এবারের বইমেলায় গুরুচন্ডা৯র প্রকাশিত কয়েকটি বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া একসঙ্গে দেব ভেবেছিলাম। এক তো তাহলে আমার লেখার কলেবর নিয়ে ভাবতে হবে না, দুই, বইমেলার পর সবাই পাঠ প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, দেবেন এটাই স্বাভাবিক। সত্যিই এতো ভালো বই হাতে এসেছে যে ইচ্ছে হচ্ছে প্রত্যেকটি পড়েই সবাইকে জানাই, আজ একটা দারুণ বই পড়া হল।
তাহলে একসঙ্গে কয়েকটি বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া দিলে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবার সম্ভাবনাও কমবে।
কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই শিহরিত হলাম একটি চটি কবিতার বই খুলে। গুরুচন্ডা৯ প্রকাশিত সোমনাথ রায়ের "অরূপ বৃন্দাবন ও অন্যান্য পদ।" সাকুল্যে ৪৪ টি পৃষ্ঠা। কিন্তু দেখলাম এর ওপরেই লিখে ফেলতে পারি পাতার পর পাতা। তাহলে আর একসঙ্গে কেন! ভালো কবিতা পড়লে মনের মধ্যে যে অবরুদ্ধ আবেগ ঠেলাঠেলি করে,তাকে সংহত রূপ দেওয়া খুব কঠিন জানি, কিন্তু তা প্রকাশ না করা অবধি অন্য কিছু ভাবতে না পারাই আমার বোকা স্বভাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জুতসই বাংলা প্রতিশব্দের অভাবে দুটো ইংরেজি কটু শব্দ নিজের প্রতি প্রয়োগ করি– আনডিপ্লোম্যাটিক এবং ইনকরিজিবল, তারপর ডুবে যাই এই অত্যাশ্চর্য পংক্তিগুলোতে–
শহরের গায়ে খুলির চিহ্ন লেগে আছে
মাটিতে বাঁচতে লাগে ঘৃণা, হিংসার আঁচে
তাবৎ সর্প পোড়ে-
বাংলা কাব্যে কে না জানে, কেউটেরূপী কাল পশে চাঁদের বাসরে
বিষের ললিতে ঘুম আসে, ভাষায় অক্ষরে সংবাদমাধ্যম
পুঁজি
চলমান অশরীরী, এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি।
হুল থেমে গেলে পড়ে
প্রাংশু দুকাঁধ থেকে ঝুলে পড়া গামছা-চাদরে
ঢাকের শব্দ ভেসে আসে, টিভির রিমোট থেকে শালডুংরির
গাছে গাছে
আমাদের সকলের গালে খুলির চিহ্ন লেগে আছে।
(কিষেণজিকে)
প্রশ্নটা এই নয়, কে কোন রাজনীতির সমর্থক। সেই গোদা প্রশ্নের পাশ কাটিয়ে এখানে উঠে এল ছোটবেলা মাখা অরণ্যদেবের সর্বশক্তিমান পেশির দার্ঢ্য। আমরা শিশুর মতই তাকে ভেবেছিলাম সর্বরোগহর। তাকেই না চাওয়া ঘুমে ঢলে পড়তে দেখা কি শুধুই আশ্চর্যের, নাকি স্বপ্নভঙ্গেরও? এখন গোটা শহরের গায়েই খুলির চিহ্ন, এমনকি আমাদের গণ্ডদেশেও। নিজেকেই অভিসম্পাতে ছিন্নভিন্ন করা এই কবিতা কোথাও সুর চড়ায় না একফোঁটা। শান্ত মনে করিয়ে দেয়, এখানে ললিতও বিষাক্ত, চাঁদের বাসরে সেই কবে থেকে কালসর্পের প্রবেশ!
যে মানুষ আপাদমস্তক কবি, কিন্তু আধুনিক জীবন তার রাজনৈতিক দূষণ আর অন্যান্য সমস্যা নিয়ে যাকে পোড়ায় হাঁমুখ আদিগন্ত ক্ষতের জ্বালায়, তারই কলমে বেরিয়ে আসতে পারে “নেড়াপোড়া”র মতো কবিতা-
আগুনে মাংস পোড়ে
ঈশ্বর-আদেশ সেইরূপ
বনস্থলী পুড়ে খাক, ছাইয়ের গাদার নিচে
স্তূপ
-আকারে ভক্ষ্য থাকে
মিঠে আলু বেগুন,আতপে সেদ্ধ হওয়া চাল
বিনিময়ে সিদ্ধি মেলে, বিনিময় মিলের গোপাল
বিধর্মীর বাড়ি পোড়ে
পাদ্রি পোড়ে শিশুটির সাথে
নীরব শান্ত গ্রাম ভেট আসে রাজার সভাতে
আগুনে ভিখিরি পোড়ে
আগুন জ্বালান ভগবান
পূর্ণিমা সন্ধ্যায় ভেসে যায় চাঁদের বাগান
বাগানে কুসুমদোলা, রঙে উচ্ছ্বাসে হিল্লোল
ঈশ্বর উবাচ, ফাল্গুনি
দেখো কাল আমাদের দোল
কনটেন্ট তো অবশ্যলক্ষ্য, সহপাঠক, শব্দের ব্যবহার দেখুন। আমি মনে মনে অনেকগুলো শব্দ এধার ওধার করলাম।’সেইরূপ’-কে ‘সেরকম’,’বনস্থলী’কে ‘বনতল’, ‘উবাচ’ কে ‘বলেন’। না, একটি এ-কার বা ই-কারকেই নাড়াতে পারলাম না, শব্দ তো দূরের কথা!
জমাট লাভার মতো এসব কবিতা,অন্তর্লীন তাপ বোঝা যায় কেবল কাছে গেলে।
তবে ‘বনস্থালী’ ছাপার ভুল না নতুন কয়েনেজ ?
শব্দখেলায় সোমনাথের পটুত্ব আরও নানা কবিতায় ছাপ রেখে গেছে। ‘মাধব মথুরা মত যাও’ -তে শুধু অনুপ্রাসের চমৎকার ব্যবহারে চমৎকৃত হই না, অবাক দেখি ব্রজবুলির মধ্যে অবলীলায় জায়গা করে নিচ্ছে স্টেশন, গাড়ি, স্টিমার শব্দগুলি। বেখাপ্পা তো নয়ই, বরং অন্য শব্দ বসানো যাবে না এমন অমোঘ। শব্দ বার বার এই পদগুলিতে ব্রহ্ম হয়ে এসেছে, কারণ যে শব্দ, সেইই মাধব-
শব্দে তোঁহার নামে আলো ফুটে ব্রজধামে
মাধব শব্দ বন যাও
মাধব মথুরা মত যাও।
পদকারকে ভেবে দেখতে অনুরোধ ‘শব্দ’ ভেঙে ‘শবদ’ লেখা যেত কি না। অবশ্য তাতে অর্থবৈকল্য হবার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
একজন অতীব সুগায়িকা আমায় বললেন অরূপ বৃন্দাবনের পদগুলো গীত হওয়া উচিত। ঠিকই বলেছেন। হ্যাঁ, একই কলম লেখে ন্যাড়াপোড়া বা কিষেণজিকে, আবার ঝংকার তোলে ‘বিগত বসন্তে’-র মতো কবিতায়। শুধু পদাবলীতে নয়, বালিবধের মতো তীব্র রচনাতেও এই সাংগীতিক কুশন-কভার আকস্মিক ধাক্কার অভিঘাতকে সামলে নেয়।
সব কবিতা ধরে ধরে আলোচনা করছি না, সহপাঠকও চাইলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দিতে বসে যেতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু অরূপ বৃন্দাবন ও অন্যান্য পদের শ্রেষ্ঠ পদাবলীটি মুদ্রিত হয়েছে ব্যাক কভারে। পড়লেই অনাহত সুর ধরা পড়ে মনের কানে। আর কিছু যদি নাও হয়, এই কবিতাটি একা পাঠককে টেনে নিয়ে যেতে পারে সেই অলীক বিভোরতায় যেখানে:
নূরনবি হজরত বাঁকা শ্যামরায়
কেউ যায় মথুরায় কেউ মদিনায়...
...রুহানি দ্বিবিধ পথ গীতা ও কোরানে
একদিশে মিশে গেছে বাংলার গানে।
সোমনাথ রায় ও গুরুচন্ডা৯কে ধন্যবাদ। খুব ভালো কবিতা পড়াবার জন্য।