১
যখন বমনেচ্ছা জাগে তখন মনে হয় মৃত্য আসন্ন। সেই সময়ে জীবনের প্রতি ঘৃণাবোধ প্রবল হয় তার। সে কখনো আটকাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু, ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবার। দমবন্ধ ভিড়বাস থেকে নেমে পড়েছে রাস্তায়, স্টপেজের তোয়াক্কা করে নি।
এখন, কোনোমতে মুখটা আপ্রাণ চেপে, একে তাকে ঠেলে, মরিয়া ছুটে গেছে বাসের দরজার কাছে। হেল্পারকে অনুনয়ে বলেছে, ভাই নামিয়ে দাও একটু। উদাসীন হেল্পার―এখন বাস থামানো যাবে না। সেই সময়ে, সে, বমি করব, বমি করব― বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল।
এই, বাস থামাও, হেল্পার চেঁচিয়ে ওঠে তৎক্ষণাৎ, প্যাসেঞ্জার বমি করবে, বাস থামাও।
ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে ড্রাইভার।
হুড়মুড়িয়ে নামে সে। ছুটে রাস্তার ধারে বসে যায়। এখানে লোকালয় নেই, কোনো দোকান নেই আশেপাশে। কেউ দেখছে না তাকে। অবশ্য দেখলেও তার যেত আসত না কিছু।
দুটো গাছ। পাশে একটু নীচে পচা কালো জল। তার দুর্গন্ধসমেত। সে প্রাণভরে বমি করতে থাকে। পাশের সড়কে ছুটে যাচ্ছে ভাবলেশহীন বাস, ট্যাক্সি, বাইক।
ভিসুভিয়াসের মতন তরল অপাচ্য ভাত, ঘ্যাঁট, ডাল এর মিশ্রণ অবলীলায় উঠতে থাকে। শরীর দমকে দমকে কাঁপতে থাকে থরথর করে। তারপর নিশ্বাস নেয় সে। আরাম হয়। মুখ আর দাঁত টকে গেছে।
এখন একটু জল খুঁজবে সে। যদিও সে আপাতত পুনর্জীবিত।
~~~
২
কিন্তু আমার জীবন একসময় সদয় হয়ে উঠছিল আমার প্রতি, তাই কি নয়? নইলে নয়না বাসস্ট্যান্ডে অতক্ষণ দাঁড়ায়? না না, তুমি নয়, তোমার ডেসপারেসি। বা, তুমি নয়, তোমার নাছোড় পাগলামি, যা আমাকে অন্য কারুর দিকে যেতে দেয়নি।
নয়নার শেষ অমোঘ বাক্যটি অমেয় সম্ভাবনাময়। অর্থাৎ, সেই অদেখা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির শিল্পী, কিংবা আরো অজানা কোনো মৃদুভাষ কবি, বা যারা এমন তথাকথিত। যারা দৃশ্যে নেই। নিরাপদ পরিপ্রেক্ষিতে, ঘুমন্ত, আছে।
ঘনিষ্ঠ ও ঐকান্তিক মুহূর্তে নয়না প্রত্যাশিত রকমের নীরবতা দেয়, ও, ভাঙে, এমন নীরবতা ও তার স্বেচ্ছাচার মাত্রাতিক কাঙ্খিত। যখন সে একান্ত তার ঘেরাটোপে, তখন সে লক্ষ্য করেছে, তাদের আপেক্ষিক উচ্চতা আসন্ন চুম্বনের চিত্রকল্প হিসেবে যথাযথ। এই যে, তোমার জন্মদাগগুলি তার সব চেনা হয়ে গেছে, তোমার এই চোখের নিচের অংশে কবেকার কাটা দাগ, এই সবই, আসলে তার নিজস্ব আবিষ্কার। বাস্তবিক, স্পর্শ যেভাবে একজনকে অন্যের কাছে পরিচিত করে তোলে, তার মত আন্তরিক কিছুই না।
কিন্তু, এসব আত্মগত অনুভূতি ক্ষণিকের। মুহূর্তকালীন আসঙ্গলিপ্সা দীর্ঘকালীন প্রেক্ষাপটে জলের মধ্যে ক’টি পৌনঃপুনিক ভুড়ভুড়ি কাটার সামিল নয়? ডাল, ভাত, নুন ও বাজারের থলির দৈনন্দিনে যে জীবন স্থাপিত হতে অক্ষম তা তাৎপর্যহীন। কে না জানে শরৎ, কাল হিসেবে ক্ষণস্থায়ী ও কাশফুল হাইওয়ের এককোণে নির্বাসিত। এ দেশ, তদুপরি, আজন্ম ট্রপিক্যাল।
সুতরাং, আপাতত দোষারোপ নিয়ে, আজকের কফিশপে মেরুনরঙা কামিজের নয়নার চোখে চোখ রাখার মুহূর্তে ঈষৎ অপরাধবোধে আক্রান্ত হবে সে পুনর্বার।
নয়না গলা নামিয়ে বললো, পাশের টেবিলের ইয়াং কাপলটাকে দেখেছ?
~~~
৩
টানা কয়েক বছর হাসে নি সে। সেই সময়, একবার তাকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একটা হাইওয়েতে গাড়িতে যাচ্ছে সে। গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া আরো তিনজন ছিল।
এই সেই সময়, যখন, সিরিয়াস ডিসকাশন হলে সে বরং স্বস্তি বোধ করত। এইসব আলোচনায় সবার সঙ্গত অধিকার থাকে না। অফিস-পলিটিক্সে, সঠিক ফোরামে, সদর্থক বক্তব্য রাখতে কজনই বা পারে? অন্তত সে যখন সুস্থ ছিলো তখনও গুছিয়ে পারতো না। এইসব সময়ে নানা আঙ্গিকে যারা বিশ্লেষণ করতে পারে তারা উপযুক্ত স্টান্স নিতে জানে। সঠিক বা বেঠিক স্টান্স, সে যাইহোক।
কিন্তু, লঘু একটা বিষয়, একটা ঠাট্টার বিষয় উপস্থিত হলে, সে ভয়ে ঘেমে উঠতো। সবাই হোহো করে ফাটিয়ে হাসছে, আর আমি, দ্যাখো, হাসার ভঙ্গি করতে গেলেও নিজেকে মনে হচ্ছে অযোগ্য। এইরকম পরিবেশে বেমানান সে, চুপচাপ, অভিব্যক্তিহীন, বসে থাকত। তার সঙ্গীরা যথোচিত ভদ্র, তাকে হাসতে কেউ তেমন পীড়াপীড়ি করে নি।
কিন্তু, এই আমি, অন্তত হাসতেও পারি না কেন? কী এমন বিপর্যয় ঘটলো আমার জীবনে, যে আমি আর সাধারণ একটা কথায় হাসতে পারি না। কেন আমি হাসতে অনিচ্ছুক এমন ? এই প্রশ্ন করেছে সে নিজেকে বহুবার।
সেই সময়ে, সেই সমুদ্রে যাওয়ার দিনে, একটা হাইওয়ে ধরে বৃষ্টির মধ্যে গাড়িটা যখন যাচ্ছে, সে চোখ বুজে ছিল। গাড়িতে বাকিরা সেই সময়ে কথা বলছিল না। একটা গান হালকা আওয়াজে ভেসে আসছিল। একটা হিন্দি ছবির গান।
গানটা তাকে স্পর্শ করছিল। গোপনে। আচ্ছন্ন ঘুমের ভেতরে। কেউ জানে না। একটা অচেনা সুর, একটা কণ্ঠস্বরের আড়ালে, পরিচিত হতে চাইছিল। গানটা থামার পরে সে চোখ মেলেছিল।
দেখছিল গাড়ির কাচে জল ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। আগে এভাবে খেয়াল করেছে কিনা মনে করার চেষ্টা করেছিল।
~~~
৪
তখন পৃথিবী নতুন। সেহেতু, স্বপ্নময়, এবং, ছোটমাসি জীবিত ছিল, যদিও সেই তরুণীর নিভৃত একটু একটু করে মরে যাওয়া পৃথিবী কোনোভাবেই টের পায়নি। কত বয়েস তখন তার? স্কুলেও ভর্তি হয়নি সে তখন। মামাবাড়িতে বহু লাগেজের সঙ্গে একটা ম্যাটাডোর থেকে নামানো হচ্ছে একটা ছোট লাল ট্রাইসাইকেল, তার উপযুক্ত। শিলংয়ে চাকুরীরত, মিলিটারির ট্রেনিং নেওয়া, অ্যাব্বা আর বিটলসপ্রেমী, ছোটমাসির কেনা। শান বাঁধানো লাল সিমেন্টের মেঝেতে সে ছোট সিটে বসে প্যাডেলিং করে যাচ্ছে। তারও পরে বাড়ির সামনে রাস্তায় গড়গড়িয়ে প্যাডেল করতে করতে সে ঘনঘন বাড়ির দিকে তাকাত, তার মা বারান্দা থেকে তার এই হুশহুশ বেরিয়ে যাওয়া দেখছে কিনা সেটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত।
সেই সময়েই সে একদিন, যখন রাস্তায় সাইকেল চালানোয় মগ্ন, সোজা একটা সাইকেল দ্রুতগতিতে এসে তাকে ধাক্কা দেয়। তার কপাল ও চোখের তলায় নিচের অংশ ফেটে গেছিল। বাঁ চোখের নিচের অংশে সেই জন্মদাগ, যা সে বহন করে আজও।
স্কার আন্ডার লেফট আই, প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে জয়েন করার চোদ্দ পাতার ফর্ম ফিলাপের সময় সে লিখেছিল। আইডেন্টিফিকেশন মার্কের কলমে।
কিন্তু, সেই সাইকেলটা আস্তে আস্তে ভাঙতে লাগলো, প্রথমে সিট, আর বেল। পরে প্যাডেল ভেঙে গেল। একসময় চাকা খুলে গেলো। যখন সে ক্লাস ফোরে তখন সাইকেলটার কঙ্কাল তার বিবর্ণ টায়ার সহ এককোণে স্তূপের মধ্যে ভেঙেচুরে পড়ে থাকত। পরে কে যেন ওটা পুরনো টিন ভাঙা লোহা ভাঙার ফেরিওলার কাছে কেজিদরে বিক্রি করে দেয়।
ছোটমাসি তারও বছর দুয়েক আগে আত্মহত্যা করেছিল। তার তখন সাত। ছোটমাসির উনত্রিশ।
~~~
৫
সুতরাং, জীবন দুরকম― এটা বলেছিল তার এক বন্ধু, পাহাড়ি পথে গাড়ি চলছিল তখন, অন্য বছর। বন্ধুটি, ডাক্তার, বলেছিল―একটা, যাকে বলে কম্প্রোমাইজ সলিউশন। আরেকটা, এসপার―উসপার। দ্বিতীয়টায় রিস্ক বেশি। গেইনও বেশি। প্রথমটার রিটার্ন ভ্যালু কম, কিন্তু তা তোমাকে একটু একটু করে মরে যাওয়ার মত আয়ু দেবে। লাইফ নিজের টার্মে বাঁচা উচিত। তোমার টার্ম তুমি ঠিক করো।
একথা, সে ভেবে দেখেছে, সম্ভাবনাতত্ত্ব, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুটি মাত্র পথ নির্ধারিত করে। একটি মেজর অপারেশন, হয় রোগী বাঁচবে বা মরবে। কিংবা সুপ্রিম কোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়, যার দিকে গোটা দেশ তাকিয়ে থাকে।
সিকিম ট্যুরের পরেই তার অলৌকিক পরিবর্তন দেখা যায়। সে অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ও অ্যান্টি-সাইকোটিক ছেড়ে দেয়। জীবনযাপনে সে প্রবল উৎসাহী হয়ে পড়ে। ফলত, জীবন-আসক্ত তার কাছে অনিবার্য ছিল যেন একটি প্রেম, যদিও তা অপ্রত্যাশিত। নয়না পার্কে সত্যিই এলো, নির্ধারিত। স্বয়ং ও একাকী। ট্যাক্সিতে যে চুম্বন খাওয়া যায়, তৃতীয় ব্যক্তিকে অস্বীকার করে, তার দুঃসাহস সে দেখাতে পেরেছিল।
কিন্তু, সেই সময়ে, সেই টালমাটাল সময়ে, তার দল তাকে অকস্মাৎ সাসপেন্ড করে। অন্য সময় হলে সে অনেক বেশি ভেঙে পড়ত, কিন্তু অন্য সময়ে, সে ভেবে দেখেছে, তাকে দল সাসপেন্ড করতো না। অকারণে বেপরোয়া মানুষ যে কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই ক্ষতিকারক। প্রতিষ্ঠান এসব বরদাস্ত করে না।
ক্রমশঃ একাকিত্ব তাকে আরো একা করে তুলছিল, প্রথমে সে টের পায় নি। একটি দল ছেড়ে সে অন্য বৃত্তে সামিল হয় নি, কিন্তু, টের পাচ্ছিল, বিশেষ ফারাক নেই কিছু। সমস্ত মধ্যবিত্ততা আগেও ছিলো, এখনো আছে। এখন শুধু তার বৃত্ত নেই, হুজুগ নেই।
নয়না, তথাপি, ছিলো। তদবধি। বছর চারেক পরে একদিন নয়না তার শেষ বাক্য― গুড বাই, বলেছিল। বিষাদ ও অবসাদ নয়নাকে ঔজ্জ্বল্য হারাতে দেয় নি।
নয়নার সেদিনকার শাড়ির রঙ ছিলো আশ্চর্য নীল।
~~~
৬
শুভ সন্ধ্যা, একটা সিগারেট দেবেন? ― বছর পনেরোর শ্বেতাঙ্গ ছেলেটা তাকে বাসস্টপে চোখে যথাযথ অনুনয় মিশিয়ে, ফরাসিতে, নিচু গলায় অনুরোধ করলো। একটি সাইকেলে বসা অবস্থায় ছেলেটি নিজের পা-খানি মাটিতে ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সে ছেলেটিকে অগ্রাহ্য করে। প্রত্যাখ্যাত নাবালক ছেলেটা সাইকেল চালিয়ে দৃশ্য থেকে চলে গেল। তার থেকে হাত চারেক দূরে এক যুবা ও যুবতী বিগত কয়েক মিনিট ধরে চুম্বনরত। মেয়েটি বাস স্টপের শেডের নীচে হেলান দিয়ে। ছেলেটি তার দিকে ঝুঁকে রয়েছে। তাদের পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে কোনো আগ্রহ নেই।
আর কেউ কোথাও নেই। একটা বাস আসে। একজন মধ্যবয়সী শ্বেতাঙ্গ প্যাসেঞ্জার নেমে যায়। বাস চলে যায় আবার।
বাইরে রোদ। গরম। কিন্তু, ঘাম হচ্ছে না তেমন।
এখানে আমাকে চেনে না কেউ, এটা স্বস্তিজনক, সে আজ আবার একই কথা ভাবছিল।
একটা অপার্থিব দেশে এসে পড়েছে সে, প্রথমদিন ফ্লাইট থেকে নামার পরেই সে টের পেয়েছিল। একবর্ণ ইংরিজি জানে না, বলে না, বোঝে না কেউ। সে সামান্য এক আধটি ফরাসি-এক্সপ্রেশন জানে মাত্র।
সুতরাং, ফ্লাইট নামার পরে রেলওয়ে স্টেশন খুঁজে পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। অনেক কসরত করে, উদ্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে যে বিল্ডিংয়ে সে পৌঁছে যায় সেখানে রিসেপশনিস্ট এক বছর চল্লিশের মহিলা অনর্গল ফরাসি বলতে শুরু করেন। সে ঘেমে ওঠে। পরে, হস্টেলের রুমের চাবি নিয়ে সে রুমে গেল। খিদে পাচ্ছিল। বিস্কুট বের করলো।
পরে, রুমে দেওয়ালে আটকানো ফোনটা বাজছিল। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ফোনটা থেমে গিয়েছিল। ধরার আগেই। ঘড়ি দেখেছিল সে। লোকাল টাইমে মেলানো। তখন আটটা বাজে। তাহলে, সন্ধে, হয়তো। তবু ঘরে এসে পড়ছে এত রোদ? আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়েছিল। ঘড়ি চলছিল। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল সেই ঘড়িতেও একই সময়। মনে আছে, তার জুলাইয়ের সেই সন্ধ্যায় বিভ্রান্ত লাগছিল।
এখন আগস্ট। জীবন এখন সুস্থির, এই স্বল্প, মনোমতন ভিড়, এই অন্যরকম গ্রীষ্মকাল, অন্য টাইম জোন, আহ, কেউ আমাকে এখন চেনে না। আমিও কাউকে না।
তার বাস এসে দাঁড়ায়। সে উঠে পড়ে।
~~~
৭
শূন্যতা আসলে নিষ্ক্রিয়তার উপলব্ধি। সক্রিয় জীবনযাপনে নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য লাগে। ধরা যাক, যে লোকটা মাউন্ট এভারেস্টে উঠছে, খাড়া বরফের উল্লম্ব দেওয়ালে চেপে গেঁথে নিচ্ছে স্নো বুট, সে জানে এখানে তার অক্সিজেন সীমিত, মেপে পা ফেলতে হয়, বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই মাত্র পঞ্চাশ শতাংশ। এখানে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে একটা তুমুল এভালান্স, এখানে এমনকী তার মৃত্যুর পরে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই এতসব ঝুঁকি তাকে এমন একটা জিগীষা দিয়েছে, যা তাকে পৃথিবীর উচ্চতমে নিয়ে যেতে পারে। হ্যাঁ, তার মৃত্যু আশঙ্কা বেশী, কিন্তু ওই ঝুঁকি আছে বলে তার জীবন সুন্দর। এমনকী, এই আরোহীর মৃত্যুও, আহা, কত দুঃসাহসিক-লিরিক্যাল।
এমনকী, কলোনীর হিংস্র জলদস্যুরাও হয়ত মরতে ভয় পেত না। কিংবা, অরণ্য ও জলাভূমির অধিকার নিয়ে লড়াই করা একাকী একরোখা মানুষ, এদের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য ছিলো, আছে।
কিন্তু, তোমার এই হা হতোস্মি জীবন, এর পরিসর কতটা তা কথা নয়, কথা হলো, তোমার পরিক্রমা ততোটা গন্তব্যমূলক নয়। এমনকি অন্যভাবে দেখলে, চূড়ান্ত গন্তব্যহীনতাও, অর্থাৎ, যে জীবন যাযাবরের, তাও কাম্য।
মামুর বাড়ির সামনে দাঁড়ালে কেমন হয়, মামু, যার বাড়ির দালানে সে ছোটবেলায় খেলত। হঠাৎ মনে পড়লো, মামুর আসল নাম সে ভুলে গেছে, তার সহপাঠী। কিন্তু ওর ডাকনাম ছিল মিগ। কেননা ১৯৭১ সালে ও জন্মায়। মনে পড়ে গেল।
বিকেলে স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটছিল সে, কার্যত গন্তব্যহীন। হঠাৎই এসে পড়েছে সে তার ফেলে আসা সেই শহরে, যেখানে কাটিয়েছে জীবনের প্রাথমিক বাইশটা বছর। পাশের শহরে অফিসের কাজ ছিলো একটা, কী খেয়ালে এসে পড়ল একটা ট্রেন ধরে।
কিন্তু স্টেশন থেকে বাঁদিকে ঘুরেই সে ধাক্কা খায় প্রথম। একটা সটান উঠে যাওয়া ফ্লাইওভার তাকে হকচকিয়ে দেয়। ফ্লাইওভারের সমান্তরাল হাঁটতে হাঁটতেই বুঝতে পারে উল্টোদিকের সিনেমা হলটার চিহ্ন নেই আর। জায়গাটা ফাঁকা। পাশে গজিয়ে উঠেছে বড় বড় শো রুম আর দোকান।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঁদিকে একটু এগিয়ে চমকে যায় সে। মামুদের দালান কোথায়? সেখানে বাড়িটারই অস্তিত্ব নেই। একটা গেট। পাশে ছোট প্যাসেজ। সবকিছুর ওপরে অনেকটা জায়গা নিয়ে একটা আটতলা অপরিচিত বিল্ডিং তাকে ভেংচাচ্ছে যেন।
আরব্য রজনীর জাদুকরের হাতের স্পর্শে যেন পাল্টে গেছে সেই শহরটা। গিজগিজ করছে গাড়ি আর বাইক। একটুও হাঁটার মতন পরিসর নেই। একটা শ্বাসকষ্টের মত অনুভূতি হয় তার।
তুলনামূলক কম ভিড়ভাট্টার একটা গলিপথ ধরে সে। কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে একটা অটো পেয়ে যায় একটা মোড়ে। মিনিট দশেক পরে নামে। এখন আলো ক্ষীণ। নদীর দিকের পথ ধরে সে। ঢালু পথ নেমেছে। কিন্তু, হাঁটতে হাঁটতে ম্লান আলোয় দেখতে পায় সেই লাল ধুলোর রাস্তা নেই আর। রাস্তা পাল্টে খটখটে পিচের এখন।
হাঁটতে হাঁটতে দুদিকে চোখে পড়ে দেদার বাড়ি, আলো জ্বলছে কয়েকটায়। কোনো মাঠ, কোনো বিল আর বাকি পড়ে নেই। চোখে পড়ে কিছু কিছু এলোমেলো কনস্ট্রাকশন। আশ্চর্য, এখানে একদিন বিস্তীর্ণ প্রান্তর ছিল, তাদের খেলার মাঠ।
একটু দূরে একটা ছোট জটলা। সেখানে আলোর তলায় জনা দশেক লোক দাঁড়িয়ে। ক্যারাম খেলা হচ্ছে।
সে নদীর উদ্দেশে হাঁটছিল। ম্লান আলোয় খুঁজছিল লুপ্ত সময়ের সনাক্তকরণ-যোগ্য একটা অবশিষ্ট চিহ্ন।
একবার পড়ে ভুলে যাবার লেখা এ নয়। মসৃণ সুতি কাপড়ের ওপর যেমন অল্প উঠে থাকে নিপুণ সেলাইয়ের ফোঁড়, তেমনি ফ্রেমে বন্দী অল্প উঠে- থাকা ছবিগুলি বার বারই ভেসে আসতে থাকে চোখের ঘাটে, জানান দিয়ে যায় জীবন দুরকমও নয়, বোধহয় অনেকরকম, অগুন্তি!!
খুব সুন্দর লিরিক্যাল কোয়াললিটি আছে আপনার লেখায়।
ভোরবেলার কনসেন্ট্রেশনেে লেখাটা পড়লাম।্আশ্চর্য লিরিক্যাল ভাষা, স্থান কালকে ইচ্ছে করেই গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে এ লেখায়। অর্থাৎ টেকনিক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা। আমার একবার মনে হল শেষটা যেন হঠাৎ করে ! কিন্তুএটা তো ছোট গল্পের চারিত্র্যলক্ষণ! যে কোনও সেনসিটিভ মনেরই মনে হবে লেখাটি কোথাও তাকে ছুঁয়ে আছে। এটা নিঃসন্দেহে লেখার গুণমান। কোথাও কোথাও হঠাৎ করে পূর্বসুরীদেরকথা মনে পড়লেও শেষাবধি লেখাটি টাটকা বেদনাসম্ভূত। আরও অনেকবার এ লেখার সঙ্গে আমার দেখা হবে, তখন আরও কিছু কথা জমবে এমনই বুনন এ গল্পে।
"শূন্যতা আসলে নিষ্ক্রিয়তার উপলব্ধি। " প্রায় দৈববাণীর মতো এই জীবনের গল্প জুড়ে থাকে বিষন্নতা, শুন্যতা, ভাংগা ট্রাই সাইকেল মার্ক। বিজনের অসুখের মতো যেন এর বিস্তৃতি।
আরও লিখুন
দারুন। কেমন যেন বিব্রতকর
কি যে বলি? অদ্ভুত সুন্দর।