জোঁক অনেকটা নেশার বশে রক্তপান করে। মশা যখন রক্ত খায় মন প্রাণ এক করে খায়। মায়াটুকু রাখে না, যেন আত্মঘাতী উগ্রপন্থী। মশার একটা মাত্র কামড়ে ঘুম ভেঙে গেলে, আমি- স্বাতীলেখা রায়, এইসব ভাবি। আজকাল প্রায় রোজ রাতে মশারিতে দু একটা মশা ঢুকে যাচ্ছে আর কানের কাছে ভন ভন... মশা এমন পারদর্শী যে তাকে খুঁজে পেতে আলো জ্বালিয়ে উঠে বসতে হয়।
এভাবে নিয়মিত ঘুম ছুটে গেলে, আমি মোবাইল ফোন হাতে তুলি আর সার্চ ইঞ্জিনে এটা ওটা খুঁজি। পুরনো প্রেম, পাপুয়া নিউগিনির জঙ্গল, সেখানকার স্বর্গীয় পাখিদের দেখি। তারপর একসময় সার্চ ইঞ্জিনে নিজেকে খুঁজে ফিরি। নিজেকে খুঁজতে গেলে ফোনের পর্দায় আরও আরও আমি এসে হাজির হয়। একেকজনের একেকরকম মুখ, একেকরকম গল্প। মাঝরাতে ঘুম না এলে, লাল লাল চোখ মেলে আমি ফোনের পর্দায় একাধিক আমাকে খুঁজি। দেখি। পড়ি। শুনি।
একজন আমি নৃত্যশিল্পী। আমার নাচের ভিডিও চালিয়ে চালিয়ে আমি দেখি, আমি কেমন নাচছি পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে, মঞ্চ থেকে মঞ্চে আর দর্শক হাততালি দিচ্ছে।
আবার আরেকজন আমি সরকারি আমলা, আফ্রিকার কোনো এক দেশে কর্মরত। আমি খবরের পাতা খুলে দেখে নিই পৃথিবী প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে আমি কী কী বলেছি।
আরেকজন আমি আবার তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। এই আমার মুখচোখ ঠিক সুবিধার লাগে না। পাতাটা থেকে সরে, নিজের থেকে পালিয়ে আসি।
ফোনের আড়ালের আরাম হল, ইচ্ছে হলেই নিজের মুখোমুখি হওয়া যায়, ইচ্ছে না হলে নিজের থেকে সরে আসাও যায়। এভাবেই পালিয়ে আসতে গিয়ে আমি আমার সামনে বমাল ধরা পড়ে গেলাম আজকে।
“আত্মহত্যায় প্ররোচনা! অভিজাত আবাসনে অগ্নিদগ্ধ স্বাতীলেখা রায়ের স্বামী গ্রেফতার”- বাংলার প্রথম সারির এক সংবাদপত্র আমার জন্য আড়াইশো শব্দ খরচ করেছে! চমৎকৃত হলাম! নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হল। খবরটা পড়তে শুরু করলাম।
এই আমার বয়স পঞ্চাশ। এই আমি পেশায় মনোবিদ। এই আমি বিবাহিতা, এক ছেলের মা। স্বামী বিদেশে থাকতেন আগে। আমার বন্ধুরা সংবাদপত্রকে বলেছে, আমার স্বামী আমার উপর মানসিক অত্যাচার চালাত বিয়ের পর থেকেই। ইদানিং তার চাকরি চলে যাওয়ার পর সে মদ্যপ হয়ে পড়ে এবং আমার উপর শারীরিক অত্যাচারও শুরু হয়। অবশেষে, ঘটনার দিন সন্ধ্যাবেলায় আমার অভিজাত আবাসনের সোফা থেকে দগ্ধ অবস্থায় আমায় উদ্ধার করা হয়। আমার দেহের নব্বই শতাংশ আমি কেরোসিনে জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর, মৃত্যুর আগে আমি পুলিশকে বলেছি,- আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
অবাক হলাম। আমি আমার প্রতি আগ্রহ বোধ করলাম। সংবাদের পর্দায় আমার একটা সাদাকালো ছবি দেওয়া হয়েছে, যেখানে আমি হাসিমুখে ভালো শাড়ি পরে, পঞ্চাশ বছরের জীবনের দায়ভার কাঁধে নিয়ে বসে আছি। আমার কপালে একটা টিপ। কানে দুল। গলায় একটা সরু হার। সম্ভবত কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে কেউ আমার এই ছবিটা তুলেছিলেন। খবরে আবার ফিরে গিয়ে জানলাম, আমার দাদা এই ঘটনায় আমার স্বামীকে দায়ী করেছেন। আমার স্বামী যখন তাকে ফোন করে আমার পুড়ে যাওয়ার খবর দেয়, তখন নাকি তার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক ছিল। ঘটনার দিন দুপুরে আমি আমার বন্ধুর সাথে লাঞ্চ করি। ঘটনার দিন বিকেলেও আমি সোশাল মিডিয়া সাইটে সক্রিয় ছিলাম। এরকম কিছু তথ্যের ভিত্তিতে আমার স্বামীকে আত্মহত্যার প্ররোচনার দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সংবাদপত্রের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম, আরও কিছু বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্রে আমায় নিয়ে লেখালেখি হয়েছে বেশ। আমি আমার খবর আরেকটু ভালো করে জানার জন্য একেক করে সমস্ত সংবাদ পড়ে ফেললাম। পড়ে শুনে, আমার সম্পর্কে আমি যা জানলাম তা হল, আমি মানুষকে আত্মহত্যাচিন্তা দূর করতে সাহায্য করতাম। গায়ে আগুন দেওয়ার আগে, বসার ঘরে দাঁড়িয়ে গায়ে কেরোসিন ঢালার পর, কেরোসিনের বোতল রান্নাঘরে আমি রেখে আসলেও আসতে পারি। আমার স্বামীরও আমার মতো একাধিক নিজেকে খোঁজার ও খুঁজে পাওয়ার বাতিক আছে। কারণ আমার স্বামী প্রথমবার দাবী করেছেন তিনি ঘটনার সময় অন্য ঘরে ল্যাপটপে কাজ করছিলেন। পরে আবার এটাও দাবি করেছেন, ঘটনার সময় তিনি সিগারেট কিনতে বাইরের দোকানে গিয়েছিলেন। আমার ছোটোবেলার বন্ধুদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল বরাবর। তারা প্রত্যেকে আমার উপর এতকাল ধরে হয়ে আসা অত্যাচারের খবর জানতো। আমি আমার স্বামীর নামে স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করেছি আগে একাধিকবার। আমার স্বামী প্রতিবার জামিন পেয়ে ফিরে এসে আরও আরও আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগে আমি বাধ্য হয়ে আমার এক বন্ধুর বাড়ি চলে গেছিলাম। কিন্তু সেখান থেকে আমার কর্মস্থল দূর হয়ে যাওয়ায় আমাকে ফিরে আসতে হয়। স্রেফ এই কারণে আমি সেদিন আমার অভিজাত আবাসনে উপস্থিত ছিলাম। এই কারণে সেদিন আমি আমার গায়ে আগুন লাগাতে পেরেছি। এছাড়া আমার মৃত্যুর আর কোনো কারণ নেই।
সমস্ত খবর পড়ার পর আমি আমার পিছু পিছু সোশাল মিডিয়া সাইটে যাই। নিজেকে খুঁজি। সহজেই পেয়ে যাই। দেখি আমাদের দুজনের দুজন কমন বন্ধু আছে। আমি নিজের ছবি খুঁজে খুঁজে দেখি। অতি সহজেই আমি আমার স্বামীর ছবি খুঁজে পাই। অতি সহজেই আমি আমার দাদাকে দেখি। এরপর আমি ছবিতে আমার বাবা, মা-কেও দেখতে পাই। দুবছর হয়ে গেল, ওরা কেমন আছে এখন, আমার জানতে ইচ্ছে করে। আমি ওদের লোলচর্ম দেখি। শুধুই দেখি। আমি শুধুই পড়ি, আর শুনি, আর দেখি, আর জানি। আমি আমার বাবার মাথার উলের টুপি দেখি। আমি আমার মায়ের পাতলা ফ্রেমের ব্যাকাত্যারা চশমা দেখি। এরপর আমি আমার ছেলেকে খুঁজে পাই।
আমি আমার ছেলেকে দেখি। কেমন কোল ঘেঁষে সব ছবিতে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে ওর বাবার মতো। কিন্তু গায়ের রঙ আর হাসিটা আমার। আমার ছেলে। ভালো কলেজে পড়া তরতাজা তরুণ মেধাবী- আমার ছেলে। আমি প্রাণপণ মনে করার চেষ্টা করি, আমি যখন জ্বলছিলাম, তখন ও কোথায় ছিল? খবরের কাগজ এই প্রসঙ্গে আমায় কিছুই জানায়নি। সত্যি বলতে, খবরের কাগজগুলোতে আমার ছেলের সম্পর্কে গুনে গুনে একটা কি দুটো বাক্য ছিল। আমি চুপ করে আমাদের দুজনের ছবি দেখতে থাকি।
দেখি আমরা নদীতে গেছি, ছবিটা বেশ ঝাপসা, নৌকোয় ছেলেকে দেখা যাচ্ছে, তখন ওর বয়স বেশ কম। মাথায় চুল পাতলা। আমরা হাসছি। ছবিতে আমি নেই যদিও। তবু ছেলের হাসি দেখে বুঝতে পারছি তখন আমিও হাসছিলাম। এক সংক্রামক হাসি আমার মুখ থেকে ওর মুখে ছড়িয়ে পড়েছে আর ধরা পড়ে গেছে আমার মামুলি ফোনের মামুলি ক্যামেরায়। আমি আমার ছেলের বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন ছবি পাই। কোনোটায় ওর বাবার সাথে, কোনোটায় আমার সাথে। ওর বাবার সাথে আমার নিজের ছবিও দেখি। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। কোথাও কোনো আগুনের কথা বলা নেই। আমি দেখি ছবি থেকে ছবিতে আমার স্বামীর মুখ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে। দেখে মনে হল, জীবন কি সত্যিই খুব কঠিন হয়ে উঠেছিল তার জন্য? তবে ভালোই করেছি বলে যে, “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।”
আমি পিকনিকের ছবি দেখি, মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত বিভিন্ন আলোচনায় আলোচকের ভূমিকায় আমার ছবি দেখি, ছেলেকে জড়িয়ে আমার ছবি দেখি, বাবা মা দাদা বৌদির সাথে এক ফ্রেমে আমাকে দেখি। আমার কোনো গোমড়ামুখো ছবি আমি দেখি না কোথাও। আমি আমার ওই সাদাকালো ছবিটাও আবিষ্কার করি, যেটা বাংলার প্রথমসারির সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদ পত্রে আমার দুটো হাত কেটে দিয়েছিল, এখানে কোলের নিরাপত্তায় রাখা আমার হাত দুটো আমি দেখতে পেলাম। আমি নিজের হাসিমুখ দেখলাম। আমি নিজের দুচোখ দেখলাম। আমার নিজেকে ভালো লাগলো বেশ। ছিমছাম, কর্মঠ, আপোসহীন এবং স্নেহপ্রবণ এক আমি। আমি আন্দাজ করলাম আমি কী কী খেতে পছন্দ করতাম, কী কী পড়তে। ছবিতে পরা আমার জামাকাপড় দেখে কোন কোন রঙ আমার প্রিয় তার ধারণা আমি করতে পারছি। আমি আন্দাজ করি, আমি কীরকম গান শুনতে পছন্দ করতাম, কোন সিনেমা আমার প্রিয় ছিল। আমি কাদের কথা বলতাম। কারা আমার কথা বলতো। কারা আমার কথা এখনো বলে।
জোঁক অনেকটা নেশার বশে রক্তপান করে। আমি দেখলাম, আমার মৃত্যুর কয়েক মাস পরে, আমার সোশাল মিডিয়ার অনেক বন্ধুই আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে গেছেন। খুব কাছের দুয়েকজন বাদে, প্রত্যেকেই আমায় বলেছেন জন্মদিন শুভ হোক, বলেছেন যেন আমি আনন্দে থাকি, সুস্থ থাকি। থাকি। বুঝি, তাদের জীবনযাপনের ব্যস্ততার ভিতর আমার আড়াইশো শব্দের মৃত্যুসংবাদ ঠিক পাত্তা পায়নি।
অদ্ভুত ভাবে খেয়াল করলাম, নিজের সম্পর্কে আমার নিজের আগ্রহ এখন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। সবকিছু জেনে নিয়েছি বলেই কি? কেউ কি নিজেকে পুরোপুরি জানতে পারে? আমি ফোনের পর্দায় ভেসে থাকা আমার শেষ ছবির দিকে তাকালাম। ফোনের পর্দা থেকে আমি হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখে কালো গোল চশমা, আমার বয়সী আর পাঁচজন মহিলা যেমন পরে থাকেন। আমার কানে দুল, হাতে পাতলা চুরি। গায়ে গোলাপি জামা। মেনে নিতে বাধ্য হলাম, আমাদের দুজনের নাম এক না হলে, আমি ওই আড়াইশোটা শব্দ এমনকিছু মন দিয়ে পড়তাম না।
বস্তুত আমার এবার সত্যিই ঘুম পেল। বস্তুত আমি ফোনের আলো নেভালাম। বস্তুত আমি আর আমার প্রতি তেমন আগ্রহ বোধ করছি না। বস্তুত আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
দারুণ
গল্পটি ভালো। স্টাইলে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছে, গল্প কীভাবে নামিয়ে আনতে হয় শূন্য থেকে।
ধন্যবাদ অমর দা এবং শানু দা
গল্প টা একটানা পড়ে ফেললাম। অর্থাৎ ভালো লাগলো। খুব ই সামান্য কিছু থেকে এই যে গল্প লিখে ফেলা, এটাই তো চমক।
ধন্যবাদ প্রশান্ত দা
অগতানুগতিক গল্প । বিলকুল আলাদা রকম।
সেই গাছটার কথা মনে পড়ল- 'দৃষ্টিনন্দন ফুলগাছের মত না, ছায়া দেওয়া বটবৃক্ষ তো আরই নয়..মগডালে একটা ইয়াব্বড়ো মৌচাক ঝুলছে।"
এই রকম গল্প আরো লেখা হোক।
ধন্যবাদ ইন্দ্রানী। ওই গদ্যটিকে মনে করালেন, ভালো লাগলো