এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • জোম্বিদ্বীপের কথকতা (পর্ব ৩)

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৩৭৭ বার পঠিত
  • | |
    বাগবুলবুলি ভাষার ছেরাদ্দ

    এখনও ভোর হয়নি বোধহয়। কিন্তু আমার বড্ড শীত করছে। পা দিয়ে লেপ বা কম্বল টানতে গিয়ে দেখছি পা অবশ, নড়ছে না। ঝিঁঝিঁ ধরেছে। সেটা হতেই পারে। ছোটবেলা থেকেই আমার এই রোগটা রয়েছে — অবশ্য যদি এটাকে কোন রোগ বলা যায়।

    জটাটবী/গলজ্বল/ প্রবাহপাবিত/স্থলে,
    গলেব/লম্ব্যলম্বিতাং/ ভুজঙ্গতুঙ্গ/মালিকাম।
    ডুমড্ডুম/ডুমড্ডুম/নিনাদবড্ড/মর্বয়ং,
    চকারচণ্ড/তান্ডবং/ তনোতুনঃ/শিবঃ শিবম।

    কোত্থেকে একটা গান ভেসে আসছে না? খুব দূরে নয়, আবার খুব কাছেও নয়। একটা কথারও মানে বুঝতে পারছি না। কিন্তু বিট ভাল লাগছে। বেশ একটা মার্চিং সং গোছের ভাব।

    ওই ডুমড্ডুম ডুমড্ডুম! কেমন চেনা চেনা—বুঝেছি , বীট ড্রাম বাজছে। আরে, একসময় তো আমিও বাজিয়েছি। না, ভুল বললাম। আমি কেটল ড্রাম বাজাতাম। বীট ড্রামটা বাজাতো সুধীরদা, বেশ লম্বা চওড়া, ক্লাস এইটে একটু গোঁফের রেখা। আসলে দু’বার ফেল করে আমাদের ক্লাসে রয়ে গেছল।

    মনে পড়ছে - ছোটবেলায় মিশনের স্কুলে পড়েছি। হোস্টেলে ছিলাম। সেখানে মেজ মহারাজের হাতে তৈরি ব্যান্ডপার্টি। শহরের মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় পুলিশ ব্যান্ডের পর আমাদের ব্যান্ড। কত পুরনো কথা সব মনে পড়ছে। এমনকি লীড ড্রামের সঙ্গে আমাদের শুরু করার ১৬ বিটের স্ট্রোকগুলো।

    ঠরাররা ঠরাররা ট্রাম--
    ঠরাররা ঠরাররা ট্রাম--
    রামপাম রামপাম রামপামা রামপাম,
    রামপাম রামপাম রামপামা রামপাম,
    রামপামা রামপামা রামপামা রামপাম,
    ঠরাররা ঠরাররা রামট্রামট্রাম--।

    গান চলছে, গানের কথাগুলো একটু একটু বুঝতে পারছি, সংস্কৃত বটেক।

    জটাকটাহ/সভ্রম/ভ্রমান্নালম্প/নির্ঝরা,
    বিলোলবীচি/বল্লরা/ বিরাজমান/মূর্ধনি।
    ধগদ্ধগ/দ্ধগজ্বল/ ললাটপট্ট/পাবকে,
    কিশোরচন্দ্র/শেখরে/ রতিঃপ্রতি/ক্ষণং মমঃ।

    ওরে বাবা! কীসব সমাসবদ্ধ শব্দের মিছিল, দাঁতকপাটি লেগে যাবে। এবার মুখড়ায় ফিরছে। শেষ দুটো লাইন!

    “ডুমড্ডুম/ডুমড্ডুম/নিনাদবড্ড/মর্বয়ং,
    চকারচণ্ড/তান্ডবং/ তনোতুনঃ/শিবঃ শিবম”।

    মার দিয়া কেল্লা! এটা কোন শিবের স্তোত্র। কিন্তু আগে কখনও শুনিনি।

    বম ভোলে! খা চাঁদিকে গোলে! ব্যোম ভোলা! ব্যোম ভোলা! খাও বাছা রূপোর গোলা।

    আমরা মিশনে শিখেছিলামঃ

    ‘জয় শিবশংকর, হর ত্রিপুরারি,
    পাশীপশুপতি পিণাকধারী’।

    বা, ‘নাচে পাগলা ভোলা বাজে বম বম বম’। কিন্তু এটা নতুন রকম, কীরকম একটা ফার্স্ট বিটের নাচের ভাব। সে যাকগে, এটা কী হচ্ছে? কোথায় হচ্ছে?ধেত্তেরি!

    কবীরা খড়া বাজার মেঁ, চাহে সবকো খের,
    ন কাহুকে দোস্তি, ন কাহুকে বৈর।।
    ভরা বাজারে দাঁড়িয়ে কবীর, চায় সে সবার ভাল,
    কেউ নয় তার শত্রুমিত্র, তাতে কিবা এসে গেল!।

    ধুর শালা, নাড়িকাটার দিন থেকে আমরা শত্রুমিত্র চিনতে পারি। কড়া চাউনির বড়পিসি আমার মিত্র। ফ্রকপরা ছোটপিসি আমার শত্রু। খালি ঘরে আমায় একা পেলে পাছায় খুব জোরে চিমটি কাটত।টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে বেড়াত, দু’চারটে পাত্তি পেলে একটা ঝেড়ে দিত। আমাকে আঙুল উঁচিয়ে শাসাতো, যদি মুখ খুলি তো বিপদ।

    তবে কেউই আগাপাশতলা ভাল বা খারাপ নয়। বড়পিসি আমার গাল টিপে ধরে মুখের ভেতর আঙুল পুরে ভাঁড়ার থেকে চুরি করে চুষতে থাকা গুড়ের ডেলা বের করে নর্দমায় ফেলে দিত। নইলে দাঁতে পোকা হবে, পেটে ক্রিমি কিলবিল করবে। হলে আমার হবে, তোমার কি!

    বড় হয়ে চাকরি করে মাইনের টাকা দিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি গুড় কিনব, দেখব কে আমাকে ঠেকায়!

    তেমনই আমার শত্তুর ছোটপিসি শিখিয়েছিল দুটো গুরুমন্তর।

    ১) পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পাপ হল চুকলি করা, বিশেষ করে বন্ধুদের ব্যাপারে।

    ২) ‘মুখ দোষে মার গলে’। যখন তখন পট পট করে মুখ খুলতে নেই।

    মুখ খোলার বিপদ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। বড় হতে হতে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।

    বাইরে বোধহয় একটু ফর্সা হয়েছে। তাহলে তো এবার উঠতে হয়। সেই ছোটবেলার শিক্ষে। বাঙলা প্রাইমারে ‘ঐক্য বাক্য মাণিক্য’র পাতায় ছিলঃ

    ‘আলস্য ত্যাজিয়া বাল্যে বিদ্যাভ্যাস কর,
    সত্যমতি ত্যাগবীর নিত্যনায়ে চড়’।

    কী খারাপ পদ্য! এটা বলে ক্লাসে কানে মোচড় খেয়েছিলাম। হ্যাঁ, কর্পোরেশনের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারমশাইয়েরা বড্ড মারতেন।

    কী ডেঁপো ছেলে! গাল টিপলে দুধ বেরোয় সে কিনা ছাপা বইয়ের ভুল ধরছে! ওটা তোমাদের পড়ানো হচ্ছে ‘যফলা’ শেখানোর জন্য, ছড়া মুখস্থ করতে নয়, বুঝেছ মাণিকচন্দ্র?

    --আমার নাম মাণিক দাস।

    এবার মাথায় পড়ল দুটো গাঁট্টা।

    সেই যে ‘মুখ দোষে মার গলে’। ভুলে গেছলাম- যখন তখন পট পট করে মুখ খুলতে নেই। আচ্ছা, আজকাল কোন মাস্টারমশাই গাঁট্টা মারে না?

    নাঃ। কাউকে কিস্যু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। কিন্তু পা নড়ে না কেন? পাশ ফিরতে পারছি না কেন? এখনও ঝিঁঝিঁ ছাড়েনি? কী কান্ড!

    আচ্ছা, এই ঘর এই বিছানা অমন অচেনা লাগছে কেন?কাল রাত্তিরে কোথায় ছিলাম? কার ঘরে?

    ছোটবেলায় ধলা ঠাকুমা এই সময় ঘরে ঢুকত। আমাদের দু’জন ঠাকুমা ছিল-দুই বোন। একজন ফর্সা আর অন্যজন কালো। তাই ধলা ও কালা ঠাকুমা।

    ধলা ছিল আমার মিত্র, কালা শত্রু নাহলেও নিউট্রাল। মা পেটালে কখনও ছাড়াতে আসত না। পানের ডাবা থেকে পান বের করে নির্বিকার মুখে চুণ খয়ের লাগিয়ে গালে পুরত। তখন থেকে আমি নিউট্রাল লোকেদের দু’চক্ষে দেখতে পারি না।

    ধলা ঠাকুমা ঝাঁপিয়ে পড়ত। বৌমা, পোলাডারে কি মাইরা ফ্যালাইতে চাও?

    - সেকি, আমি তো হাতপাখার ডাঁটি দিয়ে মাত্র এক ঘা দিয়েছি । শয়তান ছেলে আপনার পেছনে লুকুচ্ছে। আপনার লাই পেয়ে মাথায় উঠেছে। আজ আমি ওর হাড়মাস—

    ততক্ষণে ঠাকুমা মায়ের হাত থেকে হাতপাখাটা কেড়ে নিয়েছেন।

    ধলা ঠিক টের পেতেন আমি জেগে না ঘুমিয়ে। মটকা মেরে পড়ে থাকলেও লেপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে পায়ের তলায় কাতুকুতু দিতেন।

    ‘উঠরে ভাই, মাণিকসোনা, হাত মুখ ধুইয়া পড়তে বস।

    ‘সকালে শয়ন করি সকালে উঠিবে,
    সুস্থ সুখী ধনী জ্ঞানী তবে তো হইবে’।

    --পড়তে ভাল লাগে না ঠাকুমা।

    --ভাল তো অনেক কিছুই লাগে না। ওষুধ খাইতে কি ভাল লাগে দাদুভাই? খাইতে হয়। তেমনই পড়াটড়া তিতা ওষুধের মত সোনামুখ কইর‍্যা সাইর‍্যা ফেল।

    তারপর ধলা সুর করে বলেনঃ
    লেখাপড়া করে যে?

    আমি উত্তর দিইঃ
    গাড়ি চাপা পড়ে সে।

    দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠি। কাতুকুতু বেড়ে যায়। এবং আমার ঝিঁঝিঁ ছেড়ে দেয়। এবার আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি। এটা আমাদের রোজকার খেলা।

    কলতলায় গিয়ে পেট হালকা করে কালীদন্তমাঞ্জনের গুঁড়ো দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে শুনতে পাইঃ

    “নামটি আমার গদাধর, সবাই ডাকে গদা,
    সারাদিনটি খেলে বেড়াই গায়ে ধুলোকাদা।

    দাদা বলে গাধা তুই, লিখবি পড়বি নে’?

    অমনি আমি কেঁদে দিলাম – ভ্যাঁ এঁ এঁ।

    দিদি বলে -

    ষাট ষাট, গদু ভাল ছেলে,
    সোনামানিক এস খানিক হাডুডুডু খেলে”।

    বাসন মাজতে মাজতে মা গজগজ করে — বুড়িকে সাতসকালে ছড়ায় পেয়েছে।

    ঝিঁঝিঁ শুধু পায়ে নয় হাতেও ধরেছে। কাউকে ডাকবো? কী জন্যে? ঝিঁঝিঁ ছাড়িয়ে দেবার জন্যে? লজ্জার কথা। কিন্তু ঘরে কেউ তো আসুক। গোটা কয়েক খালি বিছানা - একটাও লোক নেই। এ কেমন সৃষ্টিছাড়া জায়গা?

    সেই গানটা আবার ফিরে আসছে, এবার কোরাসে। ওরা আসছে, এদিকেই এগিয়ে আসছে। কথাগুলো এখন অনেক স্পষ্ট। আমি বিট বুঝতে পারছি। মানেটাও শিখে নেব, কার থেকে? কেন, ওই যে লীড গাইছে - ওর থেকে।

    “জটাকটা/হসভ্রম, ভ্রমান্নালম্প/নির্ঝরা,
    বিলোলবীচি/বল্লরা, বিরাজমান/মূর্ধনি।
    ধগদ্ধগ/দ্ধগজ্বল/ ললাটপট্ট/পাবকে,
    কিশোরচন্দ্র/শেখরে/ রতিঃপ্রতি/ক্ষণং মমঃ।

    ধেত্তেরি! ওরা ভেতরে এল না। এগিয়ে গেল, মার্চপাস্টের ছন্দে। ওরা কারা? এ আমি কোথায় এসেছি!

    পেডিয়ান চাই! পেডিয়ান!

    এটা কী বললাম? পেডিয়ান! এসব তো সেই ছোটবেলার কথা। ভুলে গেছলাম। এই শব্দটা কোন অভিধানে নেই। এই শব্দ আমার তৈরি করা। আজ নয়, সেই মিশনের হোস্টেলের দিনে। আমি তখন ক্লাস সিক্স কি সেভেন। অনেক সময় হাত-পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে। গরীবদের জন্যে বরাদ্দ ফ্রি কোটায় ভর্তি হয়েছিলাম। বাবা সাইকেল রিকশা চালাত, মা বাড়ি বাড়ি বাসন মাজত। ওদের মধ্যে খুব ঝগড়া হত। এমনই এক রাত্তিরে বাবা এককাঁড়ি মদ গিলে মার সঙ্গে বিচ্ছিরি ঝগড়া করল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আর ফিরে আসে নি। ততদিনে কালা-ধলা দুই ঠাকুমা উপরে চলে গেছেন।

    মা কিছুদিন গুম মেরে রইল। তারপর বাবার দোস্ত সনৎকাকুর সঙ্গে থাকতে লাগল। কাকু বেশ মজার লোক ছিল। আমার সঙ্গে লুডো ও নানান খেলা খেলত। তার মধ্যে একটায় আমার ব্যথা লাগত। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিত কাছাকাছি মা আছে কিনা। তারপর বলত — মানিক, বিন্দাবন দেখবি?

    আমি মাথা নেড়ে সায় দিলে আমার দুদিকের জুলফির দুপাশে হাত দিয়ে চেপে শূন্যে তুলে ধরত। একদিন বলে দিলাম – বিন্দাবন দেখব না।

    কাকু মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের গাড়ি চালায়। ওনাকে ধরে আমাকে মিশনের স্কুলে ফ্রি কোটায় ভর্তি করে দিল। ফর্ম ভরার সময় একটু ঝামেলা হয়েছিল। বাবার নামের জায়গাটা মা খালি রেখেছিল। মহারাজ সেদিকে পেন্সিল লাগালে মা ঘোমটার ভেতর থেকে বলল—নিরুদ্দেশ।

    সনতকাকু বলল - আমার নাম লিখে নিন, আমি ওর কাকা।

    মহারাজ মার দিকে তাকালেন। মা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখে আঁচল চাপা দিল। মহারাজ মাথা নাড়লেন।

    -- মা, ঈশ্বর তোমার পরীক্ষা নিচ্ছেন। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখ, জন্মদাতা পিতার বিকল্প হয় না।

    তারপর উনি আমার দিকে ফিরলেন — খোকা, তোমার বাবার নাম কী?

    -- শ্রীযুক্ত নিবারণ চন্দ্র দাস।

    আমি ঘাবড়াইনি। ধলা ঠাকুমা শিখিয়ে দিয়েছিল যে!

    মহারাজের মুখে একগাল হাসি। দেখলে তো মা!

    উনি নিজেই নামটা ভরে দিলেন, আমি ভর্তি হয়ে গেলাম।

    প্রথম প্রথম কান্না পেত। মনে পড়ত ধলা কালা দুই ঠাকুমার কথা। পাড়ার বন্ধুদের কথা। আমার মা পারুলবালার কথা। একবার হোস্টেলে একটা ছেলের সাদা শার্ট চুরি গেল। সে এসে আমাকে বলল—মাণিক, জামাটা ভালয় ভালয় ফেরত দিয়ে দে। আমার নতুন জামা। কাউকে কিছু বলব না।

    আমি অবাক, আমি তো নিইনি। কী করে ফেরত দেব।

    ও বলল—বাইরে শুকোতে দিয়েছিলাম। ওয়ার্ডেন অচ্যুতদা দেখেছে, একটা কালো ছেলে তুলে নিয়ে গেছে।

    আমি বললাম—কালো ছেলে কি আর নেই? তোমার গায়ের রঙও তো কালো।

    ব্যস, সেই যে- মুখ দোষে মার গলে।আমি নতুন ছেলে, আমি ফ্রি কোটায় জায়গা পেয়েছি। ওরা তিনজন এল, আমার হাত মুচড়ে দিল। টিনের বাক্সে তালা ছিল না।হাণ্ডুল পান্ডুল করে দেখে কিছু ব্যাজার মুখে চলে গেল।

    রাত্তিরে হাতের ব্যথায় ঘুম না এলে মাকে মনে পড়ল। পারুলবালা থাকলে ঠিক চূণহলদি- পেঁয়াজবাটা গরম করে হাতে লাগিয়ে দিত। সব ব্যথা টেনে নিত।

    নিজের মনে মায়ের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। নিজের ভাষায়। এ ভাষা শুধু আমাদের দুজনের, অন্যেরা শুনলেও বুঝবে না। মা ঠিক উত্তর দিত।

    আমি - মাম্মা, হাম্বুল তাম্বুল? কেমন আছ মা, তোমাদের কেমন চলছে?

    মা - নিরেনবুল, চিঞ্চিতাং। যেমন চলার, চিন্তা করিস না।

    আমি - কঙ্কড় ধঙ্ক্‌র, মুই মুই? কতদিন হল তোমায় দেখিনা, কবে আসবে মা?

    মা - আলম্বন, নিলম্বন। একটু সময় লাগবে, একটু অপেক্ষা কর।

    এইভাবে আমার আর মার মধ্যে একটু একটু করে নিয়মিত গল্পগাছা হত। আর আমি পেলাম একটি নিজস্ব ভাষা। এর অভিধান, ব্যাকরণ, সন্ধি-সমাস, ণত্ব-ষত্ব বিধি- সব, সব আমার হাতে তৈরি।

    ছ’মাস পরে একদিন আমার রুম পার্টনার মলয় এটা খেয়াল করল। ধীরে ধীরে সুব্রত, গৌতম, পঙ্কজ, সবাই জেনে গেল আমি একা একা খালি ঘরে নিজের সাঙ্কেতিক ভাষায় কারও সঙ্গে কথা বলি। ওরা প্রথমে ভয় পেল, তারপর মজা। ওদেরও শিখিয়ে দিলাম।বছর ঘুরতে হোস্টেলে প্রায় সবাই জেনে গেল আমরা একটা কোড ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলি। শুরুতে কেউ পাত্তা দেয়নি।

    কিন্তু একদিন ভলিবলের মাঠে সিনিয়রদের সঙ্গে পঙ্গা। আমরা তিনজন নিজস্ব কোডে বল পাস করা, নেটের সামনে তুলে দেয়া, লাফিয়ে চাপ মারা বা নেটের সামনে দুজনে একসঙ্গে লাফিয়ে উঠে ব্লক করা – সব নিজস্ব কোডে বিনিময় করে খেলতে লাগলাম।

    মলয় চেঁচাচ্ছে — হাডুম্ব! হাডুম্ব!

    আমরা দু’জন সমস্বরে উত্তর দিলাম - হম্ব, হম্ব।

    নেটের সামনে উঁচুতে বল, মলয় লাফিয়ে উঠে বল না ছুঁয়ে সরে গেল। আমি ওর আড়াল সরতেই সপাটে স্ম্যাশ করলাম। সিনিয়র বিজনদা অদ্ভুত শব্দ শুনে বল থেকে চোখ সরাল। ফলে যা তা ব্যাপার।

    একটু পরে সুব্রত টাচলাইনের এপাশ থেকে বডি ফেলে একটা বল তুলে দিল। কিন্তু লাইনম্যান গোষ্ঠদা সেটাকে ‘আউট’ বলায় আমাদের গোটা টিম হতভম্ব।

    আমি গর্জন করলাম — পেডিয়ান চাই, পেডিয়ান! প্রতিশোধ চাই।

    মজা পেয়ে গোটা মাঠ বুঝে না বুঝে সমস্বরে গর্জন করল — পেডিয়ান চাই!

    সিনিয়র টিম এই প্রথম জুনিয়রদের কাছে হেরে গেল। ওদের মুখ থমথমে।

    সন্ধ্যেয় প্রার্থনার পরে আমার মহারাজের ঘরে ডাক পড়ল। আমি নাকি মাঠে বড়দের অশ্লীল গালাগাল দিয়েছি। উনি জানতে চাইলেন আমি ঠিক কী শব্দ বলেছি। আমি বললাম এবং বেত খেলাম।

    পরের দিন জলখাবারের সময় থেকে এই নিয়ে হাসাহাসি চলল। টিউটোরিয়াল ক্লাসে মাস্টারমশাই সমীরদা আবার জানতে চাইলেন আমরা কয়বন্ধু নিজেদের মধ্যে ঠিক কী ভাষায় কথা বলি। দিনদুই পরে উনি আমাকে একটি বই উপহার দিলেন — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গল্পসল্প’। তাতে দেখি বাগবুলবুলি ভাষা, ক্রেকংটাকৃষ্ট, তাঝঝিম মাঝঝিম।

    তারপর সন্ধ্যেবেলা আমি মলয়ের পিঠে একটা কিল বসিয়ে বললাম — রবি ঠাকুর বলেছেন পিঠে কিল পড়লে সেটা যে কিল তা বুঝতে পন্ডিত ডাকতে হয় না।

    কয়েকবার বেত খাওয়ার পর আমাদের মধ্যে সান্ধ্যভাষা নিয়ে উৎসাহ উপে গেল। অনেক বছর কেটে গেল। শুধু উত্তেজিত হলে বা দুঃখ পেলে আমার মুখ দিয়ে কিছু শব্দ বেরিয়ে যেত। তবে এর জন্যে এমন মূল্য চোকাতে হবে ভাবি নি।

    ফুলশয্যার রাতে মশারির ভেতরে সোনালির মুখ একেবারে ‘কেয়ূরকঙ্কণে কুঙ্কুমচন্দনে’!

    আমি জানতাম জানলার আড়ালে কারা আড়ি পেতেছে। ভাবলাম স্থুলতার হাত থেকে সোনালিকে বাঁচাতে হবে। অন্ততঃ আজ রাত্তিরে। ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললাম — হামতিমানু কাষ্ঠাগোকুল।

    ও চমকে উঠে একটু সরে গিয়ে বড় বড় চোখ করে আমাকে দেখতে লাগল। আমি ওর দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে বলে উঠলাম — ইস্টিমানু কাষ্ঠাগোকুল।

    ওর দুচোখে ভয়ের সমুদ্র।

    আমি এবার ‘আড্ডাপাডা, বাড্ডাপাডা’ বলে লাইট নিভিয়ে ওর দিকে পেছন ফিরে শুলাম। ও ছিটকে মশারি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওদিকে সোফার ওপরে শুয়ে পড়ল।

    পরের দিন আমার সঙ্গে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিল এবং দ্বিরাগমনে বাপের বাড়ি গিয়ে আর ফিরে এল না। একমাস পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে ক্ষতিপূরণ চেয়ে হুমকি ভরা এক চিঠি এল।

    সেদিন রাত্তিরে ঘুম এল না, ভেড়া গুণছি, এ’পাশ ও’পাশ করছি।

    -- মাম্মা, গ-গ-গ-গ-গ! থ্যাতা ব্যাতা। বড্ড কষ্ট পেয়েছি মাগো, বড় কষ্ট।

    -- নি-নি-নি-নি! ফুর ফুর ফুর! মন খারাপ করিস নে। সেরে গেলে ভাল হয়ে যাবি।

    সে তো অনেক পরের কথা। এখন ‘প্রশ্ন করি নিজের কাছে কে আমি, কোথায় ছিলাম, কোথায় যাবো এই আমি’?

    আবার ঘুম আসছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা।আধো জেগে আধো তন্দ্রার মধ্যে আবার শুনতে পেলামঃ

    “ডুমড্ডুম/ডুমড্ডুম/নিনাদবড্ডমর্বয়ং,
    চকারচণ্ড/তান্ডবং/ তনোতুনঃ/শিবঃ শিবম”।

    এবার একটা সিনেমা দেখছি। একটা মিছিল। রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম। একটা মসজিদ। তার মিনার থেকে মাইকে কিছু ঘোষণা হচ্ছে। মিছিলে কিছু ইঁট পড়ল। মিছিল ধাক্কাধাক্কি করে পিছিয়ে এল। এবার মিছিলের পেছনের সারির ভ্যান রিকশার মাইক থেকে কিছু বলা হল। মিছিলের কিছু লোক উলটো দিকে মসজিদের দেয়ালে সেঁটে গেল। ইঁট পড়া বন্ধ হয়েছে। মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিছিলের শেষ দিকের কিছু লোক উল্টোমুখো হয়ে মসজিদের কোলাপসিবল গেট ভাঙার চেষ্টা করতে লাগল।আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। দোকানপাটের ঝাঁপ পড়ে গেছে। পুলিশ অনেক দূরে ব্যারিকেড করে দাঁড়িয়ে। একটা টিয়ারগ্যাসের শেল ফাটল, খুব কাছে। ধোঁয়া, চোখে জ্বালা। আমি অন্ধের মত মসজিদে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগলাম। চোখে জল দিতে হবে। ওদের আঙিনায় অনেক কল থাকে ‘ওজু’ করার জন্যে।

    কখন যেন দরজা ভেঙে গেছে। আগল খুলে গেছে। অনেক লোক ভেতরে ঢুকছে। হাতাহাতি, শ্লোগান। ‘হর হর মহাদেব’ আর ‘আল্লাহু আকবর’ কখন মিলে মিশে বিকট কলরব। আমি কিছু লোকের সঙ্গে পাশের সিঁড়ি দিয়ে ছাদে পালাতে চেষ্টা করলাম। দুটো ছেলে মিনারে চড়ে লাল কাপড় টাঙিয়ে চিৎকার করল — জয় বজরঙবলী!

    রাস্তা থেকে ভিড় গর্জন করল- ভারতমাতা কী জয়!

    আমিও চেঁচালাম -জয়!

    তারপরই মাথার পেছনে একটা কিসের বাড়ি পড়ল সেটা আর দেখতে পেলাম না।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | |
  • ধারাবাহিক | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৩৭৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:১৪498526
  • শৈশবের ভুত আর ছাড়ে না! 
    #
    এইবার থ্রিল একটু কম হইছে মাস্টার :/
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন