সে বেশ কিছুকাল আগে কলকেতায় একটা বায়োস্কোপ এসেছিল—জুরাসিক পার্ক (আমাদের মেটিয়া কলেজ হোস্টেলের জুনিয়ার পাচক শ্রীমান অধিকন্তু পণ্ডা বলত—জোড়াসাঁকো পার্ক—তিনবার দেখেছিল!)। দলবেঁধে ডাইনোসরগোষ্ঠী পায়চারি করত সেথায়… তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিমের মতন টেরোড্যাক্টিলের ডিম পাওয়া যেত ইতিউতি। সে এক জব্বর উদ্যান!
আচ্ছা, আপনি হাড়গিলে দেখেছেন? দেখে থাকলে—শেষ কবে? আমি তো সেই ‘আলিপুর চিড়াইয়াখানায়’ যখন চিড়িয়া-টিড়িয়া থাকত... সেই যুগে দেখেছিলাম। ব্যস... এখন তারা Endangered Species. লিস্টির একেবারে মাথার দিকে লাল কালিতে তাদের নাম লেখেন সাহেবরা। ‘হাড়গিলে’ এখনও বেঁচে আছে প্রায় হারিয়ে যাওয়া মাসি-পিসির ছদ্মরাগের বকুনিতে:
“না খেয়ে-দেয়ে, রোদে ঘুরে ঘুরে একেবারে হাড়গিলের মতো চেহারা বানিয়েছিস!”
অথচ এই হাড়গিলেরা একদিন কলকেতাকে প্রায় ‘জোড়াসাঁকো পার্কে’ পরিণত করেছিল। শুধু কলকেতা নয়—ঢাকা, রেংগুন, গৌহাটি—প্রায় সব ক-টি বড়ো শহরই! তালঢ্যাঙ্গা চেহারা... বগের ঠ্যাং-এর পা... পিঠের ইয়া বঢ়কা পালকগুলিরই যত দ্যাখনশোভা... তারপর সেই যে শাপলার ডাঁটার মতো গলা চলছে তো চলছেই... মাঝে গলকম্বল... শেষ হল গিয়ে কাগের বাসার মতো একমাথা উশকোখুশকো মুণ্ডুতে আর দেড়ফুটিয়া লোহার পাতের মতো চঞ্চুর খাইখাই চাঞ্চল্যে! অনেকটা সুকুমার রায়ের ‘হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রির’ ‘ল্যাগব্যাগার্নিসের’ মতন।
এই হল হাড়গিলে।
কিন্তু স্বভাবটা ছিল গায়ের গন্ধের মতোই বদখদ। গৃ্হস্থ বাড়ি, বাজার, হোটেল, কবরখানা এমনকি ভাগাড়ের চারপাশে ‘মিলিটারি অফিসারের’ কায়দায় হেঁটে বেড়ানো আর সুযোগ পেলেই যে-কোনো খাবার মুখে তুলে... ঘুড়ির তোল্লাই দেবার কায়দায়... এক লাফ! খাদ্যের কোনো বাছবিচার ছিল না বাছার। খেত... একেবারে চেটেপুটে... রাস্তা সাফ করে! সাহেবরা তো বলত Scavenger—ঝাড়ুদার!
শকুনের খাদ্যাভ্যাসও একই রকমের। কিন্তু তারা হাড়গোড়, চামড়া ইত্যাদি ফেলে যায়। আর হাড়গিলে যেন পাখিদের মধ্যে হায়না! কিচ্ছুতেই অরুচি নেই। শক্তপোক্ত হাড়গুলি যেন তাদের Main Course—চোখ বুজে কী আরামে যে চর্ব্য-চোষ্যতে রূপান্তরিত করে—ক্যালিবার আছে মশাই!
১৮২৫ থেকে ১৯২৫—কলকেতা শাসন করত তারা। কাক তখন কাকস্য পরিবেদনার আইটেম! কত লেখা, কত ছবি, ফটো, কার্টুন, কিসসা-কাহানি, কুসংস্কার... লেখাজোখা নেই তার।
বিলিতি Harper’s Magazine-এ ১৮৩০ সালে প্রকাশিত হয়—কলকেতার রাস্তা পরিষ্কারের ছবি। যে সে রাস্তা নয়, এক্কেবারে বড়োলাটের প্রাসাদের সামনে! ভিস্তিওয়ালারা মশকের জলে ধুইয়ে দিচ্ছে রাজপথ আর সামনে ‘মিলিটারি’ পদক্ষেপে চলেছে Greater Adjutant (Leptoptilos dubius)... সাদা বাংলায়--হাড়গিলে।
আরও পুরোনো ছবিতে দেখা যায় তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রকাশ—রাজভবনের মাথায় চড়ে একেবারে সিংহের চোখে চোখ!
এতটাই বাড়-বাড়ন্ত ছিল তাদের যে কলকেতা কর্পোরেশন ১৮৯৬ সালে তাদের Emblem করে ফেলেছিল এই রামপাখিদের বহুদিন পর্যন্ত। আর কেউ যদি ভুলেও মেরে ফেলেছে ওই কর্ন্দপকান্তি রাজসিক পাখিটিকে—হাজতবাস ও পঞ্চাশ টংকা জরিমানা।
এখন যেখানে কাঁটাপুকুর পুলিস মর্গ, একসময় সেখানে ছিল বিরাট ভাগাড়... পাশে গঙ্গার খাল—স্বনামধন্য ছিল সে বিজনস্থান ‘হাড়গিলের ঘাট’ নামে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ১৮৮০ তে লিখলেন ‘দার্জিলিংয়ের পথে’। সেই রাস্তায় তিনি ছোটো রেলগাড়ি চড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠেছিলেন। পথের বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা ঝুপসি পাইন গাছগুলিকে দেখে তার প্রথমেই মনে হয়েছিল... সবকিছু ছেড়ে হাড়গিলে-গুষ্ঠির কথা। (আর জানেন, দু-তিন মাইল দূর থেকে দার্জিলিং-এর রঙিন বাড়িগুলি দেখে মনে পড়েছিল মেঠাইওয়ালার দোকানের রংচং য়ে বরফির কথা! বোঝো!)
হাড়গিলে যে সাপ দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে... সম্রাট বাবর এটি বিলক্ষণ জানতেন। তাই বোধহয় বাজারে চালিয়েছিলেন এক মোগলাই ‘কাহাওয়াত’—হাড়গিলের মাথায়, ঘিলুর ঠিক ওপরে থাকে একটি নীলাভ পাথর—যেটি ছোঁয়ালে যে-কোনো সাপের বিষ অমৃত হয়ে যায়।
এক্কেরে বাদশাহি ঢপ যারে কয় মশয়।
আরও ছিল... বামুন বেঘোরে মরলে নাকি হাড়গিলে হয়। অতেব... ভূতের ছেরাদ্দ লাগাও!
হাড়-গেলা হাড়গিলে কিন্তু এক নিদারুণ Bone of Contention হয়েছিল একবার। ১৯২০ সাল নাগাদ The Englishman পত্রিকা একটি কার্টুন ছাপায়—সঙ্গে আবার নোট!
“ ....all of these facts make it abundantly clear that no human in their right mind ought to invite one to a dinner party. They have no manners, nothing to contribute to polite table conversation, and will gobble your entire roast right up. Do not make the mistake this poor gentleman has made.” —Tomasso Smith, 1920. সাহেবের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে এসেছে এক হাড়গিলে। আদবকায়দা কিছুই জানে না। এসেই হামলে পড়েছে খাবার টেবিলে। একটা আস্ত ‘টার্কি’ মুখে পুরে দিয়েছে বেশরম! সাহেব লাঠি নিয়ে তাড়া করেছে উপায়ন্তর না দেখে... মেম ভয় পেয়ে পর্দানশিন হয়েছে।
বুঝতে অসুবিধে হয় না, এই রূপকটি সাহেবঘেঁসা ইংরেজি জানা বাঙালিদের উদ্দেশ্যেই করা। এই Racial Nonsensical Overture ইয়ং বেঙ্গল সেদিন সোনা মুখ করে মেনে নেয়নি।
গড়পারের মণ্ডা ক্লাবের (Monday Club) আড্ডায় এক সুকুমার মতি যুবকের কলম ঝলসে উঠেছিল এক বিকেলে! ঝরে পড়েছিল সেই আগুন আরও ননসেন্স হয়ে:
“বলব কি ভাই হুগলি গেলুম
বলছি তোমায় চুপি চুপি
দেখতে পেলাম তিনটে শুয়োর
মাথায় তাদের নেইকো টুপি।”
*******
তেনারা একেবারে যে নেই তা নয়। স্বাধীন সরকার বাহাদুর এই কিছুদিন আগেই তো ডাকটিকেট ছাপালেন নানা রং মাখিয়ে। ওপরে ‘হাড়গিলা’ না লিখলে অবশ্য মনে হত ‘বার্ড অব প্যারাডাইস’!
*******
মনের ভেতর একটা প্রশ্ন খলবল করতেই পারে: হাড়গিলের কি সবটাই অধমোচিত... শুধুই চোখের জল আর দুখের শ্বাস? ভালো কিছুই কি নেই? পালক সরালে কিন্তু কিছু ভালোর উল্লেখ পাওয়া যায় সেকালের লেখাগুলির মধ্যে—আজ সেগুলিকে যতই উৎখিচন বলে মনে হোক না কেন!
আপনি যদি হাড়গিলে দম্পতির মৈথুন প্রত্যক্ষ করে ফেলেন বা শীৎকার ধ্বনি শোনেন—আপনার গোলায় লক্ষ্মী প্যাঁচানি বসে গান ধরবেই—গ্যারান্টি! (ওহ হো, বলতে ভুলে গেছি—রামায়ণের সেই ‘ক্রৌঞ্চমিথুনস্য’ মনে পড়ে? Ornithologist-রা যাবতীয় ছানবিন করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ‘ক্রৌঞ্চ’—কোঁচবক নয়—আসলে তে হাড়গিলে !)
হাড়গিলের শুখা মাংস যদি ছোটো ছোটো পিস করে পানপরাগের মতো মুখে রাখতে পারেন (আপনি নন, অন্য কেউ), তাহলে তার কুষ্ঠ পালিয়ে মছলিপট্টনমেও পার পাবে না! তার পালকের (Plumage) দাম ছিল একসময়ে। অতি উমদা পালকের কলম হত তা দিয়ে। বিলেতে তার বাজার ছিল Coonmercoly Pen নামে। (ঢাকার কাছে কুমারখোলি গ্রামের হাড়গিলেদের পাখা ছিল ডাকসাইটে)। হয়তো সেরকম কলমেই জোব চার্নক সাহেব কলকেতার পাট্টায় সইসাবুদ করেছিলেন—কে বলতে পারে?
*******
তাহলে কী দাঁড়াল?
হাড়গিলে বলে অত হতছেদ্দা করবেন না। আর ভুলবেন না, এই রামপাখিটি না থাকলে হয়তো বাল্মীকির প্রতিভা কিংবা সুকুমার রায়ের সেই বাঙালি জাত্যাভিমানে জারিত অমোঘ লিমেরিক—কিছুই পেতাম না আজ।
এই হল হাড়গিলের সাতকাহন। হাড়হদ্দও বলতে পারেন।
এরপরও যদি “আধো জাগরিত তন্দ্রার ঘোরে” দু-একটা হাড্ড-গিলা না দেখেন—সাবেক কলকেতার প্রেস্টিজই থাকবে না মশাই!
খুব সুন্দর লেখা। সত্যিই কিচ্ছু জানতাম না এর সম্পর্কে ঐ মায়ের মুখে শোনা প্রবাদটি ছাড়া।
পড়ে খুব আনন্দ পেলাম যথারীতি। ছোটবেলায় আমি ভাবতাম হাড়গিলে নামটা বোধ হয় আমার জন্যই তৈরি। এসব লেখা যদি আগে পড়তে পেতাম । তবে মেটিয়া কলে জ আর জোড়াসাঁকো পার্কের জবাব নেই।
ধন্যবাদ।
অসাধারণ লেখা।লা জবাব। একটি প্রায় বিলুপ্ত অথবা অধুনালুপ্ত প্রানী যেন আবার প্রাণ ফিরে পেল এই লেখা টি তে। এরকম স্বাদু তথ্য বহু ল লেখা অনেক দিন পড়িনি।
এক ঝুড়ি ধন্যবাদ রইল , দেব ।
অনবদ্য। অসাধারণ লেখা।
Read it, diligently collected information from the bygone era and equally masterly garnished before the reader.
DARUN LAGLO !
শব্দ ব্যবহারে লেখক রম্য রচনাটিকে আরও রমণীয় করলেন
নিজেই কমেন্ট করে যাচ্চেন নাকি? আইপি তো তাই বলচে!
অনেকটা ধন্যবাদ।
বা: পড়ে মুগ্ধ।
হাড়গিলে ঘাটের ছবিটা ১৯০০-এর? মহিলার কাপড় দেখে কনটেম্পোরারি মনে হচ্ছে।
দারুণ লেখা।
Dr.Asok Sengupta | 42.110.143.162 | ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৯:৫৫
Read it, diligently collected information from the bygone era and equally masterly garnished before the reader.
এটা কি মাইরি ??? হ্যা হ্যা নিজের বাংলা লেখায় ইংরিজিতে সাট্টিফিকেট দিতে হচ্ছে? নির্মল নির্মল!
গুরুতর তথ্য, সাহিত্যের ছোঁয়া,ও রসে ভরা এক ঐতিহাসিক লেখা। কি যে ভালো লাগল।
অনেক ধন্যবাদ , নন্দিনী ।
মজার মজার কবিতার উল্লেখ গুরুত্বপূর্ণ লেখাটিকে দারুণ চিত্তাকর্ষক করে তুুলেেছে। আজ সুকুমার রায়ের প্রয়াণদিবসে কি অপূর্ব শ্রদ্ধাঞ্জলি।
একটি অপূর্ব ঐতিহাসিক খোরাক পাওয়া গেচে! কমেন্ট পড়ে হেব্বি আনন্দ পেইচি মোশাই। চালিয়ে যান।
Durdanto lekha.
Onek tothyosamriddho lekha.
Lekhok er roshobodh ebong lekhar haat....proshongsar jogyo.
খুব ভালো লাগল । অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম
অসম্ভব সরস গদ্যে একটি আপাত-নীরস পাখির পর্যবেক্ষণ। ভালো লাগল। কেবল কিছু মন্তব্যকারীর নাম আলাদা হলেও একই আইপি কেন সেটা বুঝতে পারলাম না। যাই হোক, ছোট লেখা কিন্তু ভালো লেখা। ইয়ে মানে কোনও ভাবেই কি প্রনাবির- কেরি সাহেবের রেফারেন্স আসতে পারত না লেখাটায়?লেখা জারি রাখুন।
Khub bhalo laglo . Historical tothyo janachilona.'Hadhavate' Katha ti parichito...kintu baki sab khub interesting.
.
একটা চমৎকার লেখা পড়লাম।খুব ভালো লাগলো।
কিছুদিন হলো আসামের নানা প্রদেশে এই লুপ্তপ্রায় পাখিটির সংরক্ষণের প্রয়াসে 'হাড়গিলা ক্লাব' নামে এক গোষ্ঠী প্রচার শুরু করেছে।
নিশ্চয়ই প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
OSADHARON .
সুকুমার রায়ের ননসেন্স ছড়াটির এই প্রথম ঠিক মানেটা বুঝলাম, স্যার আপনার জন্যই। ♥️♥️
অসাধারণ একটা লেখা।আমার গুরুচণ্ডালি তে আসা সার্থক হল।