১৪ কোটি রেশনের ব্যাগে তাঁর ছবি ছাপা হচ্ছে, ৫ কোটি পোস্টকার্ডে লেখা হচ্ছে ‘ধন্যবাদ’। তারপর দেশের নানান প্রান্তের বিভিন্ন বুথের অন্তর্গত পোস্ট অফিস থেকে সেই পোস্টকার্ড ঠিক সময়মত যাতে তাঁর কাছে পৌঁছয়, তার বন্দোবস্ত করা হয়েছে, তাঁর দল এবং সরকারের পক্ষ থেকে। দেশের ৭১টি গঙ্গা-সংলগ্ন ঘাট পরিষ্কারের কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে, কারণ তিনি ৭১ বছরে পদার্পণ করবেন। তিনি যে সে মানুষ নন, তিনি আমাদের প্রধান সেবক নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। এছাড়াও সামাজিক মাধ্যম জুড়ে, ৩ সপ্তাহ ধরে, তাঁর মহিমা প্রচার করা হবে: তিনি ভ্যাক্সিন নিয়ে কি কি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন, তিনি কোন সেমিনারে কি কি বক্তব্য রেখেছেন – তার টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে ছোট ছোট ভিডিও বানানো হচ্ছে, যা মানুষের মধ্যে সামাজিক মাধ্যম দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হবে, যাতে প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান সেবক সম্পর্কে জনমানসে একটা ভালো কিছু বার্তা পৌঁছয়। শুধু তাই নয়, শোনা যাচ্ছে, বেশ কিছু আঞ্চলিক ভাষার সংবাদপত্রে তাঁর বন্দনা করে লেখা প্রকাশ করা হবে। তিনি না থাকলে এই করোনাকালীন সময়ে বহু মানুষ নাকি না খেতে পেয়ে মারা যেতেন। তিনি না থাকলে, এই করোনার প্রতিষেধক নাকি বিনামূল্যে এবং সুলভে পাওয়াই যেত না, সুতরাং দেশের মানুষের উচিৎ তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা। যা জানা যাচ্ছে, যেহেতু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে, তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাই এই ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়েছে।
কিন্তু এই কর্মসূচীটি নেওয়ার কী এমন প্রয়োজন ছিল? সারা বিশ্বের যে কোনো প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃত্বের তুলনায়, নরেন্দ্র মোদির গ্রহণযোগ্যতা তো যথেষ্ট বেশি। হ্যাঁ, প্রথম সারির কয়েকটি বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের জনমত-সমীক্ষায় সম্প্রতি জানা গেছে, তাঁর জনপ্রিয়তা কিঞ্চিৎ কমেছে, কিন্তু তাও তাঁর ধারে-কাছে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। প্রায় সমস্ত বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম এবং তার সাংবাদিকেরা সকাল-বিকেল তাঁর কথা শুনে চলে। বেশিরভাগ নিউজ পোর্টালে তাঁর সম্পর্কে বা তাঁর সরকার নিয়ে কোনো বিরূপ খবর প্রকাশ করা হয় না। যাঁরা চাটুকারিতা করেন না, বা সরকারকে ভয় পান না, তাঁদের জন্য তো আয়কর হানা আছেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন নতুন করে প্রধান সেবকের বন্দনা গানের অনুষ্ঠান সচেতন ভাবে সংগঠিত করতে হচ্ছে? যে সময়ে মানুষ হাসপাতালে শয্যার অভাবে এবং অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছিলেন, যে সময়ে দেশের এবং আন্তর্জাতিক প্রায় সমস্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া গঙ্গায় শব ভেসে যাওয়ার ছবি প্রকাশিত হলেও, সেখানেও কোথাও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিন্দা করা হয়নি। এমনকি নিত্যদিন পেট্রল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হলেও আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে – আমরা তো আফগানিস্তানের থেকে ভাল আছি। রাস্তার ধারের যে কোনো পেট্রল পাম্পে তাঁর ছবি দিয়ে বারবার বলার চেষ্টা হয়েছে, এটাই আসলে ‘আচ্ছে দিন’। তারপরেও কেন তাঁর এই চর্চার মধ্যে থাকার প্রচেষ্টা? কেন প্রয়োজন পড়ছে আরও বেশি বেশি করে নিজের সুখ্যাতি শোনার এবং সেটাকেই একটা কর্মসূচী তৈরি করে সবাইকে শোনানোর? যদি তাঁর ২০ বছরের পাবলিক লাইফ অর্থাৎ সামাজিক জীবনকে পালন করতেই হয়, তাহলে তো গুজরাট দাঙ্গার ভয়াবহ ছবি পালন করা জরুরি, কিন্তু তা কি করতে দেওয়া হবে?
প্রধানমন্ত্রীর কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র, নিশ্চিত তাঁকে জানিয়েছে – সব কিছু ওপর ওপর ঠিক মনে হলেও, সমস্যা কিন্তু বাড়ছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত না হলেও, দেশের আনাচেকানাচে কিন্তু ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। শুধু কৃষক আন্দোলন নয়, দেশের নানান প্রান্তে লকডাউনের ফলে কাজ-হারানো মানুষকে কিন্তু শুধু মুসলমান বিদ্বেষ দিয়ে আর ভুলিয়ে রাখা সম্ভব নয়। পেট্রল ডিজেল সহ ভোজ্য-তেলের দাম বেড়ে যাওয়া এই ক্ষোভ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি শিক্ষা সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, যা নিজেই অন্যতম একটি মাথাব্যথার কারণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। দেশের একটি বৃহৎ অংশের মানুষ বুঝে গেছেন যে আগামী প্রজন্মের শিশুদের ভবিষ্যৎ খুব বেশি উজ্জ্বল নয়, বরং অন্ধকারই বলা চলে। সেই রিপোর্টের কিছু অংশও যদি সত্যি হয়, তার মানে দাঁড়ায়, দেশের বহু বাচ্চা গত ১৮ মাসে পড়তে পারার ক্ষমতা হারিয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৪০০ বাচ্চার প্রায় ৭৫ শতাংশের পক্ষে এই দূরত্ব আর ভরাট করা সম্ভব নয়, অর্থাৎ এই এত এত বাচ্চা হয় পড়াশুনা বন্ধ করে কাজে কর্মে ঢুকে পড়বে বাধ্য হয়ে, নয় তাদের অভিভাবকেরা কিছুদিন পরে তাদের বিয়ে দিয়ে দিতে বাধ্য হবেন। এই আশঙ্কা বহু মানুষ করছেন, যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সরকারি চাকরি তো দূর-অস্ত, খুব ভালো চাকরিবাকরিও পাবে না। ফলে, যাঁরা অতি কষ্ট করে তাঁদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁরা যে তিমিরে থাকার, সেই তিমিরেই রয়ে যাবেন।
সুতরাং আলোচনাটা যেমন করে হোক পাল্টানো প্রয়োজন, সেটা প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দপ্তর বুঝে গেছে, না হলে সামনে সমূহ বিপদ। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জহরলাল নেহেরু। তাঁর অনেক দোষ-ত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এটা বুঝেছিলেন – দেশের ভবিষ্যৎ পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। তাই তিনি পরের প্রজন্মের শিক্ষার বন্দোবস্ত করেছিলেন। এআইএমএস, আইআইটি, আইআইএম সহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে তাঁর সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছিলেন। তিনি জানতেন, এই প্রতিষ্ঠান থেকে যাঁরা বেরোবেন, তাঁরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। তাঁরাই ভারতবর্ষ গড়বেন। কিভাবে তাঁদের বড় করা হচ্ছে, তার ওপরেই নির্ভর করবে দেশের ভবিষ্যৎ। একটা সময়ে, অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের নভেম্বরের ২০ তারিখ পালিত হত ‘শিশু দিবস’। ১৯৬৪ সালে নেহেরু মারা যাওয়ার পরে, রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে কথা-সাপেক্ষে ঠিক করা হয়, যেহেতু নেহেরু শিশুদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন, তাই তাঁর জন্মদিনটিকেই এরপর থেকে ‘শিশু দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। তখন কিন্তু কোনও সমস্যা বা বিতর্ক হয়নি। অথচ গান্ধী পরিবারের পক্ষ থেকে কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিনও পালন করার চেষ্টা হয়েছিল, জরুরি অবস্থা জারির পরবর্তীতে, তার উপযুক্ত জবাব কিন্তু দেশের মানুষ তাঁকে দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদিও যদি চেষ্টা করেন জোর করে নিজেকে চর্চায় নিয়ে আসতে, জোর করে যদি তিনি চেষ্টা করেন – যে দেশের মানুষ তাঁকে ধন্যবাদ দেবেন – যে কাজটা তাঁর স্বাভাবিকভাবেই করার কথা, তাহলে মানুষ কিন্তু জানেন কীকরে এর উত্তর দিতে হয়। ঠিক যেভাবে ইন্দিরা স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়েছিল, এই নরেন্দ্র মোদি জমানারও কিন্তু পতন হবে। যাঁদের কাছ থেকে নরেন্দ্র মোদি পোস্টকার্ড পাবেন, তাঁরাই কিন্তু নরেন্দ্র মোদিকে পরাজিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন – তার পূর্বাভাস কিন্তু মুজফফরনগরের কৃষক সমাবেশ থেকে শোনা গিয়েছে, এবং তা শুধু আমাদের কানে ঢোকেনি, প্রধানমন্ত্রীর কানেও নিশ্চিত প্রবেশ করেছে।