এখন একথা প্রায় প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, এই পরিকল্পনা অনেকদিনের। দীর্ঘদিন ধরেই তা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চলছিল। আজ তার প্রকাশ্য রূপ দেখা যাচ্ছে। শিলচর শহর থেকে বেরোলে সামান্য দূরেই যে ইস্ট-ওয়েস্ট করিডোর (জাতীয় মহাসড়ক), তার দু’ধারের জমির দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে এবং সেগুলি অধিকাংশই অবাঙালি ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত। পরিকল্পনা অনেকদিন ধরেই চলছে। এমনকি ডলু চা বাগানে শোনা যাচ্ছে গত বছরের শেষ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। এই পরিকল্পনার অংশীদার জাতীয় রাজনীতির বড় বড় খেলোয়াড়েরা। যে কারণে মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছে রাজ্য প্রশাসন, বাগানের মালিক পক্ষ এবং শ্রমিকদের তিনটি ইউনিয়নের মধ্যে (জাতীয় কংগ্রেস, সিপিআইএম এবং বিজেপির শ্রমিক ইউনিয়ন)। এই চুক্তিপত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল মন্ত্রগুপ্তির শপথ, গোপনীয়তা। পরবর্তী সময়ে চুক্তি সম্পর্কিত অসংখ্য প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ায় প্রশাসন বাধ্য হয় চুক্তিপত্রটি প্রকাশ করতে, যেখানে এখনও জ্বলজ্বল করছে গোপনীয়তা রক্ষার শর্তটি। শ্রমিকের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন যেখানে জড়িত, সেই চুক্তি গোপন হবে কেন? আর শ্রমিকদের ইউনিয়ন তা নতমস্তকে মেনে নেবে কেন? তা অবশ্য রহস্যাবৃতই থেকে গেল।
স্থানীয় পত্রপত্রিকাগুলো (বরাক-বুলেটিন ইত্যাদি) এই মৌ-এর শর্ত আলোচনায় কতগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। যেমন মৌ-তে বলা হয়েছে যে, রাজ্য সরকারের একদল আধিকারিকের সঙ্গে এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়ার একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জমির উপযুক্ততা খতিয়ে দেখে এই জমিটিকেই সর্বপেক্ষা উপযুক্ত বলে পছন্দ করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যেহেতু এই নির্মাণ কাজের জন্য ত্রিশ লক্ষ চারাগাছ এবং ২৫০০ বিঘা উর্বরা জমি ধ্বংস করে ফেলা হবে, সে ক্ষেত্রে কাছাড় জেলার অন্য আর কোন কোন জমি এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়াকে দেখানো হয়েছিল যা এই মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম অনুপযুক্ত বলে বাতিল করেছে? সেগুলির সম্বন্ধে মৌ-তে কোনো উল্লেখ নেই কেন? দ্বিতীয়তঃ করিমগঞ্জ বা হাইলাকান্দি জেলার কোন জমি কি এই কাজের জন্য উপযুক্ত কি না তা যাচাইয়ের জন্য দেখানো হয়েছিল? শিলচর সংসদ ক্ষেত্রের বাইরে কোনও জমি কি দেখানো হয়েছিল? বরাক উপত্যকার অন্য দুটি জেলা, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি, সবসময়ই সমস্ত ব্যাপারে উপেক্ষিত। মেডিকেল কলেজ, এয়ারপোর্ট, টার্মিনাল স্টেশন, এনআইটি, ইউনিভার্সিটি, আকাশবাণী, দূরদর্শন সমস্ত কিছুই শিলচরে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো প্রশ্ন তুলছে যে, প্রথম থেকেই কি সবুজক্ষেত্র বিমানবন্দরের জন্য ডলু বাগানকে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছিল?
ডলু ছিল একটি চালু এবং লাভজনক চা-বাগান। সেই বাগানের এক বিশাল অংশ অধিগ্রহণের জন্য রাজ্য সরকার কোম্পানিকে কত টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেবেন তার কোনো উল্লেখ গোটা চুক্তিপত্রে নেই। এমনকি শ্রমিকদের যে ক্ষতিপূরণের কথা উঠেছে, তাও শুধুমাত্র কোম্পানির বকেয়া পিএফ এবং গ্র্যাচুয়িটি টাকা জমা দেওয়া বা ফেরত দেওয়া প্রসঙ্গে সীমাবদ্ধ। প্রশ্ন হচ্ছে, একটি চালু এবং লাভজনক চা বাগানে বহু শ্রমিককে কর্মহীন করে দিয়ে যে অধিগ্রহণ, তার জন্য শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ পাবে না? এই চুক্তিপত্রে লেখা আছে, শ্রমিকরা তাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে টাকা পাবে তা হল, মালিকপক্ষ বেআইনিভাবে এতদিন যে সব শ্রমিকের বহু টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ড হিসেবে কেটে নেওয়ার পরেও সেই টাকা এবং কোম্পানির দেয় সমপরিমাণ টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ড অফিসে জমা না করে যে যে বেআইনি কাজ করে এসেছে, রাজ্যসরকার সেই টাকাই মালিকের হয়ে পরিশোধ করছে, এবং তা ক্ষতিপূরণ হিসেবে চালাতে চাইছে। বলা আছে, ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির ১৫ দিনের মধ্যে কোম্পানি সে টাকা জমা দেবে। এবং ভবিষ্যতে আর কোনও পিএফ বা গ্র্যাচুইটির টাকা বাকি রাখবে না। প্রশ্ন হল, এতদিন শ্রমিকদের বেতন থেকে কেটে নেওয়া টাকা জমা পড়েনি কেন? প্রাপ্য টাকা ক্ষতিপূরণ ধরা হবে কেন? মৃত অথবা অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকের গ্রাচুয়িটিও তো প্রাপ্য। সেটা ক্ষতিপূরণ? মৌ-তে বলা হয়েছে, যে, শ্রমিকদের লিখিত আবেদন করতে হবে এবং কোম্পানি সেই আবেদন খতিয়ে দেখে জেনুইন বুঝলে তবেই, রাজ্য সরকারের দেয় ক্ষতিপূরণ পাবার এক মাসের মধ্যে সেই টাকা শ্রমিকদের ফেরত দেবে। আসলে চা-শ্রমিকদের জীবন এবং জীবিকাকে এইভাবেই মালিকপক্ষের বেআইনি কাজ মেনে নিতে অভ্যস্ত করা হয় এবং ইউনিয়নগুলি তাতে মদত যোগায়। আজ যখন কোম্পানির মালিক একটি অকথিত অংকের টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পাবে, সেই টাকা থেকে তারা শুধুমাত্র শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা মিটিয়ে দেবে এটুকুই চুক্তিতে লেখা হয়েছে। ইউনিয়নগুলির উপর নির্ভরশীল চা-শ্রমিকরা, মালিকপক্ষের অর্থনৈতিকভাবে অনৈতিক কার্যকলাপে অভ্যস্ত হয়ে পড়া চা-শ্রমিকরা, সেই শর্ত গুলি মেনে নিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। না মানলেই তারা উন্নয়নবিরোধী অথবা মাওবাদী?
আবারও বলছি, চুক্তিপত্রের কোথাও ক্ষতিপূরণের অঙ্ক বলা নেই। অনিচ্ছুক শ্রমিকদের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণের টাকা ধরা হয়েছে কিনা, হলে তার পরিমাণ কত – সেটা বলা হয়নি। কোম্পানি ইউনিয়নগুলিকে আশ্বস্ত করেছে, যে, জমির পরিমাণ কমে যাওয়া সত্ত্বেও কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই করা হবে না। কোথাও বলা নেই – এই চুক্তিটি, এই আশ্বাস – কত সময়ের জন্য বলবৎ থাকবে। আইনে কোম্পানিগুলিকে অধিকার দেওয়া হয়েছে অপ্রয়োজনীয় শ্রমিকদের ছাঁটাই করার। অনতিদূর ভবিষ্যতে কোম্পানি যে তার এই অধিকার প্রয়োগ করে শ্রমিক ছাঁটাই করবে না – তার গ্যারান্টি কী? এবং তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এই ধারাটিকে এই রকম শূন্যগর্ভ অর্থহীন শব্দ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কেন? চুক্তিতে ৩(সি) ধারায় বলা হয়েছে যে অনেক শ্রমিককে বাগানের নতুন এলাকায় উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা হবে। এই অনেক বলতে কত? কোথাও বলা নেই। কোম্পানি তার নিজের প্রয়োজন অনুসারে ‘অনেক’ শব্দটির ব্যাখ্যা করতে পারে। বলা আছে যে অনেক নতুন চা-গাছ পোঁতা হবে। কত চা-গাছ পোঁতা হবে, কোন সময়ের মধ্যে এবং কতটা জমিতে – সে সবই অনির্দিষ্ট। সেই জমি ৭-৮ বছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ চা-বাগানে পরিণত হবে। কিন্তু ততদিন উদ্বৃত্ত শ্রমিকদের বসিয়ে খাওয়ানো হবে? ইউনিয়নগুলিকে কোম্পানি আশ্বস্ত করেছে, যে, কোম্পানি শ্রমিকদের থাকার জায়গা যাতায়াত ইত্যাদিতে অনেক টাকা বিনিয়োগ করবে। প্রথমত, সেই প্রশ্ন কোনো ইউনিয়ন তোলেনি যে, এতদিন এই বিনিয়োগ হয়নি কেন? এই নতুন বিনিয়োগের পরিমাণ কত? এবং টাইমফ্রেম কী? কোথাও কিছু বলা নেই। ৩(আই) ধারায় বলা হয়েছে যে ডলু বাগানের অন্তর্ভুক্ত ময়নাগড় সাব ডিভিশনের শ্রমিকদের অন্যান্য ডিভিশন-এর মধ্যে অ্যাবজর্ব করে নেওয়া হবে। প্রশ্ন হল, যাদের অ্যাবজর্ব করা হবে, তাদের কোন পোস্টে এবং কী কাজে ব্যবহার করা হবে, সেটা কে ঠিক করবে? সেক্ষেত্রে তাদের মজুরি ও কি একই থাকবে, না যে কাজে তাদের লাগানো হবে সেই কাজ অনুসারে তার মজুরি পরিবর্তিত হবে? ৩(জে) ধারায় বলা হয়েছে, যে, কোম্পানি আশ্বস্ত করেছে লালবাগ সাব-ডিভিশন এর শ্রমিকদের জন্য নতুন ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরি করা হবে। কিন্তু যেহেতু এই চা-বাগান উপড়ে ফেলার সময় ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে যতদিন না নতুন ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরি হবে, ততদিন পর্যন্ত লালবাগের চা শ্রমিকরা কোন জল পান করবেন? কোম্পানি ইউনিয়নকে আশ্বাস দেয়, যে তারা চা-বাগানের ইনফ্রাস্ট্রাকচারের উন্নয়নে বিনিয়োগ করবে – যেমন লেবার কোয়ার্টার, আভ্যন্তরীণ রাস্তা, পানীয় জল ইত্যাদি। কোম্পানি কিছু আনুষঙ্গিক উন্নয়নমূলক কাজেও বিনিয়োগ করবে – যেমন হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স প্রদান, ফুটবল মাঠের পুনর্গঠন। ইউনিয়নের অনুরোধ অনুযায়ী স্থানীয় স্কুল ইত্যাদির জন্য জমি এবং কিছু সাহায্যও করবে। কোম্পানি, ইউনিয়নকে এই আশ্বাসও দেয়, যে তারা নতুন মেশিন স্থাপন, পুরোনো মেশিন আপগ্রেড করা – ইত্যাদির মাধ্যমে এস্টেটের প্রক্রিয়াকরণ এবং পরিকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগ করবে। কোম্পানি আশ্বাস দেয়, যে এটি লালবাগ বিভাগ থেকে শ্রমিকদের জন্য সড়ক তৈরি করবে, যাতে তারা কাজের জায়গায় সুবিধামত যাতায়াত করতে পারে। কোম্পানি ইউনিয়নকে এই আশ্বাসও দিচ্ছে – ২২.০৮.২০০৩ সালের সরকারি নোটিফিকেশন নং জিএলআর(আরসি) ৪১/৯৬/১৭১ অনুসারে ধীরে ধীরে শ্রমিক কোয়ার্টারের সব কাঁচা ঘর পাকা করে দেবে অর্থাৎ বছরে ৮ শতাংশ হারে আবাসিক শ্রমিকদের প্রতি বছর সিজিআই ছাদের শিট প্রদান করে ৮০টি বাড়িতে লেবার কোয়ার্টার মেরামতের কাজ করাবে। তবে একবার একটি কাঁচা বাড়িতে সিজিআই ছাদের শিট দেওয়া হলে, কোম্পানি পরবর্তী ৫ বছর একই বাড়ির মেরামতের জন্য কোনো অর্থ ব্যয় করবে না। হোক আর না হোক, একথাও স্পষ্ট – এতদিন জীবন ও জীবিকা নির্বাহের এই ন্যূনতম কাজগুলিও এই কোম্পানি করেনি। কোনও চা-বাগান মালিকই করে না। মুনাফা যেখানে প্রধান, সেখানে শোষণই চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
গোটা চুক্তিপত্রটি কতগুলি অনির্দিষ্ট ফাঁকা বুলি দিয়ে সাজানো হয়েছে। কোনো প্রতিশ্রুতির কোনো আইনগত প্রভিশন নেই, কোনো টাইম-ফ্রেম নেই। সমস্ত দায়িত্বটাই ন্যস্ত করা হয়েছে কোম্পানির সদিচ্ছার ওপর। সরকারের দায়িত্ব শুধুমাত্র কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনিচ্ছুক শ্রমিকদের পুনর্বাসন এর সম্পূর্ণ দায়িত্বও কোম্পানির। শুধু বলা হয়েছে, যে শ্রমিকদের এই পুনর্বাসনের কাজটি খতিয়ে দেখার জন্য জেলা প্রশাসন একটি মনিটরিং কমিটি তৈরি করবে।
ভারতবর্ষের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একদল বাণিয়া ক্ষমতা দখল করে বসে আছেন। বাজার অর্থনীতির ঢক্কানিনাদের উৎসবমুখরতায় চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষ বিক্রির তীব্র আর্তনাদের শব্দ। সবুজ ধ্বংসকারী উন্নয়নের চুক্তিপত্রটি প্রমাণ করে সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে শ্রমিক কতটা বঞ্চনা ও প্রতারণার শিকার হয়। তার বিরুদ্ধে তার মালিকপক্ষ, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, আর তাদেরই ইউনিয়ন। ডলু চা বাগানের শ্রমিকরা এমনিতে কাঁদছেন না। তাদের জীবন, জীবিকা, অস্তিত্ব – সমস্তই আজ সংকটে।