'ধুল্ ফুল্, বিকির মায়ের লাল চুল !'
ইরশাদের মুখ থেকে কথাটা বের হতে না হতেই তিতু ফুঁসে উঠলো, 'হুড় করছু বে। টুকবিনি মা কসম।'
অথচ যাকে উদ্দেশ্য করে এহেন তুকতাক, সেই তারিক, অবিচল, কথাটাকে পাত্তাই দিলো না। এক মনে, নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে, সে অদূরবর্তী খন্দের মধ্যে পড়ে থাকা রংবেরঙি মার্বেলগুলি নিরীক্ষণ করছিল। তিতু ভালোই জানে, এই সময়ে তারিক চুপ থাকবে। যত চুপ থাকবে তত মঙ্গল। নির্ধারিত ঘরের আটটি গুলির পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ অবস্থান থেকে তিতু ভাবছিল, তারিক এই জটিল পরিস্থিতি সামলাবে কীভাবে।
কী আছে তারিকের মনে?
তিতু নিজে হলে এই দানে নিজের আউট হওয়া ঠেকাত। কোনোমতে নিজের দান বাঁচাত। জানও বাঁচত। কিন্তু, নাছোড় তারিক সে বান্দা নয়, তিতু জানে। এ দানে ঝাড়তি মারতে পারতো তারিক। কিন্তু ঝাড়তি, আপাতত, আজকের খেলায় নিষিদ্ধ। তারিককে আটকানোর জন্য এই গণতান্ত্রিক নিয়ম। ঝাড়তি চালু থাকলে তারিককে কে আটকায়? নিশানার গুলিকে যে এক টিপের ঝাড়তিতে হাতের ভারী টল দিয়ে নিমেষে চাকনাচুর বানিয়ে দিতে পারে, সেই বছর পনেরোর টুক্কা-ওস্তাদের নাম শেখ তারিক। এখন তার দান।
আর ঠিক এই সময়েই একবার হাতের সাদা টল নিয়ে তারিকের অভ্যস্ত হাত কানের ওপর দিকে উঠতে চায়। সেই দেখে তৎক্ষণাৎ ইরশাদ শাসায়-' ঝাড়তি মার আউট!' তার সঙ্গে আরেক খেলোয়াড় আইনুল সঙ্গত করে-'ঝাড়তি মার আউট।'
যে খেলার যা নিয়ম। অগত্যা, হাত নামিয়ে, তারিক, ঝুঁকল। সামনের দিকে ঝুঁকে গেছে হিলহিলে কালো ঢ্যাঙ্গা শরীরটা। ঢোলা রঙচটা হাফ প্যান্ট। ওপরে বিবর্ণ সাদা হাতকাটা গেঞ্জি। বাঁ পা পেছনে। ডান পা দাগে। সতর্ক চোখে সব লক্ষ্য রাখছে ধুরন্ধর খিলাড়িরা। একটু এদিক ওদিক হলে দান বাতিল। ডিসকোলি।
অতঃপর সবাইকে আশ্চর্য করে তার টল, ঈষৎ শ্লথ, অধিবৃত্তাকারে উড়ে গিয়ে কোণার একটি গুলিকে হালকা আঘাত করে। অর্থাৎ, সে আলতো করে একটি মাঝারি গতির টুক্কা বসায়। গুলি মাটিতে বসে যায়, কিন্তু টল অন্য গুলিকে স্পর্শ করে না। বাকি গুলিগুলি অক্ষত।
এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য তিতু দেখলো। দেখলো অপরাপর সমবেত খেলুড়েসকল। চোখের ঈর্ষার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় তাদের তারিফ। তারিক একবার ডাইনে সকৌতূকে তাকালো। হালকা চোখ মেরে তিতুকে বললো, 'ক্যায়সা রাহা রে মেরি ময়না?'
-'কসম টুক্কা কি! একদম দিল পে লাগা! সলিড।' তিতু পানখাওয়া দাঁত বের করে বলে।
তারিক সবকটা পড়ে থাকা গুলি আলগোছে তুলে নেয়। একটা রেখে বাকি সাতটা তিতুকে বাড়িয়ে দেয়। মুখ ভার করে দ্যাখে বাকি সাতজন প্লেয়ার। এক পাক প্রদক্ষিণ ক'রে হাত ঘোরায় তারিক। তারপর সুর করে বলে:
'এসো খদ্দার ল'ড়েচ'ড়ে।
চিংড়ি মাছের ঘাড়ে প'ড়ে।'
দুজনের গুলি শেষ। বাকি দুজন আর খেলতে চায় না। এ দানে মাত্র চারজন খেলবে।
'দু গুলি, তিনগুলি, চারগুলির দান খেলবে? হ্যায় কোই মাই কী লাল?'―তারিক অকুস্থলের গুলিয়াড়দের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।
কিন্তু বাকিরা রিস্ক নিতে রাজি হয় না আর। আইনুল তার সবেধন নীলমণি মার্বেলটি তুলে দেয় তারিকের হাতে। তারপর টেনেটেনে সুর করে আকাশের দিকে কারুর উদ্দেশে দু হাত তুলে বলে:
'হাত ফুক্কা দান।
জয় টুক্কা ভগবান।'
আরও বাকি তিনজন দিল। সবার গুলিই প্রায় নিঃশেষ। আজও তারিক ফুটিয়ে দিল সব্বাইকে। অবহেলার সঙ্গে চারটি গুলি তারিক চেলে দেয় কেপের ভিতর। তারপর বলে, 'বাতা। কুনটি বাদ?'
-' বাঁয়ের উপরের বুলু গুলি।', ইরশাদ বলে, ওপরের নীল মার্বেলকে ইঙ্গিত ক'রে।
-'লে, খির খা।' বলে, কেপের মাথায় দাঁড় করানো ইঁটের গোড়া থেকে টাংকি মেরে ডানদিকের গুলিকে টল দিয়ে অবলীলায় নিশানা করে তারিক। গুলিসহ টল বেরিয়ে আসে কেপের বাইরে। তিতু, নিশ্চিত, জানত, এই দান হেলায় হাসিল করবে তারিক।
'খেল খতম পয়সা হজম', তিতু হাসলো এবার। খেলা শেষ হয়ে যায়। তারিক বলে, 'চল মেরি ময়না।'
দুজনে পাথরঘাটা বস্তির ভাঙাচোরা সরু পিচের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। রাস্তা পেরিয়ে সদরঘাটের পিচের বাস রোড। রোড পেরিয়ে মাটির বাঁধ। মাটির বাঁধ পেরিয়ে ঢালু লাল কাঁকুরে মাটির রাস্তা। এই রাস্তা চলে গেছে কাঁসাইয়ের পাড় অবধি। রাস্তা ধরে একটু এগোতেই খাল। খালের ওপরে নির্জন কালভার্ট। মেঘলা দুপুর। আশেপাশে কেউ নেই। ওপাশে ইটভাঁটা। ফাঁকা জমিতে দু-একটা গরু চরছে। কালভার্ট পেরিয়ে জাম গাছের তলায় মাঠের ঘাসের ওপরে বসে পড়ল দুই পার্টনার।
'চল্, গিনতি কর্।' তারিক বললো।
তিতু তার খাকি প্যান্টের দুই ঢোলা পকেট থেকে ঘাসের ওপর বের করে মার্বেল গোনা শুরু করে। এক, দুই করে গুনতে গুনতে বাহান্নয় গিয়ে থামে। তারপর চোট খাওয়া মার্বেলর চিহ্নিতকরণ শুরু হয়। ওগুলো পাবে তিতু আর তারিকের ছোট ভাইয়েরা। সাতটা গুলি বাতিল হয়। পরের হিসেব। তিতু ও তারিক খেলতে নেমেছিল দশটা গুলি নিয়ে। অতএব পঁয়ত্রিশখানা তাজা মার্বেল আজকের ইনকাম। এর সিংহভাগ কৃতিত্ব তারিকেরই। কেননা তিতু মাত্র একদান জিতে বাকি কয়েকদান হেরেছে। তারিক আজও অপরাজিত।
সমস্ত মার্বেল থেকে বেছেবুছে তারিক এক একটি জেল্লাদার মার্বেল পরখ করতে থাকে।
'দশ পয়সা কম একটাকা', তারিক এবারে হাসে। তিতু বলে, ' কমসেকম সত্তর পয়সা তো ভাটুদা দিবেই। কসম টুক্কা কি।'
'চল ময়না, অব ডান্স দিখা বে', তারিক তিতুর দিকে হেসে তাকায়, চেরা গলায় গাইতে শুরু করে:
'ম্যায় তেরা তোতা, তু মেরি ময়না
মানে না কিউ কহেনা।
ফুলো কি জ্যায়সি তেরি জবানি
জানে ক্যা জাদু চালা।
মেরা দিল তোতা বন যায়
ক্যায়সে মিঠু মিঠু বোলে হায়।'
গান শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই তিতুর নাচ শুরু হয়। কোমর বেঁকিয়ে সে তার দুপা ও দুই হাত তালে তালে নাড়াতে থাকে। তারিক গানের মাঝে মাঝে বিরাম নিয়ে নিজের ঠোঁট দুই আঙুলে চেপে ধরে সিটি দেয়। তিতুর বিরামহীন নাচের বেগ বাড়তে থাকে। তার আত্মহারা নৃত্যের ঝোঁকে ঢোলা প্যান্ট কোমর থেকে নীচে নেমে আসতে চায়।
একসময় তিতু ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। তারিকের গান বন্ধ হয়। দুজনে লাল রাস্তা ধরে বাঁধের ওপরে ওঠে। তারপর নেমে পিচ রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে ভাটুর দোকানের দিকে এগোয়।
নাজমা বিকেল হলে দোতলার ছাতে আসবে। তারিক একথা জানে। তিতুও। এছাড়াও তারিক জানে, নাজমা স্কুলে কখন বেরুবে, আর, সেই সময়ে তার গায়ে থাকবে একটা অব্যর্থ লালচে টিউনিক। ওই সময়ে, নাজমা, তিতুকে সে বলেছে, একদম নীলমের মাফিক।
নীলম, নীলম। চাংকি পান্ডের হিরোইন। সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো পরিহিত হিলহিলে চাংকি। ওর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে হাসতে হাসতে নাচে নীলম। উজ্জ্বল নীলম। লাল ফিতে চুলে বাঁধা থাকে তার। গায়ে লাল ফ্রক। পায়ে যেমন জুতো থাকে সেরকম জুতো সে যদিও নাজমার পায়ে দেখেনি। সত্য বোসের বেটি পরে অমন হিলতোলা জুতা, অমন ফ্রক। কিন্তু, দশটায় টিউনিক গায়ে যখন নাজমা বেরুবে, তখন সে আদতে নীলম। ওই সময় তার পথের একপাশে বসে থাকবেই তারিক, হয় হরলালের পুকুরের ধারে, নয় রাস্তাটা যেখানে বাঁক নেয়, সেই তুঁতগাছের নীচে, কোনোদিন তিতু সঙ্গে থাকবে, কোনোদিন সে একা, কিন্তু ওই সময়ে নাজমার হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য দেখবেই তারিক। একই দৃশ্য, তবুও কেন যে নতুন মনে হয়! তার যাওয়ার পরে সঙ্গে তিতু থাকলে তারিক বলবেই, কেমন দেখলি, আজ? আর হয়ত এমনই চাপাগলায় কথাবার্তা হবে তার ও তিতুর:
-'দেখা?'
-'হুঁ।'
-' আঁখ দেখা বে? নীলম, বিলকুল নীলম। '
-' তোর দিকে একবার দেখল।'
-'মা কসম?'
-'আজ হাসে নি। মুয়ে লজেস ছিল। কিন্তু, সেদিন হাসল।'
তারিকের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। তার দিকে তাকালো, সে বোঝে নি, তবুও তিতু বলছে, হতেও তো পারে। একথাও ঠিক যে, যে দৃশ্যে নাজমা অবশ্যম্ভাবী, সে দৃশ্যে তারিক তার সম্বিৎ হারায়। তবুও, নাজমা তাকে কোনোভাবে লক্ষ্য করছে, তিতুর এই আশ্বাস তাকে আত্মবিশ্বাস দেয়।
এই এখন যেমন একটা মেরুন রঙের নাইটি পরে ছাতে দাঁড়িয়ে আছে নাজমা। চোখে ঘুম লেগে আছে, এই সময়ে তার মুখে একটা উদাসীনতা থাকে, জানে তারিক। এরপরেই আসবে তার দুএকজন সহেলি। এখন নাজমা তার চুল খুলে রেখেছে, চোখে ঘুম, এ বড় বিষণ্ন অন্যরকম, কী দ্যাখে নাজমা, তার মনে কী আছে? নাজমা কি জানে না, বিষণ্নতা নীলমের জন্য নয়, তাহলে এখন কেন এমন মুখভার? হয়রানি বেড়ে যায় তারিকের।
দুঃসহ এই দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রাস্তা পার করে সে ছাতের নীচে এসে দাঁড়ায়। ওপরের নাজমার দিকে তাকায়, নিজেকে প্রস্তুত করে তারিক, তারপরে বলে, ' তাজু ভাই ঘরে আছে?'
-' আছে।' একবার তাকিয়েই নাজমা নিস্পৃহ চোখ পরক্ষণেই সরিয়ে নেয়।
রিনরিন করে তারিকের কানে বাজল কথার বোল গুলো, আসলে প্রিয় এই কন্ঠস্বর একবার শুনতে চেয়েছিল সে। কী ভাবল নাজমা, অজুহাত, বাহানা? কিন্তু, তার কিছু করার ছিলো না। দৃশ্যের কাছে অসহায় তারিক আজকের পরাজয় স্বীকার করে নাজমার দাঁড়িয়ে থাকার নীচ বরাবর এগিয়ে যায়, দাওয়া দিয়ে ঢোকে। সিঁড়ি ভেঙে উঠে এগিয়ে যায়। এই বাড়ি তার পরিচিত, অন্তত তাজুর ঘর, নাজমার বাপ শামসের মিঞা, নানীর ঘর সবই চেনে সে। কোন ঘরটিতে নাজমা থাকে, তার অবস্থানটুকুও সে জানে বহুবছর।
তাজুর ঘরে গিয়ে তারিক দ্যাখে আরো দুজন রয়েছে। এরা তাজুর বন্ধু, ভিনপাড়ার, তারিক চেনে। এদের মধ্যে একজন চাপদাড়ি, সাদিক, সাত নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের ভাই। তারিককে দেখে তাজু তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা থামায় না। শুধু একবার তাকিয়ে বলে, তারিক, হাঁসুর দুকান থিকে তিনটা জর্দা পান আর এক পাকিট সিগ্রেট লিয়ে আয়। জলদি। একথা বলেই তাজু তার দিকে একটি দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দেয়।
তারিক নেমে আসে।
সেই রাতটা মনে আছে তার। সানা ভিডিও সেন্টার থেকে ভাড়া করে আনা রাতব্যাপী ভিডিও চলবে মহল্লায়। দুদিন ধরে চাঁদা তোলা হয়। বিজলি আসবে শামসের মিঞার ঘর থেকে। নাজমাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী মাঠে রাতভর ভিডিও চালু হয়। প্রথমে সার্বিক ডিমান্ড মেনে শোলে চলে। ডায়লগ বলে ঠাকুর ও গব্বর। মহল্লার লোকও বলতে থাকে, 'লোহে নে লোহে কো কাটতা হ্যায়।'
আর, মধ্যরাতে শুরু হয় নতুন রিলিজ 'পাপ কী দুনিয়া'। চাংকি, সানি দেওল, নীলম। দেখে তাক লেগে যায় তারিকের। পুলিশের বেটা ডাকু হয়ে যায়, ডাকুর বেটা পুলিশ। কুদরতের কারিশমা। একসময় সেই দৃশ্য আসে। চাংকি-নীলম পরস্পরের দিকে এগিয়ে যায়।
দৃশ্যপটে একটা তোতা ও একটা ময়না। তোতার ঠোঁটে ময়না ঠোঁট রাখে। আর গান হয়, মেরা দিল তোতা বন যায়, ক্যায়সে মিঠু মিঠু বলে হায়। উচ্ছল নীলম নাচতে থাকে, রঙ বেরঙ্গি ড্রেস পাল্টায়। নায়িকার ঠোঁটের কাছে, একসময় তারিক টের পায়, নাজমার ঠোঁটের আদল। নীলমের মেধাবী দুই চোখে একসময় নাজমার দুচোখ মিশে যায়।
এবং তারিক জানে, সেই সময় নাজমাও এই দৃশ্য তার ছাত থেকে দুই সহেলির সঙ্গে দেখছিল। তখন কী ভাবছিল নাজমা? সে কি নিজে জানে ওই নীলম আর সে আসলে একাত্মা?
একদিন তিতুর সঙ্গে সে বাজি ধরেছিল । সদরঘাটের অ্যালুমিনিয়াম কারখানার মালিক সত্য বোসের বেটি বাস-রাস্তায় রিকশায় চেপে যাচ্ছিল। ঘাড় অবধি ছাঁটা চুল, একটা খাটো ফ্রক, তার ফর্সা, মসৃণ পা দেখা যাচ্ছিল।
তিতু বাঁধ থেকে উত্তেজিত হয়ে তার হাত চেপে ধরে, দেখছু, দেখছু বে পা-গুলা?
তাকে নিরুত্তর দেখে তিতু বলে, দুধ দিয়ে পা ধুয়ে বে সত্য কালীর বেটি।
-ঝুট। আব্বে, ঔর মত চড়া।
-আমি জানি। গঙ্গা অদের ঘরে দুধ দিতে যায়। পাঁচ লিটার দুধ ডেলি লেয় বে। দুধ দিয়ে গা ধুয়ে ধুয়ে চিকনা গোরি রঙ।
-শালা বকোয়াশ। অর বাপের পয়সা আছে। নাইত কসম খেয়ে বলছি, নীলমের কাছে ফেল মেরে যাবে।
নীলম বলতে কাকে তারিক বোঝায় তা তিতু ধরতে পারে। কিন্তু পাল্টা সেও বলে―
-শামসের মিঞার পয়সা কি কম বে? তাজুর ভটভটি আছে। অদের অত বড় ময়দা ভানার মিল।
চুপ করে যায় তারিক। একথা ঠিক যে মহল্লায় পেল্লাই তিনতলা পাকা বাড়ি একজনেরই। সেটা শামসের মিঞার। নাজমার বাপ। লোকশ্রুতি এমন, চ্যাটার্জির সাবান কারখানায় একদা ম্যানেজারি করে শামসের নাকি দেদার টাকা সরায়। সেই টাকা পরে নিজের ব্যবসায় কাজে লাগিয়েই তার আর্থিক উন্নতি। মহল্লার কেউ কেউ বলে, পাপের, হারামের পয়সা।
এখন রতন মাস্টারের বাড়ির অদূরবর্তী পাঁচিলে বসে তারিক ভাবছিল গেল বছরের কথা। কারবালার মেলায় সে তার যৎসম্বল দিয়ে একটা লাল ফিতে আর সবুজ একগাছা চুড়ি কিনতে পেরেছিল। সন্ধেয় সে গুটি গুটি পায়ে নাজমাদের বাড়ির দাওয়ায় তাকে একা পেয়েছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে সে ফিতে ও চুড়ি নাজমার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু নাজমা হাতে নেওয়ার বদলে গলা চড়ায়― তোর হিম্মত তো কম নয়! দুটাকার অওকাত দেখাস? তাজু ভাইয়ের কানে গেলে তোর চামড়া তুলবে। আসিস না এখানে।
তারপর থেকে নাজমা তার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেয়। অথচ, তারিকের মনে পড়ে, তারা আশৈশব একসঙ্গে একই পাড়ায় বড় হচ্ছিল। তার দিদি, শাদির আগে অবধি নাজমার সঙ্গীদের একজন ছিল। এমনকী নাজমা তারিকের প্রতিও কিছুটা সদয় ছিলো। অন্তত দুএকটা কথা তো বলতো।
দুটাকার অওকাত! দেমাকি নীলম বলেছে তাকে।
রতন মাস্টারের বেটির কাছে রোববারের টিউশন পড়ে উল্টো অভিমুখে ফিরে যাচ্ছিল পাহাড়ীপুর বালিকা বিদ্যালয়ের ক্লাস নাইনের নাজমা। দূরে কলতলার কাছে পাঁচিলে একা বসে দেখছিল তারিক।
ছোটবেলার একটা দৃশ্যই মনে আছে। একটা ফুলফুল জামা পরে দৌড়ে যাচ্ছে নাজমা ওই মাঠে, দৃশ্যত তার কাঁধে তখন ভর করেছে দুটো রঙিন ডানা। আর পেছনে ছুটে যাচ্ছে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের মধ্যে তারিক, সে ধরে ফেলবেই ওই প্রজাপতিটাকে। একসময়ে ভিড়ের মধ্যে আগুয়ান সে ছুঁয়ে ফেলছে নাজমাকে, কিন্তু, সে কি সহজে ধরা দিতে চায়? নাজমা দৌড়চ্ছে, আপ্রাণ, অথচ, তারিক জানে, সে তাকে ধরে ফেলবেই।
ধরেও ফেলল। তক্ষুণি তার হাত কামড়ে দিয়েছিল নাজমা। সে নাজমার ডানাটা জোর করে ধরতে উদ্যত, কিন্তু তার আগেই নাজমা ভ্যাঁ কান্না জুড়ে দিয়েছিল। তার সেই ফোলা চোখে, আর ফুলফুল জামার হাতায় জল মোছা মনে পড়ে।
আর কিছু মনে পড়ে না। শুধু জানে, তারা একটা দঙ্গল একসঙ্গে মাঠে খেলত। সে ও তার দিদি সেই দলে ছিল। কিন্তু একদিন মেয়েদের দল আর ছেলেদের দল কীভাবে যেন আলাদা হয়ে যায়। কোনো একটা অলিখিত চুক্তিবলে। তাদের দল কাবাডির দল বানায়, গুলি খেলে, আর মেয়েরা চু-কিতকিতে মেতে যায়।
কিন্তু আলাদা হয়ে তাকে ক্রমশ টানতে লাগল নাজমা। শুধু কি তাকে? সমবয়সী ও তার চেয়ে বেশিবয়সী সকলের চোখ আকর্ষণ করে শামসের মিঞার রূপসী বেটি, তার দেমাকি হাঁটাচলা, ভ্রূকুটি, আর, বাকভঙ্গি। এই মহল্লার শাহজাদী সে। তারিকের রোজস্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে নীলম, আর ঠোঁটে ঠোঁটে ঠোকরানো দুটো পাখি। কিন্তু তাকে গোপনে দুয়ো দিয়ে যায় নীলম, বলে, জানিস না তোর অওকাত?
ইমলির বীজ দিয়ে প্রথমে তারিক বাকিদের সঙ্গে গুলির প্র্যাকটিস করত। এভাবেই শুরু করে সবাই। তিতু ছিল তার সতীর্থ। গুলির অভাব তার একান্তই ছিল। কিন্তু, গুলির প্রাথমিক ব্যবস্থা তিতুই করে। টুক্কার ময়দানে অবতীর্ণ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তারিক ওস্তাদ হয়ে ওঠে। তিতু তাকে গুলি ধার দিয়েছিল। সে তিতুর গুলি দ্বিগুণ তিনগুণ, ধীরে ধীরে বহুগুণ করে তোলে। তারপরে তারা গুলির রঙিন স্ফটিকসাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে যায়। গুলির অভাব থেকে অঢেল প্রাচুর্য একসময় রাস্তাও বাতলে দেয়। একদিন সদরঘাটের ভাটুর সঙ্গেই গোপনে লেনদেন শুরু করে তারিক। দশ পয়সায় চারটে থেকে পাঁচটায় রফা হয়। ভাটু নিজের দোকানে দশ পয়সায় দুটো বেচে। এভাবে আপাতত পাঁচটাকা বারোয়ানার মালিক আজ তারিক। কিন্তু টাকা বাড়তে চায় না। খিদের সঙ্গে লড়াই যুঝতে পারে না টুক্কার অনিয়মিত অর্জন। খিদে। যখন তখন খিদে পায়। তার খিদে। ভাইয়ের খিদে। বোনের খিদে। তার বাপের অধিক আয় উড়ে যায় রক্ষিতার জন্য। তাছাড়া গুলির আসর কমই বসছে আজকাল। তিতু-তারিক যুগলকে দেখলে মহল্লার নাবালকেরা খেলার আসর ছেড়ে দেয়। কিংবা, গোপনে আসর জমায়।
তার বাপ ইয়াসিন হেড-রাজমিস্ত্রি। তারিককে মাঝেমধ্যে জোরজার করে ডাকে কাজে। লেবার খাটার কাজে তারিক গেলে ঘরের টাকা ঘরেই থাকে, সে যতই আনকোরা লেবার হোক না কেন। কিন্তু, এতে তারিকের ফায়দা কোথায়? সে দুপুরের খাবারটুকু পায়। তার পেমেন্ট তো তার বাপই মেরে দেয়। গজগজ করে ইয়াসিন, তার কাজে অনীহা দেখে। অথচ, সে আঠারো বিশ বছর বয়সী লেবারের ইঁট বওয়ার কাজ বিন-আয়াসে করে দেয়। সহজেই উঠে যায় ভারা বয়ে। এমনকী সিমেন্টের মশলা সে কোদালে অবলীলায় মেশায়। মিস্ত্রির খুনে বয় মিস্ত্রির খুন। ইয়াসিন বলে। ইয়াসিনের বাপও রাজমিস্ত্রিই ছিল।
টাকা চাই তার। অন্তত কিছুটা, সাময়িক। টাকাই অওকাত। ভটভটিতে চাংকি পান্ডে হয়ে স্টার্ট দেওয়ার অওকাত। শামসের মিঞার বাড়ির শানবাঁধানো লাল সিঁড়িতে ওঠার আত্মবিশ্বাসী অওকাত।
ব্রিজের ওপাশে রিক্সাওয়ালাদের, পয়সা দিয়ে গুলির আদলে, জুয়ার আসর বসে। মার্বেলের জায়গায় কয়েন। সিকি, আধুলিতে আসর জমে। তিতুকে সে বলে, ওখানে খেলতে চায়। অনেকটা আয়ের সুযোগ। তিতু না করে। বলে, হারাম ওসব, পাপ। পাড়ার বয়োবৃদ্ধরা বলে, জুয়া হারাম। তারিক পাল্টা বলে, তাদের গুলির অর্জিত পয়সাও তাহলে হারাম। তিতু তার কথা মানতে চায় না।
তারিকের পয়সা দরকার। এক লপতে কিছু টাকা, যা তাকে সামান্য অওকাত এনে দেবে।
কুইকোটার কাছে নাকি এক পীর থাকে, তিতু বলেছিল। জলপড়া পান দেয়। 'পান খিলিয়ে দে খালি। ওই পান মুখে দিলেই, ব্যস, নাজমা তোর', তিতু বলেছিল। একথা মনে ধরে নি তারিকের। যদি কথাটা সত্যিও হয়, এ তো হুড় করে জেতা হয়ে গেল।
'আমাকে টুক্কার মুকাবিলায় হুড় করতে দেখছু? দেখা কভি?'-তারিক সদর্পে বলেছিল।
-' তাহলে তুই কী করবি?'
-'পিঁজরায় রেখে দিব নীলমকে।'
-'ক্যায়সে বে?'
-' সে আছে পিলান।'
তিতু আর কিছু বলে নি। কিন্তু তিতুকে অমান্য করে সে আজ চলেই এসেছে কাঁসাই ব্রিজের নীচে। তিতু এমনকী সঙ্গ দিতেও রাজি হয় নি। ব্রিজের এককোণে রিকশা স্ট্যান্ড। দুপুরবেলায় ব্রিজের আড়ালে জুয়ার ঠেকে সে এককোণে দাঁড়ায়। এই জায়গাই পয়সা বাজি রেখে জুয়া খেলার পক্ষে নিরাপদ। মহল্লায় এসব খেলা হারাম, নিষিদ্ধ। বয়োবৃদ্ধরা তেড়ে আসে।
এরা বলে পয়সা খেলা। আদতে জুয়া। গুলির বদলে পয়সা। নিশানায় লাগিয়ে জিতে নাও। এই এখন, তারিক গাছের তলার এককোণে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল, ছজন খেলছে। দশ পয়সার দানে খেলছে। অর্থাৎ, একটু পরে দান বাড়বে। সিকিতে খেলা হবে তখন। খেলা, আধুলিতেও উঠতে পারে। একটা বটগাছের আড়ালে গর্ত করে কেপ তৈরি করা আছে। মাথায় ইঁট দাঁড় করানো। একজন দশ পয়সাগুলো চাললো। একটা সিকিও আছে দশ পয়সার ভিড়ে, যার পয়সা, সে হারলে পনেরো রিটার্ন পাবে পরের দানে। একজন পয়সা বাতালো। যে খেলছে তার হাত আনাড়ি। দুটো পয়সায় ঠোক্কর খেলো তার বোকা হাতের টল। আউট। হাত নিশপিশ করে ওঠে তারিকের। এই দান সে নিজে পেলে...তিনটে আলাদা চাল জানা ছিল তার। এক দানে আটানা হাসিল হতো। দশ দান জিতলে পাঁচ টাকা। তিন দান হারলে তিরিশ পয়সা। মানে চারটাকা সত্তর হাতে নিয়ে ফিরত আসতো সে। একদিনের একঘন্টার আয়। আহা! রক্ত চনমন করে ওঠে তার।
পরের জন বেমক্কা ঝাড়তি চালিয়ে দশ পয়সা টিপ করলো। কিন্তু পয়সা ঠোক্কর খেলো পাশের পয়সার সঙ্গে। আউট। ঝাড়তি চালু আছে, দেখে খুশি হলো তারিক। তিতুও দেখলে খুশি হতো। এ দান কঠিন ছিলো, কিন্তু, ঝাড়তিতে টলের জোর আরো বেশি লাগত।
তৃতীয় জন দান চাললো। বাঁদিকে দুটো দশের হালকা জোড়। টল হাতে সে নিশানা করতে যাচ্ছে, তারিক সামলাতে পারলো না, বলে উঠলো, 'টাংকি মারো। জোড় নেই তো।'
লোকটা মারতে উদ্যত, একবার তার দিকে, বিরক্ত, তাকায়। দান বাঁচলো। কিন্তু গুটি হাসিল হলো না।
চতুর্থ জন যে হাফ প্যান্ট লোকটা, আনুমানিক বিশ-বাইশ বছরের, তার বাঁ চোখটা কানা। সে বাঁহাতে পয়সা চাললো। তারপর বললো, 'বাতা।'
একজন পয়সা বাতাতেই সে কোণের সিকিটাকে যে কায়দায় বাঁহাতের টলে মুহূর্তে উড়িয়ে দিলো তাতে তারিক বিস্মিত হলো। জাত প্লেয়ার।
আরো একদান খেলা হলো। আবার কানাচোখ জিতলো, এবারে ঝাড়তি মারলো।
পরের দানে যখন সবাই পয়সা দিচ্ছে তখন তারিক হাতের থেকে দশ পয়সা তার দিকে এগিয়ে বললো, আমার দান ধরো।
সবাই তার দিকে তাকালো। কানাচোখের মুখে একটা বিদ্রূপের হাসি। একটা লোক বললো, তুই পয়সা খেলবি? ধনের গড়ায় চুল গজিছে বে?
আরেকজন বললো, কার বেটা তুই? থাকু কুথায়?
-পয়সা খেলার সময় বাপের নাম পুছতে হয় নাকি? তারিক চোয়াল শক্ত করে বলে।
কানাচোখ বললো, থাক, খেলুক। পয়সা রিটান মাঙ্গিস না ফের হেরে যেয়ে।
খেলা শুরু হয় আবার। এই দানে কানাচোখ পয়সা চালার পর আউট হয়ে যায়। ঝাড়তি মেরেছিল, কিন্তু টল বেইমানি করলো। সে হাত ছুঁড়ে বিরক্তিতে একবার জোরে 'ল্যাওড়া!' বলে চেঁচায়। তারপরে খাক শব্দে থুতু ফ্যালে।
তিনজন আউট হয়। দুজন দান বাঁচায়। তারিকের বুক ঢিপঢিপ করে। তার দান। কেপ থেকে পাঁচটা দশ পয়সা, দুটো সিকি তুলে নেয় সে। একবার জড়ো করে পয়সাগুলো ডানহাতে তুলে কপালে ঠেকায়। এ তার মুদ্রাদোষ।
পয়সাগুলো চেলে দেয় সে। কেপের ঘরে বসে পড়ে দশ ও চারানার মুদ্রাগুলো। সে নিরীক্ষণ করতে থাকে। আশ্বস্ত হওয়ার মতো দান পড়েছে। বাকি, কসম টুক্কা কী। কয়েক সেকেন্ড পরে সে বলে, বাতাও।
বাঁ কোণার দশ পয়সার দিকে অবহেলায় ইঙ্গিত করে একজন। কানের ওপর হাত তোলে তারিক। সে জানে পয়সা গুলির মতো বেসামাল নয়, আর, ঝাড়তি-অস্ত্র তার আছে। ডানদিকের সিকির দিকে চোখ রাখে সে। একটি সজোর ঝাড়তি নিমেষে বসিয়ে দেয়। সিকি উড়ে যায় একহাত দূরে, লাফিয়ে মাটিতে পড়ে। টল কেপের বাইরে ছিটকে যায়। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে কজন। একজন কানাচোখকে ইঙ্গিত করে বলে, 'আবে কাল্লু। ই কেরাসিন বাতি তো তোকে ফুটি দিবে বে!'
কানাচোখ গম্ভীর হয়ে যায়। পয়সাগুলো কুড়িয়ে তোলে তারিক। দুজন পনেরো পয়সা করে ফেরত পাবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে তারিক বলে, 'চারানার দান খেলবে?'
সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায়। কাল্লু, কানাচোখ, এগিয়ে আসে। হাসিমুখে আধুলি বাড়িয়ে দেয়। বলে―'দু সিকির দান লে । কিন্তু দুদান জিতে পালিয়ে চুতিয়া বানাতে দিবনি বে। খেল চলবে। মরতে দমতক।'
খেলা শুরু হয়। কিন্তু দুজন খেলা থেকে অব্যাহতি নেয়। পাঁচজনের দান। এদানেও তারিক ঝাড়তি মেরে অনায়াসে চারসিকি অর্জন করে। কিন্তু পরের দানে তারিক অধিক উত্তেজনায় দান মিস করলো। হাতটা, অসহায়, শূন্যে ছুঁড়ল। কিন্তু এদানে দুজন আউট হওয়ার পরে কানাচোখ কাল্লুও আউট হয়ে আবার খিস্তি করলো। পরের জন আউট হওয়ায় আবার একটাকা হাতে বিন আয়াসে এসে গেল।
তারিক, উদ্ধত, এবারে আটানার দান হাঁকে। দুজন পত্রপাঠ কাজের দোহাই দিয়ে খেলা ছেড়ে কেটে পড়ে।
কালু ও বাকিজন দুটো আধুলি দেয়। তারিক নিজের আধুলি জড়ো করে টুক্কা মারে। পয়সা অল্প নাচে। উত্তেজিত তারিক পয়সা তুলতে যাবে, কালু তার হাত ধরে ফেলে, চিল্লায়―'টল দুটা পয়সা টাচ করছে। আউট। পয়সায় হাত দিবিনি বে।'
―' পয়সায় হাত দিবে নি। হুড় করছ। এ দান আমার।' তারিক পাল্টা চেঁচায়।
হলফ করে তারিক বলতে পারে জোচ্চুরি করছে লোকটা। কিন্তু তৃতীয় প্রতিযোগী কালুকে সমর্থন করে। তিতুর অনুপস্থিতি অনুভব করে অসহায় তারিক, এই প্রথম। টের পায়, কেউ হুড় করলে তার হয়ে গলা ফাটানোর নেই কেউ আজ।
সে ঝুঁকে, মরিয়া, পয়সা তুলতে উদ্যত হয়। কাল্লু এসে তার হাত মুড়ে ধরে। যন্ত্রণায় কাতরায় তারিক, ঝুঁকে যায়। কিন্তু হাত ছাড়া পেতেই সে পাল্টা উঠেই কাল্লুকে ধাক্কা দেয়। কিন্তু এক লহমায় একটা বাঁহাতের ঘুষি তার ঠোঁট ফাটিয়ে দেয়। মাথা টলমল করে ওঠে।
' খানকির বেটা। আটানার অওকাত দেখাস? কাল্লুকে চ্যালেঞ্জ মারিস পয়সার ময়দানে?'
তারিক মাটিতে বসে ঠোঁটের রক্ত মুছছিল। কাল্লু তার পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে। তার চোখের সামনে ধরে। তারপর বলে―
'বাপের বেটা আছু তো এই টাকা পকেটে রেখে জুয়ার আসরে নামবি বাঞ্চদ। আর এখানে ফির এলে হাড্ডি গাঁড়ে ঢুকিয়ে দিব শালা।'
দ্রুত পায়ে ফিরে আসছিল তারিক। রক্তের স্বাদ নোনা, টের পাচ্ছিল। কিন্তু বাঁধের ওপর হাঁটতে হাঁটতে সে একবার কী খেয়ালে থামলো। পকেটের পয়সা গুণে দেখল মাত্র আধ ঘন্টায় টাকার পরিমাণ দুটাকা চল্লিশ বেড়ে গেছে। এখন কি তারাপদর দোকানে একশো চানাচুর কিনবে? কিন্তু মুখের ভেতরটা জ্বলছিল তখনো। কানে বাজতে লাগল তিতুর কথা, হারাম, হারামের পয়সা। খুন চুষে লেয়।
বাঁধের ওপর থেকে সে কাঁসাইয়ের খালপাড়ে নেমে গেল দৌড়ে। খালের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো আজকের দুটাকা চল্লিশ, গুনে গুনে। তারপর রক্তমাখা থুতু ফেললো খালের জলে।
তার হাতে ধরা খাঁচার মুনিয়া দুটো ছটফট করছিল। একটু দ্রুত, কিন্তু, চুপিসাড়ে অন্ধকারে হাঁটছিল তারিক। বিদ্যাসাগর পল্লীর কাছে এসে সে মাঠ পেরিয়ে নির্জন জঙ্গলের পথ ধরলো, যে পথ এসময়ে মাড়ায় না কেউ। জঙ্গলে চলার শব্দের সঙ্গে, খাঁচার ভেতরে পিক পিক করে জানান দিচ্ছিল জোড়া মুনিয়া― নীলম আর চাংকি।
আজকে একটু আগেই সতকুইয়ের মেলা থেকে পাখিদুটো কিনে ফিরছে সে। বাদামী রঙের। কালো পেট। নীচে ঘাড়ের কাছে কালো দাগ। একটার গাঢ় দাগ। একটার হালকা। খাঁচাসহ পঁচিশ টাকায় পেয়ে গেল। দোকানির কাছ থেকে পাখির তদারকি, খাবার সব কিছু মন দিয়ে শুনে বুঝে নিয়েছে সে। পাখিদুটোকে রাস্তায় আসতে আসতে বারবার ফিরে ফিরে থেমে থেমে দেখছিল। যতক্ষণ আলো ছিল। এতটুকু, যেন হাতের মুঠোয় ঢুকে যাবে। গায়ের রঙ থেকে জেল্লা মারছে।
জোড়ি। মুনিয়া। তাতে কী। সব পাখিই তো তোতা ময়না। আসলে চাংকি নীলম।
তবে এর জন্য মেহনত করতে হয়েছে। ঘাম ঝরাতে হয়েছে যথেষ্ট। লাগাতার সাত দিনের মেহনত।
সে হাসনাবাদের রাজমিস্ত্রি আলতুর কাছে এক সকালে গিয়েছিল। সোজা গিয়ে কবুল করেছিল, ওস্তাদ, মিস্ত্রির কাজ জানি। লেবারের কাজ দাও।
আলতু প্রথমে তাকে পাত্তা দিতে চায় নি। তারপর তার মহল্লা জিজ্ঞেস করে।
'পাথরঘাটায় মহল্লা।' সে বলেছিল।
-তোর বাপের নাম কী?'
'―মকবুল।' সে মিথ্যা বলেছিল, 'রবিউলের দুলা, তার বেটা আমি। হরলাল আমিনের ঘরের কাছে। দু বছর আছি ইখানে। আগে বনসোলে ঘর ছিল।'
―' তো ইয়াসিনের কাছে যা। তোর মহল্লার মিস্ত্রি।'
―' কী বলব চাচা। এক হাপ্তা খাটিয়ে এক পয়সা পেমেট দেয় নি।'
―' এই নাদান উমর তোদের। কাজ শিখ। টেনিং লে। পেমেট পেমেট করিস খালি।'
―' চাচা। আমার কাজ দ্যাখো। এক হপ্তা জি-ভর কাজ করিয়ে খুশ হয়ে পেমেট যা দিবে, আল্লা কসম, তাই হাত পেতে লিব। বুনের শাদি আছে। টাকা দরকার। দুই ভাই মিলে যেখানে কামকাজ মিলে যায় মেহনত করি।' এই কথা বলার সময়ে তারিক যথাযথ নতজানু ছিলো।
আলতু মিস্ত্রি মুডি। উঁচু দরের মিস্ত্রি। কিন্তু, বেখরচ, আর, নিজের রোয়াবে চলে। এ খবর তারিকের অজানা ছিলো না। সে এও জানত যে ইয়াসিন আর আলতু তার নানার কাছে একসঙ্গে কাজ শিখেছে। পরে হেডমিস্ত্রির পদ নিয়ে ইয়াসিন ও আলতুর সংঘাতে দুজনের পথ আলাদা হয়ে যায়। সেই থেকে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায় দুই মিস্ত্রির। এ ওর মহল্লা, তল্লাট মাড়ায় না। এসব তারিক জানতো।
এমনিতেও আলতু মিস্ত্রি নিজস্ব দার্শনিকতায় চলা আপন মর্জির মালিক। বেকার ধানাইপানাই পছন্দ করে না। তাছাড়া ইয়াসিন আর তার জন্মাবধি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ছোকরার সিধাসাধা কাজ চাইবার ভঙ্গি মনে ধরেছিল হয়ত আলতুর। কেননা সে পরের দিনই সকালে সিধা তারিককে নিজের ডেরায় আসতে বলে।
তার ভবিষ্যতের হেডমিস্ত্রীকে সালাম করে, রাতের অন্ধকারে ফিরেছিল তারিক।
তারপরের সকালে কাজে যোগ দেয় সে। মহুয়া সিনেমা অঞ্চলে, বাজারের বড় বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন। প্রথমে ইঁট, সিমেন্ট মশলা মাথায় কড়াইতে নিয়ে সে তরতর ভারা বেয়ে উঠতে নামতে থাকে তিনতলার উচ্চতায়। তার আত্মবিশ্বাস আলতু আর বাকি অ্যাসিস্ট্যান্ট, লেবার আর কামিনদের চমকিত করে। বাকিরা কি জানে মিস্ত্রির ধমনীতে আছে মিস্ত্রির কামিয়াব খুন, পসিনায় বইছে মিস্ত্রির নোনা পসিনা?
দুপুরের বিরতিতে বছর পঁয়তাল্লিশের আলতু থেবড়ে বসে একসময় জিরোচ্ছিল। বিড়ি ধরিয়ে এদিক ওদিক হাতড়ে মাচিস খুঁজছিল। কেউ কিছু বোঝার আগে তারিক পাশের বালির স্তূপের থেকে মাচিস দ্রুত নিয়ে যায়। আলতুর কাছে মাচিস জ্বালিয়ে ধরে―'লাও ওস্তাদ।'
আলতুর হাতে তখন ভেজা সিমেন্ট ভর্তি। ছোকরার অনুপুঙ্খ খেয়াল আর নিজস্ব বিবেচনাবোধ দেখে আলতু চমকিত হয়। হেডমিস্ত্রির এটা সেটার দরকার―কজন খেয়াল রাখে এই জমানায়? কিছু পরেই একটা কামচোর অ্যাসিস্ট্যান্টের ফেলে যাওয়া কোদাল হাতে নিয়ে ছেলেটা নিপুণ হাতে সিমেন্ট আর বালির তৈরি করা কালচে গোল হ্রদের জলে যেভাবে মশলা করতে থাকে তা আলতুমিস্ত্রির চোখকে মুগ্ধ করে। দিমাক ঠিক রাখলে, লেগে থাকলে, এ ছোকরা যাবে অনেকদূর।
চতুর্থ দিনে আলতু ইঁটের গাঁথনিতে মশলা ভরার কাজে তারিককে ডাকে, ইঁটের ওপরে ওলনদাঁড়ি তাকে ধরতে ডাকে। তারিকের হাত কাঁপে না। এই বিরল সম্মান স্বল্পতম সময়ে অর্জন করার পরের দিনই তাকে নগদ চল্লিশ টাকা ধরায় আলতু। বলে, ‘এখন আয়েশ কর কদিন। কাজ বন্ধ থাকবে এক হপ্তা। পরে আসবি ফের।‘
তার পরের দিন সতকুইয়ের হাটে চলে গেছে সে। এখন বাস থেকে নেমে রাস্তা ধরেছে চুপিসাড়ে। জঙ্গলের ভেতর, বুনো ঝোপের আড়াল দিয়ে সে নাজমার বাড়ির পেছনের ছুপা রাস্তা দিয়ে ঢুকে যায়, নাজমাদের দাওয়াতে ঢোকে। নাজমার নানি তাকে দেখে চমকে ওঠে, ' তারিক? হাতে কী রে তোর বেটা?'
এ বাড়ির মধ্যে মায়া মমতা তার জন্য যদি কারুর থেকে থাকে তবে এই কানবয়রা নানীর। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে যায় তারিক। বলে,' নানি, চিড়িয়া লিয়ে এসছি তুমার নাজমাকে দিব বলে। গজব চিড়িয়া। দ্যাখো নানি।' খাঁচা আলোর কাছে তুলে ধরে। নানি দেখে। জেল্লাদার জলপাই-বাদামি রঙ। ঘাড়ের কাছে কালো দাগ। একটার গাঢ়তা বেশি।
নানি অবাক হয়ে দেখে: ' আরে। ক্যা খুব। কুথায় পেলি এই পনছি?'
―'আরে সে অনেক কষ্টে জুগাড় করছি। বুলাও না নাজমাকে।'
নানি গোল ফেলে দেয়―' এ নাজমা। দ্যাখ তোর জন্য চিড়িয়া এসছে।'
ঝুপ করে তখনই লোডশেডিং হয়ে যায়।
আর, সেদিনই সন্ধেয় প্ৰকৃত একাকী ছিল নাজমা। অন্ধকার ছিল। আহ্, যেমন একাকিত্বে নাজমাকে চেয়েছিল সে, অন্ধকারে টিমটিমে লম্ফের মৃদু আলোর ঘনত্ব ততোটাই ছিল।
প্রথমে অবিশ্বাসী চোখে খাঁচার দিকে ' হায় আল্লা!' বলে মুখ ঢেকেছিল নাজমা, তারপরে, দ্রুত চোখ দুটোয় বিজলীর ঝিলিক খেলল খুব। তার ঠিক পরেই শুধু ঝিরঝির হাসতে লাগলো সে। মুনিয়া দুটো যেন সেইসময়ে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে চাইছিল, হয়ত ওরা এতটা আলো চাইছিল না।
―'এই পনছি কুথা থিকে লিয়ে এলি তারিক?' হাসি থামিয়ে খুশি খুশি প্রশ্ন করেছিল নাজমা।
কিন্তু উত্তর শোনার আগেই নাজমার প্রশ্নালু হাত তার হাত মৃদু অনুনয়ে ছুঁয়েছিল। যেমন অযত্নে, যতটা আলগোছে কোনো হারমোনিয়ামের বেলো ছুঁয়ে দেয় কোনো গজল সম্রাজ্ঞী, সেই ঈষৎ আন্তরিক অবহেলার স্পর্শ তারিককে দিয়ে নাজমার হাত, তার কনুই থেকে অনাবৃত উজ্জ্বল হাত, ফিরে গিয়ে নিজের চুল আনমনে গোছাতে লাগল। কিন্তু, নীলম, নীলম, তুমি কি জানো মুখের ঠিকরানো এই আলো অন্ধকারঘন, এই আলো মায়া বাড়িয়ে দেয়, হাহাকার এনে দেয় বছর পনেরোর আনাড়ি রোগা বুকে? তারিকের অবাক চোখ সেই সময়ে নিবিষ্ট হয়ে শুধু নাজমার মুখের আলো দেখছিল।
―' চুরি করে লিয়ে আসুনি তো?' নাজমার কথায় সম্বিৎ ফেরে তার।
―' মা কসম। তোর কসম। দুলাভাই এনে দিইছে সতকুইয়ের হাট থিকে। আমার ঘরে কুথায় রাখবো? তোর ঘরে জাগা আছে। আলো বাতাস আছে। দুটা দানাপানি পাবে।'
-' কী নাম এই চিড়িয়ার?'
-' এটা চাংকি।' একটা পাখির কাছে খাঁচায় আঙ্গুল রাখে সে, থামে, পরেরটায় আঙ্গুল রাখে ফের, 'আর এটা নীলম আছে।'
―' যা বে শরারত। ঝুট!' নাজমা যেন লজ্জা পেল ঈষৎ, মুখ নামিয়ে নিলো, অথচ একটু আলগা হাসি লেগেছিল কি? এটা কি সেই ভঙ্গিমা, যা সে দেখেছে কখনো, যাতে কখনোই বোঝা যায় না, নিষ্পত্তি হয় না, ঠিক সে হেসেছিল কিনা? আজব ধাঁধা রয়ে যায়, রহস্য। এত কাছে আছে, চাইলেই সে নাজমাকে ধরে ফেলতে পারত, তবুও পারল না, আজ এই একাকিত্বেও না। কোনোদিন কি সে নাজমার প্রজাপতি-ডানার নাগাল পাবে?
নানির গলা ভেসে আসে। রাত হয়েছে।
তারিক পাখিপড়া করায় নাজমাকে, জরুরি কথাগুলো। জোড়িতে থাকে এরা। খুব ভাব। একটার ওপর আরেকটা নির্ভরশীল। এরা তিন মাস পরে ডিম দেবে। তারপর ছানা হবে এদের। তখন বাসা দরকার। সাজুভাইকে বলে যেন ব্যবস্থা করে সে। সামান্য খরচ। আর দানা, তিল, তিসির কাগজের লিস্ট সে নাজমাকে ধরিয়ে দেয়। পরিমিত জল, হপ্তায় একটু পালং কী কলমি শাকের ব্যবস্থা করা। সামান্যই খরচ।
রাত হয়ে গেছিল। তখনো অন্ধকার ছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সে নাজমার দিকে তাকালো―'চাংকি নীলমকে তোর হিফাজতে রেখে গেলাম। খেয়াল রাখিস।'
লম্ফ ধরে সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়েছিল নাজমা। তার চোখে চোখ রেখে হেসেছিল। প্রথম।
কিন্তু সে-রাতেই ইয়াসিন দাওয়ার খাটো খেজুর গাছের ডাল ভাঙে। টানা পিটানিতে তারিকের পিঠ জ্বলে যায়, ছড়ে যায়। কে ইয়াসিনের কানে খবর দিয়েছিল সে জানে না। কিন্তু সেদিনই সব খবর পেয়ে গিয়েছিল তার বাপ। আলতুর কাছে মিস্ত্রি খেটে এসে বাপের নাক কান কেটে এভাবে বেইজ্জত করা?
সেদিন দাওয়াতে মাটিতেই শুয়েছিল সে। মাথার ওপরে চাঁদ উঠল। ফের ঢেকে গেল। গোটা শরীরময় ব্যথা আর জ্বালা। কিন্তু, একসময়ে ঘুমের প্রাক্কালে একটা হাত এসে বারবার ছুঁয়ে দিতে লাগল তার যন্ত্রণার জায়গাগুলো। শুশ্রূষা হয়ে ফিরে আসতে লাগল একটা মুহূর্ত, সে দেখলো, একটা হাত, একটা হাসি, স্পর্শ করা যায় না বলে এমন তীব্র আকাঙ্খিত। বাকি সব কিছু তো এমন স্পর্শের যোগ্য নয়, নাজমা না নীলম, কে আসল, নাকি নাজমা, খাঁচায় সে বন্দী রয়েছে এখন, তবুও তাকে স্পর্শ করা যাবে কি এক হাতের মুঠোয়, সত্যিই কি ছুঁয়ে ফেলা যায় পাখি ও মানবীর বুকের ধুকপুকুনি? কেন হাসি স্পর্শ করা যায় না, কেন ওই ঠোঁট হাসল নাকি হাসল না, এই মীমাংসা হলো না, হয় কি, হবে কখনো?
ভোরবেলা সে আলগা বৃষ্টির স্পর্শ পায়। উঠে পড়ে। গায়ে পিঠে ব্যথা। কিন্তু, এমন বেধড়ক মারে সে কমবেশি অভ্যস্ত। বেলা বাড়তেই ইয়াসিনের হুকুম আসে―' কাজে যাবি আজ থিকে। আর, আলতুর কাছে গেলে এ ঘরে জাগা নেই।'
পরের কদিন ইয়াসিন মিস্ত্রির কাজ হচ্ছিল দিনভর। ইউনিভার্সিটিতে বিল্ডিং এর দেদার কাজ। অনেক রাত অবধি কাজ থাকে। ঢালাইয়ের। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় তার।
মাঝে একদিন শুধু তিতুর সঙ্গে দেখা হয় তার। তিতু এসে খবর দেয় নাজমা নেই। ফুফার ঘর গেছে। কার শাদি আছে। সবাই গেছে। ঘরের তদারকি করছে ময়দা মিলের কর্মচারী করিমুল।
তার উদ্বেগ ছিল। কিন্তু কাজের ফাঁকে দুদিন, একবার সকাল আরেকবার রাতে গিয়ে দেখল, নাজমাদের বাড়ির তালা বন্ধ। চাংকি-নীলম দানাপানি পাচ্ছে ঠিক? কবে ফিরবে নাজমারা?
তার একদিন পরে তিতু থমথমে মুখে ফিরে আসে।করিমুলকে সে পাখির কথা বলেছিল। কিন্তু, কোন ঘরের চাবি করিমুল জানেও না, খুঁজেও পায় নি। পাখির অবস্থান সম্বন্ধে সে ওয়াকিবহাল নয়।
পরের দিন তারিক তিতুকে নিয়ে দৌড়ায়। কিন্তু, করিমুল তাদের মালিকের অনুপস্থিতিতে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। তিতু আর তারিকের সঙ্গে করিমুলের হাতাহাতি শুরু হয়। মহল্লার লোক জমে যায়। কিন্তু ফয়সালা হয় না। এ মামলায় কেউ ঢুকতে চায় না। ব্যর্থ, ফিরে আসে তারা।
নাজমারা ফিরেছিল দিনকয় পরে। পাখিদুটো খাঁচাতে পড়ে ছিল। পিঁপড়ে, পোকা আর দুর্গন্ধের মধ্যে।
কালভার্টের পাশে জাম গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে তিতু খালি খাঁচাটা হাতে ধরে দাঁড়িয়েছিল। নাজমা তিতুর হাতে ফেরত পাঠিয়েছে। তিতু বললো, নাজমা বললো, তারিক বিমারি পাখি দিয়েছে। ও পাখি প্রথম থেকেই ধুঁকছিল। যেমন বিমারি তারিক তেমনি তার চিড়িয়া। পাখির ঘর এখন ভালো করে ডেটলপানি দিয়ে ধুলাই হচ্ছে।
এসময়েই একটা ইয়ামাহা বাইক শব্দ করে লাল ধুলো চতুর্দিকে উড়িয়ে এগিয়ে যায় কাঁসাইয়ের পাড়ের দিকে। সামনে শাদা জামা, শাদা প্যান্ট আর শাদা জুতোর চাংকি স্টাইলে যে বসে আছে তাকে চেনে তারিক। তিতুও। সাত নম্বর ওয়ার্ডের, অলিগঞ্জ এলাকার কাউন্সিলরের ভাই, তাজুর ইয়ার, বিশ বছরের সাদিক আহমেদ। চোখে কালো চশমা।
আর তার কোমর জড়িয়ে বসা, মাথায় ওড়না ঢেকে আজব কালো চশমায় চোখ ঢেকেছে যে মেয়েটা তাকে চিনতে পেরে তিতু সহসা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
কিন্তু ওকে চেনে না তারিক, মুখ ফিরিয়ে নেয়। ও অন্য কেউ, নীলম না, কিছুতেই না।
চমৎকার গদ্যরীতি। শেষটা নির্ধারিত থাকলেও গল্পটা পড়ানোর জন্যে যে জিনিসটা লাগে, এই গল্পে সেটা এসেছে।
বিশেষ কথ্যরূপের ব্যবহার, চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা, বাস্তবযাপন, আর সব শেষে এই নিজেকে চোখ-ঠারা, সব মিলিয়ে গল্পটি মনে থাকবে।
আগাগোড়া টেনে রেখেছে গল্পটা। চমৎকার লাগল সবটা মিলিয়ে।
চমৎকার!
গজব!!!
সিধে দিল পে লাগ গয়ি টুক্কা......
অনবদ্য লেখা
মনে থাকবে এই গল্প ছবির মত .
ডিটেলিং অসামান্য।ভাষা সংলাপের ওপর এমন দক্ষতা মুগ্ধ করে এবং সমাজের যে অংশটির কথা বলা হচ্ছে তার নিখুঁত পর্যবেক্ষণ।আর নব্বই দশকের সেই সময়। কেবল অনুযোগ থাকলো চেনা ছকের বাইরে গল্পকে ফেলতে হবে।
টুক্কা নিয়ে এমন চমৎকার গল্প লেখা! আহা! মন ভরে গেল।
বেশ লাগলো . চমৎকার ডিটেলিং .
চমৎকার গদ্যভাষা, এত বিশ্বাসযোগ্য বুনন, কথ্যভাষা ব্যবহারে মুন্সিয়ানায়, এই গল্প মনে থেকে যাবে।
গুলির আসর উঠে এল চোখের সামনে . অসামান্য ভাষা . "কিন্তু উত্তর শোনার আগেই নাজমার প্রশ্নালু হাত তার হাত মৃদু অনুনয়ে ছুঁয়েছিল। যেমন অযত্নে, যতটা আলগোছে কোনো হারমোনিয়ামের বেলো ছুঁয়ে দেয় কোনো গজল সম্রাজ্ঞী, সেই ঈষৎ আন্তরিক অবহেলার স্পর্শ তারিককে দিয়ে নাজমার হাত, তার কনুই থেকে অনাবৃত উজ্জ্বল হাত, ফিরে গিয়ে নিজের চুল আনমনে গোছাতে লাগল। কিন্তু, নীলম, নীলম, তুমি কি জানো মুখের ঠিকরানো এই আলো অন্ধকারঘন, এই আলো মায়া বাড়িয়ে দেয়, হাহাকার এনে দেয় বছর পনেরোর আনাড়ি রোগা বুকে? " - অনেক দিন মনে থাকবে। তবে শেষে এসে তারিকের কষ্টটা সেভাবে মোচড় দিল না . তখনো ভাষার ঐশ্বর্যে মন বিহবল . আমারই অনুভবের ব্যর্থতা.
টানটান লেখা, নতুন রীতির গদ্য ভাষা আর টুক্কা এই তিনে মিলে শেষ অব্দি বেঁধে রাখল - সাধুবাদ জানাই লেখককে।
সোমনাথ, প্রতিভাদি, দ-দি, রঞ্জনবাবু, ফরিদা, Du, একলহমা, মৃণালবাবু, দেবিকাদি, সম্পদ, মণি, ঝরা ও স্বাতীদি―আপনাদের সকলকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রতিক্রিয়া ও মতামত দেওয়ার জন্য।
এই লেখাটা অসামান্য কিন্তু এটা নিয়ে আমার অভিযোগের জায়গা হল গল্প লিখে এর উপন্যাসসম্ভাবনা নষ্ট করা হয়েছে। এই আখ্যান উপন্যাসপ্রতীম সেটাকে গল্পের মধ্যে বাঁধা হল কেন? সম্ভাবনার হাত পা বেঁধে দেওয়া ভাল জিনিস নয়