একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
___________________________________________
অনেকে আমাকে বলেন, দাদা, আপনি যেসব কথা লেখেন, আমরা আগে কখনো তা শুনিনি। এই আপনি যে এতকাল আর এস এস করেছেন। আপনার দৃষ্টিভঙ্গী আর পাঁচজনের থেকে একেবারেই আলাদা। আপনি ওদের যেভাবে চেনেন, আমরা তো চিনিনা। তাই বুঝতে পারিনা, কীভাবে ওদের মোকাবিলা করা যাবে -- অন্ততঃ তাত্ত্বিক ও বাস্তব জগতের দিক থেকে। অন্ততঃ ভাবনাচিন্তার ক্ষেত্রে। আমাকে তাঁরা বলেন, আপনি একটা পথ দেখান। আমরা হতাশ, এবং ভীত সন্ত্রস্ত।
আমি লিখে যাই প্রতিদিন। জানিনা, লিখে কী লাভ হচ্ছে। আবার শুনি, আমার লেখা এখানে বেরিয়েছে, সেখানে বেরিয়েছে। কিন্তু আমাকে অনেকে জানান না মোটেই যে তাঁদের কাগজে আমার লেখা বেরিয়েছে। পরে জানতে পারি। কিন্তু তাও ভেবে আনন্দ হয়, আমার আলোচনা আরো হাজার দুহাজার মানুষ পড়ছেন, এই ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে। যত মানুষ পড়েন, ততই ভালো। মানুষের ভাবনাচিন্তা করার স্বভাবটাই নষ্ট করে দিচ্ছে এই সোশ্যাল মিডিয়ার দিবারাত্র তর্জনগর্জন এবং ভার্বাল ভায়োলেন্স -- শব্দ-হিংসা। আমাদের কাজ হলো, এই কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির বাইরে গিয়ে মানুষের মনের কাছে পৌঁছোনো।
এই কাজটা করতে গেলে বড় বড় কথা না বলে যেসব কথা সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারেন, সেভাবে কথা বলা দরকার। বড় বড় আঁতেল কথাবার্তা কেউ আর পছন্দ করেন না। এমনিতেই এসব কথা পড়ার ও ভাবার লোকজন এতই কম। তাও, আমার ধারণা, সংযত ভাষায়, ইংরিজিতে যাকে বলে কম্প্যাশন (বাংলায় বলে ভালোবাসা ও মমত্ব), সেভাবে কথা বললে এখনো অনেকে শোনেন। আমাদের কাজ হলো, সেই পরিসরটা ক্রমাগত বাড়ানো।
__________________________________________
এই বিজেপি, আর এস এস, এবং তাদের সম্পর্কে সঠিক আলোচনা করতে গেলে কয়েকটা জিনিষ করা জরুরি।
____________________
(১) বুঝতে হবে, বিজেপি অথবা আর এস এস জাতীয় শক্তিকে যাঁরা সমর্থন করছেন, তাঁরা সবাই শত্রুও নন, হিংস্রও নন, এমনকি সকলে ধর্মান্ধ, চরমপন্থী জীব নন।
____________________
ভারতের মতো একটা বিরাট দেশের একশো কুড়ি কোটি লোকের মধ্যে যেখানে তারা অন্ততঃ পঞ্চাশ কোটি মানুষের সমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে দ্বিতীয়বার, সেখানে সেই পঞ্চাশ কোটি মানুষের সবাইকে হিংস্র, বুদ্ধিহীন, এবং ধর্মান্ধ ভাবা একেবারেই মূর্খতা। ঠিক যেমন এখানে এই আমেরিকায় কোটি কোটি লোক ট্রাম্পের মতো একটা মিথ্যাচারী জাতিবিদ্বেষী ও বর্ণবিদ্বেষী লোককে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ট্রাম্প লোকটা অসভ্য, বর্বর হতে পারে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাকে যারা সমর্থন করছে, তারা সবাই অসভ্য, বর্বর।
_________________________
(২) প্রধানতঃ মিডিয়া মগজধোলাইয়ের কাজটা করে যাচ্ছে বলে সঠিক আলোচনা হয়না, এবং অধিকাংশ মানুষ অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, বিশ্বব্যাংকের খেলা, পেট্রো-রাজনীতি এসব বিষয় ভালো বুঝতে পারেননা।
___________________________
হয় এসব বিষয় আলোচনা খুব জ্ঞানীদের মতো করা হয়, বা জটিল করে তোলা হয়। মানুষ ধরতেই পারেননা যে অর্থনীতি জিনিষটা আমাদের জীবনকে কীভাবে রক্তের শিরা উপশিরার মতো নিয়ন্ত্রণ করছে। শাসকশ্রেণী চায়না, সাধারণ মানুষ অর্থনীতির মারপ্যাঁচ ধরে ফেলুক। অথচ, প্রতিদিনের জীবন আমাদের অর্থনীতি-কেন্দ্রিক। এক মার্কিন ডলারে কেন এখন ভারতীয় মুদ্রা এক ঐতিহাসিক, সর্বনিম্ন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, তা বুঝতে না পারলেও তার কারণে আমার নিজের ওয়ালেট বা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা বোঝা অবশ্যই দরকার। খুব সহজ উপায়ে মানুষকে এই বিজেপি আর এস এস জাতীয় ফ্যাসিস্ট শক্তির মিথ্যা ও ফাঁকা ভোট-প্রতিশ্রুতিগুলোকে নগ্ন করে দেওয়া সম্ভব।
হাজার উদাহরণ এখন আমাদের চোখের সামনেই আছে। দৈনন্দিন খরচ, ব্যাংকের সুদ কমিয়ে দেওয়া, পেনশন বন্ধ, ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার খরচ, ট্রেনভাড়া, বাসভাড়া, তেল, গ্যাস, কয়লা। ইত্যাদি ইত্যাদি। বেকারত্ব, নির্বিচারে ছাঁটাই, শ্রমিক ইউনিয়ন ধ্বংস। এগুলো বোঝার জন্যে অর্থনীতিবিদ হতে হয়না।
__________________
এবং (৩) এই ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলোর নিজেদের হিপোক্রিসিগুলোকে উন্মোচিত করে দেওয়া।
___________________
অর্থাৎ, তারা কী প্রীচ করে এবং কী প্র্যাকটিস করে -- কথা ও কাজের মধ্যে যে আকাশপাতাল তফাৎ। এই বিজেপি ও আর এস এস চিরকাল স্বদেশী অর্থনীতির কথা বলে এসেছে, ভারতীয়ত্ব রক্ষার কথা বলে এসেছে, এবং বিদেশী অর্থ ও সংস্কৃতি ভারতকে বেনোজলের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছে।
এখন, তারা ঠিক উল্টো কাজ করছে। ভারতীয় বাজার এখন একদিকে আম্বানি, আদানি, আর একদিকে মার্কিনি ও বহুজাতিক কর্পোরেশন সম্পূর্ণ দখল করে নিয়েছে। সামাজিক দিক থেকেও তাই -- প্রধানতঃ মার্কিনি টিভি ও বিনোদন, পর্ণোগ্রাফি, খাদ্য পানীয়, এবং টেকনোলজি বিদেশী শক্তিগুলো গ্রাস করে ফেলেছে। বিজেপি ও আর এস এস কোনো কথা বলেনা।
সেটাই বিরাট হিপোক্রিসি। মুখে এক, কাজে আর এক। সুতরাং, বিজেপি ও আর এস এস সৎ, সেই ব্যাপারটা উলঙ্গ করে দেওয়া যায় সহজেই। তারপর তো ওই বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, ভোটের সময়ে ও পরে কোটি কোটি কালো টাকার খেলা, বিদেশ থেকে ডলার ও পাউন্ড পাচার -- এসব আছেই।
__________________
এর ফলে, এমনকি শুধু যদি ভারতের ৮০ শতাংশ হিন্দুর কথাও আমরা ধরি, যা কিনা ১২০ কোটির মধ্যে ৯৬ কোটি, তাদের অবস্থারও ক্রমশই পতন হচ্ছে। কেবলমাত্র ধনী হচ্ছে সেই উপরের ১ শতাংশ। এখন ১২০ কোটির ১ শতাংশও হলো ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ। কম নয়। তার মধ্যে ফিল্মস্টার আছে, ক্রিকেট প্লেয়ার আছে, সানি লিওন আছে, বম্বের স্টক মার্কেট আছে, আরো অনেক ব্যবসায়ী আছে। তারা ক্রমশই ধনী হচ্ছে।
____________________
সুতরাং, বিজেপি ও আর এস এস হিন্দুদেরও কোনো কল্যাণ করছেনা। শুধু তাদের কাজে লাগাচ্ছে।
____________________
মানুষকে খুব সাধারণ উদাহরণ দিয়ে দেখতে হবে, গত পাঁচ বছরের তাদের আর্থিক অবস্থা কি ভালোর দিকে গেছে, না খারাপের দিকে। এবং সামনের বছরগুলোতে কীভাবে তারা অবস্থার উন্নতি হবে বলে আশা করছে।
বড় বড় তত্ত্বকথা, কিংবা হাজার রেফারেন্স ও স্ট্যাটিস্টিক্সের কোনো দরকার নেই।
___________________
নিউ ইয়র্ক
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।