১
করিমন বিবি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আছে।
একটু আগেই দুটো লোক এসে ফটকের পাশে ঠক ঠক করে কোর্টের নোটিশ লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল।
করিমন বিবি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দূরে কোথাও দূরে দূরে তাকিয়ে।
করিমন বিবির বামহাত থেকে ঝুলে আছে ঘন সবুজ নধর কচি শসা। কোর্টের নোটিশের দিকে আনমনে চেয়ে থেকে, হাতটা মুখের কাছে তুলে এনে করিমন বিবি খোসা সমেত কচি শসায় কচ করে কামড় বসায়। তারপর আহত শসা সমেত হাত নেমে আসে, আবার ঝুলতে থাকে করিমন বিবির পাশে।
আপন ধর্মে শসার গাল বেয়ে একফোঁটা রস গড়িয়ে গড়িয়ে,- শসার অশ্রু, টুপ করে মাটিতে ঝরে পড়ে।
করিমন বিবি অজান্তে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে, চোখের সামনে কোর্টের নোটিশ ঝাপসা হয়ে যায়। বাড়ির ফটক, ফটকের পাশে হিজলের গাছ আবছা হয়ে গিয়ে হলুদ অভিবাসী রোদগুলো চোখে গিজগিজ করে শুধু। আনমনে করিমন বিবি গুনগুনিয়ে ওঠে, “তু তু তু/ তুতু তারা/ তোড়ো না/ দিলহামারা...”
কোর্টের নোটিশের নীচ দিয়ে টমিকে সন্তর্পনে ঢুকতে দেখেই ঘোর ভাঙে করিমন বিবির, আধ খাওয়া শসাটা টমির দিকে ছুঁড়ে মেরে স্বভাবসুলভ কর্কশ কন্ঠে সে চিৎকার করে ওঠে, “ইবলিশের বাচ্চা! জাহান্নামের কীট! দূর হই যা!” শসাটা টমির গায়ে লাগে না। চিৎকার শুনে বাদামী লেজ পাকিয়ে টমি যেখান থেকে আসছিল সেখানেই পালায়। ফটকের কাছে ধুলোয় পড়ে থাকে আধখাওয়া শসা, ধুলো লেগে শসার গালে গজিয়ে ওঠা নতুন অশ্রু শুকিয়ে যায়।
ঘরের ভিতর থেকে ঘরঘরে গলায় রশিদা বেগম বাইরে কি হল জানতে ইচ্ছে প্রকাশ করেন।
করিমন বিবি উত্তর করে না,- নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর কালে, উঠোনে নেমে গিয়ে ধুলো থেকে শসাটা তুলে নিয়ে, দোরগোড়ায় রাখা কুঁজো থেকে জল ঢেলে ভালো করে ধুয়ে, জল ঝরিয়ে, আবার একটা নধর কামড় বসায়। শসার গাল পুনরায় অশ্রুতর হয়। মুখ ভর্তি শসা সমেত করিমন বিবি রশিদা বেগমের উদ্দেশে বলে, “তাবিজ করাইতে অইবো, আল্লার গজব পড়চে।”
ভিতরের ঘর থেকে রশিদা বেগমের অস্ফুট অনুযোগ শোনা যায়, “আবার তাবিজ!”
ঠিক সেই মুহূর্তেই বড় মেয়ে বেরিয়ে আসে অন্দর থেকে। তাকে দেখে সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে করিমন বিবির। না মাথায় না বুকে, কোত্থাও ওড়না নেই মেয়েটার, জেগে আছে ডাগর মাথাখান আর একজোড়া বুক।
“শরমের মাথা খাইসনা আর! বেদাত কাফেরে মত চলচ! মরন হয়না ক্যান এগুনের!” চিরপরিচিত কর্কশ গলায় ডেকে ওঠে করিমন পাখি।
চোয়াল শক্ত করে বড় মেয়ে অফিসের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত পায়ে ফটক পার করে যায়। কোর্টের নোটিশের সাকার অস্তিত্ব সে গ্রাহ্য করে না। করিমন বিবি জানে, তার পিছু পিছু টমিটা, যতটা টমির পৃথিবী, ততটা পর্যন্ত যাবে। সাক্রোশে করিমন বিবি শসায় আরেকটা কামড় বসায়। এবার তার ঠোঁটের কষ বেয়ে শসার অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
টের পায় ছোটোটা সুশীতল বুরহানি গ্লাস নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে কিছুটা দূরে। করিমন বিবি তার দিকে না ফিরেই বলে, “ভিতরে চল।”
২
“কোর্ট থেইকা নোটিশ লাগাই গেচে, মামলা খতম না হওয়ন অবধি বাড়ির জমিনে না কোন গাছ লাগান যাইবো না কোন গাছ কাটান যাইবো না একট ইট গাঁথন যাইবো ঘরের।”
বিস্মিত হন রশিদা বেগম, “ক্যান? এডা হেগুনের বাপের জমিন নাকি!”
ছোট মেয়ে কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে যায়।
সামনে রাখা ট্রে- র উপর তিনটে গ্লাসে বুরহানিরা এতিম পড়ে আছে। রশিদা বেগম উত্তর হাতড়ান, “এহন কি হইবো?!”
করিমন বিবি বলে, “জমি বান্ধাইতে অইবো, তাবিজ পরাইতে অইবো”
রশিদা বেগম বলেন, “ট্যেকা কোই, সোলেইমন আইজ দুই মাস অইলো কিচু কয়না। ট্যেকা দেয়না। তাবিজ করাইবি কেমনে!”
শীতল বুরহানি সহ গেলাসগুলোর গা ঘেমে উঠেছে গরমে, মসৃণ কাঁচের গা বেয়ে ঘাম গড়িয়ে গড়িয়ে নিচের দিকে নামছে।
ছোট মেয়ে নিজের নাকের উপরের ঘাম হাত দিয়ে মুছে নেয়। বয়সের কারণে রশিদা বেগমের বহু বছর হল গায়ে আর ঘাম দেয় না। রোমকূপগুলি বন্ধ হয়ে গেছে, যেন লক আউট, যেন কারখানা ছিল।
গেলাসের ঘাম দেখতে দেখতে আনমনে করিমন বিবি বলে, “হাজার দশেক টাকা হইলেই হইবো, আনিসুর ভাইরে কই গে যাই,”
রশিদা বেগম থোপা থোপা পা ও হাত নিয়ে প্রাগৈতিহাসিক মাকড়শার মত বিছানা জুড়ে ধেবড়ে বসে থাকেন। করিমন বিবি মোবাইল ফোন হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের দিকে যায়। ছোট মেয়ে বলে, “দাদু, বুরহানি,... খাইবেন না?”
উঠোন থেকে কর্কশ আওয়াজ শোনা যায়, “সুমুন্দির পুত!”
সাথে সাথে কিছুতে আহত হওয়ায় টমির কুঁই কুঁই শোনা যায় কিছুক্ষণ।
ট্রে-র উপর বুরহানিদের ঘাম জমে জমে জলাশয় তৈরি হয়েছে, সেই জলাশয়ে রশিদা বেগম উল্টোদিকের দেওয়ালের ছবিতে ঝুলে থাকা একরাম আলির মুখ দেখতে পায়। একরাম আলি তাঁর জীবদ্দশার মতই, ছবিতেও হাসছেন না। একরামের ছবির পানে চেয়ে থেকে আপনমনে খাটের পাশে ভাঁজ করে রাখা নিজের হুইলচেয়ারের গায়ে আদরবশে হাত বোলান রশিদা বেগম। ঘাম আর দেয়না বলেই সম্ভবত তাঁর অশ্রু দেয়,- অহরহ। উভয়ই রেচন ক্রিয়া বটে।
বিকেল হলে এটিএম থেকে আট হাজার টাকা নিয়ে ফেরে করিমন বিবি আর ছোট মেয়ে। রাতে খোনার আসবেন। ছোট মেয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলে করিমন বিবি বিছানায় দেহ এলিয়ে দেয়। বিছানা থেকে কিছুটা উপরে ফ্যান ঘুরছে। করিমন বিবির দেহের ঘাম শুকোচ্ছে। কতকাল হল করিমন বিবির দেহে সুলেইমান রেজা আসে না। সিলিং দেখে করিমন বিবি, ভাবতে থাকে সুলেইমান রেজা এখন দুবাই। টাকা পাঠায় না মাস দুই, ভালোবাসা পাঠায়। পাঁচমাসের পেটে হাত রাখে করিমন বিবি,- প্যাটে সুলেইমন রেজা আইছে।
ফটক খোলার আওয়াজ হয় এমন সময়।
সাত বছর ধরে বিছানায় শুয়ে বসে রশিদা বেগম কার কেমন ফটক খোলার আওয়াজ তা মুখস্থ করেছেন, ফলে আধোঘুমেও বুঝলেন বড় মেয়ে ফিরল। আশ্বস্ত হয়ে দুচোখ বুজে ঘুমের আয়োজন করেন রশিদা বেগম। বড় মেয়ে ঘরে পৌঁছোনোর আগেই রশিদা বেগমের চোখের পাতার নীচে অক্ষিগোলক দুটো ঘুর ঘুর করতে শুরু করে দেয়।
রোশন আরা ফটকের কাছে রাখা টিনের বোর্ডটা মন দিয়ে পড়ল।
তারপর, জুতোর স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে যাওয়ায় বা অন্য কোনো কারণে, ধীরে ধীরে ঘরে এল।
জুতো খুলে রেখে ধীর গতিতে নিজের ঘরে গিয়ে ফ্যান চালিয়ে বসল। ভাবল।- “এবার?!”
করিমন বিবি যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল। রোশন আরার ঘরের দরজাতে দাঁড়িয়ে বলল, “হাজার দুই টাকা লাগব, আইজ রাতে, হইব তর কাছে?”
“কি করবা?”, ভুরু কুঁচকে প্রশ্নটা করায় করিমন বিবি দেখতে পেল রোশন আরা সদ্য ভ্রূ প্লাক করিয়েছে। তাই মনে হচ্ছে যেন রোশন আরার সাথে সাথে তার ভ্রূ জোড়াও করিমন বিবিকে প্রশ্ন করছে। - অবাইধ্য মাইয়ার অবাইধ্য ভ্রূ!
“কোর্টের নোটিশ লাগাইছে, দেখস নাই?”, খোনারের কথা চেপে যায় করিমন বিবি।
রোশন আরা কিছু বলে না। ব্যাগ থেকে খুঁজে খুঁজে নোটগুলো বের করে, “ষোলশ মত আছে।”
টাকা দেখে করিমন বিবির চোখ চকচক করে ওঠে,- তাবিজের লোভে। নোটগুলো দিতে গিয়ে সেই লোভ চোখে পড়ে যায় রোশন আরার।
“তুমি আবার তাবিজ করবা!” করিমন বিবির নাগাল থেকে টাকাগুলো সহসা সরিয়ে নেয় রোশন আরা।
করিমন বিবি টমি হয়ে যায়, টাকাগুলোর জন্য কুঁই কুঁই করে প্রথমে।
তারপর করিমন বিবি করিমন পাখি হয়ে পড়ে, টাকাগুলোর জন্য কর্কশ চিৎকার করে।
অবশেষে করিমন বিবি করিমন বিবি হয়ে রোশন আরাকে অভিশাপ দিতে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
নোটগুলো দলা পাকিয়ে ব্যাগের মধ্যে ফিরিয়ে রাখে রোশন আরা। ঘরের টিউব লাইটটার মত মাথাটা দপদপ করছে তার। যেন এক্ষুনি জ্বলে উঠবে, যেন এখনই পুরোপুরি নিভে যাবে। সে জাহান আরাকে ডাক দেয়, “বোনু, চা!”
কিছুক্ষণ পরে টিউবের কাঁপতে থাকা আলোয় চায়ের কাপ হাতে ছোট মেয়ে আসে। রোশন আরা বোনের দিকে চায়। দপদপ করা টিউবের জন্য মনে হচ্ছে যেন অন্যদিনের চেয়ে বেশি কাঁপছে জাহান আরা।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রোশন আরা প্রশ্ন করে, “খোনার কখন আইবো?”
“রাইত হইবো”
“আমারে ডাকবি না।”
“আইচ্ছা”
“তরে কইছি না, মায় তাবিজ করনের লগে কিছু কইলে আমারে ফোন দিবি!”
জাহান আরা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে যায়।
“মানষের পয়সা ধার কইরা তাবিজ করতাসে, তাবিজ তো নয়, নেশা! হের কুনো শ্যাষ আছে! ব্যাবাক পয়সা পানি হইল হেই কইরা!”
জাহান আরা কিছু বলে না।
“তর কি জ্বর হইছে?”
“ক্যান?”
“কাঁপস ক্যান এমন?”
জ্বর লুকিয়ে জাহান আরা ভয়ে ভয়ে বলে, “লাইট কাঁপতাসে, আমি না।”
রোশন আরা দ্বিরুক্তি করে না, চায়ে মন দেয়। জাহান আরা স্বস্তিতে টিউবের আলোর সাথে সাথে কাঁপতে থাকে।
৩
খোনার এসে গজগজ করতে করতে হাজার আটেক টাকা নিয়ে চলে গেছে ঘন্টাখানেক হল। অবশ্য কথা দিয়ে গেছে জমি ছাড়িয়ে দেবে। কবে?- তা বলেনি, হাজার দশ না পেলে কবে তা বলা সম্ভব না। করিমন বিবি শুতে এসে দেখে বড়মেয়ের ঘরে আলোটা তখনও দপদপ করছে। করিমন বিবির গা জ্বলে যায়। নবাবের বিটি সব।
দপদপ করা আলোতে কি এক বই পড়তে পড়তে রোশন আরা ঘুমিয়ে গিয়েছে। ভুরুগুলোও এখন ঘুমোচ্ছে দেখে নির্ভয়ে বড়মেয়ের ঘরে ঢুকে আসে করিমন বিবি। তার বুকের ওপর থেকে মোটা বইটা তুলে নিয়ে বইয়ের নাম দেখে,- মহাবিশ্ব মহাপ্রাণ, নিচে লেখা জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত। “মহাবিশ্ব মহাপ্রাণ” টিউবের আলোয় দপদপ করছে। যেন এই জ্বলে উঠবে, যেন এখনই পুরোপুরি নিভে যাবে। বইটার পাতা ওল্টায় করিমন বিবি। চাঁদ তারা সূর্যর কথা লেখা বইতে। দপদপে আলোয় সব থিরথির কাঁপছে।
বড়মেয়ের দিকে চায় করিমন বিবি... করিমন বিবি মায়ায় করিমন মা হয়ে যায়। এমন শান্ত প্রশ্নহীণ সন্তান কামনা করেছিল সে। ঘুমন্ত ভুরুদের প্রতি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, নিঃশব্দে বইটা বন্ধ করে রোশন আরার মাথার পাশে রেখে, টিউব লাইট বন্ধ করতে যায়। হঠাৎ জানালার বাইরে খচখচ আওয়াজ শুনে আশরীর রোম খাঁড়া হয়ে যায় করিমন বিবির। টিউব বন্ধ করা হয় না। জানালার কাছে এসে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে করিমন বিবি করিমন সেনা হয়ে যায়। হাঁক পাড়ে, “হালারপুত! হারামজাদা!”
বড়মেয়ের ভুরু দুটো জেগে যায়।
জানালার বাইরে টমি চমকে ওঠে।
করিমন বিবি হাতের সামনে রাখা চাঁদ তারা সূর্য আদিম মানব গোঁজা মহাবিশ্ব মহাপ্রাণ ছুঁড়ে মারে জানালা দিয়ে।
টমির চিরপরিচিত কুঁই কুঁই শোনা যায় কিছুক্ষণ।
টিউবের আলোয় কাঁপতে কাঁপতে করিমন বিবি বড়মেয়ের দিকে তাকায়। দেখে, ভুরু ঘুমোল পাড়া জুড়ল।
এরপর কাঁপতে কাঁপতে করিমন বিবি টিউব লাইট নেভায়। পেট ভর্তি সোলাইমান রেজা নিয়ে নিজের ঘরে এসে বিছানায় এলিয়ে পড়ে।
এরপর সারা বাড়ি ঘুমে।
আরেকটু রাতের দিকে করিমন বিবির মাথার ভিতর রোশন আরা এসে দাঁড়ায়। আর তাকে ঘিরে পশ্চিম থেকে পূর্বে নিজের অক্ষের চারপাশে গোল করে ঘুরে বেরায় কিছু মাদুলি, তাবিজ আর কবজ। ঘুমের মধ্যে করিমন বিবির মুখ সুপ্রসন্ন হয়ে ওঠে।
বাইরে অন্ধকারে কোর্টের নোটিশ একা একা ফটক পাহারা দেয়।
চিত্রসৌজন্যঃ ঈপ্সিতা পাল্ভৌমিক