‘History’-কে ভেঙে তার মধ্যে থেকে ‘Herstory’, পুরুষকথিত, পুরুষের চোখে দেখা ইতিহাসের ভাঁজ খুলে তার ভেতর থেকে মেয়েদের ইতিহাসের টুকরোগুলো সযত্নে আলাদা করে দেখা। ইতিহাসকে এই নতুন দৃষ্টিতে অনুসন্ধান, আরও বহু অধিকার-প্রচেষ্টার মতোই, শুরু হয়েছিল আফ্রো-আমেরিকান মেয়েলেখকদের হাতে। স্বভূমি থেকে নিজের সংস্কৃতি থেকে উপড়ে আনা, ক্রীতদাস জীবনের লাঞ্ছনার দীর্ঘ কাহিনি আর তা থেকে বেরোবার জন্য, পালিয়ে বাঁচার মুক্তি-আকাঙ্ক্ষাই হয়তো এঁদের নিরন্তর প্রেরিত করেছে আত্ম-অনুসন্ধানে। শেকড়ের খোঁজে। নিজের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে পুরোনো উপাদানগুলোকে নতুন আলোয় আবার পরীক্ষা করে দেখা—সেই অনুসন্ধান থেকেই এই ‘হার স্টোরি’র উপাখ্যান। সাহিত্যে সে কাজ শুরু হয়েছে তাও প্রায় চার দশক হল। আজকে সমগ্র সাংস্কৃতিক বিশ্বেই সেই প্রভাব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাংলাও ব্যতিক্রম নয়।
বেদনার যে নিজস্ব অনুভব, তার অভাবে সেই খুলে দেওয়া পথে এসেছে আরও কিছু কিছু ব্যাখ্যান। পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজের ভাষ্য রচনার বিপরীতে পিতৃতান্ত্রিকতার বিরোধী হতে গিয়ে সত্তর-আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে বিশেষত গল্প-উপন্যাস রচনায় দেখা দিল সহজ এক ‘পুরুষবিরোধিতা’র ঝোঁক। পাঠকসাধারণের মধ্যে কিছুটা জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল তা। একটা বড়ো কারণ হয়তো এই যে ওই রচনা ও ভাবনার বাদী স্বর রয়ে গেল ‘বিরোধিতা’ই। তার মধ্যে নাটকীয়তা কিছু বেশি থাকে, ঝাঁঝ থাকে। পিতৃতান্ত্রিকতা আর পুরুষ যে এক নয়, সেই বাস্তবতা কিছুটা অস্পষ্ট হয়েই রইল। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলায় সেই ‘আমরা লাঞ্ছিত, পুরুষ ভিলেন’ গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা কম নয়। তার পেছনে আন্তর্জাতিক কিছু ক্ষমতার খেলাও আছে, যা এই লেখনের বিষয় নয়।
সরাসরি পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টির লেখা আর ‘মেয়েরা লাঞ্ছিত’ লেখা যা ক্রমশ মেয়েদের সেই মুক্তির ভাবনায় চলে যায় যাকে পুরুষতন্ত্রও ‘মুক্ত জীবন’ বলে দেখিয়েছে, তার বাইরে একটি তৃতীয় ধারাও আছে, সৌভাগ্যবশত। সেটি অনেকখানি সচেতন ভাবনার ফসল। সেটি অতখানি সরলীকরণে আস্থাবান নয়। এই অপেক্ষাকৃত পরিণত চিন্তাধারা নারীপুরুষের মিলিত সমাজকেই দেখে, এর দৃষ্টির স্থিতিটি ভিন্ন-পুরুষের দেখা না দেখে এই সাহিত্য সমাজের ইতিহাসকে দেখে মেয়েদের স্থিতিবিন্দু থেকে। একেবারে সমকালীন বাংলা গদ্যে গৌরী ধর্মপাল, অনিতা অগ্নিহোত্রীর মতো আরও কয়েকজনের লেখায় এই ধারাটি যথেষ্ট পরিণত হয়ে কিছু পাঠকের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। পূর্ণা চৌধুরীর ‘পূর্ণলক্ষ্মীর একাল-সেকাল’ নামের ছোটো উপন্যাসে এই দৃষ্টিবিন্দুটির সচেতন প্রকাশ পাওয়া গেল।
মিটিং অ্যাট দ্য স্টেয়ারকেস। শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে দার্জিলিং-এ বসবাসকারী আধা মেমসাহেব মা আর অত্যন্ত উদারমনস্ক শিক্ষিত অভিজাত বাবার সন্তান পূর্ণলক্ষ্মী ঢাকায় জেঠিমা জ্যাঠামশায়ের সংসারে লালিত। জ্যাঠামশায়ের ব্যবস্থাপনায় পূর্ণলক্ষ্মীর বিয়ে হয় একান্নবর্তী এক অভিজাত পরিবারে যাঁদের পুত্র কলকাতায় আইন পড়ে, মেসে থাকে ও উপেন বোনার্জির বক্তৃতা শুনতে যায়। ‘১৯১৪ সালের ঢাকা শহরে এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটে’ (পৃষ্ঠা ১০)। কয়েক বছর পরে স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় এসে নাগরিকতায় স্থিত হওয়া, লেখাপড়ার ঝোঁকে বাধা না-পাওয়া বধূ বিরাট সংসার সামলেও অবসর জোগাড় করেন দৈনিক খবরের কাগজ থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনের খবর পড়বার। আলোড়িত হবার। একদিকে খুড়শাশুড়ির ছায়ায় অন্যদিকে শহরের উদ্দাম স্রোতে বহমান দেওরদের টানাপোড়েনে গাঁথা সংসার। সেই প্রকাণ্ড দুই মহলা বাড়িতে আঁশ নিরিমিষ দুই হেঁসেলে ঊনকোটি রান্না—কর্তার রাত্রিভোজের লুচি আর ক্ষীর থেকে বাড়ির ‘গিন্নি’দের জন্য বিখ্যাত ‘আলু বেগুন বড়ি দিয়ে বোয়ালমাছের ঝোল তাতে আদাবাটা আর টাটকা কাঁচালঙ্কা। পাথরের ‘জামবাটি’তে ঢেলে সারারাত ছাদে রেখে সকালবেলা সেই জমাট ঝোল দিয়ে খাওয়ার জাউভাত’ (পৃষ্ঠা ১৫)। বাড়িভরতি দেওরদের গতায়াত দিয়ে ত্রিশের দশকের নগর কলকাতাকেও বেশ দেখা যায়। ১৯৩৩-এ দেওরদের একজন সাহেব মারতে গিয়ে শহিদ, আর-একজন ১৯৩৪-এ রেকর্ডের গানে পাগল। কমলা ঝরিয়ার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে গান শোনার আশায়। থিয়েটারপাড়ায় দেখা যায় তাকে। কলকাতায় ১৯৪০-৪২ সাল। সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন-দেখা বাঙালি। গুপ্ত স্বদেশিভাবনার বিরাট উকিল। অভিজাততম পরিবারের মহিলাদের যোগদান। তখনও ‘জপে বসা হিন্দু-বিধবার গায়ে হাত’ দিত না সাহেবিরাজের পুলিশ। পূর্ণলক্ষ্মী ভরা সংসার সামলাচ্ছেন। কালে কালে নয় ছেলেমেয়ের জননী। বয়স্কা। তাঁর চোখ দিয়ে সময় দেখাচ্ছেন আধুনিক ভাবনার সচেতন লেখিকা।
একেবারে আধুনিক উপন্যাসের লক্ষণে গল্পের সঙ্গে সমান তালে গাঁথা আছে রান্নাবাড়ার খুঁটিনাটি, দেশের রাজনৈতিক খবরাখবর। দেওয়া আছে সালতারিখের হদিস। আছে প্রবাদ, ছড়া, খনার বচন, ব্রতকথা। প্রবাদের ছড়াগুলিতে হয়তো প্রায়ই এক-দুটো বিচ্যুতি কিন্তু সেসবে খুব একটা আসে যায় না। আবহাওয়াটি তৈরি হয়ে ওঠে। সময় যায়। মা, খুড়শাশুড়ি জ্যাঠামশাইকে নিয়ে পূর্ববর্তী এক প্রজন্মের পর নিজের সন্তানদের তৃতীয় প্রজন্ম পার করেন লেখক পূর্ণা চৌধুরী। চুয়াল্লিশ বছর বয়সের নবম সন্তানের পাশাপাশি দেখা দেয় চতুর্থ প্রজন্ম—দৌহিত্রী। বয়সের শ্লথতায় ক্লান্তিকালে যার কাছে ইতিহাস রেখে যান পূর্ণলক্ষ্মী। সত্তর দশক আসে। যায়। ‘লাহিড়ীবাড়ি’তে মেম বউ আসে, ইতুপুজোও চলতেই থাকে, যে ইতুর মন্ত্রে ধরা আছে সাধারণ বাঙালি মেয়ের সব সাধ আর সব ভাবনা। ফাঁকে ফাঁকে গাঁথা থাকে বেয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু, গান্ধির মহত্ত্ব। সব গুছিয়ে রেখে পরিপূর্ণ সংসারের মাঝখান থেকে পরিণত বয়সেই চলে যান পূর্ণলক্ষ্মী। কোনো কোনো পাঠকের মনে পড়ে যেতে পারে বাংলার একটি ইতিহাস তৈরি করা উপন্যাসের শেষে ভরা সংসারের মাঝ থেকে ভ্রমরকাঠের পালঙ্কে শুয়ে চলে যাওয়া এক মধ্যবয়সিনীর কথা, যার নাম ছিল সুবর্ণলতা!
অত্যন্ত স্মার্ট নির্মেদ লেখনীর একশো তেতাল্লিশ পৃষ্ঠায় বিংশ শতাব্দীর আধুনিক ইতিহাসের লেখন—প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে সত্তরের দশক এক মেয়ে থেকে মধ্যবয়সিনী হয়ে ওঠা মানবীর ঘরের ভেতর থেকে দেখা। বড্ড কি দ্রুত দেখা ওপর ওপর থেকে? আধুনিকতার প্রবল উত্থানের এক অতি ঘটনাবহুল শতককে একবারে তরতর করে পড়ে ফেলার মাপে আঁটাতে গেলে একটু দ্রুতি তো হবেই। এই সুপারসোনিক স্পিডের যুগে যখন ছ-ঘণ্টায় পৃথিবী এপারওপার করা যায়! চমৎকার ঝরঝরে ভাষা। চমৎকার এডিটিং। যাকে এককথায় বলে ‘আনপুটডাউনেবল’। সুন্দর মলাট, ভালো কাগজ, চমৎকার ছাপা। তবে মুদ্রণপ্রমাদের ব্যাপারে পরের সংস্করণে প্রকাশক নিশ্চয়ই আর-একটু সতর্ক হবেন।
বিষয়টা দেখে আর গগন ঠাকুর দেখে চোখ আটকালো। গুরুচন্ডালিতে আজকাল পেশাদারী মানের ভালো রিভিউ হয়। সিনিয়র রা লেখা দ্যান , সেটা আমার ভালো ই লাগে, প্রতিভাবান কিসোর কিসোরী আর পোশায় না :-)))
পাঠ অভিজ্ঞতা নামক একটা বোকা বোকা জিনিস হয়েছে, সেটাও বিরক্ত লাগে।
তবে কোনো লেখাকে কেউ , তাঁকে যত সম্মান ই করি না কেন, স্মার্ট , নির্মেদ , তার পরে তরতরে , জলের মত ইত্যাদি বললেই সেই আলোচিত লেখা আমার আর পড়তে ইচ্ছে করে না। স্মার্টনেসের চোটে জগত যেহেতু অন্ধকার। আমি বিভিন্ন ধরণের ল্যাদানে গদ্যের পক্ষে আজকাল, শুধু ফিকশনে না, সর্বত্র , পৃথিবীর সবকিছুকে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বা ব্যাপক বুদ্ধিমান গ্রাফিক ইত্যাদি বিজ্ঞাপণ টাইপ হতে হবে এরকম কোন নিয়ম থাকার কথা না:-)
তবু ধানসিঁড়ির বই, কলেজ স্ট্রীটে এঁদের মত প্রকাশক তো বেশি নেই, প্রচুর কাজ করেন, ওঁদের কাজ ও বাছাই ভালো লাগে, শুধু সেই কারণেই হয়্তো সুযোগ হলে পড়বো। বা অন্তত নেড়ে দেখবো।
অনবদ্য !