“এ হে এ হায়েই তিমরেই মায়া লাগছা বারিলাই
হে এ এ হায়েই তিমরেই ইয়াদো আউছা বারিলাই
তিমিলাই সমঝি যাদুছুরাতি
পোলি রাহাঞ্ছা ইয়াদো মাছাতি
কা দেখু কা ভেটু ভওইরাহাঞ্ছা
তিমরেই কুরা মনমা খেলি রাহাঞ্ছা
আফনো ভান্ডানি তিমরেই ছ পিরা
আঁখো মা সাধয়েই তিমরেই তসবির
এ হে এ হায়েই তিমরেই মায়া লাগছা বারিলাই
হে এ এ হায়েই তিমরেই ইয়াদো আউছা বারিলাই”
লিংতাম মনাস্টারির পাশ দিয়ে ঘুরে পরের স্তরের রাস্তায় উঠতেই গোটা গাড়ি জুড়ে গেয়ে ওঠেন এলিনা চৌহান। সুনীল মোবাইল বের করে গাড়ির মিউজিক সিস্টেমের সাথে ব্লু টুথ দিয়ে জুড়ে দিয়েছে। তখন অবশ্য শিল্পীর নামটাম জানতাম না, সেসব নীচে এসে ইউটিউব থেকে জেনেছি। গানটার মাদকতাময় সুরে আমি তো বটেই খেয়াল করি প্রায় সব আরোহীই তাল দিচ্ছে গানের সাথে সাথে। খেয়াল করে শুনলে মানেও খানিক খানিক বোঝা যায়। এত পছন্দ হয়ে যায় গানটা যে সুনীলকে বলি আমাকে শেয়ার করে দিতে। এই গানটার সূত্রে আরো বেশ কিছু নেপালী শুনে ফেলি পরে। আমাদের পরের কয়েক দিন এই গান ঘুরেফিরেই বাজায় সুনীল, এই ট্রিপটার থিমসং হয়ে যায় গানটা।
লিংতাম গ্রামের উচ্চতা মোটামুটি ৫০০০ ফুটের মত। আজ আমরা পৌঁছাব নাথাং উপত্যকা, উচ্চতা ১৩২০০ ফুট। ৪০ কিলোমিটার রাস্তা যেতে আমাদের উঠতে হবে কমবেশী প্রায় আট হাজার দুশো ফুটের মত। বছর আট নয় আগে গ্যাংটক থেকে সোজা নাথু-লা ছাঙ্গু লেক গিয়ে আমার শ্বাসকষ্ট, বমিভাব, মাথাঘোরা হয়েছিল সেকথা মনে করে এইবার বেরোনর আগেই একটা ডায়ামক্স খেয়ে নিয়েছি। কাল আসার সময় সপ্তক পালস কিনে নিয়েছিল সেও পকেটে আছে দুই তিনটে। পরে অবশ্য দেখা গেছিল ওই লজেন্সটার নাম ‘পাওয়ার’, দেখতে এবং খেতে যদিও অবিকল পালস। তা সব মিলিয়ে উচ্চতাজনিত অস্বস্তি অসুবিধে কোথাও তেমন হয় নি। এরকম ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে ওঠার সময়ে আরেকটা জিনিষ খেয়াল রাখতে হয়, পেট সম্পূর্ণ খালি বা গলায় গলায় ভর্তি কোনওটাই করা চলে না। দুইক্ষেত্রেই আমার বেদম গা গুলায়। আমি তাই সেদিনকার জলখাবারের হিসেবে আর একটা কি দুটো লুচি খাবার মতন জায়গা রেখেছিলাম পেটে। দেবাশীস আর রোমার একটু বাদে বাদে চা তেষ্টা পায়, কাজেই ঠিক হয়েই আছে জুলুকের জিগজ্যাগ রাস্তার সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে আমরা চা বিরতি নেব।
তিব্বাতের লাসা থেকে বাংলার তাম্রলিপ্ত বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৯০০ কিলোমিটার রাস্তা এসেছে নাথু-লা অথবা জেলেপ-লা হয়ে পূর্ব সিকিমের মধ্যে দিয়ে যাকে আমরা প্রাচীন রেশম পথ বলে জানি। কেউ কেউ একে দক্ষিণ পশ্চিম রেশম পথও বলেছেন। ধারণা করা হয় খ্রীষ্টজন্মের প্রথম একশো বছরের মধ্যেই এই পথ ব্যবহার শুরু হয়, যদিও নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই পথের বেশ বড় অংশই বরফে ঢাকা থাকে বলে অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয়। তবে তাম্রলিপ্ত বন্দরই লাসার সবচেয়ে কাছের সমুদ্রবন্দর। নামে রেশমপথ হলেও রেশম বা সিল্ক তত নয়, এই পথে মূলত ঘোড়া আর চা আমদানী রপ্তানী হত। চীনের চা লাসা থেকে তাম্রলিপ্ত থেকে জাহাজে করে শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড ইত্যাদি অঞ্চলে চালান যেত। এছাড়া চিনি, নুন, তামা আর সুতীবস্ত্রও এই পথে বেচাকেনা হত। সেন্ট্রাল এশিয়ার রেশমপথের সাথে এই পথের আরেকটা তফাৎ হল, এপথে কাফেলাগুলো ঘোড়ার কাফেলা হত, উটের নয়। সমতলে নামার পর কাফেলাগুলো বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরের পথে চলে যেত ব্যবসার প্রয়োজনে। তমলুক ছাড়াও উয়াড়ি-বটেশ্বর, মহাস্থানগড়, বিক্রমপুর ইত্যাদি বন্দরও উল্লেখযোগ্য ছিল। তা পথটা লাসা থেকে নাথু-লা বা জেলেপ-লা দিয়ে ঢুকে কুপুপ, নাথাং ভ্যালী, পদমচেন, জুলুক, লিংতাম, রংলি হয়ে রেশিখোলা দিয়ে পেডং তিস্তাবাজারের রাস্তায় নেমে আসে।
৩রা এপ্রিলের সকাল থেকেই ঝলমলে রোদ্দুর। সুনীল আমাদের আশা দেয় এমন চমৎকার আবহাওয়ায় থাম্বি ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা হয়ত দেখা যাবে আজ। আসার সময় প্লেন থেকে একেবারেই দেখা যায় নি, এ অঞ্চলে এসে কাঞ্চনদাদুর সাথে একবার অন্তত দেখা সাক্ষাৎ না হলে মনটা কেমন খারাপ খারাপ লাগে না? পদমচেনের ঠিক আগে একটা বাঁকের মুখে খান দুয়েক চা’য়ের দোকান আর বাথরুম আছে। অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, আমরাও দাঁড়ালাম। এখান থেকেও জুলুক জিগজ্যাগ দেখা যাচ্ছে, তবে খুব ভাল ছবি আসবে না, মাঝে প্রচুর গাছপালা, পাহাড়ের ঢালে বাড়ির টিনের চাল ইত্যাদি এসে যাচ্ছে। এইখানে এসে অনুভব করি ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্সটা আনা উচিৎ ছিল। এদিকে সে লেন্স তো বসে আছে পুণের বাড়িতে, আমি যখন নভেম্বরের শেষে বাড়ি আসি তখন এদিকে আসার কোন পরিকল্পনা ছিল না। ডিসেম্বরে দার্জিলিং যাব বলে ৭০-৩০০ খানা সাথে নিয়েছিলাম আর ওই ১৮-৫৫। সপ্তকও ওয়াইড অ্যাঙ্গল আনে নি সাথে। অগত্যা কি আর করা, যতটুকু যা হয় তাই নেবার চেষ্টা করি।
জুলুক ৭০০০ ফুট, পদমচেন ৮০০০ ফুট, মোবাইলে নেট আছে, তাপমাত্রা দেখায় -৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ফিলস লাইক -৮। ট্রি-লাইন মোটামুটি পদমচেনের আগেপরেই শেষ হয়ে গ্রাস লাইন শুরু হয়ে যায়। দেবাশীস চায়ের অর্ডার দেয় আমরা বাথরুমের খোঁজে যাই। পাহাড়ের গা বেয়ে অল্প নেমে পাশাপাশি দুটি বাথরুম, সামনে মস্ত চৌবাচ্চায় জল রাখা। একটা ছোটমত প্ল্যাস্টিকের বালতি রাখা আর একটা বড়সড় রান্নার তেল বা ডিজেল কিছুর একটা জেরিক্যান, মুখটা অনেকটা কাটা রাখা আছে। ওতে জল ভরে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। চৌবাচ্চার সামনে একটি ২৪-২৫ বছরের ছেলে দাঁড়ানো, ৫ টাকা করে মাথাপিছু সংগ্রহ করার জন্য। বেশ পরিস্কারই বলতে হবে। রোমা ভেতরে যায়, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর সাথে গল্প করি। এদিকে চারিদিকে অজস্র পোকা উড়ছে। বেশ বড় বড় হলদে রঙের লম্বাটে আকৃতির পোকা, গায়ে মাথায় ত বটেই, হুডের ভেতরে, চোখের পাতায়, ফ্লিসের কলারের ভেতরে ঢুকে আসে। একটু জোরে থাবড়া মারলেই কেমন চেপ্টে ভচকে যায়। ছেলেটি বলে আজ এত চমৎকার রোদ উঠেছে একটু তো পোকা হবেই। ও কিছু না, মেঘ করলেই এরা মাটিতে নেমে যাবে। ও-ই বলে ট্যুরিস্টরা লাফালাফি করলে কী হবে এবারে বরফ বেশ কম পড়েছে। এপ্রিলের শুরুতে এইসব জায়গায় রাস্তায় না হোক অন্তত পাহাড়ের গায়ে বরফ থাকে।
ছেলেটিই বলে গত দুই সপ্তাহ যাবৎ থাম্বি ভিউ পয়েন্ট বা জুলুকের আশপাশ কোথাও থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে না। এদিকে আকাশ পরিস্কার ঝকঝকে থাকলেও ওদিকটা মেঘ আর কুয়াশায় ঢাকা থাকছে রোজই। ওদিকে বৃষ্টি বা তুষারপাত না হলে আকাশ পরিস্কার হবে না। দেবাশীস বলে তাহলে আর থাম্বিতে দাঁড়াবার দরকার নেই, সোজা নাথাং চলে যাই। আমরা রাজী হই, তবে থাম্বির বেশ কয়েক স্তর নীচে গাড়ি দাঁড় করায় দেবাশীস। তারপর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সরসর করে নেমে যায় অনেকটা জিগজ্যাগের আরো ভাল ভিউ পাবার জন্য। সপ্তক আর রোমা অল্প কিছুটা নেমে ক্ষান্ত দেয়, শহুরে লোকের ফালতু পাঙ্গা নিয়ে কাজ নেই। আমি আদৌ নামার চেষ্টাই করি না। একে তো ভার্টিগোমত আছে তায় চোখেও ঠিকঠাক দেখি না, আমি বরং আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে সুনীলের সাথে গল্প করি। ও আমাকে অনেক নীচের কোনও একটা ধাপ দেখিয়ে বলে ওখান থেকে ঘুরে আর একটু নেমে পেছন দিকে গেলেই ওদের গ্রাম বখখুতের। সেখানে ওর বৌ বাচ্চা আর মা আছে। ওর দাদা তার বৌ বাচ্চা নিয়ে পাশেই থাকে। ওরা দুজনেই গাড়ি চালায়। এই তো মার্চ থেকে মে আর অক্টোবর নভেম্বর এই ক’মাসই ট্যুরিস্ট নিয়ে ঘোরাফেরা। বর্ষায় ওরা অল্প কিছু চাষবাস করে শীতে শুধুই ঘরে বসে খাওয়া। শীত শুধু খরচের কাল।
বেলা ১টা নাগাদ পৌঁছে যাই নাথাঙে। বিবর্ণ ঘাসে ভরা উপত্যকা, নাথাঙ গ্রামে ঢোকার মুখে একটা মাঝারি সাইজের ইয়াকের গোয়াল। পাহাড়ি গ্রাম, দু’একটা পাকা রাস্তা আর বাকীটা পাথর বিছানো। ধার দিয়ে খোলা নালা। অল্প জল ঝিরঝির করে বইছে কি বইছে না। চারিদিকে টিনের চালওয়ালা দোতলা কি তিনতলা সবুজ রঙের বাড়ি। গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডা হাওয়া কাঁপিয়ে দিল। গ্রামের যে কোনও জায়গা থেকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে বরফচুড়া, পাহাড়ের গায়েও লেপটে আছে কিছু বরফ। তাপমাত্রা দেখাচ্ছে -৩ সেন্টিগ্রেড ফিলস লাইক -৬। বরফিলা হাওয়া এসে সোজা ঢুকে যাচ্ছে হাড় অবধি। আমাদের আজকের রাত্রিবাস সোনম’স হোমস্টে। রাস্তা থেকে বেশ একটু ভেতরে। দোতলা বাড়ি, বারান্দার পাশে একটানা ঘর। ওই দিল্লিতে যাকে ট্রেনের মত বাড়ি বলে, সেইরকম। বারান্দায় উঠেই একতলায় আমার ঘর। দেবাশীস আর সপ্তকরা দোতলায় দুটো ঘর নেয়। হাত ধুতে কলের জলে হাত দিয়েই মনে হল হাত কেটে গেল। চোখ তুলে দেখি গিজার নেই, আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখি বাল্ব আছে তবে কারেন্ট নেই তখন। কোনওমতে হাত মুখ ধুয়ে একতলাতেই খাবার ঘরে যাই। ঠান্ডায় হাতের পাতায়, আঙুলে ঝিঁঝি ধরে গেছে। একটা উঁচু টেবল, দুইপাশে দুটো বেঞ্চ পাতা বসার জন্য। মালকিন মহিলা বেড়ে দেন গরম গরম ধোঁয়াওঠা ভাত, কাঁচালঙ্কাকুচি দিয়ে আলুসেদ্ধমাখা, আলুর তরকারি, প্রায় ফুটন্ত ডাল। খেতে খেতেই ভেজে আনেন গরমাগরম অমলেট। খেতে খেতে হাতে সাড় ফেরে, খেয়ে উঠেই বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান হয়ে যায়। তখনও জানতাম না নাথাঙের রাত্রি আমাদের জন্য কী রেখেছে তার ভাঁড়ারে।
ঠান্ডার বহর দেখে আমি সবেধন নীলমণি উলের মোটা সোয়েটার বের করে পরে তার উপরে পাতলা ফ্লিসটাও পরে নিই, উলের টুপি, মোজা, দস্তানাও পরি। বেশ আরাম লাগে, বারান্দায় বেরিয়ে দেখি একটা চমরি গাই প্রায় বারান্দায় উঠে এসেছে খাবার দাবারের সন্ধানে। মালকিন, আমাদের বলেছিলেন ‘বইনি’ বলে ডাকতে, তাকে ‘হুরররর’ আওয়াজ করে তাড়া দেন। সে ধুপধাপ করে সরু ওঠার রাস্তাটা দিয়ে নেমে যায়। আমরা বলাবলি করি ইয়াক মহাশয়া দেখতে বেশ সুন্দরী, কপালে কেমন সাদা একটা টিপ আছে! আমার আর রোমার গলার আওয়াজে ইয়াকসুন্দরী মুখ তুলে হাসিমুখে তাকায় আমাদের দিকে। দুজনের কারো হাতেই ফোন নেই, আমি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকি ফোনটা আনতে। ওব্বাবা ফোন টোন নিয়ে এসে দেখি তিনি চলে গেছেন। সেই যে গেলেন, পরেরদিন সকাল পর্যন্ত আর তাঁর সাথে দেখা সাক্ষাৎ হল না, আমাদের ছবি নেওয়াও হল না। অমন হাসিমুখের ইয়াকের দেখা কি আর পাব কোনোদিন? সপ্তক অবশ্য বলে ভেবে দ্যাখো আমরা ঢুকছিলাম সময় যদি ও আসত আর এরকম তাড়া খেত তাহলে আমাদের উপরেই অমন ধপাস করে পড়ত, তখন ব্যপারটা তেমন সুবিধের হোত না। ইতিমধ্যে সুনীল গাড়ি এনে দাঁড় করিয়েছে। এখানে রাস্তা এত সরু যে গাড়ি একটু দূরে অপেক্ষাকৃত চওড়া পাথরের চাতালে রাখতে হয়েছে। দরকারমত এনে সরু পথের মুখে রাখে, আমরা সরু ঢালু এবড়ো খেবড়ো অংশটুকু হেঁটে গিয়ে উঠি। পরেরদিন সকালে অবশ্য বোঝা গেছিল হোমস্টে থেকে রাস্তায় ওঠার ঢালু পথটুকু আসলে উপরের ঢালের বরফগলা জল নেমে যাবার নালা।
আমাদের আজকের লক্ষ্য আদি বাবামন্দির। বাবা হরভজন সিং সম্পর্কে মিথ নিশ্চয়ই সবাই জানে। প্রচলিত বিশ্বাস নাথু-লা অঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমস্ত সেনাকে তিনি, মানে তাঁর ভুত সবরকম বিপদ থেকে রক্ষা করে। তো এহেন বাবার আদি মন্দির এই নাথাং উপত্যকা থেকে কিছুদূরে, কুপুপের রাস্তায় টুক-লার কাছে বাবার সমাধিস্থলে। যেহেতু এদিকে প্রকৃতি তত অনুকুল নয়, ভ্রমণার্থী কম আসে গ্যাংটক ছাঙ্গুর তুলনায়, তাই ছাঙ্গু লেক ছাড়িয়ে আরেকটি বাবামন্দির তৈরী করেছে বাবার ভক্তরা। সে মন্দির আমি ছাঙ্গু নাথ-লা যাবার সময় দেখে এসেছি। ওখানকার প্রসাদ খেতে বেশ ভাল। এই আদিবাবা মন্দির আসলে ক্যাপ্টেন হরভজন সিঙের বাঙ্কার এবং সমাধি, রাস্তা থেকে ৫০টা সিঁড়ি উঠে দেখতে হয়। সিঁড়ির মুখে জুতো খুলে জমা রাখার জায়গা, এখান থেকে একরকম পাতলা জুতো দেয় কারো যদি খালিপায়ে উঠতে কষ্ট হয় সেজন্য। সে জুতো দেখে মনে হল ঠিক কাপড় নয় পলিথিন জাতীয় কিছুর তৈরী, যাঁরা পরে উঠছেন দেখলাম অল্প অল্প হড়কাচ্ছেন। আমরা একজনও উঠতে উৎসাহী হলাম না, যদিও উপর থেকে চারিদিকের ভিউ আরো ভাল পাওয়া যাবে মনে হল। বেলা তিনটে বাজে ভালই রোদ্দুর অতএব ভাল ছবি হবার আশা নেই। তাহলে আর খামোখা অত চাপ নিয়ে কী হবে!
মন্দিরের সিঁড়ির গায়েই একটা ক্যান্টিন, সেখানে নাকি ভাল মোমো পাওয়া যায়। এদিকে এমন এলোমেলো বরফিলা হাওয়া বইছে যে ফোনে ছবি তোলাও বেশ মুশকিল। ওদিকে টাচফোন দস্তানাপরা আঙুলের ছোঁয়া চিনতে পারে না, কি গেরো বলুন দিকি? সেই দস্তানা খোলো রে তবে ফোন অপারেট করা যাবে। এই করতে গিয়ে আমার ডানহাতটা আবার অবশমত হয়ে গেল। সপ্তক আর দেবাশীসেরও হাল খারাপ, দুজনেই পাতলা উইঞ্চিটার, রেনকোট টাইপের পরে এসেছে, তাতে ঠান্ডা কিছুই মানছে না। এদিকে সেই হোমস্টে থেকে বেরোবার আগেই এয়ারটেলের সিগনালও চলে গেছে, কাজেই তাপমাত্রা কত বোঝার উপায় নেই। আমরা গুটিগুটিপায়ে ক্যান্টিনে গিয়ে দেখি সে বন্ধ। নীচ থেকে সাপ্লাই আসলে আবার খুলবে। এদিকে চারটে বাজতে না বাজতেই চারিদিক হঠাৎ মেঘে ঢেকে গেল। ঘন ছাইরঙের মেঘ নেমে আসছে ছেয়ে ফেলছে চারপাশ, কখনো আবার খানিক সরে গিয়ে সূর্যও দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বেশীক্ষণ না, আবার ঢেকে যাচ্ছে। ওদিকে এখানে নেমে থেকে হাঁটাহাটি করলেই আমার হালকা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, মাথার ভেতরটা কেমন হালকা। ডায়ামক্সের প্রভাব মনে হয় শেষ হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে নাথাঙে ফেরাই ভাল মনে হল। আসার পথে জায়গায় জায়গায় BRO রাস্তা বানাচ্ছিল, ফলে এপথে অল্প ক’টিমাত্র গাড়ি থাকা সত্ত্বেও লাইন পড়ে যাচ্ছিল এক একটা বাঁকের মুখে। ফেরার সময় সুনীল তাই আরেকটা অপ্রচলিত রাস্তায় নিয়ে এলো আমাদের, রাস্তাটা পাকা নয়, মাটির আর বেশ খাড়া। তবে গাড়ি নেই একটাও।
বাবা মন্দির থেকে ফিরে আমরা বেরোলাম পায়ে হেঁটে নাথাঙ গ্রামটা দেখতে। এমনিতে দেখার তেমন কিছু নেই, এখানে ফসল টসল প্রায় কিছুই ফলে না। যা শুনলাম অল্প কিছু টমেটো আর ফুলকপি হয়, তাও সেসব বর্ষার পরে লাগায়। বাকী সবই নীচ থেকে আসে। গাড়ি করে যাবার সময় একটা গিফট শপ দেখেছিলাম, সপ্তক আমি আর রোমা সেটার খোঁজে গেলাম। দেবাশীস গেল কোন বাড়িতে কোনও মহিলাকে যদি ওদের ট্র্যাডিশানাল পোষাক পরিয়ে ছবি তোলা যায় দেখতে। তা গিফট শপটি দেখলাম বন্ধ। সেটি শুধুই গিফট শপও নয় কাচের জানলা দিয়ে দেখে মনে হল আরো পাঁচরকম জিনিষের মনিহারি দোকান। দোতলায় হোমস্টেও আছে, তাতে দু’একজন বাঙালিও আছে, যা শুনলাম। গ্রামে যে বাড়িগুলো সবুজ টিনের দেওয়াল আর টিনের চালওলা সেগুলো সবই হোমস্টে। বাসিন্দাদের নিজেদের থাকার ব্যবস্থা নীচু নীচু ঘরে। ঘড়িতে সোয়া পাঁচটা বাজে, অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত। হোমস্টেতে ফিরে ওরা চা’য়ের অর্ডার দেয়। মালকিন আমাকে আর রোমাকে খাবারঘরের পাশের একটি ঘরে নিয়ে যান, সেখানে আগুন করা আছে তাতে দুটো চ্যালাকাঠ গুঁজে দিতেই লকলকিয়ে ওঠে আগুনটা। সামনে নীচূ বসার জায়গা, আগুনের উপরে একটা টিনের মুখকাটা কৌটো, মুখে জলভরা কেটলি বসানো। ওইই খাবার জল। আমরা আগুনে হাত পা সেঁকি আরাম করে।
#নাথাঙের_সেই_রাত
নাথাঙের রাতটা সেই অজ্জিত সুমনাদের সাথে লাচেনের রাতের খুব কাছাকাছি যাবে। সেইরকমই হোটেল হোমস্টে খুব বেসিক। বাথরুমে গিজার নেই, ঘরে হিটিঙের কোনো ব্যবস্থা নেই, ইলেকট্রিসিটি খুবই দূর্বল, আসে যায়, আর ঠান্ডা! বাপরে ধারালো দাঁতওলা শক্তপোক্ত ঠান্ডা। লাচেন তাও কষ্টের দিকে একটু ওপরে থাকবে কারণ উত্তর সিকিমের অমানুষিক কষ্টদায়ক রাস্তা, হোটেলে গরমজল দেবার তুমূল অনীহা আর মাঝরাতে পৌঁছে আবার ভোর চারটেয় ওঠা গুরুদোংমারের জন্য। এই পূর্ব সিকিমে রাস্তাঘাট দিব্বি ভাল। হোমস্টেতে গরমজলের যোগান আছে প্রায় ২৪ ঘন্টাই আর অত সকালে উঠতেও হয় নি। তো, যাহোক নাথাঙের গল্পে আবার ফেরত আসি। হাত পা সেঁকেটেকে যে যার ঘরে ঢুকলাম। সব ঘরেই দুটো করে ডবলবেড খাট, প্রতি খাটে দুটো বালিশ আর দুটো কম্বল। তা দেখলাম আমি চাইলে চারখান কম্বল গায়ে দিতে পারি। কম্বলগুলো বেজায় ভারী, দুটোকে টেনে হিঁচড়ে বিছানাজুড়ে পেতে ভেতরে ঢুকে বসলাম গপ্পের বই নিয়ে।ঘন্টাখানেক বাদে দেবাশীস এসে নক করল, বসে খানিক গপ্পসপ্পো করে গেলাম উপরে ওদের ঘরে। সপ্তক একদম কেলিয়ে পড়েছে, কম্বলের তলা থেকে বেরোতেই পারছে না। দেবাশীস জোর করে ওকে রামভজনা করায়, তারপর উঠে ও পাশের ঘরে এসে গপ্পে যোগ দিল। ফোনের নেটোয়ার্ক তখনও নেই। এদিকে দোতলার বারান্দায় টানা কাচের জানলা, কিন্তু মাঝে দুটো তিনটে খোপে কাচ নেই, ফলে একেবারে বরফঠান্ডা হাওয়া রুম ডেলিভারী হচ্ছে।
তো রাতের খাবার সাড়ে আটটা নাগাদ দেবার কথা বলা ছিল। আটটা চল্লিশ নাগাদ ডাকলেন ওঁরা আর আটটা ছেচল্লিশে এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক এলো, নেটও এলো। তাপমাত্রা দেখলাম -৬ ফিলস লাইক -৯ আর শেষরাতে যেতে পারে -৯ অবধি, অন্তত তখন পর্যন্ত তাই দেখাচ্ছিল। খাবার ছিল ভাত, গরম ফুটন্ত ডাল, পাঁপড়ভাজা আর মুরগীর ঝোল। অবশ ঝিঁঝিধরা হাত খানিক্ষণ গরম ডালভাতের মধ্যে রেখে কিঞ্চিৎ সাড় ফিরলে তবে খাওয়া শুরু। তাও হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে ভাত। খাওয়া শেষে বোতলে গরমজল নিয়ে আগুনে হাত পা সেঁকে আবার ঘরে ফিরলাম। মোজা দস্তানাসহই কম্বলদ্বয়ের নীচে তো ঢুকলাম। আর তারপরই শুরু হল কাঁপুনি। পরবর্তী তিরিশ মিনিট স্রেফ ঠকঠক করে কেঁপে গেলাম। এরপরে কাঁপুনি একটু কমল বটে কিন্তু পাশ ফিরলেই আবার শুরু। তারপর কখন যেন ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। ঘুমের মধ্যেই টের পাচ্ছি দস্তানাশুদ্ধ হাত জমে অবশ হয়ে যাচ্ছে। দস্তানা খুলে হাত জামার পকেটে ঢুকিয়ে শুলে শরীরের গরমে একটু অবশভাবটা কাটে। রাতে একবার ঘুম ভাঙে, বাথরুমে যেতে হবে। ফিরে এসে আবার সেই ঠকাঠক কাঁপুনি। সময় দেখি রাত চারটে পনেরো, তাপমাত্রা -১৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, তীব্র কাঁপুনির ফলে ফোন ধরে থাকতে পারি না, ফিলস লাইক কত সে আর দেখা হয় না। ঘুম এসে জড়িয়ে নেয়, ভাগ্যিস!
ঘুম ভাঙে সকাল ছ’টায়। কোনমতে হাত বের করে পর্দা সরাতেই বাইরে ঝলমলে রোদ্দুরে বরফচুড়া পাহাড়গুলো ঝকমক করছে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বারান্দায় আসি, রেলিঙের টিনের উপরে হাত রাখি, রোদ্দুরের হালকা ওম আশ্বাস যোগায় হাতের তেলোয়। বইনি বেরিয়ে আসেন রান্নাঘর থেকে, লম্বা ঝুড়ির নীচে চাপা দেওয়া মোরগটা বাইরে রোদ্দুরে বসানো, ডেকে উঠছে থেকে থেকে। বইনি জিগ্যেস করেন গরমজল দেবেন কিনা। ভারী খুশি হয়ে অনুরোধ করি দিতে, দুই মিনিটের মধ্যে একবালতি গরম জল নিয়ে বাথরুমে দিয়ে যান। অতঃপর মুখ টুখ ধুয়ে আবার বারান্দায় আসি, আহা উষ্ণতা ---আহারে জীবন।
গানটা থাক
সঙ্গে চলেছি।
গানটা এক্দুবার শুনলাম। বেশ ভালো। অবিশ্যি কনটেক্স্ট সবসময়েই একটা আলাদা ডাইমেনশন এনে দেয়। কলকাতার ভ্যাপসা পচা গরমে নির্বাচনী খেউড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডেও যতটুকু হয়।
আমি তুলনা করতে চাইনা, একেবারেই চাইনা। কিন্তু সামহাউ এটা পড়ার সময় আমার 'ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে' মনে পড়ছে। পার্সোনাল বায়াস হতে পারে। চলতে থাকুক। আরো ছবি আনফোল্ড করবে। লেখকের দিক থেকে, পাঠকের মনে।
শেষ শব্দবন্ধ "আহা রে জীবন" খুব ভালো লাগলো।