“হইচই” মুভি স্ট্রিমে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত “তাসের ঘর” বাংলা ছবিটি নিঃসন্দেহে আট-দশটা বাজারী ছবির ভীড়ে ব্যতিক্রম, একই সঙ্গে ষোল আনা বাঙালিয়ানা, আবার হলিউডি ধাঁচেরও, এর বিভাগ করা যেতে পারে, নাটকীয়, রহস্য, রোমাঞ্চ ইত্যাদি।
যারা ছবিটি দেখেছেন, তারা জানেন, যারা দেখেননি, তাদের জন্য বলছি, এই সিনেমা “পথের পাঁচালী” না হলেও বাংলা ছবির ইতিহাসে নির্ঘাৎ একটি মারাত্মক দাগ কেটে যেতে বাধ্য।
স্বস্তিকা মুখার্জি দুর্দান্ত একক অভিনয়ে পুরো ছবি টেনে নিয়ে যান, বলেন একজন একা, নির্যাতীতা গৃহবধুর কথা। কৌশিক সেনের “টিকটিকি”তে মাত্র দুজন অভিনেতা ছিলেন, দৃশ্যমান এবং ছায়া দৃশ্যমান চরিত্র ছিল পাঁচটি। সেখানে পুরো ছবির শ্যুটিং হয়েছে ড্রইং-ডাইনিং-এ।
“তাসের ঘরেও” প্রায় তাই। স্বস্তিকা মুখার্জি “দুপুর ঠাকুর পো”র সেক্সি ইমেজ ভেঙে এই ছবিতে আটপৌরে শহুরে গৃহবধু “সুজাতা” নামক মেয়েটির দিনের পর দিন গৃহ নির্যাতনের কথা বলে। সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে, দর্শককে উদ্দেশ্য করে দেওয়া বিবৃতি যেন গল্পের ছলে অভিনয়ে মুর্ত করা। উপস্থিত চরিত্র সুজাতা, তার স্বামীর আভাস এবং শয্যাশায়ী খনখনে ডাইনি শাশুড়ি- এই তিনটি মাত্র। অনুপস্থিত চরিত্র—সুজাতার স্বামীর গার্ল ফ্রেন্ড, তার স্বামী এবং পাশের বাড়ির বাচাল মেয়েটি।
এটি আসলে সাদাকালো বাংলায় গৃহবধু নির্যাতন ও তার “অক্ষম প্রতিবাদের” কাহিনী। কেন “অক্ষম প্রতিবাদ”? একটু পরেই তা জানতে পারবেন।
খুব সংক্ষেপে এই হলো ছবির কাহিনী। “তাসের ঘর” ছবিতে স্বস্তিকা মুখার্জি, মানে সুজাতা নামের গৃহবধুটি রিপোর্টাজ ধাঁচে ক্যামেরা, মানে দর্শককে উদ্দেশ্য করে সহজভঙ্গিতে বলা গল্পের সুচনাটুকু অনেকটা এরকম :
“গাছ আমার বড় প্রিয় জানেন? কারণ ওরা কথা বলতে পারে না। কথা কি, আওয়াজই করে না। আমি ভাবি মাঝে মাঝে, ওদের কী ইচ্ছে করে না, একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে? একে অপরকে বুঝতে? সারাক্ষণ চুপটি করে নিজেদের মধ্যে কি করে কে জানে! আমিও একাই থাকি বাড়িতে বেশিরভাগ সময়। একা মানে, একদম একা।…”
“সরি না, একদম একা নয়। ওই পাশের বাড়ির মেয়েটা আসে মাঝে মাঝে গপ্পো করতে। কতো কথা ওর, বাবা! যারা এতো কথা বলে তাদের আমার মোটে পছন্দ হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয়, (দাঁতে দাঁত ঘষে) ওকে একেবারে চুপ করিয়ে দেই। কতোবার কতোভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, ওর সাথে আমার কথা বলতে ভাল লাগছে না, গপ্পো করতে ইচ্ছে করছে না, মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি, কথার উত্তর দিইনি, মুখ ভেঙেওছি, বোঝেই না।…”
“আমি বাবা আমার রান্নাবান্না নিয়ে থাকি। রান্নাবান্না বলতে মনে পড়লো। একদিন একটু সাজুগুজু করতে ইচ্ছে করেছিল বলে নেলপলিশ পরেছিলাম। তারপর আমাদের মেয়েদের যা হয়, একটা হাত হলুদ হয়ে গেল।”
“আরো একটা কথা, রান্নাঘরে যা ইঁদুর হয়েছে না, ভাবতে পারবেন না। সংসার পেতে বসেছে ওরা।”
“রান্নার প্রতি আমার একটা অন্যরকম টান আছে। সেই ছোট্টবেলা থেকে। রান্নাবান্না ছাড়া না, আমার একটা জিনিষ খুব টানে—গন্ধ। সবকিছুর মধ্যে গন্ধ পাই আমি। বাড়িতে যখন একা একা থাকি, এ ঘর ও ঘর করি, গান গাই, (গুনগুন করে, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে) তখন আমি সবকিছুর মধ্যে একাকীত্বের গন্ধ পাই।”…
“আমার হাজবেন্ডের অবশ্য এসব ভাল লাগে না। ওর যে কি ভাল লাগে, কে জানে? আমাকে যে ভাল লাগে না, এইটুকু জানি। আমার সাথে কথা বলে না। সে একদিক থেকে ভালই হয়েছে বরং, বেশী কথা বললে আমি আবার বিরক্ত হই। তারচেয়ে এটাই ভাল না? যে যার নিজের মতো থাকি। একই বাড়িতে, এক ছাদের তলায়, কাছে, তা-ও কতো দূরে। আমিও কথা বাড়াই না। ও ওর মতোন থাকে, আমি আমার মতোন।”…
“(টবের গাছের পাতা শুঁকে নিয়ে) আমার গাছেরা যেমন থাকে, একা একা, কেউ কারো সাথে কথা বলে না, কেউ কারো ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। তাই না, বলুন?”
মুভি ট্রেইলার দেখুন :
তবে এ ছবির পরিনতি মারাত্মক। মুভি ট্রেইলারের শেষ বাক্যও শেষ করা হয়েছে ২০২০ সালকে উল্লেখ করে, “এই বছরটা তো বিষে বিষ!”
লক্ষ্মনীয়, এই ছবি মুক্তির সাথে বাঙালি পুরুষ জাতির শৌর্যবীর্য দিকে দিকে প্রকাশিত হচ্ছে। স্বস্তিকার অভিনয় শিল্প ও কাহিনীর চরিত্রের সাথে মানানসই লকডাউনে ঈষৎ আটপৌরে পোষাক ইত্যাদিতে স্যোশাল মিডিয়ায় রীতিমতো ভার্চুয়াল যৌন হেনস্তার বান ডেকেছে। কেন স্বস্তিকা পোস্টারে অন্তর্বাস ও আঁচল সরে যাওয়া স্তনাভাস দেখালেন, কেন ফেসবুক “হইচই” পেজের বিজ্ঞাপনে তিনি স্মার্ট হেয়ার স্টাইলে নারী মুক্তির কথা বললেন, এ নিয়ে কি বিভৎস ধর্ষমর্ষকামী অগনিত একের পর এক কুৎসিত মন্তব্য।
মনে হয়, এরই প্রতিবাদে ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবি আরো বেশী বেশী করে সারা বিশ্বে প্রচার হওয়া উচিৎ। জাগো নারী, বহ্নিশিখা!
সবশেষ, “তাসের ঘর” নিয়ে বিবিধ বেটাগিরির জবাব দিলেন স্বস্তিকা নিজেই :
ছবিটি দেখবার উৎসাহ পেলাম।
তবে পরিণতিটা না বললেই ভাল হতো বোধহয়।
প্রতিভা দি,
অনেক ধন্যবাদ, তুমিই প্রথম পাঠক, এ এক পরম পাওয়া।
আর ঠিকই বলেছ, সবটুকু বলে দিলে ছবি দেখার মজা থাকে না। তাই সম্পাদনা করে পরিনতিটুকু বাদ দিয়েছি।
#
অফটপিকে, চণ্ডালের এটিই প্রথম চলচ্চিত্র পর্যালোচনা, নইলে মাইনাস সিক্স বাই ফোকালে কতোটুকুই বা আর দৃশ্যমান!
ভালো লিখেছেন বস। লেখার সাথে পুরোপুরি একমত। স্বস্তিকা দুরন্ত অভিনয় করেছেন। এবং চলচ্চিত্রটি তার সব কটি বিভাগেই খুব ভালো হয়েছে।
একলহমা,
সত্যিই ছবিটি উল্লেখযোগ্য, আর চণ্ডালের লেখাটি ভাল লেগেছে জেনেও খুশী হলাম। কিন্তু তাই বলে একেবারে “বস!” কাম সারছে J)
বেশ দূর্দান্ত মুভি।
একটু দেরি বলছি, ধন্যবাদ সপ্তম!