সারা জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বুঝেছি যে ক্যাপিটালিজম অথবা কমিউনিজম দুইই মানবজাতির পক্ষে চরম বিপদজনক।
আমি মডারেট, মানবিক পুঁজি অথবা মডারেট সাম্যবাদের বিরুদ্ধে নই। বস্তুতঃ, আমি দুইয়েরই পক্ষে।
কিন্তু, সাম্যবাদ আর কমিউনিজম -- এই দুটো কথা এক নয়। এক করে দেখানো হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই। কমিউনিজম রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম অথবা ভেনেজুয়েলাতে শ্রেণীহীন সমাজ তৈরী করতে আসলে পারেনি। একটা শাসক শ্রেণী এবং একটা বিশাল শাসিত শ্রেণী তৈরী হয়েছে। এবং দারিদ্র্য ও হতাশা সমবন্টিত হয়েছে। যে মডেল পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টরা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, এবং একটা প্রতিপত্তিশালী রাজ্য -- পার্টিশনের পরেও তার যাও বা অবশিষ্ট ছিল -- একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। অর্থনীতি ধ্বংস, এবং সরকারী সংস্থাগুলো -- স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বাস ট্রাম -- যেগুলোর প্রকৃত উন্নতি হওয়ার কথা ছিল, সেগুলোই শেষ হয়ে গেছে দীর্ঘ কমিউনিস্ট শাসনকালে। আমরা সেই স্কুল জীবন থেকে দেশে এসেছি ভাঙা, রংচটা, লজঝড়ে বাস। কোনোদিনও দেখলাম না বাসগুলো একটু ভদ্র চেহারা নিয়েছে। সরকারী স্কুল আর হাসপাতালগুলো শেষ করে দিয়ে গেছে। আর কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডারদের আকাশচুম্বী ঔদ্ধত্য। শহরে একরকম তাণ্ডব। আর গ্রামে গঞ্জে আর এক রকম।
অন্যদিকে দীর্ঘকাল আমেরিকায় থাকার পর, আর এদেশের রাস্তায় নেমে রাজনীতি করার পর, শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে ওঠাবসা করার পর দেখলাম মার্কিন মডেলের পুঁজিবাদের কুৎসিত, নিষ্ঠুর, বিভীষিকাময় রূপ। যেখানে মনুষ্যত্ব বলে কিচ্ছু নেই। মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার নেই, শিক্ষার অধিকার নেই, আপনার অর্থ না থাকলে আপনার কিছুই নেই। কালো মানুষদের কুকুরের মতো গুলি করে মারছে পুলিশ। শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থীরা ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে আজও টেক্সাস থেকে ক্যারোলাইনা, মিসিসিপি থেকে জর্জিয়া, ফ্লোরিডাতে। ঠিক যেমন আমাদের দেশে দলিতদের ওপরে গরিব মুসলমানদের ওপরে হিন্দুত্ববাদী চরমপন্থীদের অত্যাচার।
এই করোনাভাইরাস মড়ক আমেরিকার আসল অবস্থা সারা পৃথিবীর কাছে নগ্ন করে দিয়েছে, যদিও মিডিয়া প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে তা লুকোনোর। কারণ, মার্কিন ক্যাপিটালিস্ট মডেল যে একেবারেই চরম ব্যর্থ এবং মানবতাবিরোধী, তা ফাঁস হয়ে গেলে আমাদের দেশের শাসকশ্রেণী এবং তাদের পোষা মিডিয়ার নোংরা ক্লোসেট উলঙ্গ করে দেবে। দেড় বছরে এই "শ্রেষ্ঠ দেশ" আমেরিকায় আট লক্ষ মানুষের মৃত্যু? এসব কথা যত কম লোকে জানতে পারে, ততই ভালো।
আম্বানি, আদানি, ক্রিকেট জুয়া, বলিউড মাফিয়া আর তাদের পিছনের পুতুলনাচের বাজিগরদের মুখোশ খুলে যাবে। তাদের আর তাদের মিডিয়ার যোগসাজশ মানুষের কাছে ধরা পড়ে যাবে। আজকের ফ্যাসিস্টরা ধর্মের নামে যে নোংরা রাজনীতি করছে সারা দেশ জুড়ে, এবং দেশের সম্পদ লুঠ করে চলেছে, তা প্রকাশ্য হয়ে যাবে।
আমি বহু বছর ধরে দুই সিস্টেমের বাইরে গিয়ে একটা অন্যরকম রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মডেল তৈরী করার কথা বলে আসছি। যেখানে অতি ধনিক শ্রেণীর হাত থেকে ক্ষমতা ক্রমে চলে আসবে সাধারণ মানুষের হাতে। কিন্তু অতি বাম ও অতি দক্ষিণ সে ক্ষমতা চুরি করতে পারবে না। এই মডেলের নাম আমি দিয়েছি দ্বিতীয় বৃত্ত (সেকেণ্ড সার্কল)। আমি প্রাচীন, প্রাগৈতিহাসিক বাম দক্ষিণ এই মেরুকরণে বিশ্বাসই করিনা। এই ডাইকটোমি বা দ্বিধাবিভক্তকরণ সম্পূর্ণ কৃত্রিম, এবং আজকের দিনে সম্পূর্ণ অচল।
আজ সময় এসেছে নতুন চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ করার। নতুন রাজনীতি তৈরী করার।
__________
ডঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক
৩০শে নভেম্বর, ২০২১
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।