১৯৯৫-সনের এক সন্ধে। বীতশোক বসে আছেন মেদিনীপুরের বাসন্তীতলার তাঁর একতলার ঘরে। সঙ্গে রয়েছে এই নিবন্ধকার ও কিছু ছাত্র। সেই মুহূর্তে সকলে মগ্ন একটি বইয়ের খোলা পাতায় পিকাসোর আঁকা একটি ছবি দেখতে, বীতশোক তার একটু আগেই সম্ভবত বলেছেন পাবলো নেরুদার কথা, লোরকাকে নিয়ে লেখা কবিতার প্রসঙ্গ: Because for you they paint the hospitals blue...
এখন আর সেই সন্ধের আড্ডার ঘটনাপরম্পরা সেভাবে মনে নেই। সম্ভবত, বিষয় ছিলো পিকাসোর এককালীন নীল-আসক্তি। সেই সময়ে, মনে পড়ছে, একটি ছবি দেখে এক তরুণের উচ্ছসিত মন্তব্য: ‘স্যার, অপূর্ব!’ মুহূর্তের মধ্যে বীতশোকের মৃদু ঝিকোনো হাসি, বললেন: ‘ঠিকই বলেছো‘, বলে, একটু থামলেন, তারপর তাঁর দ্বিবিধ উত্তর: ‘কথাটা দু-ভাবে ঠিক-- অপূর্ব, কারণ এর পূর্বে এই ছবি হয় নি। আর, অ-পূর্ব, কারণ, ছবিটি পশ্চিম থেকে এসেছে’।
এই দ্রুত, অব্যর্থ, শব্দ ভেঙে আমাদের অনায়াসে, চকিতে মুগ্ধ করেছেন তিনি, বারবার, হোক না তা একান্ত আলাপচারিতায়, বা রচিত কবিতায় ও গদ্যে। নিখুঁত ছিলো তাঁর সময়জ্ঞান, পরিমিত ছিলো তাঁর প্রকাশভঙ্গি। তাঁর পরিমিতিবোধ নিয়ে হয়তো এইজন্য কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর কবিতার বই রিভিউ করতে কোথাও লিখবেন: ‘সুমিতি, বীতশোকের কবিতার এক লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য‘। হয়তো তাঁর ‘নতুন কবিতা’ বইয়ের প্রচ্ছদে এই সাক্ষ্যই দেবে এল. তারাশভের ফিজিক্সের বই ‘This amazingly symmetrical world’ থেকে নেওয়া রেখা-নক্সা।
আটের দশকের এক ও অবিভক্ত জেলাশহর মেদিনীপুর, গলিশহর মেদিনীপুর, তখন অনেকেই নিয়ত প্রত্যক্ষ করতো এক অসম্ভব ছোটখাটো মানুষ হনহন করে শহর পরিক্রমা করেন, খুব দ্রুত গলি পেরিয়ে ধরেন বড় রাস্তা, এবং সবাই দেখতো হাঁটার সময় তাঁর উদাসীন দৃষ্টি আকাশের দিকে নিবদ্ধ। এত দ্রুত হাঁটতেন যে পরিচিত কেউ ডাকলেও তিনি টের পেতেন কিনা সন্দেহ!
আটের দশকের সেই তিরিশোর্ধ্ব তরুণ নিজের মুদ্রাদোষে কিছুটা আলাদা ছিলেন নিশ্চয়ই। কিন্তু, তিনি বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় দাপিয়েছেন নানান পত্রপত্রিকায়, গোটা সাতের দশক। তার খবর কতটা রাখতো সেই জেলাশহর? তবু, কেউ কেউ কিভাবে যেন জেনে গিয়েছিলো যে এই তরুণ বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি মূল্যবান কাজ করে ফেলেছেন। ‘হাজার বছরের বাংলা কবিতার’ সম্পাদনা, এই দুঃসাহসিক কাজের একটি। চর্যাপদ থেকে বিস্তৃত, সেই সঙ্কলনের শেষ কবি সম্ভবত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। প্রতিটি কবিতার নীচে বীতশোকের নিজস্ব সংক্ষিপ্ত সুচিন্তিত টীকা। এই বইটির সম্পর্কে নীহাররঞ্জন রায়ের মন্তব্য ছিল এই ধরনের: ‘সর্বত্র সংকলকের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হওয়া গেল না, কিন্তু একটি সন্ধে চমৎকার অতিবাহিত হলো।‘ বইটি অধুনালুপ্ত।
‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অভিধান’ আর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ এই কলমপিষিয়ের। ১৯৮৫-তে বিস্তর গবেষণা করে লিখে ফেললেন আর এক আকরগ্রন্থ, ফলিত বৌদ্ধ দর্শনের ওপর-‘জেন গল্প’। এই নিবন্ধকারের তখনো কৈশোর। সম্ভবত ১৯৮৬-র শরতে তিনি স্বরচিত সেই বই সেই অর্বাচীন কিশোরকে উপহার দেবেন, তারপর বইয়ের পাতা খুলে তাঁর স্বকীয়, জ্যামিতিক গোটা গোটা অক্ষরে লিখবেন, ‘কৌশিককে সস্নেহ শুভেচ্ছায়’, নিচে- ‘বীতশোক ভট্টাচার্য’ ও তারিখ। ১৪-বছরের রোমাঞ্চিত কিশোরের সেই উপলব্ধি আজও মনে পড়ে।
সেই বই কিছু বুঝে, কিছু না বুঝে পড়ে ফেলেছিলাম। সে বইতে একটা জায়গা ছিলো, সেটা এরকম: জেন মঠে নিরন্তর ধাঁধাঁ দেওয়া হয়, যেগুলো মৌলিক কিছু প্রশ্নের ওপর, কিন্তু দেওয়া হয় খেলাচ্ছলে। যেমন, প্রশ্ন করা হলো- ‘এক হাতের তালি কিরকম?’ প্রশ্নের ভেতরে তার নিহিত দর্শন থাকে, মঠের বিরামহীন শ্রমের মাঝে খেলাচ্ছলে করা হয় এইসব প্রশ্ন, আর এই হেঁয়ালীর মধ্যে খুঁজতে হয় তার উত্তর। খুঁজতে খুঁজতে একদিন হয়তো উত্তর পাওয়া যায়- তখনকার সেই চূড়ান্ত উপলব্ধিকে বলে ‘সটোরী’। আর, এই ধাঁধাঁর নাম, জেন পরিভাষায়, ‘কোয়ান’।
(২)
সামাজিকতা এড়িয়ে যেতেন বীতশোক, সযত্নে। হুজুগে অনুষ্ঠান একদম না-পসন্দ। কবিতা নিয়মিত লিখতেন, কিন্তু কোনো তথাকথিত কবিতা-উৎসবে তাঁকে দেখা যেত না। আমার ধারণা, তিনি অহংকারী ছিলেন না, তবে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। দেখার মতো ছিলো তাঁর কনভিকশন। রোজ লিখতেন। পড়তেন যতো, ভাবতেন তার অনেক বেশী। ভালোবাসতেন ভাবিয়ে তুলতে। না, কোনো সংঘ, কোনো গোষ্ঠীতে তিনি যোগ দেননি কখনো। তিনি নিজে পিএইচডি করেন নি, তবে ‘উত্তরাধুনিকতা ও বাংলা কবিতায় তিন বাঙ্গালী কবির অবদান’-কারুর পিএইচডির বিষয় ছিলো, এ-কথা শুনেছিলাম এবং প্রসঙ্গত, এই তিন বাঙ্গালী কবির এক কবির নাম ‘বীতশোক ভট্টাচার্য’, এ-ও শুনেছিলাম ।
বীতশোক ছিলেন যৌথ পরিবারের সদস্য। শৈশবে মাকে হারানোর পর কাকিমার কাছে মানুষ। বাবা ছিলেন, ছিলেন অনেক কাকা। তিনি সবার বড়ো বলে পরিবারের ছোটরা তাঁকে ডাকতো দাদামণি বলে। বীতশোকের এক কাকা ছিলেন অবিবাহিত, যিনি সেজোকাকা। সেই সেজকাকার তাঁর গড়ে ওঠার ওপরে প্রভাব ছিলো, তাঁর কাছেই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় শোনা। পরিবারের দাদামণি, আমাদের বীতশোক, অধ্যাপনার সূত্রে ছিলেন কারুর কারুর ‘স্যার’। তিনি প্রথাগত সামাজিকতায় আগ্রহী না হলেও গমগম করতো তাঁর বাসন্তীতলার একতলার ঘর। চুম্বকের মতো ছিলো সেই ঘরের আকর্ষণ। এখানে আসতেন মেদিনীপুরের অধ্যাপককূল, কবি, লেখক, লিটল ম্যাগের সম্পাদক, আর অসংখ্য তরুণ ছাত্র। কলকাতা থেকে বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা মেদিনীপুরে এলে কেউ কেউ বীতশোকের সঙ্গে দেখা করে যেতেন। তাঁর ঘরে ছিলো এক সমৃদ্ধ লাইব্রেরী, যা দেখে বিস্মিত হন ভূমেন্দ্র গুহ। সেই বাসন্তীতলার ঘরে বসে জমে উঠত আড্ডা, নিয়মিত ভিড় জমাতো আগ্রহী ছাত্রের দল। তিনি আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন ছাত্রদরদী। বীতশোকের একটা স্বভাব ছিল--যখন অন্যের কথা শোনেন, মন দিয়ে শোনেন। পুরোটা শোনার পর, ধীরে ধীরে বলেন, অনুচ্চ থাকে তাঁর স্বরগ্রাম। দরকারি কথার রেফারেন্স দেন আত্মবিশ্বাসী এই অধ্যাপক। অনেক সময় ভালোভাবে বোঝানোর জন্য তাঁর নিজস্ব লাইব্রেরী থেকে বই পেড়ে আনেন, তাঁর এই বই আনার ভঙ্গিমা হতো লক্ষ্যণীয় রকমের দ্রুত। যখন তাঁর কথা শেষ হয়, মুখোমুখি বসিবার সেই-বীতশোকের প্রতি মুগ্ধতা বেশি থাকে, না কি যে-বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিলো, সেই বিষয়-টা যে আলোর মত স্পষ্ট হয়ে ঊঠলো, তার মুগ্ধতা বেশি, সেই নিয়ে সংশয় আজো রয়ে গেছে আমাদের। এইসব মুহূর্তে আমরা দেখতাম নরম এক আলো তাঁর চোখেমুখে, তাঁর কণ্ঠে শুনতে পেতাম যুক্তিশীল সহৃদয়তার সুর, তাঁর কাছে এসে তাই একবার নয়, ফিরে ফিরে যেতে হতো বারবার। তিনি মাথার ভেতরে জাগিয়ে তুলতেন গহন ও কূট তর্ক, ইঙ্গিত দিতেন সমূহ বিরোধাভাসের, আলো আঁধারের বিভাজিত পৃথিবীর চেয়ে ধূসর প্রচ্ছায়ার জটিল এলাকাগুলি ক্রমে আমাদের প্রিয় হয়ে উঠছিলো সেই সব দিনে।
সমস্ত লৌকিকতা থেকে দূরত্ব রচনা করে বীতশোক একা মগ্ন থাকতেন তাঁর নির্জন বাসন্তীতলার সৃজন-ঘরে, নিজের সঙ্গে শব্দ আর ভাবনা নিয়ে অবিরাম কাটাকুটির খেলাই যেন প্রিয় ছিলো তাঁর। মায়াকোভস্কি রুশ ভাষায় লিখেছিলেন ‘কিভাবে কবিতা লেখা হয়’, আর বীতশোক বাংলায় নয়ের দশকের শেষে করছেন নতুন কাজ, লিখছেন: ’কবিতার অ আ ক খ’। বীতশোক কবিতায় ডুবছেন, কবিতায় ভাসছেন, লিখছেন নিবন্ধ: ‘কবিতার ভাষা, কবিতায় ভাসা’। কবিতা না গদ্য কিসে তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল তা বলা মুশকিল। অনুযোগ করতেন, কেউ আমার কাছে কবিতা ততোটা চায় না, প্রবন্ধই চায়। তাঁর মৃত্যুর পরে সংবাদপত্রে সংক্ষিপ্ত কড়চায় লেখা হয়েছিল: ‘প্রবন্ধসত্ত্বা কবিসত্ত্বাকে গিলে ফেলছে, এমন অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে ছিল।‘ এই তর্ক স্থগিত রেখে তাঁর অতুলনীয় গদ্যভঙ্গির একটা নমুনা রাখছি একটি নিবন্ধ থেকে:
“জেনবাদী জানেন : টোকা নয়, ধাক্কা দিলেই আচমকা দরজা খোলে। তোরণ-নেই এমন এক তোরণ সহসা উন্মুক্ত হয়ে যায়। তিনি জেনবাদকে বুদ্ধহৃদয় বলেন, তাঁর প্রিয়তম পুঁথি লঙ্কাবতারসূত্র। হয়তো ধ্যানঘরে বসে শীতের রাতে জেনসাধনা করছেন, জ্বালানি নেই, আগুন নিভে আসছে, হি হি হাওয়ায় মনোযোগ ভেঙ্গে যাচ্ছে। জেনসাধক কুলুঙ্গি থেকে কাঠের বুদ্ধমূর্তিটি আগুনে ছুঁড়ে দিলেন, খানিকটা ঝিকিয়ে উঠে আগুন আবার মরে এলো। আর হাওয়া ছুটে এলো হূ হূ করে। জেন সাধক লঙ্কাবতারসূত্রটি ছুঁড়ে দিলেন, ঝলসে উঠে আগুন তখনই খেয়ে ফেলল পাতা পুঁথির পাটা, তারপরই নিবে আসতে থাকলো। এবার উঠলেন জেন সাধক, ধ্যানঘরের দেওয়াল থেকে দুচারটে তক্তা তূলে এনে আগুনে নামিয়ে ঠেলে দিলেন, ফের সমাহিত হলেন—নিস্পন্দ, নিশ্চিন্ত। এবার প্রবাহিত হও উত্তরের হাওয়া, যদি ইচ্ছা হয়।“
বাংলা সাহিত্যের মেইনস্ট্রিম বীতশোককে ব্রাত্য করেই রেখেছিল। খুব একটা মূল্যায়ন করেনি সমকাল। যদিও, সাতের দশকের অন্যতম কবি হিসেবেই উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। স্নেহ পেয়েছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, বীতশোক--এই ছদ্মনাম তাঁকে রাখতে বলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তাঁর আসল নাম অশোক ভট্টাচার্য। কেউ কেউ তাঁকে বলতো ‘মেদিনীপুরের কবি’, কেউ বলতেন দুর্বোধ্য, কেউ কেউ স্থির করতে পারেন নি যে তিনি আসলে কবি নাকি প্রাবন্ধিক। তবে তাঁর কোনো কঠোরতম সমালোচকের মন্তব্য তাঁর-বিষয়ে আকর্ষণীয়: ‘যে বিষয়টা ও দেখে, তার তলদেশ অবধি দেখতে পায়।‘
আমরাও কখনো বুঝে উঠতে পারিনি তাঁর স্থানাঙ্ক। ১৯৮৬-ই হবে, দেখছি ঘরে একা তন্নিষ্ঠ ও মনোযোগী বীতশোক, একটি বড় চার্ট পেপারে পরম যত্নে এঁকে রাখছেন সমস্ত নক্ষত্রের নিখুঁত অবস্থান। অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিলো। মনে আছে একদিন গল্পচ্ছলে, আমার তখন ক্লাস নাইন, বলছেন, ‘মনে করো তুমি এখান থেকে বসে অনেক আলোকবর্ষ দূরের একটি তারা দেখছো, হয়তো এখন মরে গিয়েছে সেই তারা, কিন্তু এখনো আসছে তার আলো, তাই তাকে দেখতে পাচ্ছো তুমি।’ রাতের আকাশ এখনো মনে করায় তাঁর সেই মৃদু কণ্ঠস্বর। এই সময়েই তিনি শ্বেত বামন আর নিউট্রিনো স্টারের গল্প বলছেন, বলছেন ব্ল্যাক হোল এর কথা।
বিশ্বসাহিত্য, লোকায়ত-বিদ্যা, ভাষাশৈলী, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান-সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিলো তাঁর। নানা গদ্যে ও কবিতায় পাঠক এসবের পরিচয় পাবেন। তিনি মুক্ত জ্ঞানচর্চায় বিশ্বাসী ছিলেন, ডগমা তাঁর অপছন্দ ছিলো। বিশেষ (Special) একটি ধারণা থেকে যে কোনো আলোচনাকে তিনি সাধারণ (General) স্তরে সফল ভাবে উত্তীর্ণ করে দিতে পারতেন, সে হোক ক্লাশরুমের বা সেমিনারের বক্তৃতা, বা জটিল কোনো বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা। আগ্রহ নিয়ে পড়তেন কলেজ-ছাত্রদের লেখা গল্প, কবিতা। মতামত দিতেন সহৃদয়তার সঙ্গে, সমালোচক হিসেবে ছিলেন খুঁতখুঁতে। তাঁর সুবাদেই পড়া হয়ে গিয়েছিল একদিন জীবনানন্দের উপন্যাস, মিলান কুন্দেরার লেখা লাফেবল লাভস, অমিয়ভূষণ মজুমদার ও সুবিমল মিশ্র। সৃষ্টিশীলতায় যে কোনো চ্যালেঞ্জ নিতে পারতেন তিনি। তাই আশ্চর্য হইনি যখন দেখবো নয়ের দশকে বীতশোক লিখবেন চিত্রনাট্য, বিভূতিভূষণের জীবন নিয়ে। তথ্যচিত্রের নাম ‘অভিযাত্রিক’, পরিচালক--ঈশ্বর চক্রবর্তী। প্রসঙ্গত, এই তথ্যচিত্র বিভূতিভুষণের জীবনের এক প্রামাণ্য দলিল। একবার গিয়ে দেখি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মেতে উঠেছেন, স্থাননাম নিয়ে কাজ করছেন, অবিরাম ঘুরে বেড়াচ্ছেন এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রাম। তাই বীতশোকের পুরনো কোনো কবিতার প্রথম লাইনই এইভাবে শুরু হয়, আমরা মেলাতে পারি তাঁর কবিতা ও জীবন:
‘তুই কি বিষাদমূর্তি, তুই কি গ্রামের নাম, পাথরপ্রতিমা?’
(৩)
বীতশোকের প্রথম দিকের কবিতা বাংলা কবিতাকে এক অন্য স্বর শুনিয়েছিলো, তাঁর কণ্ঠস্বরে ছিলো নাগরিক সপ্রতিভতা, কিন্তু এইসব কবিতার মধ্যে আলগোছে লুকোনো থাকতো লোকজীবনের টুকরো ইঙ্গিত। ৭৩ বা ৭৪ সালের পুরনো ‘গল্পকবিতা’র (কৃষ্ণগোপাল মল্লিক সম্পাদিত) কোনো সংখ্যায় আমার মামাবাড়ির পুরনো বইয়ের ঘরে খুঁজে পেয়েছিলাম এই কবিতাটি, কবিতার নাম ‘শীতকাল’। কবিতাটি বীতশোকের ‘কবিতা সংগ্রহে’ও আছে।
চেয়ে দ্যাখো, সেরকম-ই রেখেছি স্বভাব;
সহজ কবচে কত যত্ন করি, বেতার যন্ত্রের কাছে কান পেতে থাকি
কারা এত শব্দ করে, মনে প’ড়ে যায়
কত ডেকে কাকে যেন লিখিয়েছি তোমার চিঠিটি;
যাকে দিয়ে পাঠিয়েছি, সে ন্যুব্জ ও পথচারী,
ঘোড়া দেখে খোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে কারশেডতলে;
তা বলে কি শীতকালে বৃষ্টি হতে নেই,
শব্দ হতে বাকি আছে তোমার চালা-য়?
সানশেডে ঝ’রে যায় বৃষ্টি কত, তোমার প্রস্তুত
বাথরুম থেকে দূরে উড়ে যায় জলাধার, এমন গরম
জলের ভাপ ও বাষ্পে ক্রমাগত ভ’রে যাবে চোখ!
এই রোদ এই বৃষ্টি- প্রকৃতি মানুষ হতে চায়!
রক্ত ও রৌপ্যের মধ্যে ট্রেন যায় কোলাঘাট ব্রিজের ওপরে;
উত্তরেই যায় চিঠি, শব্দহীন উত্তরেই যায়।
রোদ ভালো লাগে বলে স’রে বসি ছায়াতে ছায়াতে শীতকালে।
বেতার যন্ত্রের কাছে কান পেতে আছেন, আর ‘সহজ কবচে’ যত্নে এ-কবিতা লিখছেন বছর চব্বিশের তরুণ বীতশোক। এই কবিতা লেখা হচ্ছে সেই সময়ে, যখন টেলিভিশন ঘরে ঘরে যায়নি, ফলে রেডিও বা ‘বেতার-যন্ত্র’ ছিলো সংবাদ আর বিনোদনের এক অন্যতম উপায়। এই সময়ে মানুষ ‘আকাশবাণী কলকাতা’ য় ‘স্থানীয় সংবাদ’ শুনতেন। ‘বিবিধ ভারতী’ বিভাগে তখন রিনরিনে শ্রাবন্তী মজুমদার আর মেঘমন্দ্র কাজী সব্যসাচী মাতিয়ে রাখতেন গ্রাম থেকে শহর। এই ফেলে আসা সময়ে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিলো চিঠি। বীতশোকের ‘কত ডেকে কাকে যেন লিখিয়েছি তোমার চিঠিটি’-এই লাইন-টি মনে করায় আমাদের নিরক্ষর লোকজীবনের অঙ্গীভূত প্রথা, যেখানে গ্রামে ও শহরে লোক ডেকে চিঠি লেখানো হয়, এবং, পত্রলেখকের মতো পত্রবাহকের গুরুত্ব-ও কম নয়। ফলে পত্রবাহকের সেই ভূমিকা ফুটে উঠছে এই লাইনে: ‘যাকে দিয়ে পাঠিয়েছি, সে ন্যুব্জ ও পথচারী’। পাঠক, পরের লাইন পড়ুন: ‘ঘোড়া দেখে খোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে কারশেডতলে’। ‘ঘোড়া দেখলেই খোঁড়া’- এই চালু লোকপ্রবাদ লিখছেন দক্ষ কবি, কিন্তু, ঘোড়া এখানে ট্রেন, তাই সেই ন্যুব্জ পথচারী দাঁড়িয়েছে ‘কারশেডতলে’। কবির নাম বীতশোক, দক্ষতার নাম বীতশোক।
কবি তার পরের লাইনে বলছেন শীতকালে-ও বৃষ্টি হতে পারে (‘তা বলে কি শীতকালে বৃষ্টি হতে নেই?’), কিন্তু তার অব্যবহিত পরের লাইনে লিখে দিলেন : ‘শব্দ হতে বাকি আছে তোমার চালা-য়?’ নিবিষ্ট পাঠক লক্ষ্য করবেন ‘চালা’ এই আটপৌরে শব্দ-টির তুখোড় ব্যবহার। আসলে ‘কারশেড’ এর ‘শেড’ এখন গ্রামীণ চালা-র অবয়ব নিলো। পরের লাইনে আবার ‘সানশেডে ঝরে যায় বৃষ্টি কতো...’, ‘কারশেড’ থেকে হলো গ্রামীণ ‘চালা’, কিন্তু সে আবার নাগরিক ‘সানশেড’ হয়ে দেখা দিচ্ছে তার পরের লাইনে। এই সানশেড আসলে রেইন শেড-ও বটে, তাই ‘সানশেডে ঝরে যায় বৃষ্টি কতো,’। বীতশোকের এই কবিতায় একই সঙ্গে খেলা করছে প্রাকৃতিক রোদ, ছায়া(শেড), বৃষ্টি। ‘তোমার প্রস্তুত/ বাথরুম থেকে দূরে উড়ে যায় জলাধার, এমন গরম/ জলের ভাপ ও বাষ্পে ক্রমাগত ভ’রে যাবে চোখ!’- এই লাইনগুলি একদিকে ধরিয়ে দিচ্ছে উষ্ণতাপ্রিয় মানুষের শীতকালীন স্নানের প্রস্তুতি, আবার ভাপ, গরম আর বাষ্পীভবনে জলাধারের উড়ে যাওয়া- বৃষ্টি তৈরির গোপন নিয়ম-টিকে চিহ্নিত করলো না কি? ‘এই রোদ এই বৃষ্টি- প্রকৃতি মানুষ হতে চায়’!-এই লাইন ইঙ্গিত দিচ্ছে এই শীতকালীন বিরল কবিতার বৃষ্টি আর রোদের বিরল ও রহস্যময় সহাবস্থান, প্রকৃতি যেন মানুষের মতোই বেখেয়ালী, তাই সেই-প্রকৃতি, ‘মানুষ হতে চায়’। পরের লাইনে সশব্দে কোলাঘাট ব্রীজ পার করছে বীতশোকের ট্রেন, স্মরণে রাখুন কিছু আগে এই ট্রেন দাঁড়িয়েছিলো ‘কারশেডতলে’।
শব্দময় এ-কবিতা, বিভিন্ন অনুষঙ্গে শব্দ কিভাবে ফিরে ফিরে আসছে দৃশ্যপট ধরে, লক্ষ্য করুন:
(১) বেতার যন্ত্রের কাছে কান পেতে থাকি
(২) কারা এত শব্দ করে, মনে পড়ে যায়
(৩) শব্দ হতে বাকি আছে তোমার চালা-য়?
(৪) সানশেডে ঝরে যায় বৃষ্টি কতো
(৫) রক্ত ও রৌপ্যের মধ্যে ট্রেন যায়, কোলাঘাট ব্রিজের ওপরে
এ-কবিতার প্রথম লাইনে বীতশোক লিখছেন: ‘চেয়ে দ্যাখো, সেরকম-ই রেখেছি স্বভাব’, কাকে লিখছেন বোঝানোর দায় কবির নেই, তবে ‘চেয়ে দ্যাখো’-এই উচ্চারণ ভীষণ ব্যক্তিগত বলেই মনে হয়। তিনি যত্নবান, তাই লিখলেন: ‘সহজ কবচে কত যত্ন করি’, যত্ন করে চিঠি লেখালেন কাকে যেন ডেকে, আর কাকে দিয়ে যেন পাঠালেন। সেই চিঠির প্রসঙ্গ আবার ফিরিয়ে আনছে কবিতার শেষ লাইনের অব্যবহিত আগের লাইন, যেখানে আমরা দেখবো বীতশোক-হেঁয়ালী: ‘উত্তরেই যায় চিঠি, শব্দহীন উত্তরেই যায়’। কোন উত্তরে যায় চিঠি? আগের লাইনে সূত্র রেখে দিয়েছেন কবি: ‘রক্ত ও রৌপ্যের মধ্যে ট্রেন যায় কোলাঘাট ব্রিজের ওপরে’। কোলাঘাট ব্রিজ হয়ে ট্রেন ছুটছে সাউথ ইস্টার্ন রেলপথ ধরে, দক্ষিণ থেকে উত্তরে ছুটছে সেই ট্রেন, তাই উত্তরে ছুটছে চিঠি ও পত্রবাহক। ‘শব্দহীন উত্তরে যায়’- এর অর্থ যে কোনো চিঠি লেখাই হয়নি হয়তো। প্রশ্ন করা হয় নি কোনো, তবু তার উত্তর দিচ্ছে এ কবিতায়- লেখা -চিঠি, এমনটাও হতে পারে। ‘চেয়ে দ্যাখো, সেরকম-ই রেখেছি স্বভাব’-এ যেন কোনো ব্যক্তিগত চিঠির অভিমানী প্রথম লাইন।
লক্ষ্যণীয় এই যে এই কবিতায় কিভাবে যান্ত্রিক সভ্যতা ফুটিয়ে তুলছেন বীতশোক। ‘বেতার যন্ত্র’ এই সময়ের মূল গণমাধ্যম ছিলো, ডাকবিভাগ ছিলো ব্যক্তিগত ও পেশাদারী যোগাযোগের মূল উপায়, ‘চিঠি’ এই কবিতায় ফিরে ফিরে আসছে, ব্রিজ আর ট্রেন পরিবহণে সমান গুরুত্বপূর্ণ আজো।এই কবিতায় এই সব মাধ্যম দিয়ে পাঠকের সঙ্গে কমিউনিকেট করছেন বীতশোক, আর মেলবন্ধন ঘটাচ্ছেন নগরজীবনের সঙ্গে লোকজীবনের।
বিশেষ থেকে সাধারণ সূত্র লেখায় পারদর্শী ছিলেন বীতশোক, কিভাবে- এই কবিতা তারও সাক্ষ্য দেয়। এই কবিতায় কারশেড, সানশেড-এই নাগরিক শব্দদ্বয়, আর চালা –এই লোকশব্দ বিশেষ অনুষঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই যেন লুকিয়ে রোদ ঢাকছে ছায়া। পাঠক, লক্ষ্য করুন কবিতার শেষ লাইন:
‘রোদ ভালো লাগে বলে স’রে বসি ছায়াতে ছায়াতে শীতকালে।‘
সেহেতু, কবিতা-র শেষ পংক্তি প্রবাদ তৈরি করে ফেলে। একবার সমস্ত কবিতার থেকে সমস্ত লাইন ছেঁটে যদি প্রথম ও শেষ লাইন দুটি শুধু রেখে পড়া হয়, তাহলে দেখবো, বেশ মিলেমিশে রয়েছে একটি ব্যক্তিগত, আপাত-অভিমানী পংক্তি, এবং আরেকটি বিস্ময়কর রকমের নিরভিমানী ও নৈর্ব্যক্তিক পংক্তি :
চেয়ে দ্যাখো, সেরকম-ই রেখেছি স্বভাব
রোদ ভালোবাসি বলে ছায়াতে সরে সরে বসি, শীতকালে।
বস্তুত, শেষ পংক্তিটিতে এসে মূর্ত হচ্ছে যেন মানুষের শীতকালীন আকাঙ্ক্ষা।
বীতশোক পাঠের অভিজ্ঞতা, আমার কাছে বরাবর-ই নতুন বিস্ময় এনে দিয়েছে। পরতে পরতে তার রহস্য আর হেঁয়ালী; মোক্ষম লোকশব্দ, আর লোকবাক্যে তাঁর কবিতা প্রথম থেকেই নিজস্ব, ভেতরে তার নিহিত দর্শন থাকলেও, তা জ্ঞানভারে নুয়ে পড়েনি। তিনি নিজের মত করে ছেনে আনতেন জুতসই লোকপ্রবাদ, আর তাঁর কবিতার ভেতরে থাকতো বিশেষ থেকে সাধারণে যাওয়ার এক অনায়াস কাব্যময়তা। বিশ্লেষণে যাবো না, তবু সেই সাতের দশকের কয়েকটি কবিতার পংক্তি-তে হয়তো পাঠক খুঁজে পাবেন কিছু অপরূপ নুড়িপাথর, স্বকীয়তায় যা উজ্জ্বল:
১) বাংলার পাঁচের দিকে ভেসে যায় এক মুখ বিষাদে গম্ভীর;
অন্ধকারে হাত দিলে স্থিরভাবে বোঝা যায় তার জিওগ্রাফি
আজকাল পালটে গেছে: প্রহৃত মানুষ মাত্র, নিচু হবে, পাপী
খুব ভালোবাসবে তারা, শরীরকে ভালোবাসে গাধারা যেমন:
এইসব ভেবে ভেবে তাকে ভেসে যেতে হবে যেখানে নদীর
শাদা স্রোতে ঈশ্বরের শাদা দাড়ি বয়ে যায়, দশ আঙুলে তাঁর
সমান হলো না সৃষ্টি, পথ নেমে গেল পথে, জিভের সাঁতার
বন্য পিপাসাতে ছোঁয় যেরকম, তারও কম তৃষ্ণা নিয়ে চাঁদের মতন
সন্তের সিঁড়ির দিকে চলে যেতে হলো তাকে; ......
(বাংলার পাঁচের দিকে/ কবিতা সংগ্রহ-পৃষ্ঠা ২৫৬)
২)বা যেন কথার কথা, থ বর্ণটি অনায়াসে ভেসে চলে যায়;
হাঁসের গলার মতো তার মুখ, অথবা হ-এর গলা হাঁসেরই
মেয়েলি গলা হয়;
এভাবে কী যেতে হয় সমুদয় বর্ণমালা, সমস্ত আকাশে শাদা ঝরে;
এতসব বিজ্ঞাপন, ঘোরতম স্থানে আলো, কলকাতা নগরে
তবু কোনো ঠাঁই নেই এই কী কথার কথা, আমাদের ভালোবাসাচয়
ভাই ও ভগ্নীর মতো তা হলে কেমন করে রাজা আর পিতা আর
ঈশ্বরের হাতের উপরে
জেগে আছে:
(বা যেন কথার কথা/ কবিতা সংগ্রহ-পৃষ্ঠা ২৫৫)
৩)সংগীত কেবল ছিলো কল্পনায়, আমি শুধু চর্মচোখে প্রস্বর শুনেছি
ঘাম ও পাতার রাজ্যে, ধূসর ফলের বিন্দু পরিপূর্ণ অশ্রুময়তায়
চোখের পাতার থেকে রক্তের ভিতরে গেলে, শব্দ শব্দে অব্যক্ত বেদনা
প্রস্ফুট রোদের রাজ্যে; দ্বিপ্রহরে লম্বমান ছায়া ভাঁজে ভাঁজে
কেন ভ্রমণের শাড়ি, দূর থেকে উড়ে আসা অভ্রান্ত গমক:
দীর্ঘস্থায়ী এর নাম? আমি কিছু না বুঝেও বেদনা বুঝেছি;
সুন্দর হাতের লেখা চেয়ে চেয়ে আঁকাবাঁকা হয়েছি আবেগে;
(সংগীত কেবল ছিলো/ কবিতা সংগ্রহ-পৃষ্ঠা ২৫০)
৪) বাংলো ধরনে বাড়ি, ছাঁচতলায় দাঁড়িয়ে
আরও কতক্ষণ আধঘোমটা, ছায়া? সংগোপন
ভেঙে যায় বৃত্তচাপে, তোমার তলপেটের মতো চাঁদ,
সবুজ বসন ঘুরে যায় ঝিল্লিময়-- আ-হা, কিছুই জানো না! এমনি
ফুসলিয়ে নিয়ে যায় ব্যায়ামবীর হাওয়া, এমনি
চতুর প্রেমিকারা ছিপছিপে শিক হয়ে আছে জানালায়?
(রাত্রিদিন আধঘোমটা/ কবিতা সংগ্রহ-পৃষ্ঠা ২৫৫)
এই সমস্ত কবিতা সাতের দশকে লিখিত, লিখেছিলেন বছর তেইশের এক তরুণ। বলার ধরন, শব্দচয়নের মুন্সীয়ানা তাঁর ছিলো একান্ত নিজস্ব। কিন্তু যে কবি লিখেছিলেন : ‘চেয়ে দ্যাখো, সেরকম-ই রেখেছি স্বভাব’- তিনি তাঁর রচনার অভিমুখ পালটে ফেললেন আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে। যদিও, অনুমান, স্বভাব তিনি পালটান নি ততোটা, যে লোকজীবন তাঁর কবিতায় আলগোছে মিশে থাকতো, তা যেন বরং স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে দেখা দেবে এবার:
এসেছি জলের কাছে পীড়িত খরার দেশ থেকে
যেখানে চোখের কালো মণি থাকে এখন সেখানে
কাজললতার মতো এক নদী খুলে যায়; পথের দুধারে
পাথর মেঘের স্তুপ; প্রতিধ্বনি থেমে গেল বিস্তৃত দুপারে।
দেখা যায় হাল পড়ে, স্তব্ধ চাপা ভাটিয়ালি দীর্ঘ গুণ টানে।
(এসেছি জলের কাছে/ কবিতা সংগ্রহ-পৃষ্ঠা ১০০)
তোমায় দেখাই পোড়ামাটির কাজ
তোমার হাসি পোড়খাওয়া এই মাটি
মাটি সহজ, সরল তোমার হাসি।
ভেঙেছে মাটি, গিয়েছে হাসি থেমে।
দাঁড়াও তুমি, দাঁড়িয়ে থাকো আজ
দেখব আমি চাতাল থেকে নেমে
মন্দিরের এই গড়ন খুঁটিনাটি;
মাটির দেওয়াল ভরাট টেরাকোটায়।
তুমি কেন হঠাৎ যেন রাজি
এই কবিতার ভিতর গেয়ে ওঠায়।
(মন্দির/ কবিতা সংগ্রহ-পৃষ্ঠা ১০০)
পীড়িত খরার দেশের চাতক-আকাঙ্খা হয়ে কাজললতার মতো এক নদী খুলে দিলো তাঁর কবিতা। জল আর মাটি তাঁর কবিতায় এবার আসছে সরাসরি, কবিতার উপজীব্য হয়ে। তাঁর কবিতায় এখন ভাটিয়ালির সুর, তাঁর কবিতার মাটির দেওয়াল এখন দেখাবে ‘পোড়খাওয়া মাটি’ র হাসি। তাঁর সমকালীন অন্য অনেক কবিদের কবিতা যেখানে দেখাচ্ছিলো নতুন নাগরিক বোল ও চাল, সেখানে বীতশোক একাকী নিজের পথ খুঁজে পেলেন ব্যাপ্ত এক লোকজীবনে, আর তাঁর কবিতা ক্রমশ ‘আমার’ এই ব্যক্তিগত শব্দ থেকে কখনো কখনো ‘আমাদের’ এই বহুবাচনিক গৌরব-শব্দ-ও লিখে ফেলছিলো যেন :
বালিয়াড়িতে বসে আছি, বনের ভিতর, তারার আলোর নিচে।
পাল নড়ে উঠেছে একবার,
একবার হাল বসে গিয়েছে মাটির গভীরে,
উঠে এসেছে দুঃখের বীজ,
আমাদের মেয়ের নাম দেওয়া হয়নি এখনও।
(যাত্রা/ কবিতা সংগ্রহ-পৃষ্ঠা ১৫৫)
ঘাটের রানায় বসানো রয়েছে ঘট।
মুখখানি একা ভাসিয়ে রেখেছে মেয়ে।
এ ঘটের ডোল নিটোল অপ্সরার,
এই ঘট ছিল ভারতীয় দর্শনে-
জল ভ’রে ওঠে মেয়ের গা-ভরা দেহে।
না প্রত্যাহার, না ঠিক নির্বাচনে
রোদ ঠিকরোয় নাকের পাথর নথ।
বোধনে ভরাট এ ঘট নিরঞ্জনে,
ঘটে ডুবে যায় আশরীর প্রতিমার।
আমাদের ছিলো দর্শনে এই পট-
টানা ও পোড়েন নীল বেনারসী বোনে।
ছত্র স্নাতক কথক চিতার হাঁড়ি
ধাপে ধাপে নেমে সিঁড়ি উঠে যায় ক্রমে।
(দর্শন/ কবিতা সংগ্রহ-পৃষ্ঠা ১৬২)
আমাদের কৃষিপ্রধান যে দেশ, সেই দেশের রুক্ষ মাটিতে হাল ধরেছেন বীতশোক। মাটির গভীরে হাল বসে গিয়েছে, উঠে আসছে দুঃখের বীজ; আমাদের যে মেয়ের নাম দেওয়া হয়নি এখনো, সেই মেয়ে ও এই কবিতার জনক বীতশোক, জনমদুখিনী সীতা যেন মিশে এই কবিতার মাটির দুঃখের বীজে। অন্য কবিতায় ‘ঘট’ আর ‘পট’- আমাদের দর্শনের দুই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কিভাবে উঠে আসছে, পাঠক, লক্ষ্য করুন। প্রত্যাহার আর নির্বাচন, বোধন আর নিরঞ্জন, টানা ও পোড়েন-এই দ্বন্দ্বে প্রতিমা, অপ্সরা, মেয়ে, নথ, বেনারসী-সব মিলিয়ে বীতশোক এখানে আবহমান এই দেশ, এই ‘ভারতীয় দর্শনে’র নারী-মোটিফের কথক। সার্বজনীন প্রতিমা, সার্বজনীন ঘট, আর পটুয়ার লোকপট নিয়ে তাঁর কবিতা যেন এখানে মগ্ন ব্যাপক এক লোকসংস্কৃতির ভেতর।
ভারতীয় এই কবি, বাংলার এই লোককবির কবিতায় তবু কোথায় যেন মিশে থাকে মেদিনীপুর, তার লোকসংস্কৃতি, লোকশিল্প, আর এমনকি তা কখনো কখনো এই বার্তাও দেয় যে সংবাদ, মূলত কাব্য:
রামেশ্বরের শিবায়ন থেকে আমি
মাথা তুলে দেখি বিষণ্ণ ষাঁড়টিকে
ভোরের কুয়াশা ঘাস দলে এই দিকে
এসে মন্থর খোদাই একটি বৃষ।
রোমন্থ করে, রোমন্থ; মন্থর
মন্ত্র… এভাবে আমি কিছু সরে সরে
রামেশ্বরের শিবায়ন পড়ি, মেঘে
কাজলের রঙ গাভীর চোখের মত।
মৃত্যুর মত। কে বলেছে: কেউ নয়।
কেউ নেই আর। এমন কী সেই বৃষ
গইআর ছবি ফেলিনির ছায়াছবি
মেদিনীপুরের পট থেকে আরও দূরে।
(মৃত্যুর মতো/ কবিতা সংগ্রহ-পৃষ্ঠা ১৪৭)
শিবায়ন এই লোককাব্য রচিত ষোড়শ শতাব্দীতে। রচয়িতা রামেশ্বর ভট্টাচার্য। পশুপতি শিব ও তার বাহন বিষণ্ণ একটি ষাঁড় এই কবিতায় দৃশ্যমান। মেঘে কাজলের রঙ, বৃষটির অনুষঙ্গে, যেন তার প্রার্থিত গাভীর মতো। ‘মেদিনীপুরের পট থেকে আরও দূরে’-এই প্রসঙ্গে একটু ধাঁধা লাগে। প্রসঙ্গত, মেদিনীপুরের কর্ণগড়ের রাণি শিরোমণির দুর্গের মহামায়ার মন্দিরে বসেই রামেশ্বর এই কাব্য রচনা করেন। জানিনা, এই কারণে মেদিনীপুর উল্লিখিত কিনা। ‘মেদিনীপুরের পট’ একভাবে কবির স্থানিক পরিপ্রেক্ষিত দেখিয়ে দেয়। অন্যভাবে, এ-কথা বলাও হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে মেদিনীপুরের পট শিল্প এখনো নজর কাড়ে যে কোনো হস্তশিল্পমেলায় ।
শেষের আগের পংক্তিতে স্প্যানিশ শিল্পী গইয়ার উল্লেখ, এই কবিতায়? আর নবম লাইনে-‘মৃত্যুর মত। কে বলেছে: কেউ নয়‘? প্রসঙ্গত, ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে গইয়ার ৩৩-টি ছবির সিরিজ প্রকাশিত হয়, বুলফাইটের। মানুষের সঙ্গে পশুর সেই উন্মত্ত যুদ্ধ, রক্ত ও শিহরণ-আসন্ন সেই মৃত্যুর অনুষঙ্গ যেন এই কবিতায় ছায়া ফেলে। শিবায়নের ষাঁড়, আর গইয়ার বুল যেন স্থান আর কাল ফেলে বীতশোকের কবিতায় এক তলে এসে দাঁড়ায়।
ফলে এ-কবিতায় রামেশ্বরের শিবায়ন, গইয়ার ছবি, ফেলিনির ছায়াছবি, আর মেদিনীপুরের পট-এই চার ধরনের সাহিত্য ও শিল্পমাধ্যম বীতশোকের মুন্সীয়ানায় বারো লাইনের একটি ফ্রেমে সংশ্লিষ্ট হতে পারলো। আমার নিজের বীতশোক সম্বন্ধে যা ধারণা তাতেও মনে হয়েছে সাহিত্য, শিল্প, স্থিরচিত্র, চলচ্চিত্র এই সবের নির্দিষ্ট গন্ডীতে বেঁধে দেওয়া কোনো সিলেবাসের তোয়াক্কা তিনি করতেন না।
আর একটি কবিতা এখানে উল্লেখ করছি, যেখানে হয়তো অন্য এক মেদিনীপুরের দেখা পাবো:
ঘুম যাও তুমি
এতকাল যার জন্য পেতে রেখেছিলে ঠান্ডা সন্ধ্যা মছলন্দ
এতকাল যার জন্য মেদিনীপুরের থেকে এনেছ মাদুর
দ্বিপ্রহর বেলা
শীতলপাটির সেই পাট তুলে দিয়ে সে তো কবে চলে গেছে
(নিদালি/ কবিতা সংগ্রহ-পৃষ্ঠা ১৬০)
পাঠক, এই কবিতায় লক্ষ্য করুন বীতশোকের কবিতার বিন্যস্ত পংক্তিগুলির ঝোঁক, যাকে অলোকরঞ্জন বলছেন সুমিতি। এই কবিতাটি স্বামীহারা এক নারীর বৈধব্য বিষয়ক।এক গ্রামীন গৃহবধুকে তুমি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে এ-কবিতায়। তৃতীয় লাইনের ‘মেদিনীপুরের থেকে মাদুর’ আনার প্রসঙ্গ, প্রথম লাইনের ‘ঘুম যাও তুমি’ আর চতুর্থ লাইনের ‘দ্বিপ্রহর বেলা’ এই তিনটি বাক্যবন্ধ দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামের গ্রামীণ প্রেক্ষাপট-কে চিহ্ণিত করছে। মেদিনীপুরের মাদুর- বিশেষত সবং, রামনগর এই সব অঞ্চলের এই লোকশিল্পের সঙ্গে আজও জড়িয়ে অসংখ্য গ্রামীণ মানুষের জীবন ও জীবিকা। দ্বিতীয় লাইনের ‘মছলন্দ’ (স্থানীয় নাম- মোসলন্দ)-ও আরেক বিশেষ ধরণের মাদুর, তুলনামুলক ভাবে মিহি, শৌখিন ও বেশি দামের। লক্ষ্যণীয় এই লাইনটি: ‘এতকাল যার জন্য পেতে রেখেছিলে ঠান্ডা সন্ধ্যা মছলন্দ’। সন্ধ্যা শব্দটিতে জোর দিচ্ছি, জোর দিচ্ছি ঠান্ডা শব্দটিতেও। চতুর্থ লাইনে পড়ুন: ‘দ্বিপ্রহর বেলা’। দুপুরের ভাতঘুমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাধারণ ‘মাদুরের’ উল্লেখ। আর ‘ঠান্ডা সন্ধ্যা মছলন্দ’ যেন দিনের শেষের এক শীতল ও আরামদায়ক স্বস্তি। মাদুর, দুপুর, সন্ধ্যা, মছলন্দ- যেন এক নিবিড় গার্হস্থ্য তুলে আনছে এই কবিতা।
কিন্তু, এখনো বিস্ময় বাকি আছে। পঞ্চম লাইনে পড়ুন: ‘শীতলপাটির সেই পাট তুলে দিয়ে সে তো কবে চলে গেছে’। বেত দিয়ে বোনা শীতলপাটি আর এক গ্রামীন কুটির শিল্প, বিশেষত উত্তরবঙ্গের। দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলে গেলো কবিতা, গ্রীষ্মে শীতল হতে চাইছে কবিতা। একসময়ে গ্রীষ্মকালে কাঁথার ওপর শীতলপাটি পেতে শোয়ার চল ছিলো, আর শৈত্যের অনুভূতি আসতো বলে ‘শীতলপাটি’-এই নাম। ‘শীতলপাটির সেই পাট তুলে দিয়ে সে তো কবে চলে গেছে’-এখানে পাট শব্দ-টি দ্বিমাত্রিক ভাবে লেখা। এক পাট রাজ্যপাট-এর পাট যে অর্থে ব্যবহৃত হয় সেই অর্থে, আর এক পাট শীতলপাটির পাট বা বেত। পাঠক, স্মরণে আনুন আগের কবিতাটির ‘মেদিনীপুরের পট’-এর পট শব্দটির দ্বিবিধ ব্যবহার।
লোকশিল্প ও লোকজীবন বীতশোককে টানতো, তিনি আধুনিকতা নিয়ে পরোয়া করেন নি। প্রান্তিক লোকজীবন, লোকশিল্প, তাদের মনন, ভাষা ও সংস্কৃতি তাঁকে আকৃষ্ট করতো। আজকের বিশ্বায়নে প্রান্তিক মানুষ আরো বিপন্ন যেন, আর আমাকে আজো আলো দেখান প্রান্তিক লোককবি বীতশোক।
বীতশোকের কবিতায় ছন্দের নানান পরীক্ষানিরীক্ষা রয়েছে, নিবিষ্ট পাঠক পাবেন এসব কবিতায় এক নিজস্ব শৈলী। রণজিৎ দাশ একটি আলচনাতে এই নীচের উল্লিখিত কবিতার ছন্দকে হরিণ-চাল বলেছেন। পাঠক, কবিতাটির শব্দে শব্দে তৈরি হওয়া আশ্চর্য ঝংকার উপলব্ধি করুন, লক্ষ্য করুন এক ধাবমান হরিণকে:
কে তুমি আজ হরিণ, যাও, সঘনস্রোতে গগনে
তারা ছিটোও ; অদেখা খুর, শাণিত রুপো, অরণি
ও শিঙে জ্বলে ; কোথায় জল? পায়ের তলে ধরণী
সরাও, আর হরিণ ধাও। সোনার কণা নয়নে
সোনার কণা শরীরে আরও : এত অনল, হরিণী
নিলয় পায় তবে কোথায় ! কোথাও, কার চরণে
হিরণহার ছিঁড়ে লুটোয়, যা তুমি গেলে আমি নিই
মালায় গেঁথে--বরণ কী এই রশ্মি খরকিরণে।
(হরিণ, কবিতা সংগ্রহ, পৃষ্ঠা- ১৬)
একান্ত ব্যক্তিগত উচ্চারণেও বীতশোকের কবিতায় এক কৌম চেতনার স্পর্শ পেতে পারেন পাঠক। নীচের দুটি কবিতা, প্রিয় পাঠক, নিজস্ব মননে উপলব্ধি করুন, লক্ষ্য করুন কাব্যময়তা ও দার্শনিক প্রত্যয়ের যুগপৎ সহাবস্থান--
১)
একশো গ্রামের পরে তুমি।
সমতল শেষ হয় ; আজীবন চলে যায় রৌদ্রবেলা ব'য়ে ;
হলুদ রক্তাভ ঢল, তারও পরে ধোঁয়া কালো ঢল ;
সমস্ত ঢালুর মুখে, সবকিছু অতল উজানে ;
তিনটে গাছের দ্বীপ সৌন্দর্যের মত আজ উঁচু ;
হেলানো শরীর ছুঁয়ে দূরে যাব, ঠেশমূল, আনত আকাশ ;
অশ্রান্ত ঘুঘুর ডাক শেষ করে জানালার পাখি, ঘুলঘুলি ;
কেবলই খবর আসে, বাঁকানো রোদের রেখা বেয়ে বেয়ে ধুলোর খবর ;
কোথায়, বলো তো, বলো পড়ে আছে তোমার হাতপাখা?
সামান্য চিত্রিত ভুরু, প্রথমা চাঁদের চোখে কোমল জিজ্ঞাসা।
(একশো গ্রামের পরে তুমি-কবিতা সংগ্রহ- পৃষ্ঠা- ৭৬)
২)
আমি তো ছিলাম ন্যাংটো, বাবলাগাছ, বড়দি আমাকে পুজোর পোশাকে ডেকে সাজালেন। মায়ের মতন,
অথচ মাকে তো আমি ভুলে গেছি, আমি এই ভেবে নদীর ধারের থেকে উঠে এসে ছোটো পায়ে ছায়া নিয়ে ছুটে একলা পথের দিকে চলে গেছি। বাঁদিকে তাকালে বনানী পোশাক পরে আছে এই ভুল হতো, সমাসোক্তি হতো : এবং উপমা হতো ডানদিকে কিছু নেই বালির বানানো ধু ধু ঢিবি রুগ্ন স্তন হলে। আরো অলঙ্কারহীন আরেকটি বাড়ি- সে যেন তোমারই মতো সারাদিন ছিমছাম, সারারাত বেদী কোনো পীরসাহেবের, যদি জানি আমাকেও সিন্নি দিতে হবে, দরগায় দেওয়ার তবু কিছুই তো নেই শুধু প্রত্যাসন্ন ছায়া, কিছু বিষণ্নতা, মেঘ, একাকিত্ব চটকে দেওয়া; কিন্তু এর কোনও মানে আছে, জানা নেই। কাঁটায় দুফুটো কান, পুরুত শিশুর নগ্ন পুজো নেয় প্রেত, বড়দি তা জানে যদি, মা যদি তা জানে কিছুতে কী কিছু হয় ; কিংবা দেওয়ালে যদি তোমার ও নাম লিখে যাই, হবে কিছু ; বৃষ্টি, নোনা, ইঁট, দাঁত, শ্যাওলা, পল্লবে সব স্তরে স্তরে মোছে ; বা ভেতরে থেকে যায় ; আজ যা থাকে না তাকে ভালোবাসা বলে; গোশালার মাচা থেকে খুঁজে পাওয়া পুঁথি কেউই বলে না তাকে, স্মারক বা অভিজ্ঞান, স্মৃতিচিত্র বলে।
(তাকে ভালোবাসা বলে/ কবিতা সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-৬৬)
খরার দেশের কবি বীতশোক কখনো নিজের দেশকাল বিস্মৃত হতে পারেননি। তাই তাঁর কবিতায় সেই ব্যর্থ রূপকথার বয়ান, পাষাণ বটের তলায় জড়ো হওয়া জনমানব, কলাপাতা আর রাখালের অনুষঙ্গ, শেষাবধি নটে গাছ মুড়িয়ে যাওয়ার আখ্যান একটি দীর্ঘশ্বাসে এসে শেষ হয়। এই কবিতা পড়ে মনে হয় এ কি ব্যক্তিগত প্রেম, নাকি এক যৌথ হাহাকার, সেই পীড়িত দেশের?
তুমি জানতে না কথা থামানোর মানে
চুপ করে থাকা তার নাম গোপনতা
দুচোখের জল নয়ানজুলিতে নামে
দুচোখের জলে পিছল পায়ের পাতা
পায়ে পায়ে চলে গিয়েছ খরার মাসে
সকলে মিলেছ পাষাণ বটের তলা
কি যেন কি খেলে মনে নেই মনে আছে
চুমুক দিয়েই ছুঁড়েছ বেলের খোলা
কেউই জানে না কেন জল হয় না যে
কেন গাছ আজ ফেলে না কলার পাতা
কেন বউ আজ ভাত বা না বেড়ে আছে
কেন ভোলে আজ ও রাখাল চরানোটা
কেন গোরু আজ এমন মুড়িয়ে খায়
কেন নটেগাছ মুড়োয় ফুরোয় কথা
তুমি জানতে না কথা থামানোর দায়
তুমি জানতে না একটাই রূপকথা
(খরা- কবিতা সংগ্রহ, পৃষ্ঠা ১৭৬)
যারা বীতশোকের কবিতার সঙ্গে পরিচিত তাঁরা জানেন, তাঁর কবিতায় কীভাবে রেফারেন্স লুকিয়ে থাকে। সেগুলির সামান্য কিছুর আবিষ্কারে বিস্মিত হয়েছি। একটি কবিতা প্রাসঙ্গিক মনে করে তুলে দিই। পড়লে ভেসে ওঠে এক চিরন্তন বাংলার গ্রামীণ ছবি। আর কেবলই মনে হয় এই দৃশ্য কোথায় যেন দেখেছি :
এরকম হালকা, যেন খেলবার ছলে
মনে হয় জলের মনেই
জল পড়ে। জল ঝরে যায়
সরে আজ পান কলসের শাদা ফুলে
বধূর নবীনা নাকছাবি
শোনো গো বামুনবউ,
শোনো
যদি না বাগদী ছেলে কোনোদিন আমি কূল থেকে
তোমাকে না করতাম বার...
যদি না বামুনবউ দুগ্গাপিতিমের মতো কেউ
হরতেল রঙ মুছে হাঁটুজলে নেমে
চুপড়ি ভরে গুগলি তুলে শামুকপোতার বিল থেকে
কোথাও না চলে যেত....
ছোট ঢেউয়ে ভেঙে
জলের ছিটে ও ফোঁটা তাহলে কি এত কথা হতো
এরকম, ঠিক, এরকম
(কথা- কবিতা সংগ্রহ- পৃষ্ঠা- ১৬৯)
কবিতাটির অনুষঙ্গ যেন চেনা। এই দৃশ্য কোথায় দেখেছি? কী এর রেফারেন্স? বীতশোক নিজের কবিতা নিয়ে কিছু বলতে চাইতেন না। অথচ কখনো কখনো অন্যের কবিতা নিয়ে উচ্ছসিত হয়ে উঠতেন। এমনিতেও, মনস্ক পাঠক জানেন, বীতশোকের শেষের দিকের কবিতা, অনেক বেশি মাত্রায় রেফারেন্স নির্ভর। আশ্চর্য, এই রেফারেন্স একদিন ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেলাম, বিভূতিভূষণে। পথের পাঁচালীর দ্বিতীয় ভাগে। প্রাসঙ্গিক অংশটুকু তুলে দিলাম শুধু। প্রিয় পাঠক, পড়ে দেখুন:
"কোন গ্রামের এক ব্ৰাহ্মণবাড়ির বৌ এক বাগদীর সঙ্গে কুলের বাহির হইয়া গিয়াছিল-আজ অপুর সঙ্গীটি এইমাত্র তাকে শামুকপোতার বিলে গুগলি তুলিতে দেখিয়া আসিয়াছে। পরনে ছেঁড়া কাপড়, গায়ে গহনা নাই, ডাঙায় একটি ছোটছেলে বসিয়া আছে, বোধ হয় তাহারই। অপু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোমার দেশের মেয়ে? তোমায় চিনতে পারলে?
হ্যাঁ, চিনিতে পারিয়াছিল। কত কাঁদিল, চোখের জল ফেলিল, বাপ-মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করিল। অনুরোধ করিল যেন এসব কথা দেশে গিয়া সে না বলে। বাপ-মা শুনিয়া কষ্ট পাইবে। সে বেশ সুখে আছে। কপালে যাহা ছিল, তাহা হইয়াছে।
সঙ্গীটি উপসংহারে বলিল, বামুন-বাড়ির বৌ, হর্তেলের মতো গায়ের রঙ-যেন ঠাকরুনের পিরতিমে!
দুর্গ-প্রতিমার মতো রূপসী একটি গৃহস্থবধূ ছেঁড়া কাপড় পরনে, শামুকপোতার বিলে হাঁটুজল ভাঙিয়া চুপড়ি হাতে গুগলি তুলিতেছে-কত কাল ছবিটা তাহার মনে ছিল!"
পাঠক, মিলিয়ে দেখুন।
বীতশোকের কবিতার নীচে উল্লিখিত এই প্রেমের কবিতাটি আমাকে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার একটি অভিনব তথ্য জানিয়েছে:
অনেক দূর দেরিতে তুমি আছ,
মেদিনীপুরে হাজার তেরো গ্রাম।
তোমার নাম চিনেছি কাল- আজও-
এক এক দিন আকাশ নীল খাম।
(ডাক/ কবিতা সংগ্রহ-পৃষ্ঠা ১৩৮)
পাঠক, অবিভক্ত মেদিনীপুরের গ্রামের সংখ্যা ছিলো তেরোহাজারের কিছু বেশি। তাই এই কবিতায় দেখা দিচ্ছে এই লাইন -‘মেদিনীপুরে হাজার তেরো গ্রাম’। এই কবিতা আমাকে এই উক্তিটিও মনে করিয়েছে আরেকবার: ‘সংবাদ, মূলত কাব্য’।
এবং, বীতশোক আমাকে এখনো মনে করান আমার সেই ফেলে আসা মেদিনীপুরের রুখু পথঘাট, মনে পড়ে তাঁর সঙ্গে হেঁটে হেঁটে শহর পরিক্রমা, নদীর পাড়ে বসে আড্ডা দেওয়ার স্মৃতি। আমার মেদিনীপুরের পটে আঁকা, আমার মেদিনদুপুর জুড়ে আজও সেই একটা অন্য মানুষ, অন্য কবি, পীড়িত খরার দেশ থেকে যিনি জলের কাছে একদিন আমাদের একান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই আত্মগোপনকারী, নিজস্ব বিশ্বাসে স্থির, একাকী ও মগ্ন, বীতশোক।
Somboboto ai lekhati porei tor sathe amar bondhutwo hoi.
অসাধারণ কবি, অসাধারণ লেখা ! তাঁর যোগ্য মূল্যায়ন।
বীতশোক আমার অধ্যাপক ছিলেন। ক্ষীণকন্ঠ অধ্যাপক বিখ্যাত কবি, তখনই শুনেছিলাম। বেশি এগোনো হয়নি তাঁর কবিতা নিয়ে। এই প্রবন্ধ কৌতূহলী করল, এবার তাঁকে পড়তেই হবে।
মননসমৃদ্ধ এ লেখায় মানুষ ও কবিতার বীতশোক ভট্টাচার্যকে বোঝবার চেষ্টা আছে। ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে এ লেখাটি একটি কথামুখ হয়ে উঠতে পারে।
অসামান্য লেখা বীতশোককে নিয়ে। এত বিস্তারিত বীতশোকে মুগ্ধ লেখা ইতিপূর্বে পড়িনি । আর একটা কথা কী মনে হয় জানো, কবি যত উপরের দিকে হয়, মানে তার চেতনা স্তর, ততই তার আলোচক কম হয়, সমকাল কম বোঝে তাকে। কারন তাকে চিনতে সেই স্তরে হাজিরা দিতে হয়। বীতশোক তেমনই একজন, এই নিচ থেকে এটুকু অনুভব হয়।
এখনো আমার অবসরের সঙ্গী বীতশোক,তাঁর সাহচর্যে কাটানো সময় এখনো জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় মনে হয়। কৌশিকের অনবদ্য মূল্যায়ন পড়ার পর তাঁর পরিণত বয়সের এক গবেষণার বিষয়ে বলতে ইচ্ছে করছে আজ।বীতশোকের 'শ্রীচৈতন্যের কবিতা' প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে।মহাপ্রভুর জীবন-দর্শনের এই আলোচনার অতল গভীরতা বীতশোকের অন্তর্দৃষ্টিতে ভারতীয় ঐতিহ্যের সম্যক রূপটিকে ধারণ করেছে।তাঁর অনির্বচনীয় বিশ্লেষণ আর ব্যাখ্যা বইটি না পড়লে বোঝা সম্ভব নয়।আমি শুধু একটি কবিতা লিখে বিদায় নিতে চাই--
যুগ
হয়ে
যায়
নিমেষ।
বর্ষা
হয়ে
যায়
অশ্রু।
শূন্য
হয়ে
যায়
সব জগৎ।
হে গোবিন্দ,
তোমার
বিরহে।
লেখাটা পড়ে কবি বীতশোক এর কথা আরো কাছ থেকে জানতে পেলাম। একজন কবিই পারে আরেকজন কবির পরিচয় দিতে। সত্যি বলতে কি, এটা একটা জীবনীমূলক গবেষণাপত্র নয়, এটা একটা কবিতা। কৌশীকদা, মুগ্ধ হলাম আপনার অসম্ভব সুন্দর কবিতা টা পড়ে।
বীতশোক সম্পর্কে অজানা অনেক কথা জানা গেল। এমন রচনা কবি সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলবে পাঠককে সন্দেহ নেই। আর হ্যাঁ, "চেয়ে দ্যাখো"-র বিশ্লেষণ যে ভাবে পাওয়া গেল তাও তো আর এক কবিতা।
শ্রী গুপ্ত কবি বীত শোক ভট্টাচার্যের কবিতার মূল্যায়ন করেছেন খুব আন্তরিক ভাবে সযত্নে। কয়েকটি কবিতার নিবিড় পাঠ আমাদের মতো পাঠকের পক্ষে উপাদেয় হয়েছে। কবিকে প্রান্তিক লোক কবি আখ্যা দিয়েছেন - সেটা কতোটা সঙ্গত সে নিয়ে মতান্তর থাকতে পারে। তবে তাঁর কবিতার উপজীব্য লোকায়ত জীবন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ হতে পারে। কবি মূলস্রোতের তথাকথিত আধুনিক নাগরিক কবিতা থেকে দূরে সরে থাকা বেছে নেন সচেতন ভাবে - এমনটা মনে হয়। একদা কবির " হাজার বছরের বাংলা কবিতা" বইটি বহু বছর আগে পড়েছিলাম। কিন্তু কবির সম্বন্ধে এত কিছু জানার সুযোগ হয়নি - এটা আমাদের ই দুর্ভাগ্য। শ্রী গুপ্ত কে ধন্যবাদ জানাই আমাদের সঙ্গে কবির পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।
খরার দেশের কবিকে নিজস্বতায় চিনিয়ে দিয়ে বীতশোককে আরেকবার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছে এই লেখা।
কুশান কথিত "শীতকাল" এর তত্ত্বতালাশ আগেও পড়েছিলাম, স্বীকার করি, নরেন বিশ্বাসের পর বহুকাল পরে এইরকম দাগকাটা কবিতার উন্মোচন আর হয় নাই।
বাংলা ভাষাকে বীতশোক যেমন ঋণী করেছেন, এইসব লেখাও যেন তাই। উদ্ধৃত কবিতাগুলো মুগ্ধতায় বার বার পড়ি
পুনশ্চঃ
কুশান গুপ্ত এবং কৌশিক ঘোষ কী একই ব্যক্তি? "শীতকাল" এর ব্যাখ্যা সূত্রে এই প্রশ্ন।
বছর দুয়েক আগের লেখার সাথে অংশত লাইন বাই লাইন মিলে যাচ্ছে। অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক মন
"কুশান | 342323.176.7889.102 (*) | ২৯ নভেম্বর ২০১৮ ০৭:৫৮62721
ধন্যবাদ।
তৃণা, আমিই কৌশিক ঘোষ। এখন কুশান নামে লিখছি, যেহেতু আমার নামে একজন আছেন যিনি গুরুতে লেখেন।"
-----
আচ্ছা, এই তাহলে ঘটনা। কৌতুহল মিটেছে, ওপরের প্রশ্নটি প্রত্যাহার করে নিলাম। শুভেচ্ছা
বাংলার মেন স্ট্রিম মিডিয়া অনেক গুণী জনকেই ব্রাত্য করে রেখেছে। সংস্কৃতি তে তাদের মনোপলি ভাঙার দায়িত্ব বর্তমান জেনারেশনের। এই ধরণের খা সেদিকে একটি উল্লেখ যোগ্য পদক্ষেপ।
আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানাতে চাই।১৯৭১সালে মেদিনীপুর বক্সীবাজার কমিউনিস্ট পার্টির দপ্তর থেকে "অগ্নিকোণ" নামে একটি ছোট ত্রৈমাসিক পত্রিকা বের হতো।পত্রিকাটি কবি ও লেখক অশোক মিশ্রর উদ্যোগে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো।১৯৭৮ সালে অশোকের অকাল প্রয়াণের পরে বন্ধ হয়ে যায়।আমি কলকাতায় চলে আসি।তৎকালীন ঐ পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীতে বীতশোক এবং বিপ্লব মাজী দুজনেই ছিলেন।প্রত্যেকটি লেখার বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে স্থির করা হতো।ওদের দুজনের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হতো। মনে হয় এটাই বীতশোকের কাব্য জীবনের গোড়ার কথা।