আমাকে যদি কেউ চট করে জিজ্ঞেস কর, ভাই বেড়াতে বেড়িয়ে তোমার অনুভূত এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে ওভার-হাইপড জিনিস কি? খুব বেশী না ভেবে যে জিনিসটির কথা আমার মনে সর্বপ্রথম চলে আসবে তা হল – ভেনিসে গন্ডোলা চেপে ঘোরা!
বেশ কিছু ইতালি বা মলটা দেশের বন্ধু বান্ধব থাকার জন্য গন্ডোলা নিয়ে আজকের দিনের ওভার-হাইপড ব্যাপারটা আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু যা হয় আর কি – জেনেশুনেই বিষ পান করতে হয় আমাদের সবাইকেই মাঝে মাঝে। বিশেষ করে যেখানে এই গন্ডোলার সাথে কিভাবে যেন রোমান্টিকতা জুড়ে যায় – তার পর আর কিভাবে এ জিনিস চাপা থেকে নিজেকে এড়াতে পারেন যদি কেবল আপনারা দুটি-তে ঘুরতে যান! বেশ কিছু ইংরাজী সিনেমায় এই গন্ডোলা চাপার ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করেছি – এমনি ভেনিসের ক্যানেল জুড়ে মারপিট-দাঙ্গা হাঙ্গামার সিনেমাও! নতুন এক স্পাইডারম্যানের সিনেমায় দেখলাম ভেনিসের অনেক কিছু ধ্যুলিস্যাৎ করে দিয়েছে ভিলেনের সাথে পাঙ্গা নিয়ে – পরের বার গিয়ে সেই সব স্থাপত্য কেমন অবস্থায় দেখব কে জানে! তবে ভেনিসের গন্ডোলা জড়িত হিন্দী সিনেমার নাম এই মুহুর্তে আমার মনে পড়ছে না – কারো জানা থাকলে লিখে ফেলতে পারেন নীচে।
মেক নো মিষ্টেক – ভেনিস এক অপূর্ব শহর, এবং অনেক কিছু দেখার আছে। এক টুকরো ইতিহাসকে ছুঁয়ে ফেলবেন এই শহর ঘুরতে ঘুরতে। ভেনিসের মুক্ত সমুদ্র অনেক বেশী জীবন্ত – কিন্তু এই ক্যানালের অলিগলি! বেশ কিছু ক্যানাল তো একদম এঁদো টাইপের – জল বদ্ধ হয়ে টকে গেছে মনে হচ্ছে। আর আমার তো মনে হয় অনেক বর্জ্য পদার্থ বা বাড়ির টয়লেটের জিনিসপত্র বেয়াইনী ভাবে এখানে এসে মিশছে, তা না হলে এমন গন্ধ কি ভাবে সম্ভব!
এটা হয়ত অনেকেই জানেন যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর সাথে সাথে যখন সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে – আর এর ফলে ভেনিস ক্রমে ক্রমে একটু একটু করে যাচ্ছে ডুবে। সাম্প্রতিক সময়ে ভেনিস বন্যায় প্রায়ই ভাসতে শুরু করেছে। একটু খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম সাম্প্রতিক সময়ের – অনেক জায়গাতেই রিপোর্ট করেছে যে পরিবেশ রক্ষা এবং দূষণের হাত থেকে ভেনিস বেশ রক্ষা পেয়েছে এই কোভিড-এর সময়ে। ভেনিসে বছরে প্রায় আড়াই কোটি টুরিষ্ট বেড়াতে! এবার ওই টুকু জায়গায় এত বেশী টুরিষ্ট এবং হাজার হাজার ডিজেল চালিত বোট দিনের পর দিন পরিবেশ দূষিত করে চলেছে। এমনটাও বলা হচ্ছে যে প্রায় এক বছর এখানে টুরিষ্ট না আসার জন্য ক্যানালের জল আবার অনেকটা আগের মত স্বচ্ছ দেখাচ্ছে! এই লিখছি একটাই কারণে যে পরিবেশ রক্ষার সব থেকে ভালো উপায় হল যে ট্যুরিজম একেবারেই না থাকা! কিন্তু সেটা অর্জন করা যখন পুরোপুরি সম্ভব নয় (কারন এর সাথে জড়িয়ে আছে স্থানীয় অর্থনীতি, মানুষের রুটি রোজকার ইত্যাদি), তখন আমরা ন্যূন্যতম যেটা করতে পারি তা হল ‘রেসপনসিবল ট্যুরিজম’ – সেই নিয়ে অন্য একদিন লেখা যাবে ক্ষণ – আজকে গোন্ডলার গল্প ফিরে আসা যাক –
এখনকার সময়ে ভেনিসের সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জুড়ে গেছে গন্ডোলার নাম – এরা প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। কিন্তু ভেনিসের লোকজন যখন গন্ডোলা আমাদেরই অবদান বলে দাবী করেন, তখন ওই ভূমধ্যসাগরের আশে পাশের কিছু দেশ যেমন মালটা, ইতালি, তুরস্ক, গ্রীস – এরাও উঠে পরে লাগে ‘গন্ডোলা’ আমাদেরও ছিল তোমাদের আগে এমনটা বলে! কিন্তু আমদের এই তর্কে কোন স্টেক নেই – কারণ আমরা শুধুই ঘুরতে এসেছি – তাই গন্ডোলা যারাই মার্কেটে নামাক না কেন, আমরা এখানে হালকা করে ভেনিসে গন্ডোলার ইতিহাসটা দেখে নেব।
ইতিহাসবিদরা দাবী করছেন ভেনিসে গন্ডোলার ব্যাপার স্যাপার শুরু হয় প্রায় ১০৯৪ সাল নাগাদ – মনে আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে! তখনকার ভেনিসের শাসক এই গন্ডোলা মার্কেটে নামিয়েছিল একটা বৃটিশ চাল (তখনো অবশ্য একটা বৃটিশ চাল বলা ঠিক হবে না – বৃটিশ সাম্রাজ্যের উত্থান এর অনেক পরে শুরু) দিয়ে! দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষেপে উঠেছিল রাজার কাজকর্মে – তাই আজকের দিনে আমাদের দেশে যেমন চাল, সাইকেল ইত্যাদি দেওয়া হয় মানুষকে ঠান্ডা এবং খুশী রাখতে – তেমনই ভেনিসের রাজা করলেন কি দেশবাসীদের উপহার দিলেন গন্ডোলা – বললেন এই দিয়ে তোমরা খুব সহজে যাতায়াত করতে পারবে জলপথে – লাইফ উইল বিকাম ইজি (উনি অবশ্য ইতালিয়ান ভাষায় বলেছিলেন এটা!)
তবে সেই রাজার দেওয়া গন্ডোলা দেখতে কেমন ছিল বা তার কারিকুরি এই সব নিয়ে বিশাল কিছু লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় না। এর অনেক পরে প্রায় ১৪০০ সালের কাছাকাছি কারপাচ্চিও ও বেলেনি নামক দুই শিল্পী প্রথম গন্ডোলার চিত্র অঙ্কন করেন – সেই প্রথম যাকে বলে আমরা ইতিহাসে পাতা থেকে গন্ডোলা কেমন দেখতে ছিল তার একটা ধারণা পেতে পারি। সেই চিত্রগুলি আজও সংরক্ষিত আছে। বলাই বাহুল্য সেই সময়কার গন্ডোলার সাথে আজকের বেশ তফাত আছে – আর এর পিছনে বেশ হাত ছিল তখনকার অভিজাত এবং সমাজের ধনী ব্যক্তিদের। পালকি এবং ঘোড়ার গাড়ির মত হল কি, যার যেমন পয়সা সে তেমন ভাবে গন্ডোলা-কে সাজাতে লাগলো – যার যেমন ইচ্ছে রঙ করছে, কেউ কেউ তো আমার সোনা ইত্যাদি দিয়ে গন্ডোলা সাজাচ্ছে! কারো কারো আবার জলসাঘরের ছবি বিশ্বাসের মত কেস্ - পকেটে পয়সা নেই, কিন্তু কেত মেরে বেড়াতে হবে! এটা আপনারা সবাই জানেন যে ইতালিয়ান-রা খুবই ফ্যাশন সচেতন। তাই ১৬শ শতাব্দীতে ইতালিয়ান সরকার এক ফরমান জারী করল যাতে করে গন্ডোলা-কে যেমন তেমন খুশী করে সাজানো যাবে না – আর সব গন্ডোলাকে কালো রঙের হতে হবে। সেই ট্র্যাডিশন আজকের দিনেও চলছে – তাই এখনো আপনি ভেনিসে গন্ডোলা চাপলে একটা কালো রঙের নৌকাতেই চাপবেন। ১৭শ শতাব্দীতে যদিও ভেনিসে ছিল প্রায় ১০০০০ মত গন্ডোলা – কিন্তু বর্তমানে নাকি গোটা ভেনিসে মাত্র ৪০০টি গন্ডোলা আছে এবং তাদের সবার একই স্ট্যান্ডার্ড ডিজাইন।
সেই ভাবে দেখলে গন্ডোলা এক বিশেষ ডিজাইনের কাঠের নৌকা মাত্র – নানা ধরণের কাঠ দিয়ে গন্ডোলা তৈরী হয় – মেহগিনি, অক, বির্চ, চেরী, ওয়ালনাট ইত্যাদি। এক একটা গন্ডোলা বানাতে প্রায় মাস বারো মাস মত সময় লাগে – এদের ওজন প্রায় ৬০০ কেজি এবং দৈর্ঘ্যে ২৫-৩০ ফুট মত, আর চার থেকে পাঁচ ফুট মত চওড়া। ১৮শ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন গন্ডোলা-র ডিজাইন, কারিগরী ইত্যাদি এক পারফেক্ট অবস্থায় পৌঁছালো, ঠিক তখনই বাজারে আবির্ভুত হল বাষ্পচালিত নৌকা। এর ফলেই গন্ডোলার গুরুত্ব হ্রাস পেতে শুরু করল – ১০০০০ থেকে কমে কমে আজকের দিনের ৪০০তে। আজকের দিনে গন্ডোলা ভেনিসের মূল পরিবহনের মাধ্যম নয় – মূলত টুরিষ্ট-দের জন্য এবং ইতিহাসের একটুকরো সাক্ষী হিসাবেই এরা আছে।
যারা গন্ডোলা বায় তাদের বলা হয় গন্ডোলিয়ার – ১৬শ শতাব্দী থেকে এই গন্ডোলিয়ার-রা এক বিশেষ সম্প্রদায় হিসাবে পরিচিত পেতে শুরু করল। বংশ পরম্পরায় তেই কেবল মাত্র গন্ডোলিয়ার হওয়া যেত একটা সময় পর্যন্ত। আজকের দিনে মনে হয় আর অত ব্যাপারটা স্ট্রীক্ট নেই – কেউ গন্ডোলাচালক হতে চাইলে তাকে গন্ডোলা স্কুলে ভর্তি হতে হবে। তাকে নানা ট্রেনিং দিয়ে লাইসেন্স ইত্যাদি পেলে তবেই ভেনিসে গন্ডোলা চালাবার অনুমতি পাবে।
গন্ডোলা-র ট্যুর মোটামুটি মিনিট ৩০-৪০ মিনিট মত স্থায়ী হয় – নিজেদের জন্য প্রাইভেট বা অন্যদের সাথে শেয়ার করে রাইড-এর ব্যবস্থা আছে। তবে পকেটে পয়সা থাকলে এবং খরচ করতে চাইলে আরো অনেক কিছু ব্যাবস্থা হয়ে যাবে গন্ডোলা-র স্পেশাল সার্ভিসে। এমনকি নিজের প্রিয়তম-র জন্য সংগীত এর ব্যবস্থাও করা যায় – হালকা মিউজিক শুনতে শুনতে ভেনিস ঘুরছেন! আর কি চাই! রোমান্স-ই রোমান্স! ভেনিস গিয়ে প্রথম দিনেই গন্ডোলা চাপবেন নাকি শহরটা একটু চিনে নিয়ে পরের দিন – সবটাই আপনার ব্যাপার। তবে একদম প্রথমবারের জন্য ভেনিস হলেও প্রথমদিনেই গন্ডোলা নিয়ে শহর চিনে নেওয়াটা খুব একটা খারাপ হবে না – সেই গ্রান্ড ক্যানাল, স্যান মার্কো এরিয়া বা রিয়াল্টো ব্রীজ – এগুলো তো দেখতেই হবে!
দিনের ঠিক কোন সময়ে গন্ডোলা চাপা উচিত? এটাও পুরোপুরি আপনার ব্যাপার – সকালের ভেনিসের সাথে রাতের ভেনিসের বেশ তফাত – আবার সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে, সূর্্য ডুবে যাচ্ছে জলের ওদিকে, সেও এক মোহমইয় পরিবেশ সৃষ্টি করবে। তাই ঠিক কোন সময়ে রাইড নেবেন, সেটা নিজেরাই ঠিক করুন –
আর একবার গন্ডোলা ভাড়া করে চেপে বসলে উপভোগ করার চেষ্টা করুন – মনে হচ্ছে পয়সাটা জলে গেল, এই সব ভেবে ভেবে চাপ নিয়ে ওই মিনিট ৪০ মাটি করবেন না! যদিও তেমন ভাবার কারণ পেয়ে যাবেন গন্ডোলা এঁদো ক্যানাল গুলোতে ঘুরতে ঘুরতে – সেগুলো ইগনোর করে রিয়াল্টো ব্রীজ এর ওদিকটা আসার জন্য অপেক্ষা করুন –
গন্ডোলা যার রোমান্টিক চাপে পড়ে চেপেছিলেন, নৌকাবিহার শেষে সে আপনাকে জিজ্ঞেস করবে – “কি দারুণ, না?” আপনি বুদ্ধিমান হলে শুধু “হুঁ” বলে চুপ করে যাবেন -
'...তবে ভেনিসের গন্ডোলা জড়িত হিন্দী সিনেমার নাম এই মুহুর্তে আমার মনে পড়ছে না – কারো জানা থাকলে লিখে ফেলতে পারেন নীচে।'
১৯৭৯ সাল কি এতোটা'ই অতীত হয়ে গেছে? হায়...
এই গন্ডোলা নামটি বেশ অদ্ভুত লাগে। জলযান আর আকাশযানের নাম একই হয় কেমন করে? লেক টাহোতে এই নামেই রোপওয়ে চলে এই দেখুন https://www.skiheavenly.com/explore-the-resort/activities/epic-discovery/scenic-gondola.aspx
@শিবাংশু,
আরে!! সুকির লেখাটা পড়ে এই গানটার কথাই মনে এল।
সেইকালের বিখ্যাত লাইন "আমোরে মিয়ো" ?
ইয়েস, আমোরে মিয়া!!!!
ধেৎ, মিয়ো!!!
গন্ডোলা নিয়ে আস্ত ভ্রমণকাহিনী! আজকের সকালটা এই চমৎকার মানসভ্রমণে আরও সুন্দর হলো।
"পরিবেশ রক্ষার সব থেকে ভালো উপায় হল যে ট্যুরিজম একেবারেই না থাকা! কিন্তু সেটা অর্জন করা যখন পুরোপুরি সম্ভব নয় (কারন এর সাথে জড়িয়ে আছে স্থানীয় অর্থনীতি, মানুষের রুটি রোজকার ইত্যাদি), তখন আমরা ন্যূন্যতম যেটা করতে পারি তা হল ‘রেসপনসিবল ট্যুরিজম’ – সেই নিয়ে অন্য একদিন লেখা যাবে ক্ষণ " ...
অনেকটাই এ ক ম ত। বিতর্কটি তোলা রইল। আরও লিখুন
আরে তাইতো এই গানগুলো তো মনে ছিল না! গুগুল করলেই হয়ত পেয়ে যেতাম লিষ্ট - কিন্তু এই গানগুলো টপ অব দ্যা হেড থাকবে না - এটাও একটা লজ্জার ব্যাপার!
:|: হ্যাঁ, অনেক জায়গাতেই কেবল-কার এর ছোট ক্যুপ গুলোকে দেখেছি গন্ডোলা বলে। কেন জানি না, এই নিয়ে একটু পড়াশুনা করতে হবে।
বিপ্লব, রেসপনসিবল ট্যুরিজম নিয়ে একদিন লিখব। আমরা ট্যুরিজম বন্ধ করে দিলে কার্বন এমিশন কত কমবে সেই নিয়ে অনেক ডাটা আছে।
এই আমোরে মিয়ো গানটাই পোস্ট করতে গেছিলাম। তবে রঞ্জনদার ট্রান্সলেশানটাও অসাধারন হয়েছে - ও আমার মিঞা, আমারে গন্ডোলা করে ভাসায়া নিয়া চলো রে।
খারাপের থেকে তো গন্ডোলা চাপার ভালো দিকটাই বেশি পেলাম। তবে রোমান্টিক নয় কেন?