মিস্টি মাইন্টেইনস
_________________
সকাল দশটায় বেরোনো - তার আগে হোটেলেই ব্রেকফাস্ট। আজ ডাইনিং হলে। মেঘ ইতিমধ্যে প্রায় সব কর্মীদের সঙ্গেই ভাব জমিয়ে ফেলেছে, মাঝে মাঝেই গিয়ে আড্ডা মেরে আসছে। খেয়েদেয়ে বাইরে বেরোতে দেখি ঠান্ডা বেশ কম আজ, বাইরে বেশ ঝলমলে, যদিও কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা নেই। ওদিকটা একই রকম - মেঘাচ্ছন্ন। টাইগার হিল যাবার কোন মানেই হত না। বিকাশবাবু হাজির যথাসময়ে গাড়ি নিয়ে - রাজভবনের সামনেই। পটাপট উঠে পড়লাম। গাড়ি চলল আগের দিনের রাস্তা ধরেই। চিড়িয়াখানা ডাইনে রেখে নীচে নেমে আরেকটু এগিয়ে আবার ডাইনে এক কঠিন খাড়া বাঁক - রোপওয়ে স্টেশন। টিকিটের লম্বা লাইন - কাউন্টার তখনো খোলেনি। লোকজন বলল সাড়ে দশটায় খুলবে - আদতে খুলল এগারোটারও মিনিট পাঁচেক পরে। তারপর টিকিট কেটে আবার কেবল কারে ওঠার লাইন - সে প্রতীক্ষা আরো দীর্ঘ। অবশেষে আমাদের পালা এল - আমরা তিনজন, আর উল্টোদিকে এক নবদম্পতি - রাজস্থানি। মেয়েটি ছটফটে, বকবক করতে পারে প্রচুর, ছেলেটি যথারীতি শাইনিং চাড্ডি (হাসি কান্নার ইমোজি)।
তবে শুরুতেই এসব বোঝার সময় ছিল না - ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর হবে কিনা এই নিয়ে জনতা যথেষ্ট টেনশনে ছিল। আমার নিজের হালকা ভার্টিগো আছে, তাই আমিও খুব একটা কনফিডেন্ট ছিলাম না। তবে একটু পথ যেতেই বোঝা গেল, ভয়ের কোন ব্যাপার নেই - বরং ওপর থেকে নীচের যে বার্ডস আই ভিউ, সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। প্রথমে জঙ্গল, তারপর চা বাগানের মাথার ওপর দিয়ে ঈগলের মত উড়ে যাওয়া, দূরে অনেক নীচে আঁকাবাঁকা সাপের মত রাস্তা, ছোট ছোট পুতুলের মত কর্মরত কামিনরা, আর মাঝে মাঝে জানলায় মেঘেদের উঁকিঝুঁকি।
অনেকটা নেমে নেক্সট স্টেশনে থামল কেবল কার। আমরা নেমে পাশের চা বাগানে ঘোরাঘুরি। ছবিছাবা। তারপর আবার অন্য একটা কেবল কার ধরে আবার ওপরে। আবার গাড়ি - পরের স্পট তেনজিং রক। এখানে দেখার কিছু নেই - রক ক্লাইম্বিং শেখানো হচ্ছে। মেঘের একটু ইচ্ছে ছিল বটে, কিন্তু যথেষ্ট সাহস করে উঠতে পারল না মনে হয়। আমরা ফুচকা খেলাম। তারপর ধা। পরবর্তী স্পট জাপানীজ পীস প্যাগোডা। আবার সেই ম্যালের রাস্তা ধরে জলাপাহাড়ের দিকে - তবে এবার একটু অন্য রাস্তা। এদিক দিয়েও জলাপাহাড় যাওয়া যায় বটে।
পীস প্যাগোডায় ঢোকার আগে একটা সাধারণ দর্শন বৌদ্ধ মন্দির - এমনিতে দর্শনার্থীদের জন্য ব্যবস্থা আছে কিন্তু করোনাকালে অনেককিছুর মত এটিও আপাতত স্থগিত। গেটের ঠিক বাইরে ফায়ারবলের লালবাহার। এটিকে বাঁয়ে রেখে এগিয়ে গেলে পাহাড়ের গায়ে সাদা রঙের সেই প্যাগোডা - অনেকটা ধবলগিরির মতই। সামনে অনেকটা চত্বর - আর তিন ধাপে উঠেছে প্যাগোডার মূল প্রাঙ্গনে। পুরোটাই জাপানি টাকায় বানানো, লামারাও প্রায় সবাই জাপানি, এবং শোনা গেল, যাচাই করতে পারিনি, এরা নাকি জাপানি ছাড়া অন্য ভাষায় ইন্টেরাক্ট করেন না। হতে পারে। এই পীস প্যাগোডাটিতে আমি খুব একটা মৌলিকতা কিছু পাইনি - তবে আশেপাশের পরিবেশ তো অসাধারণ। পাইনের বনে ঘেরা পাহাড়চূড়ায় একটা শুভ্র প্যাগোডা তার পারিপার্শ্বিকের গুণেই কিছুটা সম্ভ্রম আদায় করে নেয় বই কি। জাপানিদের সৌন্দর্যবোধও সন্দেহাতীত।
যাই হোক, এবার আবার নামতে নামতে হিলকার্ট রোড। আমাদের সফরসঙ্গী কুয়াশা ততক্ষণে আবার ধরে ফেলেছে আমাদের। ডালি মনাস্ট্রিকে বাঁয়ে রেখে, অ্যাঁকাব্যাঁকা সেই রাস্তা ধরে আবার ঘুমের দিকে - গন্তব্য বাতাসিয়া লুপ। আমাদের ছোটবেলার বাতাসিয়া লুপের সাথে তো বটেই, ২০০৫ এর সাথেও অনেক ফারাক। এটা এখন পুরোপুরি ট্যুরিস্ট স্পট। তার ভাল দিক হল, জায়গাটা অনেক সাজানো গোছানো এবং পরিষ্কার। একদিকে কয়েকজন দূরবীনে দার্জিলিং শহর দেখাচ্ছেন, মাথাপিছু ৪০ টাকা। আমরা থাকতে থাকতেই একটা টয় ট্রেন এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ থাকল, তারপর ভোঁ বাজিয়ে লুপ করে চলে গেল ঘুমের দিকে। কিছু মানুষ স্থানীয় পোষাকে ছবি তুলছেন। এদিক ওদিক কেয়ারি করা বাগান - ফুলের, গাছের, ক্যাকটাসের।
খারাপ দিক বলতে একটাই - সেটাও তর্কসাপেক্ষ বটে, এত কৃত্রিমতায় প্রকৃতির আসল রূপটা ধরা পড়ে না। কিন্তু সে বোধ হয় এসব হবার আগেও পড়ত না। প্রকৃতির মাঝে একখণ্ড পার্কের দরকার আছে কি নেই, তা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু এই পার্ক যদি কিছু মানুষের রুজির ব্যবস্থা করতে পারে, তাহলে থাক। সব কৃত্রিমই কিছু অশ্লীল নয়। আমার মোটের ওপর ভালই লাগল এইসব পরিবর্তন।
লাঞ্চ এখানেই করব বলে নীচে নেমে একটা জুৎসই রেস্তরাঁ খুঁজছিলাম, মেঘের চোখে পড়ে গেল "সান্টা বান্টা ধাবা"। সান্টা বান্টার যেসব গল্প শুনেছি, তাতে খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলাম না, কিন্তু মেঘ ইনসিস্ট করল। কোথাও একটা ঢুকে পড়া দরকার ছিল, কারণ আমাদের সফরসঙ্গী তখন হাওয়ার সঙ্গে জুটে রীতিমত হাড় কাঁপাচ্ছিল। কাজেই তিনজনে তড়িঘড়ি ঢুকে পড়লাম সেই সান্টা বান্টারই খপ্পরে। বিকাশবাবু এলেন না - বললেন এখানে পার্কিং এর সমস্যা, তাছাড়া উনি আগেই খেয়ে নিয়েছেন নাকি। অগত্যা।
ভিতরে ঢুকে এক ঝলকে মন্দ লাগল না - কাঠের দেওয়াল, মেঝে - গাছের গুঁড়ির টেবিল। জানলার বাইরে পাহাড়ের ঢাল - কুয়াশায় ঢাকা। জানলার পাশেই একটা টেবিলও পাওয়া গেল। মেঘের ভাত, আমাদের রুটি, চিকেন ভর্তা, মাশরুম কারি। কিন্তু কার্যত মাশরুম কারি আর চিকেন ভর্তা দেখতেও একরকম, খেতেও। এবং কোনটাই ঠিক মাশরুম কারি বা চিকেন ভর্তার মত খেতে নয় (কান্নার ইমোজি)। মেঘের অবশ্য তাতে বিশেষ কিছু যায় আসে না, সে দিব্যি খুশী।
যাই হোক লাঞ্চ সেরে আবার বেরোনো গেল। এবার রকি আইল্যান্ডের দিকে। আভা আর্ট গ্যালারির একটু আগে থেকে বাঁ দিকে (দার্জিলিং এর দিকে মুখ করলে) নেমে গেছে - একদম খাড়াই ঢাল। সুভা কাকীমা (
) আর রাণাদের বাড়িটার পাশ দিয়েই রাস্তা। আমাদের ছোটবেলায় এই স্পটটা ছিল না, তবে ২০০৫ এ এসে দেখে গেছিলাম। খাড়া নামতে নামতে পথে অরেঞ্জ ভ্যালি টি এস্টেট। এখানে গাড়ি একটু দাঁড়াল - ম্যান্ডেটরি পারচেজ - ফার্স্ট ফ্লাশ দার্জিলিং টি। তারপর আবার হুড়হুড় করে প্রায় গড়িয়ে নেমে যাওয়া রকি আইল্যান্ডের দিকে।
ফেরার পথে ম্যালের আগে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডেই নেমে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে আবার গ্লিনারিজ। মেঘের আরেক প্রস্থ ঘোড়সওয়ারির ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সোমবার ঘোড়াদের ছুটি থাকে। গ্লিনারিজে আজ শুধু মাফিন, পেস্ট্রি আর দুটো বড় কেক কেনা হল - একটা প্লেন, একটা ফ্রুট অ্যান্ড নাট। তারপর বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটু ঘোরাঘুরি, কিউরিয়ো শপগুলোয় হানা দিয়ে কিছু ছোটখাটো জিনিষ নেওয়া, ম্যালের দুধারের কাপড়ের দোকান। কিন্তু সেরা অবশ্যই মহাকাল মন্দিরের রাস্তার ফুটের বাজার। সেসব সারতে সারতে, হাঁটতে হাঁটতে হোটেল। ম্যাল থেকে আমাদের হোটেল অবধি হেঁটে যাওয়ার এই রাস্তাটা বেশ রহস্যগল্পের প্লটের মত। ডানদিকে খাদ আর বাঁদিকে পাহাড় - দুইই খাড়া, জঙ্গলে ঢাকা। বাঁদরেরা স্বচ্ছন্দ, কুকুরেরাও, আমাদের দু-পেয়েদের একটু গা শিরিশির তো করেই। অনেক নীচে দেখা যায় গুরুং বস্তি, লেবং রেসকোর্স, আঁকাবাঁকা ফিতের মত রাস্তা। সন্ধ্যে হলে অজস্র আলোর ফুটকি।
রুমে আজ হুইস্কির বদলে কফি আর কেক নিয়ে বসা গেল। গ্লেনারিজ এর এই কেক এর তুলনায় আসে একমাত্র নাহুম'স। এই দুটোর মধ্যে একটাকে বাছতে বললে অবশ্য আমি বিপদে পড়ব। ছোটবেলার দোহাই দিয়ে গ্লেনারিজকেই বাছব হয়তো। দার্জিলিং এ অদ্যই শেষ রজনী - তাই সবারই একটু মন খারাপ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।