আগের রাত্রের মারাত্মক ঠান্ডার পর লিংতামে রাত কাটে ভালই আরামে। সক্কাল সক্কাল লুচি আর সুজির হালুয়া খেয়ে আবার রংলিবাজার। দেবাশীষরা গেল পার্মিট আর ট্রাভেল কার্ডের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির ব্যবস্থা করতে। সপ্তকদের কিছু কেনাকাটার ছিল। আমরা ঘুরতে লাগলাম এ দোকান সে দোকান, এই রঙ সেই রঙ, এটা মা ওটা। ওই ওই উপরে ঝুলছে রূপোলী কাজকরা চাক্কু, ওইটে একবার দিখাইয়ে না। টুকটাক কেনাকাটা সেরে আরিটার লেক। সপ্তক আগে থেকেই বলছিল এ নাকি এক দারুণ লেক, ছাঙ্গু থেকে এদিক না ওদিক, কোনদিক থেকে যেন নীচে তাকিয়ে চারিদিকে উঁচু উঁচু গাছে ঘেরা এক অপূর্ব লেক অনেক নীচে দেখা যায়, সেই হল আরিটার। তো বারবার শুনতে শুনতে আরিটারকে কুপুপের চেয়েও সুন্দর কোন লেক ভেবে ভেবে এসে দেখি সে এক এঁদোজলা টাইপ। চারদিক পাড় বাঁধানো মানুষের তৈরী এক কৃত্রিম জলা। চারপাশে গাছ আছে বটে, প্রচুর গাছই আছে কিন্তু সপ্তকের বর্ণনামত মোটেই নয়। আর ... আর সবচেয়ে বড় কথা হল এ প্রায় সমতলে, ছাঙ্গুর আশপাশ থেকে এ লেককে দেখা কিছুতেই সম্ভব নয়। সপ্তকও বেজায় হতাশ, ওরা যে লেক দেখেছিল এ তো সে নয়, সে তবে কে? কোথায় লুকিয়ে সেই ঘন জঙ্গলের মাঝে নীলজলের লেক? হায় তাকে তো আর দেখা হল না এযাত্রা।
এবার যাব লাভা, সেখানকার মনাস্টারি দেখে কিছু খাওয়াদাওয়া করে কোলাখাম। উল্টোদিকের পাহাড়ে যেতে হবে আমাদের। তার জন্য একেবারে নীচে নেমে এসে আবার ঘুরে ঘুরে ওঠা। লাভার উচ্চতা দার্জিলিঙের চেয়েও বেশী। সেই তুলনায় লাভার নাম শোনা যায় কম। একটা মস্ত ষোল লেনের রাস্তা নাকি তৈরী হচ্ছে, জায়গায় জায়গায় কাদামাটির উপর দিয়ে সরু একফালি পথে কোনোমতে পা টিপে টিপে এগোয় গাড়ি, এত ধুলো যে সমস্ত জানলার কাচ বন্ধ রেখেও ধুলো মাটির সোঁদাগন্ধ আসে নাকে। এতোল বেতোল গল্প করি আমরা, রাস্তাটা আস্তে আস্তে জুড়তে জুড়তে মা ফ্লাইওভার অবধি পৌঁছে যেতেই পারে। অসম্ভব নয়, একটু পরিকল্পনা করলেই হবে। লাভা বাজারে গাড়িটাড়ি বেশ কম, ট্র্যাফিক প্রায় নেইই। আমাদের বেজায় খিদে পেয়েছে, নামা হয় মোমো খেতে। দোকানগুলোর বাইরে কি চমৎকার একফালি করে বাগানে রঙবেরঙের ফুল। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বাজার এলাকা। মোড়ের ট্র্যাফিক পুলিশের কাছে জানা গেল মনাস্টারি বন্ধ। বাইরের লোকের প্রবেশাধিকার নেই। মনে পড়ল আরিটার লেকের পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া পাহাড়টার মাথায় যে মনাস্টারি আছে সেটাও বন্ধ। তার মানে আগের বছর করোনার জন্য যে মঠে বাইরের লোকের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হয়েছিল সে আর খোলে নি।
আমি আর রোমা আগে লাভা আসি নি, মনাস্টারি দেখতে না পাবার দুঃখ আমাদের আর যায় না। এ বেশ বড়সড় অনেকটা এলাকা জুড়ে মনাস্টারি। দেবাশীষ চিন্তিত হয়ে পড়ে আগস্ট সেপ্টেম্বরের এক বিশেষ মনাস্টারি ট্রিপ প্ল্যানের ভবিষ্যত নিয়ে। ততক্ষণে আমরা জেনে গেছি সাত তারিখ থেকে সিকিমে ঢুকতে গেলে বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে করানো আরটিপিসিয়ার নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে যেতে হবে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে, খবর পাচ্ছি পুণে বোম্বের অবস্থা আবার খারাপ হচ্ছে। এইসব করতে করতেই নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের গেটে এসে পৌঁছোলাম। কোলাখাম যেতে গেলে নেওড়াভ্যালির গেটে পার্মিট সম্পর্কিত আনুষ্ঠানিকতা সেরে উদ্যানের ভেতরে ঢুকে বাঁয়ের রাস্তাটা নিলাম আমরা। ডানদিকের রাস্তাটা আস্তে আস্তে উঠে ঢুকে গেছে জঙ্গলের ভেতরে। পাখিদেখিয়েদের স্বর্গ এই জায়গা। শীতের কয়েকমাস নেওড়াভ্যালির ভিতরের রিসোর্টে জায়গা পাওয়া খুব মুশকিল। বহু টাকা ব্যয় করে বিদেশীরা এসে পড়ে থাকে। এই জঙ্গলে রেডপান্ডাও আছে, তবে জঙলি রেডপান্ডারা খুবই লাজুক প্রকৃতির হয়, দার্জিলিঙ চিড়িয়াখানার রেডপান্ডার মত ফোটোস্যাভি নয় মোটেই। এখানে তাদের দেখা টেখা বিশেষ পাওয়া যায় না। গাড়ির ধারেকাছে তো মোটেই নয়।
জঙ্গলের কোর এলাকা না হলেও একেবারে কোলঘেঁষা বলে এ রাস্তাও বড় অপূর্ব। পুরো রাস্তা তেমন মসৃণ নয় বটে, জায়গায় জায়গায় বেশ এবড়ো খেবড়ো। কিন্তু দুপাশের উঁচু উঁচু গাছেরা এমন ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তাটাকে গার্ড করে রেখেছে আর রোদ্দুর তারই ফাঁক গলে এদিক ওদিক দিয়ে টুকি করছে, সবুজ আর সোনালীর কতরকম শেড দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে যে গাড়ির ঝাঁকুনি তেমন গায়েই লাগে না। কোলাখাম জায়গাটার অবস্থান ভারী চমৎকার। হোমস্টেগুলোর সবকটার সামনের দিকটা পুরো খোলা, কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জ, ১৮০ ডিগ্রি দেখা যায়। বাঁ দিকের পাহাড় রিশপ আর বাঁ কোণে লাভা। রাতে রিশপ আর লাভার বসতিতে আলো জ্বলে চিকমিক, সামনে গভীর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর মাথার উপর অনন্ত আকাশ কালপুরুষ , সপ্তর্ষি দিব্বি দেখা যায়। আরো কতসব ঝিকঝিকে তারারা। তবে ছায়াপথ দেখা যায় না। রিশপ আর লাভার পাহাড়ে বসতির চিকমিকে আলোগুলো না থাকলে হয়ত তাও দেখা যেত। তবে এসব তো সন্ধ্যের পরের কথা। আমরা পৌঁছোলাম তো বিকেল চারটের একটু আগে। রাস্তা থেকে খান পঁয়ত্রিশেক সিঁড়ি উঠে হোমস্টের খাবার ঘর লাগোয়া রিসেপশান ডেস্ক। দেবাশীষ সইসাবুদ করে, আমরা ঘরটর বুঝে নিই, হাত মুখ ধুয়েই খাবার টেবল।
সপ্তক রোমার ঘরটা দোতলায় সামনে ফালি বারান্দা, আর একটা ঘর তিনতলায় খোলা ছাদের একপাশে কাঠ ও বাঁশের ড্যুপ্লেক্স। প্রথমে তো ড্যুপ্লেক্স শুনে ভেবেছিলাম দুটোতলায়ই শোবার ঘর আর বাথরুম দুইই আছে। পরে দেখি তা না, নীচে দিব্বি মস্ত বিছানা, সোফা, সেন্টার টেবল, টুকিটাকি জিনিষপত্র রাখার ড্রয়ারসহ টেবল লাগোয়া স্নানঘর বেশ বড়সড়, পশ্চিমের রোদে গরম হয়ে আছে। বিছানার পাশ দিয়ে উঠে গেছে কাঠের সিঁড়ি, উপরে শুধু আরেকটা ডাবল বেড আর অল্প একটুখানি দাঁড়াবার মত জায়গা। তাও আমার মত পাঁচফুটিয়াকেও সেথায় ঘাড় গুঁজে দাঁড়াতে হয়, মনে হল নিতান্ত বাচ্চাদের জন্যই সম্ভবত ব্যবস্থা করা। হ্যাঁ বিছানা লাগোয়া একটা মস্ত জানলা কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখোমুখী। এদের বাড়ির লাগোয়া নিজস্ব খেত আছে তরিতরকারির জন্য। সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে তরিতরকারি ফলায়। খেতের ফুলকপির তরকারি, ডিমের ডালনা, ডাল আর পাঁপড়ভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে আমরা বেরোলাম কোলাখাম জায়গাটা ঘুরে দেখতে। খান তিনেক হোমস্টে চালু দেখলাম, বাকীগুলো কিরকম বাচ্চাদের খাতায় আঁকা বাড়ির মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সব দরজা জানলা বন্ধ করে। গত বছরের লক ডাউনের ধাক্কায় হোটেল হোমস্টে বন্ধ করে সব যে যার গাঁয়ে ফেরত চলে গিয়েছিল, এখনো ফিরতে পারে নি অনেকগুলোই।
এমনিতে কোলাখাম যথেষ্ট দামী জায়গা, কাজেই হুট করেই গাদা পর্যটক এসে যাবার সম্ভাবনা একটু কমই, তাতে করোনা আর লক ডাউনের ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে পারে নি বেশীরভাগই। আমরা বলাবলি করি দামী জায়গা হওয়া একদিকে ভাল, ডিজে পার্টি এসে উৎপাত করবে না। কিন্তু পর্যটনই যাঁদের উপার্জনের একমাত্র উপায় তাঁরা এমতাবস্থায় আর কতদিন দাম বাড়িয়ে রেখে জায়পগাটা শান্ত নির্জন রাখতে পারবেন কে জানে! গোটা কোলাখাম একটাই রাস্তা বরাবর। সেটার এপাশ থেকে ওপাশ ঘুরলেই পুরোটা দেখা হয়ে যায়। আমরা যেদিক থেকে এসেছি সেদিকেই হাঁটা দিই। অজস্র পাখীর ডাক, কোথাও একটা দলছুট টিয়া ডাকছে। দেখতে পাই এবং চিনতে পারি পুঁচকে সানবার্ডদের। দ্রুতগতিতে এক গাছ থেকে পোকা মাকড়শা খেয়েই উড়াল দিয়ে গিয়ে বসে আরেক গাছে। আমাদের হোমস্টের বাঁ পাশের হোমস্টের একতলায় এক চায়ের দোকান, এক বয়স্ক মহিলা মালকিন। সেখান থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে রাস্তায় এলোমেলো ঘুরে বেড়ান পাঁচটা ঝাঁকড়া ল্যাজের কুকুরকে খাওয়ায় সপ্তক। অন্ধকার নামে চারপাশের পাহাড় বেয়ে ঝুপঝুপিয়ে। আমরা ঘরে এসে ঢুকি । বিদ্যুৎ নেই, আসবে নাকি ঘন্টাখানেকের মধ্যেই। কাঞ্চনজঙ্ঘা আজও মেঘের লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে রইল, দেখা যাক যদি কাল ভোর চারটে নাগাদ উঠে দেখা পাওয়া যায়।
স্নান টান করে তাজা হয়ে বই নিয়ে বসি। এখানে মোটামুটি নেট পাওয়া যাচ্ছে, সেসব দেখতে দেখতে কতক্ষণ কেটেছে খেয়াল নেই। হঠাৎই শুনি কিসের একটা জোরালো আওয়াজ হচ্ছে, আর মৃদু কাঁপুনি। প্রথমে মনে হয় হয়ত উপরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হয়ত বড় কোন ট্রাক যাচ্ছে তারই আওয়াজ আর কাঁপুনি, ভাবতে না ভাবতেই ঘরের বাঁশের খুঁটিগুলো, দেওয়াল সবই প্রবল আওয়াজ করে ঝাঁকাতে শুরু করে দিয়েছে। তবে কি ধ্বস নামছে? নাকি ভূমিকম্প? ভাবতে ভাবতে টলতে টলতে পাতলা চটি পায়ে ঘরের দরজা অবধি এসে মনে হয় নাঃ যদি রাস্তায় নামতে হয় ... এই তিনতলা থেকে ওই সাতাত্তর খানা সিঁড়ি, তায় শেষের পঁয়ত্রিশখান তো স্রেফ এবড়ো খেবড়ো পাথরে ধাপ কাটা ... নাহ জুতো মোজা পরেই নিই। ইতিমধ্যে দেবাশীষ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ‘দমদি ও ও দমদি, শীগগির বেরোও, ঘুমোলে নাকি? ওঠো ওঠো’ বলে চেঁচামেচি লাগিয়ে দিয়েছে। তা দরজা খুলে বললাম এই বেরোই, দাঁড়াও। ততক্ষণে একটু থেমেছে ব্যপারটা। আমি আবার জুতো পরব বলে বসতেই আবার সজোরে ঝাঁকি, বাঁশেকাঠে মিলে সে কি খটাখটি বাপস। দেবাশীষ এবারে রেগেই গেল ‘আরে বেরোও বলছি। কী করছ টা কি, চল নীচে চল’। অগত্যা সেই পাতলাচটি পরে দরজা টেনে রেখে দোতলায় নামলাম। নামতে নামতে এও থেমে গেল। সপ্তকরা বারান্দায়ই ছিল। দেবাশীষ আমাদের রাস্তায় নামাতে চাইছিল, আমরা দেখালাম হোমস্টের লোকেরা আপনমনে কাজকর্ম করে যাচ্ছেন বিশেষ বিচলিত হবার কোন লক্ষণই নেই, তাহলে খামোখা আমরাই বা নামব কেন!
ঘড়ি দেখলাম আটটা কুড়ি। দেবাশীষ প্রথমে ভেবেছিল হয়ত হাতি এসে ঠেলছে বাড়িটাকে। সুনীল বলে ও গাড়িতে বসে মোবাইলে সিনেমা দেখছিল হঠাৎ গাড়িটা প্রবল নড়ে ওঠায় তাড়াতাড়ি ব্রেক চেপেছে প্রাণপণে। তাও গাড়ি এদিক ওদিক দুলছে দেখে অবাক হয়, তখন খেয়াল হয় গাড়ি তো স্টার্ট করা নেই, তখন কোনোমতে দরজা খুলে বাইরে আসে, রাস্তা তখনও দুলছে। আস্তে আস্তে খবর পাই গ্যাঙটকের ২৬ কিলোমিটার দূরে পূর্ব সিকিমে ভূমিকম্পের কেন্দ্র, ৫.১ তীব্রতা। ইতিমধ্যে সুনীলের বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। ওদের গ্রামে খুবই তীব্র হয়েছে ভূমিকম্প। আমরা হিসেব করে দেখি সে প্রায় কেন্দ্রের দুই তিন কিলোমিটারের মধ্যেই। সুনীল বাড়ির লোককে বোঝায় ও আগামী কাল আমাদের শিলিগুড়ি পৌঁছে দিয়েই বাড়ি চলে যাবে। রাতের খাবারে চিকেন ছিল, তবে এদের রান্নার আসল স্বাদ তো জৈবচাষের তরকারি। রাতেও মাটি কেঁপেছে বারকয়েক, আবছা ঘুমে টের পেয়েছি তা। পরেরদিন সকালেও বার তিনেক। আমরা নেমে যাওয়ায় আর টের পাই নি। কিন্তু সুনীলের বাড়ি থেকে ফোন আসে ঘনঘন আবার কেঁপেছে, আবার, আবার, এমন করে ষোলো কি সতেরোবার। আফটার শক চলতেই থাকে। পরেরদিন ভোরেও কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখ থেকে মেঘের লেপ সরে না। এযাত্রা আর দেখাই হল না কোথাও থেকেই।
সকালে খোলাছাদে বেড়াবার সময় ধনেপাতার তীব্র গন্ধ পাই। উঁকি মেরে দেখি নীচের খেত থেকে গোছা গোছা ধনেপাতা তুলে আনছে রান্নাঘরের দিকে। প্রাতরাশে দেয় আলুপরোটা আর সেই টাটকাধনেপাতার চাটনি। এমনিতে বাজারে ধনেপাতা নাকের কাছে তুলে গন্ধ শুঁকলেও বিশেষ পাওয়া যায় না আর এখানে তিনতলার উপরেও গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে খেতের ধনেপাতার! এরা কফিটা চমৎকার বানায়। এমনিতে আমি অবশ্য কফি সঙ্গেই রাখি, যাতে গরম জল পেলেই বানিয়ে নেওয়া যায়। সপ্তকদের পাশের ঘরে দুজন ভদ্রমহিলা এসেছেন দুদিন থাকবেন এখানে, তারপর রামধুরা যাবেন। আমি মনে মনে নোট করি নভেম্বর কি ডিসেম্বরের কোন পূর্নিমার আশেপাশে আবার আসতে হবে কোলাখাম। তারপরেই ধন্ধে পড়ে যাই পূর্নিমা না অমাবস্যা, কোনটা বেশী ভাল হবে? আকাশ পরিস্কার থাকলে পূর্নিমায় কাঞ্চনজঙ্ঘা আর অমাবস্যায় আকাশভরা তারা, কে জানে হয়ত গভীর রাতে ছায়াপথও দেখা দিয়ে যাবে। আজ আরেকদফা কুকুরগুলোকে খাওয়ান হয়। ইতিমধ্যে ওরা চিনে গেছে, দাবী করতে শিখে গেছে। বেরোনর সময় হয়ে যায়, ফেরার পথে জঙ্গলের মধ্যে আমরা একটু বেশী সময় নিই। পেছনের গাড়িগুলোকে আগে যেতে দিয়ে আমরা নেমে হেঁটে বেড়াই এদিক ওদিক। মোটাসোটা ফার্ণেরা কৌতুকভরে দেখে আমাদের। যত্ত শহুরে আদেখলা!
উত্তরবঙ্গে বেড়াতে গেলে ফেরার দিন যেটা অবশ্যকর্তব্য এবার আমরা সেইদিকেই। মালবাজারে বাপীদার দোকানে। উত্তরবঙ্গ বেড়াতে গিয়ে বাপীদার দোকানে ইলিশ না খেয়ে এলে সেই যাত্রা ‘বেড়ানো’ বলে গণ্যই হয় না। বাপীদার দোকানে ইলিশের সাইজ তো জানেনই আট থেকে দশ ইঞ্চি সাইজের হয়, রান্নাও অসাধারণ। আপনি যদি সাজানো গোছানো এসি লাগানো দোকান ছাড়া খেতে না পারেন তাহলে বাপীদার দোকানের দিকে খবরদার যাবেন না। দোকান দেখতে ওই বাসস্ট্যান্ড বা হাইওয়ের ধারে ভাতের হোটেল যেমন হয় তেমনই। সামনে ক্যাশ কাউন্টার আর ভেতরে দুইপাশে সারি সারি টেবল, প্রতি টেবলের দুইপাশে বসার জন্য সরু সরু কাঠের বেঞ্চি। স্টিলের মস্ত থালায় ছোট বড় বাটিতে করে বিভিন্ন পদ দিয়ে যাবে আর মাঝখানে ভাত। শুরুতেই একটা শাক আর বোরোলিমাছের চচ্চড়ি থাকবেই। শাকের সাথে খাবার জন্য ঝাঁঝালো কাসুন্দি নিয়ে আসবেন একজন, যার যতটুকু লাগবে ঢেলে দিয়ে যাবেন। শাক, বোরোলির চচ্চড়ি, ডাল, ঝুরি আলুভাজা, শেষপাতে টক এগুলো সব থালিতেই থাকবে। এরপরে মাছ মাংস যা আপনি চান। এখানে মস্ত তেলালো চিতলের পেটিও হামেশাই পাওয়া যায়। মোদ্দাকথা হল সাধারণ রুই কাতলা কি চিকেন মিকেন খাবার জন্য বাপীদার দোকানে যেতেই পারেন সেসবও খুবই স্বাদের হয়। কিন্তু ওঁর বৈশিষ্ট্য হল মাছ। চ্যাংরাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে সরাসরি বাংলাদেশ থেকে মাছ আনেন উনি।
বলা বাহুল্য বাপীদার দোকান এবারেও হতাশ করল না। বাপীদা যথারীতি নিজে এসে তত্ত্বাবধান করে গেলেন, বিনীতভাবে বলেন আজকের ইলিশটা ভাল আছে, একটু খেয়ে দেখুন। আমরা ততোধিক বিনীতভাবে জানাই ওঁর দোকানের ইলিশের স্বাদ সম্পর্কে আমরা ভালই ওয়াকিবহাল এবং দুই কি তিনবছর অন্তর এদিকে এলেও ওঁর দোকানের ইলিশ চেখে তবেই ফেরার ট্রেনে উঠি। তা হবে ত্রিশ কি পঁয়ত্রিশ বছর বাদে আবার ডিমভরা ইলিশ খাই, গাদাপেটি একসাথে লম্বালম্বি কাটা মাঝখানে মস্ত হীরের মত ডিমখানি জাঁকিয়ে বসে। দেবাশীষ অবশ্য আর খাবার জন্য অপেক্ষা করে নি, আলিপুরদুয়ারে ওর বাড়ীর দিকে রওনা দিয়েছে। সেইদিন আবার আলিপুরদুয়ারের ওদিকে পরধনমন্ত্রীর ভোটের সভা করতে যাবার কথা, এদিকে কুচবিহার হয়ে জলপাইগুড়ি শিলিগুড়ি আসছেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলে শিলিগুড়ির জায়গায় জায়গায় ট্র্যাফিকের গতি প্রায় স্তব্ধ, জোড়া ভিভিয়াইপি বলে কথা! আমি বাগডোগরার পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে একটা হোটেল বুক করে রেখেছি। কাল সকালে কলকাতার ফ্লাইট। সপ্তক আমাকে সেই হোটেলে ঢুকিয়ে ঘর দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে তবে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশানের দিকে যায়, ঘরটর নিজের চোখে না দেখে কিছুতেই ছাড়ে না। আমি এইবারে বুঝে যাই বুনুরা কেন ওকে ‘বাপ’ ডাকে। মাইনাস তেরো বা মাইনাস ছয় থেকে শিলিগুড়ির সাতাশ ডিগ্রিতে নেমে মনে হয় হাতেপায়ে আগুন ধরে যাচ্ছে বুঝি। ওই প্রতিবারেই যেমন হয় আর কি।
তাহলে বদ্দিবুড়ি চলো এবার বাড়ি। আবার কবে বেরোন হবে কে জানে! সিল্করুটে উঁকিঝুঁকি তো হল, একটু ভাল করে ধীরেসুস্থে যদি ঘোরা যেত! আসতে হবে আবার। আরিটার লেক কাটিয়ে দিয়ে যুলুক কিম্বা লুংতুঙে থাকতে হবে দু’তিনদিন। সেই লুকানো লেকটার নাম ঠিকানা ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছি। ইশ নাথু-লা জেলেপ-লা দিয়ে যদি পুরোটা যাওয়া যেত তিব্বত পর্যন্ত! হবে হয়ত কোনদিন। সেইদিনের অপেক্ষায় ...।
দমদি, পরেরবার লাভায় থাকার প্ল্যান কর।
লাভার সরকারি বাংলোয় জায়গা পাওয়া চাপ। তবে একবার তো থাকতেই হবে। লাভা আর রিশপ দুটোতেই।
লাভা থেকে কিন্তু কাঞ্চন দেখা যায় না। তবে খুব পরিস্কার দিনে নাথুলা দেখা যায় অভি বলল।
সে দেখা যায় না। কিন্তু ছোট ছোট পায়ে চলা পাহাড়ি রাস্তায় এদিক সেদিক বেকার হেঁটে বেড়াতে বেশ লাগে বা কিছু না করে চুপ করে বসে থাকা।
সে ধর নেওড়ার ভেতরেও হেঁটে বেড়াতে ভালই লাগবে। তবে ভালুক আছে নাকি, সেটা একটু ইসে।
কত জায়গা যে ভাল করে ঘোরা বাকী।
ভালো লাগলো সিরিজটা। ঐ অমাবস্যার রাতের আকাশের বা পূর্নিমায় কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি কোনদিন তুললে আমাকে দেখিও একটু।