d5c:***:*** | ১৬ জুন ২০২২ ০৭:১৯509052
বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায় | 103.102.***.*** | ১৮ জুন ২০২২ ১৫:১৬509138
কৌশিক সরকার | 2409:4061:400:d7b3::101d:***:*** | ১৮ জুন ২০২২ ১৫:২৬509139
কৃশানু নস্কর | 2405:201:8007:8063:1808:3260:f3b5:***:*** | ১৮ জুন ২০২২ ২২:০৬509147
Ujjal Saha | 117.226.***.*** | ১৮ জুন ২০২২ ২২:১৯509148