এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  বইপত্তর

  • পাঠ অভিজ্ঞতাঃ দ্য সাইলেন্ট ক্রাই

    Anirban M লেখকের গ্রাহক হোন
    বইপত্তর | ১৪ আগস্ট ২০২০ | ৩০২১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মুরাকামির কাফকা অন দ্য শোর (Kafka on the Shore) এর ম- ম করতে থাকা ইউরো-গন্ধ এতটাই হতাশ করেছিল যে  মাঝখানে পড়া থামিয়ে উইকি করে দেখতে হল ভদ্রলোক ইউরোপের বাসিন্দা কিনা। দেখলাম, না! ভদ্রলোক জাপানেই থাকেন, তবে ওনার লেখায় ইউরো-গন্ধ এতটাই সমালোচিত বিষয় যে, এমনকি উইকিতেও তা স্থান করে নিয়েছে। যাই হোক, কাফকা অন দ্য শোর শেষ করার পরে, Goodreads এর সাজেশনে পেলাম দ্য সাইলেন্ট ক্রাই বইটির নাম, লেখক আরেক জাপানী কেনাযাবুরো ওয়ে (ইংরিজি বানান Kenazaburo Oe, এটাই সঠিক উচ্চারণ কিনা জানা নেই)। আমি একটু আধটু সাহিত্য চর্চা করে থাকি, কিন্তু এনার নাম শুনিনি কোনদিন। কিন্তু Goodreads এর ভালো রেটিং ওয়ালা (3.7-4.5, এর বেশী রেটিং পাওয়া বই তেমন ভালো লাগে না দেখেছি!) আমার ভালো লাগে – এই ভরসায় বইটা কিনেই ফেললাম। পরে জেনেছি ভদ্রলোক নোবেল পেয়েছিলেন অনেকদিন আগে, ১৯৯৪ সালে। বইটি লেখা আরও আগে ১৯৬৭ তে।

    এই বইয়ের কাহিনীর কেন্দ্রে আছে দুটি চরিত্র – মিতসু আর তার ভাই তাকাশি। মিতসু  টোকিওতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায় আর অনুবাদকের কাজ করে। সে আর তার স্ত্রী নাতসুমি যে  গভীর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত তার খানিকটা হয়ত যাপন উদ্ভূত, কিন্তু অনেকটাই তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশাহীন “বিশেষ “ সন্তানের জন্য, যে ভর্তি আছে একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে। এরই মধ্যে মিতসু’র বন্ধু (যাকে গোটা উপন্যাসেই বন্ধু বলেই চিহ্নিত করা হয়, কোন নাম ছাড়াই) আত্মহত্যা করে এক আশ্চর্য স্পেক্ট্যাকল তৈরির মাধ্যমে --- সে মুখে লাল রং করে, উলঙ্গ অবস্থায় ঝুলে পড়ে দড়ি থেকে আর তার ঝুলন্ত মৃতদেহের পশ্চাদ্দেশে গোঁজা থাকে একটি শসা! মিতসু-নাতসুমির জীবনের এই অন্ধকার, বিষণ্ণ জীবনে হঠাতই আবির্ভাব হয় মিতসুর ভাই তাকাশির, যে ফেরে আমেরিকা থেকে। জানা যায় তাকাশি একটি কাল্ট চরিত্র, যে আমেরিকা যাওয়ার আগে জাপানের একটি রক্তাক্ত ছাত্র আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল। তাকাশি রোমান্টিক, স্বপ্নপ্রবণ এবং কিছুটা নিষ্ঠুরও। তাকাশির আগ্রহেই মিতসু, নাতসুমি, তাকাশি আর তাকাশির দুই ভক্ত সহযোগী রওনা দেয় তাদের পুর্বপরুষের ভিটের দিকে তাদের পারিবারিক জমিজমা বিলি-বন্দোবস্ত করে আসার উদ্দেশ্যে। তাদের দেশের গাঁয়ে পৌঁছে তারা দেখে যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে কিছু দুঃখী কৃষক, লোকসানে বন্ধ হতে বসা কয়েকটা মুরগির খামার, আর একটি বড় সুপারমার্কেট এম্পেরর, যার কোরিয়ান মালিকের কাছে গ্রামের প্রায় সবার টিকি বাঁধা। গল্পের এই মূল ধারার পাশাপাশি চলে মিতসু আর তাকাশির পারিবারিক ইতিহাস – ১৮৬০ এর এক কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস যেখানে মিতসু-তাকাশির প্রপিতামহ ছিলেন সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে কিন্তু তাঁরই এক ভাই ছিল বিদ্রোহীদের নেতা, যে কিনা তাকাশির স্বপ্নের নায়ক। তাকাশি তাকে আইডলাইজ করে। রাষ্ট্র এই কৃষক বিদ্রোহ দমন করার পরে বহু কৃষকের মৃত্যুদণ্ড হয় কিন্তু প্রপিতামহের ভাইকে পাওয়া যায় না। মিতসুর কাছে এই ভাই তাই এক অবাস্তব স্বপ্নের ফেরিওয়ালা যার রোম্যান্টিক বিপ্লব চিন্তার বলি হয় অনেক কৃষক, কিন্তু সে নিজে গা বাঁচিয়ে পালিয়ে যায়। তাকাশি মানে না এই পলায়ন তত্ত্ব, সে বলে এই ভাই চলে গিয়েছিল জঙ্গলের পথে, নতুন বিপ্লবের খোঁজে। এই টানাপোড়েনের পাশাপাশি সুপারমার্কেট বিরোধী ক্ষোভ কয়ে সামনে রেখে তাকাশি এক নতুন অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে থাকে, সেখানে তার অনুগামীও জুটে যায়। প্রাথমিক ভাবে গ্রামের লোকেদের জয় আসে, অবাধে লুট হতে থাকে সুপারমার্কেটের ভাঁড়ার আর তা বিলিয়ে দেওয়া হতে থাকে গ্রামের গরীব চাষিদের মধ্যে। শুধু মিতসু বলে এই বিপ্লবী রোম্যান্টিকতা অর্থহীন, সে বোঝে বরফ সরে গেলেই রাষ্ট্র তার বাহিনী পাঠাবে আর তখন গ্রামের প্রতিরোধ খড়কুটোর মত উড়ে যাবে। যেখানে পরাজয় নিশ্চিত সেখানে এ যেন আত্মহননের শামিল। কিন্তু এই আত্মহননকে ঘিরেই একটা মরে যাওয়া গ্রাম জেগে ওঠে, বাঁচার ইচ্ছে ফিরে পায় মিতসুর সুরাসক্ত স্ত্রী নাতসুমি। শুধু সংশয়ী মিতসুকে সবাই আলাদা করে দিতে থাকে। কাহিনীর শেষ কিন্তু হয় সেই নিশ্চিত আত্মহননের মধ্যে দিয়েই, কিছু চমকসহ অবশ্যই। কিন্তু  মিতসু জানতে পারে এক নতুন ইতিহাস, বোঝে প্রপিতামহ আর তার ভাই সম্পর্কে সে যা ভেবেছিল তা ভুল। কাহিনীর শেষে টোকিও ফেরার উদ্যোগ নেয় মিতসু আর তার স্ত্রী – কিন্তু তারা সেই মিতসু আর নাতসুমি নয় যারা গ্রামে এসেছিল তাকাশির ডাকে, এখন তারা অন্য মানুষ। 

    আমি এতক্ষণ যা লিখলাম তা শুধুই গল্পের কাঠামো। সে বিষণ্ণতা, অন্ধকার আর আত্নহনন কেনযাবুরো ওয়ে রচনা করেছেন প্রায় তিনশ পাতা জুড়ে তা বইটি না পড়লে অনুভব করা যাবে না। এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের চেনা সমাজের এক আখ্যান, যা আমাদের ইউরো-কেন্দ্রিক পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে অনেকটাই আলাদা। রোম্যান্টিক তাকাশি, বাস্তববাদী মিতসু আর তাকাশির সংক্রামক প্রাণোচ্ছলতায় নতুন জীবন পাওয়া নাতসুমির সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম সন্দীপ, নিখিলেশ আর বিমলাকে। কিন্তু এখানে প্রতিটা চরিত্রই ধূসর, প্রতিটা চরিত্রই আমাদের সমব্যথার ভাগীদার। ওয়ে কি রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন? খুব অসম্ভব নয়, কিন্তু সেই সন্ধান অনর্থক। আমার বরং মনে হচ্ছিল এই মিল যেন আমাদের সাংস্কৃতিক অবিচ্ছিন্নতার প্রকাশ, যা অনেক মাইল আর অনেক বছরের পার্থক্যকেও অনায়াসে জুড়ে দিতে পারে। সেই অবিচ্ছিন্নতার ডানায় ভর করে আমার আরও মনে হচ্ছিল, এ গল্প হতে পারত ২০৭০ সালের কলকাতারও। যে কলকাতায় দুই ভাই ফেরে মুম্বই বা দিল্লি বা নিউ ইয়র্ক থেকে।  ফিরছে তাদের পুরনো জমি-বাড়ির বিলি বন্দোবস্ত করার জন্য। দুজনেই জীবনে বীতশ্রদ্ধ, দুজনেরই রক্তে খেলা করে বেড়ায় অন্তর্গত বিপন্নতা। একজন তাদের মধ্যে চির রোম্যান্টিক, আরেকজন বাস্তবের সাথে সমঝোতা করতে করতে ক্লান্ত। কোলকাতার সাথে তাদের যোগ খুব ক্ষীণ।তারা শুধু জানে একশ বছর আগে তাদের প্রপিতামহের ভাই চলে গিয়েছিল বনে, এক কৃষক বিদ্রোহে শামিল হয়ে। আরে জানে যে তাদের প্রপিতামহ ছিলেন পুলিশ। অনেক তরুণ প্রাণের বিনিময়ে আন্দোলন দমনের পরে খোঁজ পাওয়া যায় নি প্রপিতামহের সেই ভাই-এর। কী হয়েছিল তার? সে কি নতুন পরিচয়ে বাড়ি, গাড়ি করে সুখে ছিল কোন বিদেশী শহরে, নাকি আবারও বন্দুক নিয়ে হারিয়ে গেছিল বস্তারের জঙ্গলে?  আমার মনে হয় সময় ২০৭০ সালের কোলকাতায় এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বসে থাকা কোন তরুণ লেখক অক্ষর জুড়ে চলেছেন একটাই উপন্যাসে যা স্থান, কালের গণ্ডি পার করে ক্রমাগত লেখা হয়ে চলেছে বিভিন্ন লেখকের হাতে।

    The Silent Cry

    Kenzaburo Oe

    First Published in 1967

    Translated in English by John Bester

    Serpents Tail publication


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • বইপত্তর | ১৪ আগস্ট ২০২০ | ৩০২১ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
    আরও পড়ুন
    বটগাছ - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১৭ আগস্ট ২০২০ ১৯:১০96395
  • আরে এমন ইন্টারেস্টিং লেখাটা চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন