এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • এন জি রোডের রামলাল-বাংগালি

    কুশান গুপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ | ২০৫৪ বার পঠিত
  • রামলাল রাস্তা পার হইতে যাইবেন, কিছু গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা চ্যাংড়া যুবক মোড়ে বসিয়া তাস পিটাইতেছিল— অকস্মাৎ একজন তাহার পানে তাকাইল।  রামলাল সতর্ক হইলেন। হাত মুষ্টিবদ্ধ করিলেন, তুলিয়া, ক্ষীণকন্ঠে বলিলেন, 'জ্যায় শ্রীরাম।'

    পূর্বে ভুল হইত। অকস্মাৎ কেহ না কেহ পথের এক মোড় হইতে অন্য মোড়ে অব্যর্থ ডাকিত, 'কে যায়?' সম্বিৎ ফিরিয়া রামলাল উচ্চারণ করিতেন, 'জয় শ্রীরাম।' দুর্বল শরীর, প্রখর গ্রীষ্মেও একটি গেরুয়া উত্তরীয় সর্বদা গলায় জড়াইয়া রাখিতেন। উহা একটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কবচ। প্রখর গ্রীষ্মের হাল্কা অসুবিধেসহ নাগরিককে সহজে স্বাচ্ছন্দ্য দেয়। তবে মধ্যে মধ্যে সহজে ঘাম মুছিয়া ফেলা যায়।

    সে...পূর্বের কথা। সেই সময়ে একদিন স্থানীয় জনকল্যাণ অফিসে ডাক পড়িল। এক তরুণ নেতা বসিয়া রহিয়াছেন। চেহারা, আশাকপোশাক, হাবভাব দেখিলেই সম্ভ্রম হয়। জরুরি তলব। বিশেষ বিশেষ স্থানীয় নাগরিকদের আহ্বান করা হইয়াছে।

    নেতা অ্যাটেন্ডেন্স খাতায় একটি নম্বরে টিক চিহ্ন কাটিয়া কহিলেন, 'আপনার নাম কী, মহোদয়?'

    -'আজ্ঞে, রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।'

    -'রামলীলা ময়দান থিকে আসলেন নাকি, মহোদয়?' বলিয়া নেতা দাঁত বার করিয়া হাসিলেন। তীব্র জর্দার খুশবু বাহির হইল।

    -'বেশ। দেখি, জাতীয় মন্ত্র বলুন।'

    -'জয় শ্রীরাম।'

    চেয়ারে উপবিষ্ট নেতা বিস্ময়ে তাঁকে দেখিলেন। পরক্ষণেই চিৎকার করিয়া ডাকিলেন: 'নিতাইরাম। মাধবরাম। কাঁহা হো তুমলোগ! '

    শশব্যস্ত হইয়া কোমরে গেরুয়া গামছা বাঁধা, খাকি হাফ প্যান্ট, এবং, শাদা স্যান্ডো গেঞ্জী পরিহিত কতিপয় গাঁট্টাগোট্টা তরুণ দৌড়াইয়া আসিল।

    'ইয়ে তুমলোগ ক্যা শিখসা দে রহে হো নাগরিক কো? শরম আনি চাহিয়ে। তুমলোগ যুব মোর্চা কে নওজোয়ান হো? নালায়েকোঁ !'

    তার পরে নেতা ঠান্ডা গলায় বলিলেন, 'মহোদয়ের কি হিন্দি ভাষার কোর্স ছিলো না? কবে পাস করেছেন?'

    রামলালের তখন, নেতার হাবভাবে, হিমেল স্রোত শিরদাঁড়া দিয়া নামিতেছে। পাজামায় প্রস্রাব না হইয়া যায়। তবে কি কোনো গর্হিত অপরাধ হইল?

    তিনি প্রথমে করজোড় করিলেন। সেই কোন সুদূর ছাত্রজীবনে নাটকে বাঁধা চাকরের রোল করিয়া তিনি একদা অভ্যস্ত ছিলেন। অকস্মাৎ, করজোড়রত, রুদ্ধস্বরে কহিলেন, 'হুজুর, আপনি আমার মা বাপ, আপনিই মনিব হুজুর।' বলিয়াই অঝোরে ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। দৃশ্যত নাটকীয়, তথাপি ইহা কপট ক্রন্দন নয়। প্রকৃতপক্ষে হৃদয়-অভ্যন্তরীন ঘুমন্ত হিমশীতল মৃত্যুভয় এক্ষণে জাগিয়া উঠিয়া তাকে এরূপ অপারগ ক্রন্দনে বাধ্য করিল।

    তাঁকে রোরুদ্যমান দেখিয়া ঘাড়ে গর্দানে, সোনার চেন পরা, গলায় বিচিত্র রুদ্রাক্ষধারী, শ্মশ্রূগুম্ফময়, ভয়ালদর্শন, যুবনেতার শরীরে বোধহয় ঈষৎ মায়ার উদ্রেক হইল। কেননা তিনি রামলালের মস্তকে আলগা তথাস্তুহাত রাখিলেন।

    তিনি বয়সে হয়ত বড়জোর চল্লিশ। রামলাল ষাটোর্ধ্ব। কিন্তু তিনি হেঁটমস্তক হাতজোড় রামলালের টাকমস্তকে ভারী হাত অলস বুলাইতে বুলাইতে যথোচিত সস্নেহে বলিলেন,'আপনার কুনো খেতি হোবে না রামলাল বাবু। এ রামের দেশ হিন্দুস্তান আছে। তার উপরে আপনি হিন্দু আছেন। এখন আর মছলি মাংস খান?'

    রামলাল সম্বিৎ ফিরিয়া পাইলেন। এতক্ষণে ধড়ে যেন প্রাণ ফিরিয়া আসিল। মনিব খুশি হইয়াছেন। তিনি দুকান ধরিয়া, জিভ কাটিয়া বলিলেন, 'না স্যার। ধরলাম কবে? ধরলে তো ছাড়ব ! এমনিতেও আমার বাবা মা সাত্ত্বিক হিন্দু ব্রাহ্মণ। আমরা পিরালির ম্লেচ্ছ বামুন না। ভটচাজের মত ছোট বামুন না। সেনরাজার আমলে কনৌজ থেকে আমার চোদ্দ গুষ্টি এসেছে স্যার। রাঢ়ীয় বামুন। রেয়ার স্পিসিস। এই পৈতে ছুঁয়ে বলছি স্যার। দেখুন। দেখুন।' বলিয়া তিনি নিমেষেই তার ফতুয়া খুলিয়া ফেলিলেন। অভ্যন্তরের শতচ্ছিন্ন ময়লা গেঞ্জি জাগিয়া উঠিল।

    এই দৃশ্য দেখিয়া পার্টি অফিসের বাকি সব ছোকরা যুবক্যাডাররা মুচকিহাসি হাসিতে লাগিল। এমনিতেও নেতার মুড দেখিলেও মানিতে হয়, এইরূপ শক্তিশালী, নির্দয়, সজাগ নেতা দলের তথা জাতির সম্পদ। তথাপি স্নেহ অতি বিষম বস্তু। এমন নেতাও শেষে কেস খাইল স্নেহবিগলিত হইয়া ! নেতাদের রকমসকম বোঝা সত্যি ভার। বিশেষ বিল পাস হইয়া নির্বাচন বন্ধ হইয়া গেছে কয়েক বৎসর। তাছাড়া এই আপদে প্রচুর ব্যয় হইত। দেশের কোটি কোটি টাকা তো বাঁচিল। জনগণ বলিল, সাধু সাধু। সর্বজ্ঞ হোয়াটস অ্যাপ বলিল, চীনে তো ইলেকশন হয় না। চীন তো দিব্যি উন্নতি করিতেছে। আমরাও পারিব। অলিম্পিকে পঞ্চাশটা গোল্ড আমাদিগের কাঙ্খিত। রূপা গোটা ষাট। ব্রোঞ্জ আমরা পাকিস্তানকে ডোনেট করিয়া দিব। আমাদের ট্যাক্সের টাকা পূর্বে অনর্থক ইলেকশনে ব্যয়িত হইত। এক্ষণে জনহিতার্থে খরচা হউক।

    ইলেকশন তো উঠিয়া গেল। কিন্তু নেতাদের কাজ কমিবে কী, উল্টে আরো বাড়িয়া গেল। কতশত জনহিতকর বছরঠাসা কর্মসূচী। পবিত্রনারীব্রতপ্রকল্প। আসলে, নারীদের সতীত্ব রক্ষায় নতুন সরকার সদা জাগ্রত। পূর্বে, সেকুলার ভারতে, নানাবিধ নারীকেন্দ্রিক অনৈতিক কাজ হইত। ইহা নিন্দুকেরাও স্বীকার করে, স্বহস্তেই তো কৃতকর্ম রচিয়াছে। বিশেষত বেহায়া বাঙালি লেখকেরা কার্যত বটতলার অশ্লীল নামতা ছাড়া আর কী-ই বা লিখিয়াছে? অধিক বলিবার প্রয়োজন নাই, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় হইতে সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়― সকলেই বেয়াদব বাংলা ভাষার নকশিকাঁথার আড়ালে অনৈতিক যৌনতার বাড়াবাড়ি চর্চা করিয়াছে। ইহাতে সেকুলার জমানায় জাতি হীনবীর্য তথা দুর্বল হইয়া পড়ে, অধঃপাতে যায়। শেষের দিকের, বিশেষত ২০০০ সনের পরের দিকে বাংলার নারী লিবারেল লেখিকারা প্রায় ভুলিয়া বসিয়াছিলেন, যে, এদেশে কখনো সীতা বাস করিতেন। এইসব লইয়া বিস্তর কোর্ট কাছারি, আইন ইত্যাদি হয়। অনেককেই  সেকুলার জমানার নির্বিচার পাপাচারের দরুন আজ জেলের ঘানি টানিতে হইতেছে। বিশেষ বিশেষ আইন আসিয়া দুরমুশ করিয়া দিয়াছে অবাধ যৌনতার চর্চা, যা বস্তুত অনৈতিক ও আদ্যন্ত অনধিকার-চর্চা। ইহা, বলাই বাহুল্য, পশ্চিমীবায়ু-অধ্যুষিত ও সেকুলার নামক ঘৃণ্য, একপেশে, অযথা-যৌনগন্ধী-ক্যাডবেরি-মোড়কে পরিবেশিত। হিন্দুরাষ্ট্র হইবার পরে বিবিধ বাংলা পুস্তক ব্যানড হয়― যেগুলি সতীত্বের পক্ষে অবমাননাকর। দুই চারিটি বাংলা বই রহিয়া গেছে, যথা―এডিটেড ভারত প্রেমকথা। বেলা দের― নিরামিষ রান্না প্রণালীর বই। কিন্তু আমিষ রান্নার বই বাদ পড়িল। লক্ষীর পাঁচালি রহিয়াছে। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণ নিষিদ্ধ হইয়াছে, কেননা রামের বিকৃতি চক্রান্তপূর্বক ঘটানো হইয়াছিল, যথেচ্ছ অশ্লীল বর্ণনায়। ভাগ্যে আজ দেশের নাম ভারতবর্ষ না হইয়া হিন্দুস্তান, তবে না সকল চক্রান্ত ফাঁস হইল? মেঘনাদবধের শেষ একটি উইখাওয়া কপি এক অশীতিপর ব্যক্তির ট্রাংক হইতে মধ্যরাতে রেইড করিয়া উদ্ধার হইবার পরে বিশেষ ইউএপিএ আইনবলে সেই বৃদ্ধকে পুলিশ শীতের রাতে হ্যাঁচড়াইতে হ্যাঁচড়াইতে লইয়া যায়। আন্দামানে পুনর্নিমিত সাভারকার সেলুলার জেলে সেই বৃদ্ধকে, যাবজ্জীবন দণ্ডে দন্ডিত করিবার পরে, পাঠানো হয়। কিন্তু জনশ্রুতি এই, জেলে যাইবার পূর্বেই সেই ব্যক্তি পথিমধ্যে নাকি মারা যায়। অতঃপর মহাভারতের নতুন ভার্সন বাহির হইয়াছে। উহার বিশেষ অংশ ছাপানো হইয়াছে। মুষল পর্ব বাদ পড়িয়াছে। গবেষকদল জানাইয়াছেন নীচ দলিত ব্যাধের তীরে কৃষ্ণ কদাপি মরিতে পারেন না। বস্তুত, কৃষ্ণের মৃত্যুই হইতে পারে না। রাম বা কৃষ্ণ ইহারা অমর অবতার। রামই মূল। কৃষ্ণ গৌণ। নব মহাভারতে রামপর্ব বলিয়া নতুন চ্যাপ্টার বাহির হইল। ইহার সপক্ষে যুক্তি পেশ করিয়া নতুন 'ইতিহাসবেত্তা'রা রীতিমতো কনফারেন্স করিয়া রেজোলিউশন গ্রহণ করেন। নতুন ইতিহাস লিখিত হইতেছে। কত কাজ সকলের। কর্মযোগে ঘর্ম ঝরিতেছে সকলের, আনন্দধারা বহিছে ভুবনে, কিন্তু এত ভলিউমের রবীন্দ্র রচনাবলী কোন শ্মশানে পুড়িয়া ভস্মীভূত হইয়াছে কেউ জানে না।

    এক বিপুল কর্মযজ্ঞে হিন্দুস্তান মাতোয়ারা হয় সপ্তাহাধিক কাল। পবিত্র অগ্নি-উৎসব নামক এক স্বতঃস্ফূর্ত বৈদিক কর্মসূচিতে স্বেচ্ছায় হিন্দুস্তান-ভাবাবেগ বিরোধী সকল বই আগুনে নিক্ষিপ্ত হয়। সে এক অভূতপূর্ব উদ্দীপনা, দেশব্যাপী। বাংলাতেও সেই দাবানল লাগিল।স্বেচ্ছাসেবকদের দল অলিতে গলিতে, পথে পথে হাত ধরিয়া দেশসঙ্গীত গাহিতে গাহিতে মাতিয়া উঠিল। লিটার লিটার কেরাসিন ও ক্ষুদ্র মাচিস সংগ্রহ করিয়া বইয়ের পাহাড়ে দিকে দিকে অগ্নিসংযোগ ঘটিতে লাগিল। লেলিহান, দেদীপ্যমান, উচ্ছৃত নীল শিখা আকাশে শহীদ মিনার স্পর্শ করিতে চায়। উহাতে ঘি ঢালিয়া দিলো পুরোহিতের দল। অং বং চং কীসব রোমহর্ষক বেদোদ্ধৃত মন্ত্র বাজিতে লাগিল মাইকে। নেপথ্যে চলিতেছে সামগান। ওদিকে চড় চড় শব্দে পুড়িতেছে রকমারি অখাদ্য, অশ্রাব্য পুঁথি। কোথা হইতে আসিতেছে রাশি রাশি সানন্দা ও উনিশ কুড়ি, রকমারি অপ্রাসঙ্গিক, অচল লিটল ম্যাগাজিন, মোটা ভলিউমের সুনীল রচনা সমগ্র। একই সঙ্গে পুড়িতে থাকিল জয় গোস্বামী, বাৎস্যায়ন ও মিলান কুন্দেরা। হুররে বলিয়া  কেউ কেউ আগুনে সমর্পণ করিবার পূর্বে ডেবোনেয়ারের পাতা উলটাইয়া শেষবারের মতো নিষিদ্ধ জলবিভাজিকা ও নদীউপত্যকা দেখিয়া লইল গোপনে। পুড়িয়া খাক দুর্লভ প্লেবয়ের অনাঘ্রাতা ডেমি মুর, পাশেই পুড়িতেছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ও ফ্রয়েড। লক্ষ্যনীয় রূপে বাহির হইল যৌনবিষয়ক পাঠ-অযোগ্য গ্রন্থাবলী। বস্তুত, দেশের সাধারণ নাগরিক যে এই পরিমাণ বানানভুলে ভরা কাঁচা ভাষায় গালিগালাজপুর্ন বইসমূহ পড়ে তা জানা ছিলো না। তোষকের তলা হইতে, ঘুলঘুলির চড়ুই বাসা হইতে, ক্যাশবাক্সের ড্রয়ার হইতে, কোমরের ট্যাক হইতে, এমনকী জাঙিয়ার ভিতর হইতে যত্রতত্র বাজেয়াপ্ত হইল রকমারি গুপ্ত চোরামাল―কোনো পুস্তকের নাম 'সুন্দর জীবন', কোনোটির নাম-'আঁকাবাঁকা যৌবন'। নিষিদ্ধ বইয়ের এরূপ ধরপাকড়―সকলই স্পেশালি ট্রেইন্ড স্বেচ্ছাসেবকদের কেরামতি। 

    অবাক ঘটনা ঘটিয়াছিল রামলালবাবুর হাউসিংয়ে। উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের সুখেন বসু এলাকার বিশিষ্ট সজ্জন ব্যক্তি। ধর্ম ও দেবদ্বিজ ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ে যেন আলোচনায় তাঁর আস্থা নাই। তবে তিনি প্ৰকৃত গ্রন্থপিপাসু। প্রচুর বই সেকুলার যুগেও কিনিতেন, এখনো কেনেন। ভদ্রলোক নিঃসন্তান। অকস্মাৎ স্বেচ্ছাসেবকের দল যখন ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাইতেছে তখন তিনি নিশ্চিন্তে হাসিমুখে তাদের স্বাগত জানান। অকস্মাৎ এক ভলান্টিয়ারের কী সন্দেহ হয়, 'সেকুলার―এক অন্ধযুগ'―এই বেস্টসেলার বইটির মলাট দেখিয়া। সে বইটির পাতা উল্টায়। বইয়ের ভিতরের পাতাগুলিতে দেখিয়া তার দুচোখ বিস্ফারিত হইয়া উঠে। ভিতরের হলুদ পাতাগুলিতে রহিয়াছে 'নির্বাচিত জীবন যৌবন'। অতঃপর আবিষ্কৃত হয় 'যোগ সাধনা ও মনঃসংযোগ' এই মলাটের আড়ালে রহিয়াছে 'সচিত্র রসময় গুপ্ত'। আরো নানান ভুয়া মলাটের আড়ালে অশ্লীল হইতে অশ্লীলতম বইপত্র আবিষ্কৃত হয়। শেষে প্রচ্ছদ ধরিয়া বই বাছিতে বাছিতে ক্লান্ত ও অধৈর্য ভলান্টিয়ারের দল তাদের নেতৃবৃন্দের পরামর্শ চায়। তখন উপরমহল হইতে নির্দেশ আসে― সুখেনবাবুর সমস্ত বই বাজেয়াপ্ত হোক।

    ডজন তিনেক ভারী বস্তা চারতলার সিঁড়ি দিয়া নামাইবার সময় বছর বাইশের এক ভলান্টিয়ার শুধু বলিয়া যায়, 'ওফ, মেসোমশায়, আপনার পেটে পেটে এত?' সুখেনবাবু মাথা নীচু করিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। কিন্তু হাউসিংয়ের সকল সদস্য ইহা দেখিল। এই ঘটনার পরে সুখেন-সংস্রব সকলেই এড়াইয়া চলিতেন। বেচারা সুখেন নিঃসঙ্গ হইয়া গেলেন।

    এহেন অগ্নি উৎসবের বার্তা দেশ পার করিয়া বিদেশেও দ্রুত পৌঁছাইয়া যায়। ইউ এন চটিয়া যায়, মার্কিন প্রশাসন বলে পাগলামি, তথাপি কে শুনে কার কথা ? বস্তুত ইহা হিন্দুস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়।

    কিন্তু এতসব সংগৃহীত রকমারি অনৈতিক, অদরকারী কিতাব পুড়িল, তথাপি বই আর শেষ হয় না। সকলে বিস্মিত। এত অনৈতিক ভুষিমাল দেশের ঘরে ঘরে, লাইব্রেরিতে, শপিং মলে, দোকানে, ফুটপাথে মজুত ছিল? তখন জাতীয় ধারার উজ্জীবিত প্রযুক্তিবিদরা এক উপায় বাতলাইলেন। অকস্মাৎ এক ঐতিহাসিক জাতীয় প্রকল্প রচিত হইল। ইহা অভূতপূর্ব এবং বলাই বাহুল্য ইন্ডিজেনাস। হিন্দুজেনাস। চমকপ্রদ। এমনিতেই ফুয়েল কস্ট বাড়িয়া গেছে। বিদ্যুতের খরচও। এইবার নতুন টেকনোলজি আসিবে, নিরন্তর গবেষণাপ্রসূত। সমূহ বই বিকল্প জ্বালানি হিসাবে অতঃপর নানান পাওয়ার প্ল্যান্টে এবং ভেহিকলে ব্যবহৃত হইবে। জিও বিশ্ববিদ্যালয়, যাহা দেশের সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এই দেশাত্মবোধক গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করিল। রিসার্চ চলিতে লাগিল। ফলও হাতেনাতে ফলিল। ইউরেকা রিসার্চার, ভারতবিখ্যাত প্রযুক্তিবিদ, ডক্টর ছাগময়ূররাম জটিল সমস্ত যন্ত্রাদি তৈরি করিলেন। প্রথমে ডিটেনশন ক্যাম্পের রাষ্ট্রহীন নিখরচার নানান বয়সী ভুখা শ্রমিকেরা ভারী পুস্তকসমূহ  ম্যানুয়ালি বা কাতান, কাঁচি ইত্যাদি দিয়া খন্ড বিখন্ড করিবে। ইহার পরে এক ক্রাশার যন্ত্রে প্রথমত ছোট টুকরা হইবে কাগজ ও বাঁধাইমলাট। ধাপে ধাপে আরো দুইটি যন্ত্রে কাগজ আরো ক্ষুদ্র হইবে। অতঃপর আরেকটি অদ্ভুতদর্শন যন্ত্রে এক ভৌতরাসায়নিক ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাগজ মাইক্রন আকারের ট্যালকম গুঁড়ায় রূপান্তরিত হইবে। পেপার-পালভাইরাজেশন এর পর উক্ত গুঁড়া সমূহ ব্লোয়ারবাহিত গরম হাওয়ার মাধ্যমে বয়লারে নিক্ষিপ্তপূর্বক নিমেষে দগ্ধ হইবে। জানা যাইতেছে, কোল-ফায়ার্ড বয়লারের তুলনায় এই বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক কম অর্থে তৈরি হইবে। বস্তুত ফুয়েলের তো খরচই নাই। কাঁড়ি কাঁড়ি কিতাব যত্রতত্র পড়িয়া আছে। বিদেশেও এই যন্ত্র এক্সপোর্ট হইলে দেশীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হইবে, সন্দেহ নাই। হোয়াটস অ্যাপে এই সিস্টেমের নকশা ও অনুপুঙ্খ বর্ণনা ভাইরাল হইয়াছে। গাড়িতে এই প্রযুক্তি এখনো সফল নয়, তবে অচিরেই হইবে। পেট্রোল ও ডিজেল নির্ভরতা কমিবেই কমিবে। অচিরেই পেপার-পাম্প, পেট্রোল-পাম্প সমূহকে প্রতিস্থাপিত করিল বলে। নেতা ধরিয়া অনেকেই আবেদনপত্র জমা দিতেছে। পেপার-পাম্প ডিলারশিপ-লাগি।

    ময়ূররাম তাঁর উদ্ভাবিত মৌলিক গবেষণাপত্র এক ইন্টারন্যাশনাল এলসেভিয়ার জার্নালে পাঠাইয়া দেন। কিন্তু উহার অ্যাবস্ট্রাক্টখানি পড়িয়া নাকি মার্কিনমুলুকের শয়তান এডিটর তাহা পত্রপাঠ বাতিল করেন এবং তাঁকে ইমেইলে জানান― অদূর ভবিষ্যতে এইরূপ রাবিশ মেটেরিয়াল না পাঠাইয়া তাঁর সময় নষ্ট না করিতে। কিন্তু ময়ূর তাতে দমিবার পাত্র নন। রিলায়েন্সের ওপেন অ্যাকসেস ঝিনচ্যাক রঙিন জার্নালে তাঁর গবেষণালব্ধ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। পেটেন্টও পান। অতঃপর তাঁকে প্রধানমন্ত্রী সংবর্ধনা দেন। ময়ূররাম জিরাফের ন্যায় গলা বাড়াইয়া আছেন, প্রযুক্তিবিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার পদ মারিলেন প্রায়। এইসব গোপন তথ্য ও কর্মকান্ড হোয়াটস অ্যাপ নিরন্তর ফাঁস করিয়া দিতেছে।

    তবে ব্যাপক হারে পুস্তকে অগ্নিসংযোগের ধুম মাচাইবার অনতিবিলম্বে শহরের ও গঞ্জের হাসপাতালে অগনিত শিশু ফুসফুসের জটিল ব্যাধি লইয়া ভর্তি হয়। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে ডেঙ্গি কমিয়া যায়। ইহাতে কলিকাতা ও অন্যান্য পুরসভা উপকৃত হয়। ইহার অনতিপরেই অশ্লীল হিন্দুস্তান ঐতিহ্যের পরিপন্থী খাজুরাহোর মুর্তিসমূহ ভাঙিয়া ফেলা হইবে। কেবল ফ্যালফ্যাল করিয়া পাথরকাঠামো দাঁড়াইয়া থাকিবে, মিথুনরত অসভ্য মূর্তিসব গায়েব হইয়া আরবসাগরের মাঝ দরিয়ায় নিক্ষিপ্ত হইবে।

    ঈষৎ লজ্জিত রামলাল যখন ফতুয়ার বোতাম লাগাইতেছিলেন নেতা তাঁকে শুধান, 'আপনি কুন সালে মাধ্যমিক পাস করেন মহোদয়?'

    -'আজ্ঞে ১৯৮৪ সালে।'

    -'যে বৎসর মাগীবাজ নেহরুর চুড়েইল বেটি সর্দারের গুলি খেয়ে মরে যায়?'

    -'আজ্ঞে।'

    'কী আর করবেন। তখন তো সেকুলার জমানা।জাতির কলঙ্ক। ভাষাশিক্ষায় হিন্দি কম্পলসারি হয় নি। যাই হোক রিপোর্ট যাচ্ছে কেন্দ্রে। আপনাদের কেসগুলা লিয়ে জাতীয় কমিটি বসবে। কী বিধান হয় দেখুন। তবে চিন্তা করবেন না। নাগরিক প্রায়র্টি আছে আমাদের। আপনি তো বাংগালি ব্রাহ্মণ আছেন। নোট করা আছে।'

    ইহার পরে নানাবিধ রিপোর্ট জমা পড়ে। জাতীয় ভাষা পরিষদ নড়িয়া চড়িয়া বসে। শিক্ষাবিশারদ, ভাষাবিদ, রাজনীতিকদের মধ্যে তুমুল তর্কবিতর্কের পর চিন্তন-শিবির স্থির করে, 'কমজোরি' প্রবীণ নাগরিকদের জন্য দেশের প্রান্তে প্রান্তে সান্ধ্য হিন্দি শিক্ষার আসর বসিবে। বিনামূল্যে। মহিলাদের জন্য আলাদা। শিশু ও কিশোরদের বিদ্যালয়ে যেহেতু আবশ্যক হিন্দি প্রথম ভাষা হিসাবে প্রতিটি বিদ্যালয়ে রহিয়াছে, তাই বিদ্যালয় লইয়া না ভাবিলেও চলে।

    ইহার পরে ছয় মাস সান্ধ্য ক্লাসে যাইবার পরে রামলালের হিন্দি উচ্চারণ হইতে বাঙালি তোতলামির জড়তাদোষ কাটিল। এখন বাংলা বলিতেই বরং কষ্ট হইতেছে। দোকান যাচ্ছি বলিতে 'দুকান যাচ্ছি' বলিয়া জিভ কাটেন। স্ত্রী হাসেন। স্ত্রীরও কাজ বাড়িয়া গিয়াছে। সিঁদুরের সঙ্গে মঙ্গলসূত্রও পরিতে হয়। একটা ময়দার চালুনি দিয়া তার মুখ দর্শনকরত কারুয়াচক ব্রত পালন করেন স্ত্রী। তথাপি শহরে চাঁদ দেখা যায় না। কিন্তু উপবাস রাখেন স্ত্রী। দেখিয়া কৌতূক জাগে, এই কি তাঁর এম এ পাস, একদা কর্মরতা স্ত্রী?  মঙ্গলসূত্র, জাতীয় নারী আচরণবিধির অন্তর্গত আইনের আওতায় আসিয়া, এখন, কাশ্মীর হইতে কন্যাকুমারী, হলদিয়া হইতে পোরবন্দর অবধি, আবশ্যক পরিধেয়। ইহার লঙ্ঘন বিবাহিতা নারীরা করিলে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হইবার সাড়ে ষোল আনা সম্ভাবনা।  প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা হিসাবে জেলার প্রত্যন্ত, নির্জন সাধ্বী-আশ্রমে গিয়া উপযুক্ত শুদ্ধিকরণের দাওয়াই রহিয়াছে। কিন্তু তাহা ব্যয়সাপেক্ষ। সেখানে গুরু আসেন। মাটির কুটিরে প্রদীপ জ্বলে। নিত্য গুরুসেবায় নিয়োজিত হইতে হয়। গরুর বাঁট হইতে, আঙুলে সর্ষের তেল মাখিয়া, দুধ দুইতে হয়। জঙ্গল হইতে কুটা কুড়াইয়া চোঙা দিয়া চুলা ফুঁকিয়া, ধোঁয়ায় ক্রন্দনপুর্বক ধানসিদ্ধ করিতে হয়। গৃহকর্মের অন্যান্য জরুরী পাঠ রহিয়াছে। গুরু প্রীত হইতে অন্যূন দুই হইতে ছয় মাস সময়কাল লাগে। এপাড়ায় এক মুখরা নারী স্বামীর সঙ্গে যখন তখন বাদানুবাদে লিপ্ত হইত, উপর্যুপরি কয়েকটি নারীআচরণবিধি লঙ্ঘন করিল। এমনকী পরপুরুষের সঙ্গে নাকি প্রকাশ্য দিবালোকে বেহায়ার ন্যায় দরজার কাছে দাঁড়াইয়া গুজগুজ করিত, যা গর্হিত। গুপ্তচরপ্রেরিত গোপন রিপোর্ট দ্রুত যথাস্থানে চলিয়া যায়। জরিমানাপূর্বক উক্ত তরুণী সাধ্বী-আশ্রমে প্রেরিত হইল। ছয় মাস বেচারা স্বামী একাই থাকিল, সঙ্গে দুই বৎসরের সন্তান। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, অমন মুখরা নারী কেমন সিধা হইয়া গেল। ফিরিবার পর কার্যত চুপচাপ প্রাণ ঢালিয়া স্বীয় পতিসেবায় নিয়োজিত থাকিল, পুত্র সন্তানকে সাতিশয় যত্ন করিতে লাগিল। সকলে বলিল, না, মানিতেই হইবে, জাতীয় 'কারীয়ক্রমে'র শ্রেষ্ঠ এই নারীবিষয়ক আইনগুলি। দানবীকে দেবীতে ইহা অনায়াসে রূপান্তরিত করিতে সক্ষম।

    ওই নারীকে রামলালের পত্নী চিনিতেন। তিনি একদিন হাত ধরিয়া বলিলেন, 'বলো না ভাই, একটু সাধ্বী আশ্রমের গল্প। সেখানে কী হয়?'
    মেয়েটি চুপ করিয়া রহিল।
    অনেক সাধাসাধির পরে সে বলিল, 'দিদি। সে যে কী দুর্বিষহ ! সে বলা বারণ। আর নতুন শাস্তির মুখে পড়তে চাই না।'

    এই বলিয়া সে ঝরঝর করিয়া কাঁদিতে লাগিল।

    রামলাল রাস্তা ক্রস করিলেন। একটা অটো আসিয়া থামিল। অটো ড্রাইভার, 'জ্যায় শ্রীরাম' বলিল। রামলাল প্রত্যুত্তর দিয়া অটোতে উঠিতে গিয়া কোমরের ব্যথা চাগিয়া উঠিল। বাড়িয়া গেছে ব্যথা। ঔষধ আছে, তবে নিয়মিত জোগাইতে পারেন না। সরকারি চাকুরী করিতেন। পেনশন বন্ধ। আইন করিয়া পেনশন তুলিয়া দেয় সরকার বছর পাঁচেক পূর্বে। ব্যাংকের গচ্ছিত টাকা তুলিবার পূর্বেই ব্যাংক বন্ধ হইয়া যায়। এল আই সিও একদিন লাটে উঠিল। কন্যার বিবাহ কোনোক্রমে দিয়াছিলেন। এখন কোনোমতে দিনাতিপাত হইতেছে তাঁর ও পত্নীর।

    অটো থামিল। সহযাত্রী দুইজন 'জ্যায় শ্রীরাম' বলিয়া উঠিল। তন্মধ্যে এক বালক। এক মহিলা। ড্রাইভার ও রামলাল যৌথকণ্ঠে 'জ্যায় শ্রীরাম' বলিলেন।

    সিগন্যালে অটো দাঁড়াইল। গান বাজিতেছে- 'ওম জয় জগদীশ হরে, স্বামী জয় জগদীশ হরে।' পাশের মহিলা প্রণাম ঠুকিলেন। রামলাল বালকের দিকে তাকাইলেন। তাহার প্রবাসী নাতি স্মরণে আসিল। আহা, এমনই বয়স। রামলাল শুধাইলেন, 'বাবু, তোমার নাম কী?'

    ছেলেটি একবার তার মায়ের দিকে তাকাইল। মা চোখের ইশারায় সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন, বোধ হইল। ছেলেটি, সাত আট বৎসর, তাহার দিকে ঘুরিয়া বলিল, 'নীলাভরাম রায়।'

    -'ভারী সুন্দর নাম তোমার। কোন ক্লাসে পড়ো?'

    -'ক্লাস ফোর।'

    আরেকটু কথা বলার ইচ্ছা ছিল, তাদের স্টপ আসিয়া গেল, দুই সহযাত্রী নামিয়া গেল।

    নীলাভরাম রায়। রামের গাত্রবর্ণ নীল ছিল। বেশ মানানসই। তথাপি সকলেই নামের সঙ্গে রাম জুড়িয়া দেয় আজকাল। ইহাতে অনেক ঝামেলা এড়ানো যায়। তাঁর নিজের কথাই ধরা যাক। বামালাল বন্দ্যোপাধ্যায় নাম ছিল তাঁর শৈশবে। এই নাম পিতামহী রাখেন। মাধ্যমিকের অ্যাডমিট আসিবার পরে একটি ইংরিজি স্বরবর্ণ বাদ পড়িল। তিনি বামালাল হইতে বামলালে রূপান্তরিত হইলেন। আর সংশোধন করান নাই। সেকুলার ভারতের সেকুলার পশ্চিমবঙ্গের বাম আমলে একবার কলেজে এসএফআই ক্যান্ডিডেট হইলেন। ইহার পরে রটিয়া যায় তিনি কট্টর লাল। তাই তাঁর নাম বামলাল। ইহাতে তাঁর প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল দীর্ঘদিন। ইহার পরে তিনি পার্টির সঙ্গে মনান্তরে স্বীয় পার্টি ত্যাগ করিয়া একদিন জোড়াফুলের মিছিলে হাঁটিতে থাকিলেন। পুরানো বন্ধুরা প্যাঁক দিতে লাগিল। বলিল, স্বার্থলোভে আদর্শ ছাড়িয়া দিলেন। আসলে তাঁর কোনো আদর্শ বা মত ছিলো না। অষ্টাশি সনে অষ্টাশির হুজুগ ছিলো। এগারো সনে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে 'বাঁধ ভেঙে দাও, ভাঙ্গো' বলিয়া বেসুরো চিৎকারেও সেই হুজুগ অব্যাহত ছিল। ইহা এগারোর হুজুগ। অতঃপর তিনি পদ্মহুজুগে মজিয়া যান। ২০১৯ এ তাঁর সম্বিৎ আসিল, যখন ক্যাব লইয়া মাতামাতি, কিছু বিচক্ষণ ব্যক্তি বলিল, এনার্সি যদি বাছিয়া বাছিয়া করা হয়, তোমার নামের কারণে ক্যাম্পে রহিয়া যাইতে পারো। তিনি ক্যাবের সপক্ষে কিছু আমতা আমতা যুক্তি খাড়া করিলেও প্রাণভয় ছিলো।

    অতঃপর তিনি এফিডেফিট করাইয়া নেন। সর্বপ্রচারিত দৈনিকে 'আমি বামলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আজ হইতে রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায় রূপে পরিচিত হইলাম'-মর্মে। পরবর্তী কালে কোনো কথা উঠিলেই বলিতেন প্ৰকৃত নাম তাঁর রামলালই ছিলো। ব-য়ে ফুটকি পড়ে নাই অনবধানে। বাস্তবিক, একটি ফুটকির ত্রুটি সামান্যই ও সহজে মার্জনীয়।

    সিগন্যালে বাজিতেছে-' দেখো অ্যায় দিবানো অ্যায়সা কাম না করো, রাম কা নাম বদনাম না করো।' সহসা, তরুণ বয়সে সেকুলারযুগে দেখা কলারতোলা দেবানন্দ ও রঙিন চশমা পরা ইনোসেন্ট জিনাত আমন স্মরণে আসিল। আহা কালো ভোমরার ন্যায় সেই চোখদুটি ! পরক্ষণেই গাঁজার ছিলিম হস্তে বেলবটম ও টপপরিহিতা উচ্চারণ-অনুচিত, নিকৃষ্ট শ্রেণীর নাগরিক 'জিনাত আমন' স্মরণে আসায় ঈষৎ লজ্জিত হইলেন রামলাল। খানিক গ্লানিও আসিল।

    স্টপ আসিয়া গেছে। নাথুরাম গডসের ছবি সম্বলিত পঞ্চাশের একটি নোট ড্রাইভারের দিকে বাড়াইয়া দিলেন রামলাল।

    যেখানে তিনি নামিলেন সেই সুদীর্ঘ রাস্তার নাম এন জি রোড। এখানে, এই রাস্তার উপরে অবস্থিত একটি অতিকায় মাড়ওয়ারী দোকানে আপাতত খাতা লেখার কাজ করেন সেকুলার ভারতের এমএসসি ফার্স্ট ক্লাস, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত, পেনশনবঞ্চিত, রামলাল বাংগালি। এক বিশেষ আইনবলে, অতি সম্প্রতি, বিস্তর গবেষণার পরে, বাঙালির ব্রাহ্মণত্ব, কায়স্থত্ব ও বৈশ্যত্ব কাড়িয়া নেয় চিন্তন শিবির। দেশে চতুর্বর্ণ স্থাপিত হইয়াছে। সকল বাঙালির পদবী আসলে বাংগালি। প্ৰকৃত প্রস্তাবে সকল কিসিমের বাঙ্গালী আজ হিন্দুস্তানে শূদ্রের স্টেটাস ও সীমিত নাগরিক অধিকার পাইয়াছে। বাঙালির নিজেদের মধ্যে আজ তাই, হিন্দুস্তানে, আইনত জাতপাতের বিভাজন নাই। অপমানে আজ সকলেই সবার সমান।

    এন জি রোড দিয়া, শ্লথ পায়ে, হাঁটিতেছেন এখন রামলাল বাংগালি। পূর্বে এই রাস্তার নাম ছিলো এম জি রোড।

    পূর্বে, অর্থাৎ, সেকুলার ভারতে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ | ২০৫৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • r2h | ***:*** | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৭:২০50926
  • সত্যিই এখন কোনটা সম্ভব কোনটা অসম্ভব গুলিয়ে যাচ্ছে।
  • anandaB | ***:*** | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৮:৩৩50927
  • জাস্ট ব্রিলিয়ান্ট
  • Amit | ***:*** | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৮:৪৮50928
  • অসাধারন। কয়েক বছর পর এটা ডকুমেন্টারি বলে ধরা হবে।
  • প্রতিভা | ***:*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:২৮50929
  • শ্লেষ আর বিদ্রুপ ব্যবহার হয়েছে দুই ধারালো অস্ত্রের মতো। হাসতে গিয়ে ঘেন্না আর ভয়ে ঠোঁটের কোণ বেঁকে যাচ্ছে। অরওয়েলকে মনে পড়ে গেল।
  • | ***:*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৫:৪৪50930
  • গুরু দেব,
  • Phutki | ***:*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৬:২৭50931
  • ভয় পেলাম। সত্যিই ভয় পেলাম।
  • কুশান গুপ্ত | ***:*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:২৮50932
  • খুব ভয় পাচ্ছিলাম। চূড়ান্ত অস্বাচ্ছন্দ্য থেকে এই লেখাটা লিখতে বাধ্য হয়েছি।

    যাঁরা পড়লেন, যাঁরা মন্তব্য করলেন, কৃতজ্ঞতা জানবেন।

    সবাই ভাল থাকার চেষ্টা করুন এই দুঃসময়ে।
  • anandaB | ***:*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:১০50933
  • সত্যি এই লেখাটা চূড়ান্ত অস্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয়

    গত কয়েকদিন ধরে চলতে ফিরতে ওই দৃশ্যটা কুরে কুরে খাচ্ছে, ওই যে একদল লোক ফুটপাতের ওপর চেয়ার টেবিল নিয়ে বসলো এবং ক্যামেরার দিকে মুখ তুলে বললো 'name ?', তার পরেই ইহুদীদের লম্বা লাইন।

    আর কানের কাছে ভেসে আসছে, Ralph Fiennes পূর্ণ সামরিক উর্দি তে সেই অমোঘ ডায়লগ: today is history

    বেঁচে থাকতে এরকম সম্ভাবনা তৈরী হবে, কোনোদিন ভাবি নি
  • Arijit | ***:*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৪:৩৭50934
  • স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাড়া নিস্তার নেই।
  • কুশান গুপ্ত | ***:*** | ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:১৭50935
  • এই লেখা, ঠিক এই লেখা পড়ার জন্যেই অপেক্ষায় ছিলাম।ভয় করছে আর একইসঙ্গে ভালোবাসছি এই লেখাকে
  • ঝরা দে | ***:*** | ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ১০:৫৩50936
  • লেখাটা পড়ে একটা ধারণা পেলাম যে নাৎসি আমলের জার্মানি বা কমিউনিস্ট আমলের চীনে মানুষের কি অবস্থা ছিল বা আছে । ঠিক একটা মারাত্মক দুঃস্বপ্নের মত। হীরক রাজার /রানীর দেশে
  • fn | ***:*** | ২০ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:৪৫50937
  • বেশ লেখা । "পূর্বে এই রাস্তার নাম ছিলো এম জি রোড।" এ শেষ করলে মন্দ হতো না।
  • S | ***:*** | ২০ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৯:২০50938
  • বানানো গল্প বলে মনেই হচ্ছে না।
  • aranya | ***:*** | ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:৩৮50939
  • দারুণ
  • অনিরুদ্ধ | ***:*** | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:০২50940
  • জানিনা হয়তো আমিও বদলে যাচ্ছি। অতি সেকুলারিজমের কুপ্রভাব হতেপারে।
    তবে এর বীজ বপন হয়েছিল ঐতিহাসিক ভূল এর সময়েই।
    আমার কাছে সেটা এখন প্রাগৈতিহাসিক ভুল, কারণ আর বুক ফুলিয়ে বলতে পারি না যে "বামপন্থাই শ্রেষ্ঠ পন্থা"।
    মাফ করবেন যদি কাউকে আঘাত দিয়ে থাকি তো।
  • গবু | ***:*** | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৪২50941
  • শিরশিরে ভাব, আর বমনেচ্ছা! লেখাটা দারুন!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন