রোদ্দুরে গরম চায়ের কাপ দুইহাতে ধরে বইনির সাথে গপ্প জমে। সোনম, তাঁর আটান্ন বছরের জীবনে বারকয়েক গ্যাঙটক গেছেন আর দুই একবার আরো কোথাও, ঠিক মনে করতে পারেন না সেসব জায়গার নাম। স্বামী আর্মিতে কাজ করত কন্ট্র্যাক্টে, পয়সাকড়ি পেত মোটামুটি। সেসব পয়সায় বেশীটাই অবশ্য মদে উড়ে যেত। মদেই লিভার পচে মারা যাবার পর ‘বাচ্চারা আর্মির হয়ে রাস্তা বানাবার কাজে লাগে। বাচ্চা ছিল তাই পুরো মর্দের মত কাজ ওঠাতে পারত না, বাচ্চারাই তাই ব্যবস্থ করে বাড়ীটাকে হোমস্টে করে নেয়। ‘সোনম’স হোমস্টে। এখন মোটামুটি চলে যায়। আমরা বেরিয়ে গেলে দুপুরে আবার অন্যরা আসবে। এবারে বরফ একটু কম পড়েছে। মোরগটা কিনে এনেছে বড়বাচ্চা (বড়ছেলে), যাদের মুরগী আছে তারা নিয়ে টিয়ে যায়, সুবিধেমত একটি কি দুটি মুরগীছানা নেবার ইচ্ছে আছে। তাহলে ডিমটা আর কিনতে হবে না। ট্যুরিস্টরা বেশীরভাগই ডিম আর চিকেন খেতে ভালোবাসেন তো। আমার সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করেন। রোমা এসে যোগ দেয় গল্পে। এ অঞ্চল তো প্রায় অ্যালপাইন গ্রাসলাইনেরও শেষপ্রান্তে, এত মোটা মোটা জ্বালানী কাঠ পান কোত্থেকে? বাচ্চারা নিয়ে আসে। কাঠের যোগান দেখলাম পর্যাপ্ত, সারাদিনরাতই আগুন জ্বলে। ছেলেদের আর্মির হয়ে কাজের সুবাদেই সহজলভ্য সম্ভবতঃ।
একবাটি করে ওয়াই-ওয়াই চাউমিনের একটা স্যুপমত খেয়ে আমরা রওনা দিই কুপুপ লেকের দিকে। ঘড়িতে তখন ন’টা বাজতে মিনিট দশেক বাকী। নাথাঙ গ্রামের সরু সরু রাস্তাগুলো গাড়ীতে গাড়ীতে ছয়লাপ, কেউ ফিরবে গ্যাঙটক, কেউ আমাদের মত কুপুপ হয়ে লিঙতাম, কেউ আবার কুপুপ থেকে ছাঙ্গুর দিকে বেরিয়ে যাবে, সেখান থেকে গ্যাঙটক। সুনীল আজও কালকে বাবামন্দির থেকে ফেরার সময়কার শর্টকাট নেয়, কিন্তু বার দুই তিন বোঁ বোঁ করে ঘুরপাক খেয়ে ওঠার পরে আরেকটা খাড়াইয়ের মুখে হঠাৎ দুম করে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। গেল তো গেলই স্টার্ট যদি বা নেয় অ্যাক্সিলেটার দিলেই ‘চেক ইওর এঞ্জিন’ দেখিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। কিছুতেই এগোতে না পেরে অগত্যা পিছোবার চেষ্টা করি আমরা। সেও মোটেই সহজ হয় না, অ্যাক্সিলেটার দিলেই ঘপাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। মনে মনে ভাবি এইবার হয়ত নেমে ঠেলতে হবে। কোনোমতে এক’পা দু’পা করে এসে দাঁড়ায় হোমস্টের কাছাকাছি পাকা রাস্তায়। আকাশ তো কাচের চুড়ির মত চকচকে নীল, দু চারখান সাদা মেঘ ব্যস্ত কুকুরছানাদের মত এলোমেলো দৌড়োদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। রোদ্দুরে হেঁটে বেড়ালে ঠান্ডাটা একটু সহনীয় হয় বটে, ততক্ষণে নেটও মোটামুটি স্থির হয়েই আছে, তাপমাত্রা দেখা যায় -৭ ডিগ্রি।
এদিকে নাথাঙে নাকি গাড়ি সারাবার কোনও ছোটমোট গ্যারেজও নেই। নীচে থেকে আসা এক যাত্রীবাহী গাড়ির চালক গাড়ি কোনওমতে এক কোণায় দাঁড় করিয়ে লেগে পড়লেন সমস্যা সমাধানের চেষ্টায়। কে জানে যাত্রীরা রাগমাগ করছিল কিনা, তবে একবার তাদের গাড়ির জানলার কাচ একটু নামিয়েই বোধহয় হাওয়ার ঝাপ্টায় শনশন করে কাচ তুলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন দেখলাম। ইতিমধ্যে কাকে যেন ফোন করে আনিয়েছে সুনীল। পাইপটা দেখা দরকার, একজনের কাছে স্প্যানার চাইতে তাজ্জব হয়ে দেখলাম তিনি হাসিহাসি মুখে একটা প্লায়ার্স ধরিয়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। আরো তাজ্জবের ব্যপার হল সেই প্লায়ার্স দিয়েই সুনীলরা ব্যাটারি খুলে বের করার চেষ্টা করতে লাগল। যাইহোক অবশেষে সেই প্লায়ার্সওলাই একটা স্প্যানার যোগাড় করে এনে পাইপের মুখে মুখ লাগিয়ে চোঁ চোঁ করে তেলের জমা ময়লাজাতীয় কিছু টেনে থু থু করে ফেলে গাড়ি চালু করে দিলেন। ঘড়িতে ততক্ষণে বেলা সাড়ে দশটা। এবার কুপুপ হয়ে লিংতাম ফেরা। দেবাশীষ দেখি লিংতামের সেই হোটেলে ফোন করে লাঞ্চে মাছেরঝোল ভাতের অর্ডার করছে। হাঁইমাই করে তাকে তাড়াতাড়ি থামানো হল। রাস্তায় মোমো, থুকপা যা পাব তাই খাব আমরা, ওই মাছেরঝোল ভাত আর খাব না।
এবার নির্বিঘ্নেই কুপুপ বা হাতিপোখরি পৌঁছালাম সোয়া বারোটা নাগাদ। কুপুপ মিলিটারি এলাকা, তাই লেক ছাড়া রাস্তা, দোকানপাট বা বাড়িটাড়ির ছবি তোলা মানা এখানে। ভর দুপুরে ঠিক মাথার উপারে সূর্য নিয়ে ছহবি বিশেষ সুবিধের হল না। কিন্তু জায়গাটা এত শান্ত সুন্দর। এদিক থেকে একটা সোজা রাস্তা চলে গেছে ছাঙ্গু পর্যন্ত। অল্প দু’একটা গাড়ি সেপথে যাচ্ছে, সোজা গ্যাঙটকে নামবে। দেবাশীষ বলেছিল ছাঙ্গু অবধি যেতে। আমাদের ঘোরা বলে আমরা রাজী হলাম না। কিন্তু পরে নেমে এসে দেখলাম গেলেই হত। কুপুপ আর ছাঙ্গুর মাঝে একজায়গায় খানিক ডিট্যুর করে মেমেঞ্চো নামে একটা অপূর্ব লেক আছে। আমরা রাস্তা থেকে দেখছিলাম, কুপুপ লেক খানিকটা নীচে। ঝকঝকে রোদ্দুরের মধ্যেও বরফিলা হাওয়ার দাপটে হাত পা অসাড় হয়ে আসে, ছবি তুলে আর ক্যামেরা ব্যাগে ঢোকাতে পারি না এমন অবস্থা। তাড়াতাড়ি গিয়ে ঢুকি এক চায়ের দোকানে। মালকিন বলেন ভেতরে গিয়ে আগুনের পাশে বসতে। আমাদের দেখে একজন একটা মাঝারি কাঠের টুকরো গুঁজে দেন আগুনে। চা কফি নুডলস ইত্যাদি খাবার পর কাগজের কাপ প্লেটগুলো ওই আগুনেই গুঁজে দিতে বলেন ওঁরা। শুনি এখানে কাঠের খুব অভাব, নীচ থেকে অনেকটা দাম দিয়ে আনতে হয়। স্বাভাবিক, এ জায়গা তো পুরোই স্নো লাইনে। আর এঁদের কোনও মিলিটারি যোগও নেই যা বোঝা যাচ্ছে।
নীচে নামা সবসময়ই দ্রুত। ডোকলামের মোড়টায় এসে খানিক হ্যা হ্যা হল, চল যাই মিস্টার এগারোকে হাই বলে আসি। সুনীলকে জিগ্যেস করে জানা গেল ওই মোড় থেকে ডোকলাম পনেরো কি বিশ মিনিটের রাস্তা। আরো কমও হতে পারে। পরে নীচে চা খাবার সময় ডোকলামের সেই গ্রামের কথা জিগ্যেস করলাম সুনীলকে। খুব স্পষ্ট কোনও উত্তর দিল না, খালি বলে আগে এসব ফাঁকা ভ্যালি আর পাহাড়ি ছিল। এই দুই বছর হল ‘গড়বড়ি শুরু হুয়া’। বলল এদিক সেদিকের পাহাড়ে চড়লে ওসব জায়গা দেখাই যায়, গাঁও টাও সব। তুমি চড়েছ? খেয়াল করলাম ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলল না। আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেল মানুষজন ভীড়ের মধ্যে। নামার সময় থাম্বি ভিউ পয়েন্টে থামা হল। আগে বলেছি কি এখান থেকে জুলুক জিগজ্যাগের দুর্দান্ত ভিউ পাওয়া যায়। তা, চা মোমো ইত্যাদি খেতেখেতেই আকাশ কালো হয়ে হাওয়ার ঝাপটার সাথে বরফের গুঁড়ো (ফ্লারিজ) ঝরা শুরু হল। যে দুটো গাড়ি নীচ থেকে আসছিল তাদের যাত্রীরা তো নেচেকুঁদে একশা। আমরা বলাবলি করলাম যাও না যাও, নাথাঙে রাত্রে থাকলে বুঝবে ঠ্যালাখান। ছবিটবি তুলে আরো খানিক নামার পর শুরু হল সত্যি সত্যি বরফপাত। তো এ ব্যপারটা তো একটু উপভোগ করতেই হয়। অতএব গাড়ি থামিয়ে ভিডিও, দৌড়োদৌড়ী ইত্যাদি হল।
সুনীলের নির্বন্ধাতিশয্যে কি একটা জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়ান হল। এই এপ্রিল মাসে তার এমন জীর্ণ শীর্ণ চেহারা যে দেখে মায়াই লাগে। সুনীলের দাবীমতে এ নাকি বিখ্যাত প্রপাত, একে দেখতে প্রচুর লোক আসে। সিকিমেরই অন্য বড়সড় প্রপাত বর্ষার পরেপরেই দেখে আসা আমরা কেউই এ প্রপাত দেখে তারিফ করতে পারলাম না। তবে বর্ষায় নিশ্চয়ই মোটাসোটা সুন্দর হবে এই প্রপাতও। তা থামাই যখন হল সেখানে আরেক দফা থুকপা, শ ফালে ইত্যাদি খাওয়া হল। ধীরেসুস্থে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ লিংতাম পৌঁছানো গেল। এইদিন আর তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। এবারে আর হোটেলে তেমন ভাল ঘর দেয় নি। বাহান্ন জন বাঙালির একটা দল সেইদিনই নীচ থেকে আসছে তাই সব ভাল ঘর তাদের জন্য বুকড। তো সেই বাহান্ন জনের দল এলেন বিকেল ছ’টা নাগাদ। আর এসেই আমার দিদার ভাষায় যাকে বলে ‘তাফাল তুইল্যা’ দিলেন। রাত বারোটা অবধি ডিজেবক্স চালিয়ে বনফায়ার হচ্ছিল। আমি অবশ্য বেরিয়ে আমার ঘরের দিকের বক্সটা বন্ধ করিয়ে এসেছিলাম। রাতের খাবারের জন্য ঘোষিত মেনু ছিল ছিল চিকেন ফ্রায়েডরাইস। খাবার টেবলে বসে অবশ্য বোঝা গেল আসলে ফ্রায়েডরাইস আর চিকেন কষা। তা এদের রান্না ভাল। খাওয়াটা ভালই হয়েছিল। পরেরদিন সকালে রওনা আরিটার, লাভা হয়ে নেওড়া ভ্যালি, কোলাখাম।
এখানে একটা ঘটনা আলাদা করে লিখে রাখি। আমার মত যারা একলা বেড়ায় তাদের সাধারণত ডাবল রুম নিতে হয়। এক তো অনেক হোটেলেই সিঙ্গল রুম বলে কিছু থাকে না। আর যদি বা থাকে তাহলে সেসব ঘর বেশ বাজে ধরণের হয়। তো আমি ডাবল রুমই নিই। এই ফিরতি লিংতাম যাত্রায় দেখি আমাকে একটা ছোট্ট সিঙ্গল ঘর দিয়েছে একতলায় তার বাইরে হাঁটু উচ্চতার রেলিং দেওয়া একটা ছোট্ট বারান্দা, নীচে পাহাড়ের নীচের ধাপের রাস্তা। আরো একটু নীচে লিংতাম নদী বয়ে চলেছে। কিন্তু ঘরের বাথরুমটা ওই বারান্দার পরে আর বারান্দার দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করার কোনও ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ বাথরুমে যেতে গেলে আমাকে ঘরের দরজাটা খুলেই যেতে হবে। আর রাস্তা থেকে টুক করে সেই বারান্দায় উঠে আসা কোনও ব্যপারই না। এবার সঙ্গে কেউ থাকলে ঘরটা দারুণ হত। রাত্রিবেলা দিব্বি ওই ডিজের ঝামেলামুক্ত হয়ে বসে নদীর কলকলানি শোনা যেত। কিন্তু একলা থাকার পক্ষে একটু রিস্ক হয়ে যায়। সিকিমে কোন ধরণের অপরাধ হয় না ঠিক কথা। স্থানীয় লোক নিয়ে আদৌ ভয় নেই। ভয় নীচ থেকে আসা ট্যুরিস্টদেরই। তা ঘরটা বদলে দিতে বলায় মালিক ভদ্রলোক, সুমন সাহা কানই দিলেন না। দুই তিনবার বলে অল্প রাগ দেখিয়েও শুনতে হল ‘কী করব ম্যাডাম এত লোক আসছেন যে আর কোনও ঘর নেই। একটু মানিয়ে নিন।‘
এবারে ঠান্ডা গলায় দেবাশীষকে বললাম তাহলে আমি অন্য কোথাও যাই, সুনীল থাকতে থাকতে আমাকে অন্য কোথাও যেখানে ঠিকঠাক ঘর আছে পৌঁছে দিয়ে আসুক। দেবাশীষ তো বেজায় ঘাবড়ে গেল, এইবার সুমন সাহার কানে জল ঢুকল। পাশেই ওঁদের আর একটা বিল্ডিঙ তৈরী হচ্ছে, যার একতলার ঘরগুলো চালু হয়ে গেছে। অতঃপর উনি নিজেই চাবিফাবি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আমাকে ওই বিল্ডিঙের ঘরটা দেখালেন। ওই বাহান্ন জনের দলের কারো জন্য অ্যাটাচড বাথরুম ছাড়া ওই ঘরটা রেখে আমাকে পাশের বিল্ডিঙের একতলার ঘর দিলেন। সেখানেও অবশ্য গিজার ঠিকঠাক কাজ করছিল না, আবারো সুমনবাবুকে ধরে নিয়ে ঠিক করাই। তো বলার কথা হল একলা পর্যটক, বিশেষত একলা মহিলা পর্যটকদের জন্য সুযোগ সুবিধে দেবার ব্যপারে এখনো এই ২০২১ এও অদ্ভুত ঔদাসীন্য। তাও সম্পূর্ণ একলা গাড়ি নিয়ে গেলে হোটেল মালিকরা একটু ঘাবড়ে যায় দেখেছি। কিন্তু দলের সাথে গেলে ধরেই নেয় যে মহিলা যাত্রীটিই ‘মানিয়ে নেবে’ সবচেয়ে বেশী। ভেবেই নেয় যে এ ত দলের সাথে এসেছে, মেয়েমানুষ একলা তো আর যেতে পারবে না। সত্যিই একা বেরিয়ে যাবার সাহস দেখলে তখন ল্যাজ পকেটে ভরে কুঁইকুঁই করে।