কথায় বলে মানুষের জন্য নিয়ম, না নিয়মের জন্য মানুষ। সন্দেহ নেই, থাকার কথাও নয়, যে মানুষের জন্যই নিয়ম। এটা আমরা সবাই জানি, নানাবিধ সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তা নিয়ে মাঝে মাঝে যতই সন্দেহ উঁকি দিয়ে যাক না কেন। আসলে নিয়ম নিয়ে - ঠিক ঠিক বলতে গেলে কোনও বিষয় নিয়েই - প্রশ্ন করতে আমাদের শেখানো হয় না, উৎসাহ দেওয়া হয় না। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শেখানো উত্তর পরীক্ষার খাতায় লিখলে ভাল নম্বর মিলবে, নিজস্বতা প্রকাশ করতে গেলে বিপদ ঘটতে পারে। একটি ক্লাস টু-তে পড়া বাচ্চাকে জানি, সে খাওয়ার প্লেটে আঁকিবুঁকি কাটত। তার ঠাকুমা তাকে অমন করতে নিষেধ করলেন। বাচ্চাটি সরল মনে জিজ্ঞাসা করল, "কেন? করলে কী হয়?" বাচ্চাটি উত্তর পায়নি, বকুনি পেয়েছিল। সম্ভবতঃ উত্তরটা ঠাকুমারও জানা ছিল না। তাঁকেও হয়তো তাঁর ছোটবেলায় বাবা-জ্যাঠা বা মা-ঠাকুমা নিষেধ করেছিলেন ওই কাজটি করতে, এবং কোনও কারণ না দর্শিয়ে। যুক্তিতে পেরে না উঠলেই ক্ষমতাবানরা (এই ক্ষেত্রে বাড়ির বড়রা) লাঠৌষধি প্রয়োগ করে থাকেন। অতয়েব এই বাচ্চাটিও জানল যেহেতু প্রশ্ন করলে বকা খেতে হয়, তাই প্রশ্ন করাটা নিশ্চয় অপরাধ। এত সাধারণ বিষয়েই যদি এমন হয়, তাহলে এর চেয়ে বড় ঘটনায় -- ধরা যাক রজস্বলা অবস্থায় থাকার সময়ে মহিলাদের নানাবিধ অবশ্যপালনীয় নিয়মকানুন -- সেসব মেনে চলার ব্যাপারে প্রশ্ন তুললে যে ধুন্ধুমার শুরু হবে তা বলাই বাহুল্য। এমন উদাহরণ আরও দেওয়া যেতে পারে, তবে আসল কথা হল ক্ষেত্রবিশেষে ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আমাদের সমাজ ও রাজনীতি অতীব ব্যগ্র।
কোনও এক কালে, মনে করা যাক আজ থেকে ৫০০ বা ১০০০ বছর বা তারও আগে সেই সময়ের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা ধর্মীয় পরিস্থিতিতে যে নিয়ম তৈরি হয়েছিল তা আজকের বহু বহুগুণ বদলে যাওয়া সমাজে কেন মেনে চলতে হবে সে প্রশ্ন তোলা বা তা নিয়ে তর্ক করাটাও অনিয়মের মধ্যে পড়ে। ক্লাস টুর বাচ্চাটার গল্প থেকে একটু সরে আসা হয়েছে, তার কথাও এখানেই শেষ হতেই পারত, তবে কিনা এটা তো ঠিক গল্প নয়, তাই একটা "তার পর" রয়েছে, তবে সে কথা পরে হবে। আপাততঃ ওই শিশুর ছোট্ট জীবনে যে নতুন নিয়মটা যোগ হল তা হচ্ছে প্রশ্ন করতে নেই। আর বৃহত্তর সমাজে এরই অনুসিদ্ধান্ত হল প্রশ্ন করতে দিতে নেই। কেন্দ্র বা রাজ্যগুলোর আইনসভায় এমনই দেখা যাচ্ছে কিছুদিন ধরে, প্রশ্নোত্তর পর্ব বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে। ‘ক’ দলের শাসনে এই ব্যাবস্থা বন্ধ হলে বিরোধী ‘খ’ দল প্রতিবাদ করছে, অথচ নিজের এলাকায় ‘খ’ দলও কিন্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব বাদ দেওয়ার পথেই হাঁটছে। যা হোক একটা কারণ দেখিয়ে দিতে পারলেই হল। নিয়ম হচ্ছে কথা একজনই বলবেন, বাকিরা শুধু শুনবেন, প্রশ্ন করতে পারবেন না, তর্ক তুলতে পারবেন না। তেমন করলে প্রশ্নকর্তার গায়ে “মাওবাদী”, “দেশদ্রোহী” ইত্যাদি লেবেল যে সেঁটে দেওয়া যায়, বা অন্য নানাবিধ আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা আগেও দেখা গেছে, এখনও যাচ্ছে, ভবিষ্যতেও হয়তো যাবে। আসলে তর্কবিতর্ক ব্যাপারটাই বোধ হয় খুব খারাপ। সুকুমার রায় 'চলচ্চিত্ত-চঞ্চরি'-তে লিখেছিলেন না, আজ পর্যন্ত তর্ক করে কোনো বড় কাজ হয়নি, "এই যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, যাতে করে চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্রকে চালাচ্ছে, সে কি তর্ক করে চালাচ্ছে?"
যাই হোক, নিয়মের, আইনের অনেক ধারা-উপধারা থাকে, তার কয়েকটা লেখা থাকে বইয়ের পাতায়। আর কয়েকটা কোথাও লেখা থাকে না, যদিও তা সবাই সুন্দর ভাবে মেনে চলে। 'সবাই' মানে সেই সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বা মহদাশয় ব্যক্তি যাঁদের ওপর আমরা আইন রক্ষার গুরুদায়িত্ব সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত রয়েছি। শুনেছি আগেকার যুগে রাজামহারাজারা নাকি নিজেদেরই চালু করা আইনের ঊর্ধ্বে থাকতেন, রাজপরিবারের সদস্যরা আইনের আওতায় আসতেন না, তাঁদের মুখের কথাই ছিল নিয়ম। প্রাচীন ভারতের "সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে" আজকের নিউ ইণ্ডিয়াতেও। কোথাও তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। হাজার বছর আগে যা ছিল, বিশ বছর আগে যা ঘটেছে, আজও তাই হচ্ছে এবং আশা করা যায় বছর কুড়ি পরেও একই জিনিস দেখতে পাওয়া যাবে। রাজতন্ত্র অনেক কাল বিদায় নিয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্রে তার জিন ছড়িয়ে পড়েছে, পড়ছে অনেক অনেক মানুষের মধ্যে। 'আম' আর 'খাস' তো আর সমান হতে পারে না।
এ ব্যাপারে দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রথমটা বেশ টাটকা। করোনাকালে কিছু দিন আগে পর্যন্তও ফোন করলেই, টিভি খুললেই, রেডিও চালালেই শোনা যাচ্ছিল মুখোশ পরার গুণাবলী আর দূরত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা। এমনিতেই আমরা নানারকম অদৃশ্য মুখোশ পরে থাকতে অভ্যস্ত, তবে দৃশ্যমান মাস্কে দেখা যাচ্ছে অনেকেরই অ্যালার্জি। পত্রপত্রিকাতেও ছবি সহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা গেছে কারও মাস্ক থুতনিতে, কারও বা এক কান থেকে ঝুলছে, আর কারও নেইই। তাঁরা আম জনতা, রাজন্যবর্গের মধ্যে পড়েন না, তাই মাস্ক পরা তাঁদের জন্য বাধ্যতামূলক। আর যাঁরা ওই শ্রেণীতে পড়েন, যাঁরা মাস্ক পরার নিদান দেন, তাঁদেরই পদাধিকারীদের বিনা মাস্কে দেখা যাচ্ছে রোড শোয়ে, মিছিলে আর রাজনৈতিক সভায় - মুখ ঢাকার নিয়ম মানার দায় তাঁদের নেই।
দ্বিতীয় উদাহরণটা চিরকালীন। বাইক চালাতে হলে হেলমেট পড়তে হয় এটা নিয়ম। আইনের কেতাবে এ বিষয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে, সরকারের তরফ থেকে জরিমানার নিদান রয়েছে, গালভরা স্লোগান সহযোগে ঘরে আর বাইরে নিত্যদিন প্রচার চলেছে, চলছে। দুর্ঘটনার খবর দিতে কাগজে প্রথমেই উল্লেখ করা হয় বাইক আরোহীর হেলমেট ছিল কি না। তবে ওই, এ সবই হল সাধারণ মানুষের জন্য। অসাধারণরা অত্যন্ত শক্তিমান - এ সব বিধির বাঁধন তাঁরা অনায়াসে কাটতে পারেন। তাই লাল-নীল হলুদ-সবুজ দলের বাইক মিছিলে কাউকে মাথা ঢেকে হেলমেট পড়তে হয় না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, কারণ তাদের ফাঁকা মাথায় রাজারানীদের আশীর্বাদের হাত আছে। ছোটবড় নেতা, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীরাও কখনো সখনো ওই রকম বাইকের পিছনে সওয়ার হন, আমজনতা টিভিতে আর খবরের কাগজে তাঁদের ছবি দেখেন।
এ তো গেল 'আম' আর 'খাস'-এর ব্যাপার। তবে 'খাস'-এর মধ্যেও দুই খান কথা আছে। যেমন তোমার ভোটার আর আমার ভোটার আলাদা জীব, তেমন তোমার 'খাস' আর আমার 'খাস'-ও এক হতে পারে না, তাই তাদের জন্য নিয়মও আলাদা। আর এরই অনুসিদ্ধান্তে নিয়ম আচমকাই বেনিয়ম হয়ে যায় যখন রাজন্যবর্গের কেউ শিবির বদল করে। তোমার দলের কেউ গোলমেলে স্লোগান দিলে তা অপরাধ, পুলিশে কেস দেয়। আমার দলের কেউ ওই একই ভাষা ব্যবহার করলে তার কোনও দোষ খুঁজে পাওয়া যায় না। তোমার দলের কেউ শিক্ষককে নিগ্রহ করলে তার জন্য বরাদ্দ জেল, আর আমার দলের কেউ তা করলে সেটা হয়ে যায় ছোট ছেলেদের ভুল। রাজার অপছন্দের জনকে খুঁজে বার করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে অভিযান চালায় সান্ত্রী; আর হস্টেলের ঘরে ঘরে লাঠি আর পাথর নিয়ে হামলা চালায় যারা, তাদের খুঁজেই পাওয়া যায় না বছর ঘুরে গেলেও। তবে যাঁরা এই হামলা নিয়ে বেশি চিৎকার করেন তাঁদের রাজত্বকালের ইতিহাসও অন্য রকম কিছু নয়। তাঁদের আমলেও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা মোটেই বিরল ছিল না। যাই হোক, ধরা যাক আমি একজন ‘খাস’, যে নিয়মে আমি এতদিন চলছিলাম, চমকাচ্ছিলাম ধমকাচ্ছিলাম, লোক নিয়োগ করছিলাম বা রোজগার করছিলাম, সেগুলো অশুদ্ধ ছিল না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি ‘ক’ দলে ছিলাম। যে মুহুর্তে আমি ‘খ’ শিবিরে গেলাম, সবই না-পাক হয়ে গেল।
তাহলে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এই যে একটা নিয়মই ধ্রুব আর সেটা হল নিয়ম সবার জন্য এক নয়, কোনও কালে ছিল না, আজও নেই। নিয়ম ব্যবহার করা হয় প্রয়োজন মত বেড়া দিয়ে আটকে রাখার জন্য। যাঁরা হঠাৎ করে ভোটের আগে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিস্তর টানাটানি শুরু করেছেন তাঁদের কেউই ওনার মত মেনে বলবেন না, "বেড়ার নিয়ম ভাঙলেই পথের নিয়ম আপনিই বেরিয়ে পড়ে, নইলে এগোব কী করে।" বরং তাসের দেশের মানুষের মত তাঁরা বলতে চাইবেন, "ওরে ভাই, কী বলে এরা। এগোবে! অম্লানমুখে ব'লে বসল, এগোব।"
শেষ পর্বে এগোবার কথাটা এল সেই ক্লাস টু-এর বাচ্চার গল্পে "তার পরের" সূত্রে। তার একজন প্রাইভেট টিউটর ছিল, যিনি এই কলমচির পরিচিত আর যাঁর থেকে এই বাচ্চাটার গল্পটা শোনা। তাঁকে গাদা গাদা প্রশ্ন করত সে। সেই কাকুস্যার বুঝেছিলেন যে বাচ্চাটা বাড়ির লোকের কাছেও ওই প্রশ্নগুলো করেছিল, আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনও উত্তর কেউ তাকে দেয়নি।কাকুস্যার যথাসাধ্য তাকে উত্তর দিতেন। প্লেটে দাগ কাটলে কী হয়, এই প্রশ্ন তাঁকেও শুনতে হয়েছিল এবং তিনি জানিয়েছিলেন কিছু হয় না। কাকুস্যারের উত্তর নিয়ে ঠাকুমাকে প্রতিপ্রশ্ন করেছিল বাচ্চাটা। আর তার ফলে তাঁর টিউশনিটা যায়। কারণ অবশ্য একটা দেখান হয়েছিল, তবে ভিতরের গল্পটা কাকুস্যার জানতে পেরেছিলেন অন্য একজনের কাছ থেকে, যার সূত্রে ওই বাড়িতে টিউশনিটা পেয়েছিলেন তিনি।
তাই প্রায় ৫০ বছর আগে মুক্তি “পাওয়া সোনার কেল্লা” ছবির লালমোহনবাবুর মত আজও সবাই আউড়ে যায়, “কোনও প্রশ্ন নয়। নো কোয়েশ্চেন্স।”
বাদল সরকারের "এবং ইন্দ্রজিৎ" নাটকে "সব্বাই করে তাই, সব্বাই সব্বাই". "
ধন্যবাদ রঞ্জন রায়।
তাই পিঞ্জরাতোড়েরা বিনাবিচারে বছরের পর বছর আটকে থাকলেও আমজনতা র মনে কোন আলোড়ন ওঠে না।