এর আগের বার লিখেছিলাম যে করোনা বাতাসে ভাসমান অবস্থায় সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম, এবং কেবলমাত্র ড্রপলেট বা বড় কণার মাধ্যমেই নয়, অতি সূক্ষ্ম কণার মাধ্যমে প্রায় ঘন্টা তিনেক বাতাসে ভাসমান অবস্থায় থাকে | কাজেই একটির জায়গায় দুটি মাস্ক পরলে সুবিধে হবে। এই নিয়ে বন্ধুরা প্রশ্ন করেছেন, যে একটির জায়গায় দুটি মাস্ক পরলে বাড়তি কি সুবিধা?এই নিয়ে দু-একটি বক্তব্য রাখা যাক। দুই, আরো একটি ব্যাপার পরিষ্কার করা উচিৎ, যেহেতু বহুকাল ধরে, বিশেষ করে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় থেকেই জানা আছে যে করোনাভাইরাস হাওয়ায় ভাসমান অবস্থায় অবস্থান করে, তবে শুরু থেকে বিশেষজ্ঞরা কেন বলে আসছিলেন যে শুধুমাত্র ড্রপলেট নিয়ন্ত্রণ করলেই চলবে, বিশেষ করে যখন মাস্ক পরিধান, বাড়ির ভেনটিলেশন, ইত্যাদির দিকে নজর দেওয়া সমান গুরুত্বপূর্ণ। তিন, মেলা বা জনসমাবেশ কেন করোনাভাইরাসের বৃদ্ধির জন্য এত মারাত্মক বলে মনে করা হয়?
দুটি মাস্ক পরার কথা বলা হচ্ছে কেন?
দুটি মাস্ক পরার কথা বলা হচ্ছে। ভাল দু-লেয়ারের মাস্ক হলেও চলবে। না হলে দুটি মাস্কের মধ্যে একটি মাস্ক সাধারণ মানের সার্জিকাল মাস্ক, মুখের ওপর হালকা করে পরা থাক, তার ওপর কাপড়ের একটি মাস্ক চাপান, যাতে করে মুখের অংশটি রীতিমতন ঢেকে যায়। এতে করে কি উপকার হবে? আসলে যে অবস্থায়ই হোক, মাস্ক পরার উপকারিতা আপনার নিজের শরীর থেকে জীবাণু অন্য কারোকে সংক্রমণ করতে গেলে আটকে যায় । যে কারণে শল্যচিকিৎসকরা মুখে মাস্ক পরে অপারেশন করেন, যাতে তাঁর মুখ থেকে বা নাক থেকে নির্গত জীবাণু যে রোগীর ওপর অপারেশন করছেন তাঁর শরীরে না প্রবেশ করতে পারে। একই কারণে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও মুখে মাস্ক পরার কথা বলা হচ্ছে যাতে করে, আপনার শরীরে যদি সংক্রমণ হয়েও থাকে, তাহলে সেই সংক্রমণ অন্য কারো শরীরে যাতে সহজে না প্রবেশ করতে পারে। এখন আমরা এও জানি যে বাতাসে ভাসমান বড় বা ক্ষুদ্র কণার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায়, কাজেই যত ভালভাবে নিজের নাক-মুখ ঢেকে রেখে সেই সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার পথ রোধ করতে পারব, তত অন্যেরা আমার কাছ থেকে নিরাপদ থাকতে পারবেন। পরিভাষায় এই ব্যাপারটিকে বলে "সোর্স কন্ট্রোল"। কিন্তু মাস্ক মাত্রেই তাতে ছিদ্র থাকবেই, কারণ না হলে বায়ুর গতিরোধ হবে | তা হলে উপায়?
চিত্র ১: সুইস চিজ মডেল | অকল্যাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রে প্রাপ্ত চিত্র |
২০০০ সালে ব্রিটিশ মনস্তাত্ত্বিক জেমস রিজন চিকিৎসকদের ভুলভ্রান্তি নিয়ে লেখা একটি গবেষণাপত্রে লেখেন যে ব্যক্তিমানুষের ওপর জোর না দিয়ে যদি ভুলচুক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গোটা সিস্টেমটির দিকে নজর দেওয়া যায়, তাহলে উপকার হতে পারে [১] , এবং তাতে তিনি সুইস চীজের উদাহরণ তুলে ধরেন। রিজন লিখেছিলেন, মনে করুন একেকটি সিস্টেম যেন একেকটি সুইস চিজের স্লাইস। সুইস চিজের স্লাইসে ছিদ্র থাকে। সিস্টেমটি যদি সুইস চিজ হয়, তাহলে সেখানকার ভুলভ্রান্তিকে মনে করুন সুইস চীজের ছিদ্র। এবার পরপর যদি দুটি তিনটি চিজের স্লাইস পরপর সাজানো যায়, তাহলে একটি ছিদ্র অন্য একটি স্লাইস দিয়ে ঢেকে দেওয়া যাবে, যাতে করে ভুলের সম্ভাবনা কম হবে। তা এই মডেলটি করোনাভাইরাস ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণ করার কাজেও আজকাল ব্যবহার করা হচ্ছে, ও দুটি মাস্ক পরার ব্যাপারটিকে এইভাবে ভাবতে পারেন যে, ভিতরের দিকে মাস্কে যে ছিদ্র, বা বায়ুপথ থাকবে, তার ওপরের দিকের মাস্ক পরলে সেই সমস্ত ছিদ্র আটকানো যাবে (চিত্র ১ দেখুন) | যার জন্য একটির জায়গায় দুটি মাস্ক পরলে যে সূক্ষ্ম বায়ুকণা বাহিত হয়ে করোনাভাইরাসের নির্গমনের পথ অনেকটাই আটকানো যাবে বলে মনে করা হয়।
করোনা যদি বাতাসে ভাসমান অবস্থায় থাকে, তাহলে কেবল ছ ফুট দূরত্ব, ইত্যাদির কথাই কেন বলা হচ্ছিল?
করোনার ড্রপলেট এবং ক্ষুদ্র কণায় সংক্রমণ নিয়ে সম্প্রতি জয়ন্ত ভট্টাচার্য বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন | যে কারণে প্রশ্ন উঠছে যে কেন প্রথম দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ছ-ফুট দূরত্ব, হাত ধোয়া, ইত্যাদি বিষযের ওপর যতটা জোর দিয়েছিলেন, মাস্ক পরা, ঘরের ভেনটিলেশন ইত্যাদি নিয়ে ততটা সতর্ক করেন নি। কেন? স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের মতে এঁরা দুটি কারণে মনে করছিলেন যে মূলত অল্প দূরত্বের হাঁচি কাশির মাধ্যমে, বড় ড্রপলেটের মাধ্যমেই করোনাভাইরাস ছড়ায়, কারণ এক, কোভিডের সংক্রমণ ক্ষমতা তেমন বেশী নয়। মানে একটি ঘরে একজন আক্রান্ত মানুষ বহুলোককে সংক্রমণ করেন না। দু নম্বর কারণ, যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের অসুখের বহি:প্রকাশ সর্দি-কাশি ইত্যাদি | তখনো অবধি, এসিমপটোমাটিক বা প্রিসিমপটোমাটিক (অর্থাৎ লক্ষণ বেরোয়নি এমন) মানুষের মাধ্যমে যে প্রায় ৫৯% সংক্রমণ ছড়ায়, তখনো সে ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা ভাবনা হয়নি। ফলে কম মাত্রার সংক্রমণ ও সর্দি-কাশির মাধ্যমে রোগ ছড়ানোর দুটি ব্যাপার বিবেচনা করলে এঁরা ধরে নিয়েছিলেন যে নিশ্চয়ই যাঁরা আক্রান্ত মানুষজনের কাছাকাছি রয়েছেন এবং যাঁদের নাক-মুখ থেকে কফ/থুতু বেরোচ্ছে, তাঁদের ওই জাতীয় বড় আকারের এরোসল/ড্রপলেটের মাধ্যমেই অসুখ ছড়াচ্ছে। এবং যার জন্য বার বার করে সাধারণ হাইজিন ও মানুষে মানুষে অন্তত ছফুট দূরত্ব, সোস্যাল ডিসটেনসিং এর ওপরেই বার বার জোর দেওয়া হচ্ছিল। এতে করে কাজও হচ্ছিল,কিছুটা স্বাভাবিক ভাবেই, কারণ নিরাপদ দূরত্বে থাকলে বড় ড্রপলেটই নয়,ছোট এরোসল নিয়ন্ত্রণ করা কিছুটা হলেও সম্ভব হচ্ছিল তো বটেই |
মেলা এবং জনসমাগম কেন করোনা সংক্রমণে মারাত্মক?
সূত্রসমূহ
[১] Reason J. Human error: models and management. BMJ [Internet]. 2000 Mar 18 [cited 2021 Apr 21];320(7237):768–70. Available from: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1117770/
খুব জরুরী লেখা এই সময়ের জন্য।
কয়েকটি প্রশ্ন ছিল:
সার্জিক্যাল মাস্কের কার্যকারিতা প্রায় 89% শতাংশ বলা হচ্ছে। এটা কতটা সত্যি ? যদি n95 মাস্ক না পায়, সেক্ষেত্রে দুটো সার্জিক্যাল মাস্ক পড়লে কি লোকে অনেকটা নিরাপদ ?
চোখ, কান এইসব অঙ্গের সুরক্ষা কতটা প্রয়োজনীয় ?
অনেকে মাথা বিশেষ ভাবে ঢেকে বেরোচ্ছেন। এর দরকার আছে ?
করোনায় এফেক্টিভ ওষুধের জন্য গবেষণা চলছে কি ?
এই ছবিতে দেওয়া তথ্য গুলো কতখানি সঠিক একটু জানাবেন দয়া করে? কিছুদিন আগে কাপড়ের মাস্ক পরলেও চলবে বলা হয়েছিল। এখন বলছে কোন কাজই হবে না ভাইরাস ফেরাতে!
একটা করোনা ভাইরাসের আকার 0.1µm আর কাপড়ের মাস্কের বুননের ছিদ্রের আকার 5 to 200 µm । কাপড়ের মাস্ক এর ছিদ্র দিয়ে এটা সহজেই প্রবেশ করতে পারে এমনকি দু-লেয়ার কাপড় থাকলেও তা কতটুকু আটকাতে পারবে? যদিও দেখছি অনেকেই কেবল একটি কাপড়ের মাস্ক পড়েই ঘুরছেন। আমার প্রশ্ন, একটা কাপড়ের আর একটা সার্জিক্যাল মাস্ক পড়লে কত শতাংশ সুরক্ষা পাওয়া যাবে করোনা ভাইরাস সংক্রমন থেকে। এটা কি ৯০ শতাংশের বেশি?
এই লিঙ্কের লেখাটা একটু পড়ে দেখুন, কাজে লাগবে:
মাস্কের প্রধান উপকার রোগীর নাক মুখ থেকে এরোসলের মাধ্যমে অসুখ না ছড়ানোর। যেহেতু একা মাস্ক যথেষ্ট নয়, বরং আরো অনেক কিছুর সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়, কোন মাস্কে কতটা উপকার হবে, এই ধরণের মন্তব্য অপ্রাসঙ্গিক।
@Ramit, সাধারণ মানুষের, মানে যাঁরা রোগী দেখেন না, তাঁদের চোখ ঢাকার বিশেষ প্রয়োজন নেই। কান ঢাকার প্রায় কোন দরকার নেই ।
@প্রতিভা,
https://www.recoverytrial.net/
এই লিঙ্কটি দেখতে পারেন।
অরিনদা, চশমা পরার প্রোটেক্টিভ এফেক্ট সংক্রান্ত এই স্টাডি নিয়ে কী বলবেন? এই নিয়ে দ্বিমত, বিতর্ক থাকতেই পারে কিন্তু ওড়ানো যায় কি? আর পরলে লাভ থাকতে পারে অথবা নেই, কিন্তু ক্ষতি ত নেই। রোগী দেেখ
https://jamanetwork.com/journals/jamaophthalmology/fullarticle/2770872
আগের পোস্ট এ এডিটরে লিখতে সমস্যা হচ্ছিল।
যেটা বলছিলাম, যদি রোগী দেখা ব্যক্তিকে প্রোটেকশনের জন্য পরতে বলা হয়, তাহলে তো রিস্ক আছে বলেই বলা। এবার ভারতের মত জনঘনত্বের দেশে, বিশেষ করে শহরগুলোতে, যেখানে রাস্তাঘাটে বাদেট্রেনে হাস্পাতালের লাইনে প্রচুর ভিড়ভাটটা, র্যালি, বাজারের ভীড়, ক্লোজ কন্টাক্ট এড়ানো সম্ভব না, সোশাল ডিস্টান্সিং বহু সময়েই রাখা যায়না, আর এই মাত্রায় কেস, সেখানে পরলে লাভ বই ক্ষতি তো নেই।
ঈপ্সিতা,
প্রথম কথা, সহমত।
কথাটা তো ঠিকই, যে চোখের পথ ধরে, কনজানকটাইভার সূত্রে করোনা ছড়াতে পারে | সুতরাং চশমা পরলে ক্ষতি কি? কিন্তু কি জান? এক বছরের ওপর ধরে চলছে, মানুষ ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছে | তবে সবই তো তুলনামূলক, চশমা থাকুক চোখে, নাকে মুখে মাস্ক ঢাকা কিন্তু খুব জরুরী, ও সে মাস্ক ঠিকমতন পরা চাই | মাস্ক পরা হল, কিন্তু থুতনীর নীচে নামিয়ে "ওই, একটু বুড়ি ছোঁয়ার মতন ঝুলিয়ে রাখি আর কি!" (আমাদের কলকাতার ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী ভদ্রলোক তাঁর মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে ফোনে বলছিলেন ফেব্রুয়ারী মাসে), এই ব্যাপারটি যেন না হয়।
তবে সবচেয়ে বড় কথা, ভিড়ের মধ্যে একেবারে না যাওয়া | ইলেকশন রালি আর কুম্ভমেলা যে কি ভয়ংকর ক্ষতি করেছে, ও কেন, তাই নিয়ে বিশদে লিখছি। একটু সময় চাই লেখার। এ ব্যাপারটা বেশ জটিল |
জরুরি লেখা