ইদানীং সুপ্রিম কোর্টের একটি বক্তব্য নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত নাকি পুলিশ প্রশাসনকে বলেছে ভারতে যৌনকর্মীদের সঙ্গে সম্মান দিয়ে কথা বলতে, মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার করতে, কথায় কথায় ওদের টানা হ্যাঁচড়া করে অপদস্থ না করতে। ওরা একটি পেশায় রয়েছে, কোন অপরাধ তো করেনি। আর নিজের পছন্দমত জীবিকা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত। তাহলে?
আমরা এ নিয়ে উলুত পুলুত। কেন? ওই বক্তব্যের থেকে আমরা মানে করেছি যে ভারতে আদিম জীবিকাটি বেআইনি নয়। ব্যস, আমরা এখন মাসের প্রথমে মাইনেটা হাতে এলেই বুক ফুলিয়ে হানা দেব হাড়কাটা গলি, সোনাগাছি, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে, গড়িয়ার পুলের নীচে—ঠিকানা ও ঠেক কি কিছু কম পড়িয়াছে?
ঠিক এমনই ভাবে আমরা লাফালাফি করেছিলেম আগস্ট ২০১৯শে, যখন ভারত সরকার কলমের এক খোঁচায় ধারা ৩৭০ বাতিল করে দিলেন। তখন জনৈক সাংসদের মুখে অনেকের সুপ্ত ইচ্ছার প্রতিধ্বনি শোনা গেছলঃ এবার আমরা অনায়াসে কাশ্মীর সুন্দরীদের বিয়ে করতে পারবো!
খেয়াল করুন, কোথাও কাশ্মীর সুন্দরীদের বিয়ে করে ঘরে তোলা এবং মনের আনন্দে বুক ফুলিয়ে বারমুখো হওয়া দুটোর মধ্যে একই সুপ্ত ইচ্ছে কাজ করছে— মন নয়, শরীরের দখল নেওয়া। কাশ্মীরিদের মন জয়ের বদলে জমির দখল চাই, তেমনই পয়সা দিয়ে নারী শরীরের দখল চাই। দরকার শুধু আইনের সমর্থন, ব্যস।
এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় পরে আসছি। আগে দেখা যাক মূল দুটো ইস্যু।
এক, সুপ্রিম কোর্ট ঠিক কী বলেছে? দুই, সুপ্রাচীন জীবিকাটি ভারতে সত্যিই বে-আইনি কিনা।
সুপ্রিম কোর্ট কী বলেছে?
প্রথমেই এটা স্পষ্ট করে বলা দরকার যে সুপ্রিম কোর্ট কোন আইন পাশ করেনি, কোন আইনে সংশোধনও করেনি। তাহলে করেছেটা কী?
গত মাসের ১৯ তারিখে শুনানির সময় বিচারপতি এলো নাগেশ্বর রাও এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ অভিমত প্রকাশ করেছে যে যৌনকর্মীর কাজটাও একটি ‘পেশা’ (‘profession’), কাজেই তাঁরা পেশাগত ব্যাপারে অন্যদের সমান আইনি সুরক্ষা ও সম্মান পাওয়ার অধিকারী। তাঁদের বক্তব্যঃ যদি যৌনকর্মীরা এবং তাঁদের খদ্দের, দু’জনেই প্রাপ্তবয়স্ক হন এবং বিনা জোর জবরদস্তি স্বেচ্ছায় মিলিত হন তাহলে পুলিশ যেন অকারণ হস্তক্ষেপ না করে এবং পেনাল কোড না লাগায়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ অনুযায়ী, সবাই- -পেশা যেমনই হোক—মর্যাদাসম্পন্ন জীবন যাপনের অধিকার রাখে। কাজেই বেশ্যালয় (brothel) খানা তল্লাসি করার সময় যৌনকর্মীদের গ্রেফতার করা, শাস্তি দেওয়া, উৎপীড়ন করা এবং দোষী বানিয়ে দেওয়া চলবে না। কারণ আইনে স্বেচ্ছায় পেশাগত যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া কোন অপরাধ নয়, বেশ্যা-গৃহ চালানোটা অপরাধ।
পুলিশকে বিশেষ সতর্ক এবং সজাগ থাকতে হবে যাতে বেশ্যা-গৃহে তল্লাসি চালানোর সময় বা সেখান থেকে কাউকে গ্রেফতার বা উদ্ধারের সময় যেন যৌনকর্মীদের, অভিযোগকারী বা অভিযুক্ত যাই হোন, পরিচয় প্রকাশিত না হয়। তাঁদের কোন ফোটো যেন ছাপা বা টেলিকাস্ট করা না হয়। বিচারপতি রাও এ’ব্যাপারে মিডিয়াকেও সংবেদনশীল হতে বলেছেন। এটাও বলেছেন যে কোন যৌনকর্মীকে যেন তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংশোধনাগার বা আশ্রয় গৃহে আটকে রাখা না হয়। মা যৌনকর্মী বলে তাঁদের সন্তানদের যেন জোর করে মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন না করা হয়। এছাড়া সরকারের দায়িত্ব যৌনকর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।
বিচারপতি-ত্রয় (নাগেশ্বর রাও, গবই এবং বোপন্না) এভাবে পুলিশের জন্য গাইডলাইন জারী করে কেন্দ্র সরকারকে নোটিস পাঠিয়েছেন এবং ২৭ জুলাই, ২০২২ নাগাদ, অর্থাৎ পরবর্তী শুনানির দিন, এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে বলেছেন।
এই রায় দুটি কাজ করল।
এক, যৌনকর্মীদের সংবিধান সম্মত অধিকারের ব্যাপারে আমাদের সচেতন করাল। হ্যাঁ, আমরা মনে করি যৌনকর্মীদের কাজ কর্ম অনৈতিক, অতএব ওদের কোন সামাজিক মর্যাদা এবং আইনে সমান ব্যবহার পাওয়ার অধিকার থাকতে পারেনা। তাই তারা কোন অভিযোগ করলে ও তো বেশ্যা বললেই তার সঙ্গে যেমন ইচ্ছে ব্যবহার করা যায়। চুল কেটে মুখে কালি মাখিয়ে রাস্তায় ঘোরানো যায়, পাড়াছাড়া করা যায় এবং প্রকাশ্যে জুতোপেটা করা যায়। এককথায়, তাদের সুরক্ষা কেড়ে নেয়া যায়।
ঠিক যেমন অনেকে মনে করেন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত আসামীর জেলের মধ্যে কোন মৌলিক অধিকার থাকতে পারেনা।
দুই, সর্বোচ্চ আদালতের এই পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে এবং স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত রাজনৈতিক দলকে এই আইনি এবং নৈতিক প্রশ্নে তাদের নিজস্ব অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করল। মুম্বাইয়ের কামাঠিপুরা লালবাতি এলাকার গঙ্গুবাঈ হরজীবনদাস নামের বিখ্যাত সামাজিক কার্যকর্ত্রীর জীবন অবলম্বনে নির্মিত ‘গঙ্গুবাঈ কাথিয়াওয়াড়ি’ নামের বাণিজ্যিক সিনেমাটি একটি প্রশ্ন তুলেছে—কেন যৌনকর্মীর পেশাকে অন্য যে কোন পেশার সমতুল্য মনে করা হয় না?
সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের সদস্যীয় বেঞ্চের পুলিশের উদ্দেশে জারী করা এই আচরণবিধি যেন এরই জবাব।
ভারতে যৌনকর্মীর পেশা কি বে-আইনি?
এর উত্তর আমার মতে একইধারে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। কোন আইনে বেশ্যাবৃত্তিকে অবৈধ বলা হয় নি। আবার এই পেশার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত আনুষঙ্গিক কাজকর্মকে বে-আইনি বলা আছে। যেন গান গাইতে মানা নেই, কিন্তু তবলা সঙ্গতে, মাইকের সামনে গাইতে এবং রেওয়াজ করতে আপত্তি।
উত্তর যখন সোজাসুজি ‘না’ নয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে তবে কেন ধরপাকড়? কেন লুকিয়ে চুরিয়ে এই পেশার কারবার? একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।
বিশ্বে কিছু দেশ এই পেশাকে খোলাখুলি আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে যেমন—নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া নেদারল্যান্ড ইত্যাদি। কিছু দেশ একেবারে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে যেমন কেনিয়া, মরক্কো, আফগানিস্তান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি ফেডারাল কানুন নয়, রাজ্যের আইনের আওতায় পড়ে। সামান্যতঃ নেভাডা ছাড়া কোন রাজ্যে এই পেশাটি বৈধ নয়। তবে আটটি রাজ্যে আংশিক বা শর্তাধীন স্বীকৃতি আছে।
আবার কিছু দেশের অবস্থান হল ধরি- মাছ- না- ছুঁই -পানি গোছের। এরা পেশাটিকে বে-আইনি বলেনি কিন্তু এমন সব বেয়াড়া শর্ত রেখেছে যে মুশকিলের অন্ত নেই। ভারত এই তৃতীয় দলে।
ভারতীয় দণ্ডবিধির কোন ধারাতেই দু’জন প্রাপ্তবয়স্কের পারস্পরিক যৌনমিলন নিষিদ্ধ নয়। এমনকি অর্থের বিনিময়ে হলেও। কিন্তু এ’ব্যাপারের একটিই আইন আছে— THE IMMORAL TRAFFIC (PREVENTION) ACT, (1956). তার কোন ধারাতেই পেশাটিকে দণ্ডনীয় বলা হয়নি বটে, কিন্তু এমন সব শর্ত রাখা হয়েছে যে খোলা মনে এই পেশায় নিযুক্ত হওয়া মুশকিল। কী সেই শর্তগুলি?
ইমমর্যাল ট্র্যাফিক অ্যাক্ট
বেশ্যাবৃত্তি কী? যৌন শোষণ অথবা ব্যবসায়ের জন্য কারও সঙ্গে অসদ্ব্যবহার (ধারা ২ফ)। দেখতেই পাচ্ছেন, কেমন ভিক্টোরীয় লজ্জা লজ্জা গোছের সংজ্ঞা। এমন ‘ব্রড’ ডেফিনেশন হলে পুলিশ ইচ্ছেমত অনেক কিছুকেই দণ্ডের আওতায় ফেলতে পারে।
এই আইনে বলা হয়েছে যে আইন মেনে দেহব্যবসা চালাতে মানা নেই কিন্তু আইনের কিছু শর্ত মানতে হবে, তবেই না! যেমন,
• বেশ্যা-গৃহ চালানো বা ভাড়া দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ (ধারা-৩)। আর বেশ্যা-গৃহ মানে ওই কাজটি করা হয় এমন কোন বাড়ি, ঘর বা জায়গা। মানে পার্কও হতে পারে।
• বেশ্যাবৃত্তির পয়সায় বসে খাওয়া অপরাধ, তাতে পরিবারের লোকজন বুড়ো বাপ-মা কাউকেই ছাড় দেয়া হয়নি। (ধারা-৪)
• বেশ্যাবৃত্তির জন্য কাউকে ফুসলানো, ফুসলে আনা, সাপ্লাই দেওয়া শাস্তিযোগ্য ( ধারা-৫)। এর লক্ষ্য বাড়িওয়ালী, দালাল এবং কুটনি ।
• বেশ্যাবৃত্তির জন্য কাউকে কোন বাড়ি বা ঘরে আটকে রাখা অপরাধ (ধারা-৬)। এর উদ্দিষ্ট বাড়িওয়ালী ও দালালেরা।
• ‘পাবলিক প্লেসে’ বেশ্যাবৃত্তি শাস্তি যোগ্য। পাবলিক প্লেস বলতে বোঝাবে ঘনবসতির লোকালয়, স্কুল, হাসপাতাল, নার্সিং হোম, হোস্টেল, ধর্মস্থান এবং পুলিশ কমিশনার, জেলা বা রাজ্য প্রশাসন দ্বারা বিজ্ঞাপিত এলাকা। যৌনকর্মীকে এখান থেকে ২০০ মিটার দূরে দাঁড়াতে হবে ( ধারা -৭)।
• যৌনকর্মীরও নিস্তার নেই। ও কাউকে এই কাজের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারবে না। চোখের ইশারা, হাতছানি অথবা ‘যাবেন নাকি’ বলা –সবই শাস্তি যোগ্য (ধারা-৮)।
শেষ দুটো ধারা মন দিয়ে দেখলেই বোঝা যায় কেন এই কর্মটি গোপনে চলে, কেন পুলিশ এই ব্যবসা থেকে তোলাবাজি করতে পারে।
খদ্দেরের দিক থেকে ভাবলে আপনি কোন পাবলিক প্লেসের থেকে ২০০ মিটার দূরে কেন যাবেন? ছিনতাইয়ের ভয় নেই? কী করে বুঝবেন কে যৌনকর্মী? ভুলভাল প্রপোজ করে মার খাবেন?
যৌনকর্মীর দিক থেকে ভাবলে—কী করে সে কোন সম্ভাব্য খদ্দেরকে বেছে নেবে? ডেকে আনবে? নিয়ে যাবে কোথায়? অন্ধকারে? নিজের বাড়িতে? বাড়ি ভর্তি লোকজন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে মেয়ে কোন অফিসে চাকরি করে আমাদের ভাত যোগাচ্ছে।
এছাড়া এই পিতৃতান্ত্রিক আইনটি ভীষণভাবে নারী-বিদ্বেষী। উক্ত ধারা দুটো ভাঙলে নারীর যে শাস্তি হবে, পুরুষটির শাস্তি হবে তার অর্ধেক। কেন? সেই ‘নারী নরকের দ্বার’?
গোমাংস নিষিদ্ধ করার আইনের সঙ্গে তুলনা
ভারতে কিন্তু গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ নয়। চমকে যাবেন না। উত্তর, মধ্য এবং পশ্চিম ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে যে আইন আছে তাহলো গোহত্যা নিষিদ্ধ, গোধন হত্যার উদ্দেশ্যে কেনা-বেচা-রপ্তানি নিষিদ্ধ। অর্থাৎ দুধেল গাই যদি গোয়ালারা কেনে বা বেচে এবং হালের বলদ যদি লাঙল দেবার জন্যে কেউ বেচাকেনা করে তাতে আপত্তি নেই। এবং মোষের মাংসে আপত্তি নেই। কেরল, বঙ্গ , তামিলনাড়ু, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয় এবং গোয়ায় এ’নিয়ে কোন নিষেধ নেই।
আর গোমাংস ভক্ষণ ভারতের কোন রাজ্যেই আইনতঃ নিষিদ্ধ নয়। শুধু গোহত্যায় আপত্তি!
কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? দাদরির আখলাকই বলুন অথবা অমুক পাড়ার তমুক। ওরা যতই অস্বীকার করুক যে ওরা গোমাংস খায় নি,মোষের মাংস খেয়েছে—প্রমাণ করতে পেরেছে? কোর্টে কেস চলবে, ঢিমে তেতালায়। তার আগে তো সন্দেহের চোটে মার খেয়ে মরে ভূত! তেমনই কোন মেয়েকে যদি পুলিশ ধরে বলে যে তার সঙ্গে কাস্টমার ছিল মানেই সে আগে ইশারা করে ডেকেছে, তাও চৌরঙ্গীর কাছে বাস স্টপেজে –সে কী করে নিজেকে ডিফেন্ড করবে?
এ হল মার্চেন্ট অফ ভেনিসের প্যাঁচ—এক পাউন্ড মাংস কেটে নাও আইন মেনে, কিন্তু খবর্দার! এক ফোঁটা রক্ত যেন না বেরোয়। তেমনি যদি মাংস কাটা নিষিদ্ধ, পশু কেনা বেচা নিষিদ্ধ—তাহলে খাওয়ার মাংস জুটবে কী করে? একইভাবে, যৌনকর্মীর পক্ষে কাস্টমারকে ইশারায় ডাকাও চলবে না, তবে তিনি নাকি আইন মেনে পেট চালাতে পারেন।
কাজেই অতি উৎসাহীদের বলি--সাধু সাবধান!
সুপ্রিম কোর্টের উক্ত নির্দেশিকা তাহলে বিশেষ কী করল?
বর্তমান ভারতে যৌনকর্মীর সংখ্যা আনুমানিক ৩ মিলিয়ন যার অধিকাংশই হচ্ছে ১৫-৩৫ বছর বয়েসের। দেখাই যাচ্ছে এঁদের স্বাভাবিক সম্মানের জীবনে ফিরিয়ে আনা এবং শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষা প্রদান করার জন্যে ওই ক’টি নির্দেশ যথেষ্ট নয়।
কারণ, আইনের ধারাগুলো মহিলাকে পাবলিক প্লেসের ২০০ মিটার দূরে ঠেলে দিয়ে এবং কাউকে আমন্ত্রণ জানানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তাঁদের যথেষ্ট অপমানিত করেছে এবং মুখ্য জীবনধারার সীমানার বাইরে স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। দরকার ওই পিতৃতান্ত্রিক কলোনিয়াল আইনের জায়গায় একটি সুস্পষ্ট নতুন আইন।
আরও প্রশ্ন রয়েছে।
সোনাগাছিতে একজন যৌনকর্মীকে দেয়াল বারবার মাথা ঠুকে হত্যার অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত বুদ্ধদেব কার্মাসকার সুপ্রিম কোর্টে আপীল করে। বিগত ২ অগাস্ট, ২০১১ তারিখে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বুদ্ধদেব কারমাস্করের আপীল( নং ১৩৫/২০১০) খারিজ করে বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু বলেন – যৌনকর্মীরা অপরাধী নয়, তারা মুখ্যতঃ দারিদ্র্য জনিত পরিস্থিতির শিকার। তাদের আর্টিকল ২১ ( রাইট টু লাইফ) অনুযায়ী সুরক্ষা পাবার সমান অধিকার রয়েছে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের কর্তব্য তাদের রক্ষা করা এবং অন্য পেশায় ট্রেনিং দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। একজন যৌনকর্মীরও দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে সমস্ত মৌলিক অধিকার আছে।
বিগত ২০১১ সালে গঠিত একটি প্যানেল তাদের রেকমেন্ডেশনে বলেছিল যে যৌনকর্মীদের এবং পারস্পরিক সম্মতিতে যৌনকর্মে লিপ্ত প্রাপ্তবয়স্কদের যেন অপরাধী হিসেবে গণ্য না করা হয় এবং শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
উপরোক্ত প্যানেলের পরামর্শের কথা মাথায় রেখে আমাদের সর্বোচ্চ আদালত গত ১৯শে মে সংবিধানের আর্টিকল ১৪২ এর থেকে প্রাপ্ত অধিকারের প্রয়োগ করে উপরোক্ত নির্দেশিকা জারি করেছে। এর উদ্দেশ্য পুলিশ তন্ত্রকে যৌনকর্মীদের সঙ্গে দৈনন্দিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ সংবেদনশীল করে তোলা এবং সরকারকে একটি নতুন যুক্তিযুক্ত মানবিক আইন প্রণয়নে প্রেরিত করা।
সেই অর্থে এটি যৌনকর্মীদের সম্মান ও মর্যাদা প্রাপ্তির দিকে স্বাধীন ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম পদক্ষেপ।
উপসংহার
আমার মনে হয় আসল গণ্ডগোল আমাদের মানসজগতে যা শুধু আইন করে বদলানো যাবে না। আমরা এখনও মেয়েদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের কথা মন থেকে স্বীকার করি না। কোন মহিলাকে মাতৃ অথবা ভগিনী হতেই হবে। নতুন কাউকে পরিচয় করিয়ে দিই—অমুকের মা, তমুকের বোন, তমুকের মেয়ে বা মিঃ অমুকের মিসেজ বলে। কাজেই তাকে দখল করতে চাই, বিশেষ করে তার শরীরকে। তার নিজস্ব অনুভূতি বা মতের ধার ধারিনে। ফলে তাদের নিজের পছন্দমত জীবিকা বেছেছে নেওয়ার অধিকার মন থেকে মেনে নিতে পারি নে। তাই তাদের সুরক্ষার কথা ভাবি কিন্তু সোজাসুজি আইন করে যৌনকর্মীর পেশাকে বৈধতার মর্যাদা দিতে কোথায় যেন বাধে। আবার ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ব্যাপারটার অস্তিত্বই স্বীকার করতে চাই না।
সুপ্রিম কোর্টের মার্গ-দর্শিকা সত্ত্বেও যে ইকো-সিস্টেমে ভারতে যৌনকর্মীদের কাজ চালিয়ে যেতে হয় তাতে হাতে গরম সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়।