সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত টক্রান্ত বললে একসময় লোকে খুব হাসাহাসি করত। কারণ লাঠিসোঁটা নিয়ে এসে সীমান্তে জমিজায়গা দখল করে না নিলে আর সাম্রাজ্যবাদ হল কোথায় ! খালি চোখে দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায় এমন আগ্রাসনও যে সাম্রাজ্যবাদ, অধুনা কর্পোরেটবাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, একথা মানুষকে বোঝানো যায়নি। লাদাখের প্রত্যন্ত গিরিশিরায় আর কিছুই নেই, শুধু পেট্রল পাম্পে তেল না থাকলেও কোকের বোতল আছে, বিজ্ঞাপনের এই ছবিও যে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কথা বলে এটা মানুষ বুঝতে না পারলে নয়া শিক্ষানীতির সঙ্গে বিশ্ব ব্যাঙ্কের কী যোগ সেটা বোঝার ক্ষেত্রেও ধোঁয়াশা দেখা দেবে।
এসব নিয়ে যাতে কথা না হয়, বিরোধিতার পারদ তুঙ্গে না চড়ে সেজন্যই অতিমারি এবং লক ডাউনের আড়ালে, পার্লামেন্টকে এড়িয়ে এই নতুন শিক্ষানীতি পাস করিয়ে নেওয়া হল। আয়তনে বিশাল, বাইরেটা কথার ফুলঝুরিতে উজ্জ্বল এই নীতিকে টুকরো টুকরো করে বোঝার চেষ্টা হয়েছে। দেখা হয়েছে কী ভাবে স্কুল লেভেল থেকেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে দাস বানাবার যন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। এই নীতির শুরুতেই বলা হয়েছে অতি উচ্চ গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া হবে নার্সারি থেকে ১২ ক্লাস অব্দি ভারতীয় শিশু, কিশোর-কিশোরীকে। বিশ্বব্যাংক ঋণ দেবে, ফলে তার মনমতো করেই তৈরি হল এই পলিসির আগাপাশতলা। তবে টাকা দেওয়া হবে কিন্তু কেবলমাত্র বিশেষ বিশেষ প্রোগ্রামে। তেমনি একটি প্রিয় প্রোগ্রাম STARS যা আগেই চালু করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের মস্তিষ্কপ্রসূত এই ব্যাপারটি কী সেটা অনেকেই জানেন।
সম্পূর্ণ কথাটি হচ্ছে Strenghthening Teaching Learning and Results for States। এই প্রজেক্টের আওতায় প্রাথমিক স্তরে আছে ছ'টি রাজ্য - হিমাচল প্রদেশ, কেরালা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং উড়িষ্যা। এটি প্রাইভেট খেলোয়াড়দের শিক্ষাঙ্গনে নাচানাচি করবার ঢালাও অনুমতি দিচ্ছে এবং সঙ্গে ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজির ওপর প্রচন্ড জোর দিচ্ছে। এই বিরাট দেশে বেশির ভাগ ছাত্রের হাতে একটি স্মার্ট ফোনের আকাল যতই থাকুক না কেন, সেটা কারোরই বিচার্য নয়। উল্টে এইচআরডি মিনিস্টার রমেশ পোখরিয়ালের মতে বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রস্তাবগুলি সবই "rooted in Indian ethos"। অথচ এতেই রয়েছে সমস্ত রকম পরীক্ষা নেবার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে ন্যাশনাল এসেসমেন্ট সেন্টার গঠন। এখন যে অধিকার কেন্দ্রের একেবারেই নেই, সেই স্টেট বোর্ডগুলির বাৎসরিক রিভিউ চালু করবার অধিকার কেন্দ্রকে পাইয়ে দেওয়া। আমাদের দেশে নাকি শিক্ষা রাজ্য ও কেন্দ্রের যৌথ তালিকায় ? এ তো সংবিধান সম্মত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত।
বিশ্ব ব্যাংকের কথায় তৈরি হবে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের শিক্ষাব্যবস্থা ? তারা যে পরিমাণ ঋণ দেবে তা হবে সমগ্র শিক্ষা অভিযানের মোট খরচের মাত্র ১.৪% আর তাদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়বে গ্রামে গ্রামান্তরে ? বাদবাকী ৯৮.৬% টাকা সরকারী কোষাগারের, মানে ও টাকা জনসাধারণের পকেট থেকে আসা। নিজেদের অর্থে নিজেদেরই নয়া দাসত্বের পথ পাকা করতে চলেছি আমরা ? অথচ বিশ্ব ব্যাংক তো কোন আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। তাহলে নয়া শিক্ষানীতির রূপরেখা তৈরি করার অধিকার একে দেওয়া হল কেন ? যার কাজ আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির তাঁবেদারি, শিক্ষার অধিকার খায় না মাথায় দেয় সে স্বাভাবিকভাবেই তা বুঝবে না।
অথচ আশির দশক থেকেই পূর্বতন উপনিবেশগুলিতে বিশ্ব ব্যাংক একটি খেলা শুরু করেছে। সেটি হল সরকারকে পটিয়েপাটিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে খরচ কমানো এবং বেসরকারি লগ্নির অনুমোদন যোগাড় করা। এই বেসরকারি পার্টিদের মধ্যে অলাভজনক (non profit) প্রতিষ্ঠানও আছে। এরা সবাই স্কুল ম্যানেজমেন্ট এবং কার্যকলাপের অঙ্গ হবে। ন্যাশনাল কারিকিউলাম অনুসরণ করলেও নিজস্ব প্রণালীতে তারা শিক্ষণপদ্ধতি চালু করবে। শিক্ষকদের শিক্ষণপদ্ধতিও এর বাইরে নয়। ভারতে বেসরকারি স্কুলগুলির দীর্ঘদিনের দাবী "ভাউচার" পদ্ধতি চালু করা। সরকার মাথাপিছু ছাত্রের জন্য নির্দিষ্ট অংকের ভাউচার দিয়ে তার কর্তব্য শেষ করবে। অভিভাবক ঠিক করবেন সেই ভাউচার তারা সরকারি না বেসরকারি স্কুলে ব্যবহার করবেন। স্কুল পছন্দ করার অধিকার অভিভাবকের। বোঝাই যায় এতে বেসরকারি স্কুলের উল্লাসের কারণ কী। এইভাবে জনগণের টাকা সরকারি ব্যবস্থার উন্নতি করার বদলে প্রাইভেট পকেট ভারী করবে। স্টারস প্রোগ্রাম সে ব্যবস্থা পাকা করে দিয়েছে।
যেটুকু টাকা সরকার দেবে তাও দেওয়া হবে নির্দিষ্ট ছ'টি ফলাফল অর্জিত হল কিনা সেদিকে নজর রেখে। এদেরকে বলা হচ্ছে DLI বা Disbursement Linked Indicators. এই বিচার করার দায়িত্ব থাকবে "স্বাধীন" সংস্থার, যাকে নিযুক্ত করবে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। কোথায় আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ?
নয়া শিক্ষানীতিতে তাহলে প্রাধান্য পাচ্ছে বেসরকারি মাথারা যাদের "non- state actor"নাম দেওয়া হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং সরকারের পোষ্যপুত্র এই "actor" রা কারা ? গাইডলাইনে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে এরা বহুজাতিক কর্পোরেশন, কর্পোরেট লগ্নিকারী বিভিন্ন NGO, সিভিল সোসাইটির ধারকবাহকেরা, অবধারিতভাবে ধর্মীয় সংগঠনগুলি এবং এমনকি ভলান্টিয়ার্স বা স্বেচ্ছাসেবীরা। এক কথায় শিক্ষাক্ষেত্রের যাবতীয় দায়ভার সরকার ছাড়া আর সবার।
আরো আছে। 'সহাবস্থান ও সদর্থক আদানপ্রদানে' অভ্যস্ত করবার জন্য সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের মধ্যে গাঁঠছড়া বাঁধা হবে। একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি স্কুলকে যমজ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হবে। এর ভাল ও নেবে, ওর ভাল এ। সবদিক থেকেই দুটো অসম প্রতিষ্ঠানকে মিলিয়ে দেখার এই প্রবণতা স্বাধীন সংস্থার দ্বারা অনুষ্ঠিত বাৎসরিক চূড়ান্ত বিচার পদ্ধতিকে প্রভাবিত করবে না ? কোন স্কুল ক্রমাগত পিছিয়ে পড়বে তা ভালই আন্দাজ করা যায়। এতো কথা হল, এতো প্ল্যানিং, শুধু সরকারের দায়িত্ব নিয়ে একটি কথাও খরচ করা হয়নি। বেসরকারি স্কুলের তুলনায় সরকারি স্কুল পিছিয়ে পড়লে তাকে টেনে তোলার দায়িত্ব যে সরকারের এই কথাটাই কোথাও বলা হল না।
নার্সারির ওপর এতো জোর দেওয়ার ফল কী হবে তাও আন্দাজ করা যায়। রাজ্যের প্রাইমারি স্কুলগুলোর দুর্দশা সবচেয়ে বেশি বিপদে ফেলেছে যাদের তারা হল গরীব মানুষ এবং গ্রামীণ মানুষ। এদের মধ্যে বেশি সংখ্যক হল শিডিউল কাস্ট এবং ট্রাইবের মানুষেরা, ওবিসিরা, মুসলমান এবং অন্যান্য দরিদ্র গ্রামীণ সম্প্রদায়। শহুরে দরিদ্র, বস্তিবাসীও এই হিসেবের বাইরে নয়। ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি এবং ফেলো-কড়ি-মাখো-তেল স্কুল গজাচ্ছে, গজাবেও, কিন্তু প্রাথমিক পাঠটুকু সেখানে নিজের ঘরের শিশুকে দেবার রেস্তোঁ এদের অনেকেরই থাকবে না। সরকারের কোন দায় নেই, ফলে প্রতিযোগিতায় এঁটে ওঠা দুষ্কর, খুব তাড়াতাড়ি কোনোক্রমে টিঁকে থাকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো মানবসম্পদ মন্ত্রক নিয়োজিত "স্বাধীন" সংস্থার বিচারে ভ্যানিশ হয়ে যাবে। এই বাচ্চারা তখন যাবে কোথায় ?
১৯৯১ সালে নিও লিবেরাল রিফর্ম পলিসির অঙ্গ হিসেবে যখন বিশ্ব ব্যাঙ্ক এদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা এবং রূপরেখা তৈরিতে নাক গলাতে শুরু করে, তখন যে সর্বনাশের মুকুল দেখা দিয়েছিল, আজ এতোদিন পরে কর্পোরেটের কাছে বিকিয়ে যাওয়া একটা ভয়ংকর সময়ে তার পূর্ণ প্রস্ফূটন সম্পূর্ণ হল। প্রথম থেকেই ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সুপারিশ ছিল কর্পোরেট চাকরির বাজারে অন্তহীন শ্রমশক্তি যোগান দেবার পক্ষে। তার জন্য চাই ঢালাও বাজারি শিক্ষাব্যবস্থা, বেসরকারিকরণের রমরমা। ছাত্র এবং অভিভাবক হল গ্রাহক বা কনজিউমার যারা বাজারি শিক্ষাব্যবস্থাকে লগ্নিকারীদের কাছে লাভজনক করে তুলবে। শিক্ষার যাবতীয় ব্যয় আস্তে আস্তে চেপে যেতে থাকে এই গ্রাহকের ঘাড়ে। ওদিকে সরকার ক্রমাগত বাজেটে বরাদ্দ ছাঁটাই করে, কম লাভজনক স্কুলগুলিকে তুলে দিয়ে বা অন্য স্কুলের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে, রাষ্ট্র-পোষিত শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বাজাতে থাকে। নয়া শিক্ষা নীতি ২০২০ হচ্ছে সেই কফিনে শেষ পেরেক। অত্যন্ত চতুর ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে, যারা আবার মোট জনসংখ্যার ৮৫%,বংশানুক্রমিক ভাবে মূর্খ করে রেখে দেবার ব্যবস্থা পাকা। এই পিছিয়ে পড়াদের মধ্যে রয়েছে এসসি, এসটি, ওবিসি, মুসলমান, ডিনোটিফায়েড ট্রাইব, কন্যাসন্তান, ট্রান্সজেন্ডার এবং শারীরিক মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জডরা। একটি "অন্তর্ভুক্তি তহবিল" তৈরির কথা বলা হয়েছে বটে, কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার এই অর্থলোলুপ চরিত্রে তা কতোখানি সাফল্য পাবে বলা খুব মুশকিল।
এইভাবে বিশ্বব্যাংকের মদতে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার পণ্যায়ন করছে এবং শ্রম বাজারের চাহিদা মেটানোই সেই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য। জ্ঞানার্জন, জ্ঞানতৃষ্ণা, বিশ্লেষণী চিন্তাপদ্ধতি, এইসব কথার আর কোনো মানে নেই। আবার একই সময়ে এই গোটা ক্ষেত্রটিই নিজেকে খোলা বাজারে রূপান্তরিত করছে। সেখানে লাভই হচ্ছে একমাত্র মূলমন্ত্র। জ্ঞান, নৈতিকতা, মূল্যবোধ সবকিছু ছাপিয়ে প্রধান হয়ে উঠছে দক্ষতা বা স্কিল। এই বিশেষ দক্ষতার আওতার বাইরে চিরকালই রয়ে যাবে সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধতা বা ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন। এই শিক্ষাব্যবস্থা যে ভারতীয় নাগরিকের জন্ম দেবে তারা শুধু শিখবে দাসত্ব করতে, অর্থনৈতিক এবং কারিগরীপটু এক বিশাল যন্ত্রের নাটবল্টু হতে। নিজস্বতা বিসর্জন দিয়ে তারা পরিণত হবে তাসের দেশের নাগরিকের মতো এক ছাঁচের মানসিক দাসে।
মেরুদণ্ড ক্ষয়ের গুরুতর ষড়যন্ত্র। আর এর প্রথম ও সহজ শিকার হবেন গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ, আদিবাসী ও দলিতরা।
কর্পোরেট যুগে ভালবাসাও নাকি বিনামূল্যে পাওয়া যায় না, সে ক্ষেত্রে ভাউচার ধারণাটি অভিনব বটে!
প্রতিভা দি, আরও লেখ
ম্যাডাম,ত্রিভাষা সূত্রের দিকটা নিয়ে কিছু লিখলেন না?
NEP নিয়ে এতো বলার আছে, যে একবারে হবে না। ত্রিভাষা সূত্র নিয়ে গুরুতে সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাল লেখা বেরিয়েছে।
Modi'fication সম্পূর্ণ প্রায়! কথার ফুলঝুরির আড়ালে সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দিল !!
এবার ছড়াগুলো অল্প বদলে নেওয়া দরকার।
গাড়িঘোড়া আছে যার
লেখাপড়া হবে তার।
অনেকাংশেই একমত। একটি কথা ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট সম্পর্ক। এর ব্যাপক অপব্যবহারের ভয় অবশ্যই আছে। তবে বিভিন্ন স্টেট বোর্ডের মধ্যে কিছু সামন্জস্য আসা ভীষণ জরুরী। পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছি না। কিন্তু অন্যান্য স্টেট বোর্ডের ছাত্রেরা যখন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য আসে, তখন দেখি তাদের মান কি ভীষণ দুর্বল। কত ছাত্র সামলাতে না পেরে পরের বছর ফিরে যায়। এই পার্থক্য স্কুল থেকে শুরু করে পি এইচ ডি পর্যন্ত সব স্তরে।
আর সরকারী স্কুলের প্রসঙ্গে আর আরেকবার তারিফ করি কেজরীওয়াল সরকারের। অসাধ্য সাধিত হয়েছে দিল্লীর সরকারি শিক্ষা ব্যবস্হায়।
শিক্ষ আর স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পুঁজির লোলুপ দৃষ্টি এবং এর চাপ খুব তীব্র। গেরুয়াদলের ক্ষমতায় আসা শুধু ধর্ম আর দেশভক্তির পিঠে চড়ে নয়, অনেকগুলো খাল কেটেই কুমীরকে আনা হয়েছে।
'সোনা পাওয়া গেছে' গোছের হাইপ তুলে মাঝনব্বই থেকে মিলেনিয়ামে নব্য উদারীকরণ মধ্যবিত্তকে ছুটিয়েছে আইটি আর ম্যানেজমেন্টের গোল্ড রাশে। এরপর সব ফাঁকা। মাঝখান দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে কিছুটা প্রত্যক্ষভাবে কিছুটা পরোক্ষভাবে বহু জরুরী জিনিষ কাটছাঁট করে অন্তঃসারশূণ্য স্মার্ট বানিয়ে ছেড়েছে। নব্বইর শেষ দিকে মাশরুমের মত গজানো স্মার্ট শিক্ষার স্বাদবঞ্চিতরা কুলিকামিন হয়েছি, ফ্রন্ট অফিসে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কমফোর্ট পাইনি। অ্যাকাডেমিয়ায় মুখোজ্জ্বল যারা করতে পেরেছেন তাদের কথা আলাদা। এবারের বুদ্ধিমান সরকার তাই চান সবকিছু যেন বাজারের মতিগতি বুঝে চলুক। রেস্ত থাকলে পড়ো, নইলে কুলিকামিন হও। সোজা হিসেব। মাতৃভাষা গৌরবে যতই কলজে ফোলা থাক, সাব-অল্টার্ন ওসবের ধার ধারে না, চায় ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা। চায় দুপুরের খিদের ভাত-খিচুড়ি। একুটু দিতেই সরকারের একের পর এক কেলেংকারি।
কয়েকবছর পরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। মানে পুঁজির সঙ্গে দোস্তি-মিতালি। এবারেররটা একটু ঘটা করে। কারণ করোনা জুজুতে যাদের চাপ সৃষ্টি করার কথা বা সরকারের ঠিক করে দেওয়া স্কোয়ারে জোট বেঁধে স্লোগান দেওয়ার কথা তারাও অসহায়। বাদবাকি টিভি-সংবাদপত্রের কথা বাদ দিলাম। তারা সরকার-পুষ্য। যাহাই বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন। এই যে দিদি এতোটা কষ্ট করে সরকারি সাঁড়াশি আক্রমণের কথা লিখলে, মমতা-সূর্য মহলে সেই মাপের হইচই কই? পড়ুয়ারা করোনার ঝুঁকি নিয়ে পরীক্ষায় বসছে, শীর্ষ আদালতও এতে রাজি। আজব দেশের আজব কথা! (আদালত অবমাননা হয়ে গেল কি?)
পরীক্ষ-পড়াশোনা আজকাল অনলাইন নির্ভর করোনার কল্যাণে। করোনা হটুক তারপরও দেখা যাবে সরকার বাহাদুর এতেই আরও জোর দেবে। ১০ হাজারি মোবাইল, ২০ হাজারি ল্যাপটপ। ডাটা-প্রিন্ট আউট বাবদ আরও মাসিক ২০০০ টাকা (নেটওয়ার্ক কাভারেজ এলাহি ভরসা)। এনসিইআরটি সমীক্ষা জানাচ্ছে কমপক্ষে ২৭% পড়ুয়া অনলাইন ক্লাসের জন্য স্মার্টফোন, ল্যাপটপ অ্যাক্সেস নেই।
ভাষা নীতি নিয়ে পুরোনে একখানা চমৎকার টিভি কাজিয়া দেখলাম। লিংক রইল সবার জন্য।
"এই শিক্ষাব্যবস্থা যে ভারতীয় নাগরিকের জন্ম দেবে তারা শুধু শিখবে দাসত্ব করতে, অর্থনৈতিক এবং কারিগরীপটু এক বিশাল যন্ত্রের নাটবল্টু হতে। নিজস্বতা বিসর্জন দিয়ে তারা পরিণত হবে তাসের দেশের নাগরিকের মতো এক ছাঁচের মানসিক দাসে।"
দুঃখের বিষয় এই ব্যাপারটা এখনই ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রবল | নতুন শিক্ষানীতি তাকে আরো পুষ্ট করবে।
এর পরেও এই নীতিপত্রে সরকার যখন ঘোষণা করেন কয়েক বছরের মধ্যে ভারত শিক্ষাক্ষেত্রে "বিশ্বগুরু" হবে (কথাটি নতুন এডুকেশন পলিসি ডকুমেন্ট থেকে নেওয়া), তখন মনে হয় অকারণ বাকচাতুরি না করে পলিসিগুলো ঠিক মতন চিন্তা ভাবনা করে লিখলে ও কাজে লাগালে ভাল হত।
Onek kichu janlam, khub e valo laglo pore.