

ইনি আসতেন সপ্তাহে তিনদিন। বুধ, শুক্র আর রবি। বুধ আর শুক্র তাঁকে দেখা হত না আমার। রবিবারেও হত না কারণ তখন আমি ভয়ংকর আড্ডা মারতাম।
এঁর কথা আমি প্রথম শুনি আমার মেজদির কাছে। মেজদির কথা আমি আগে লিখেছি। আমাদের ভাইবোনেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত ছিলেন মেজদি আর আমার ন-দা। বাকি পাঁচজন দাদাদিদি শিক্ষিত আর আমিই একমাত্র অশিক্ষিত৷ মেজদি ছিলেন আমার পাড়ার সব কাজের মহিলাদের গার্জেন। কার বাড়িতে কী অসুবিধে, কার বর তাকে রোজ পেটায় এ সবের পরামর্শদাতা ছিলেন আমার অবিবাহিত মেজদি৷ আমাদের সবার অলিখিত গার্জেনও ছিলেন তিনিই৷
একবার, আমাদের বাড়িতে তখন কাজ করে ভগবতী। পুরুষদের মতো কণ্ঠস্বর ছিল তার। তবে প্রায় আমাদের বাড়ির অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল ক্রমেই। বয়সও হয়েছিল বেশ৷ তো ভগবতীর বিয়ের কথা চলছে৷ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে৷ কোথায় দেখানো হবে৷ কেন ভগবতীর মেজমাসি আছে না! বাইরের ঘর সাজানো হল। তারা দেখতে এলেন৷ মিষ্টি-ফিষ্টি আনা হল৷ ভগবতীকে সাজানো হল৷ তারা দেখে চলে যাবার সময় বলে গেলেন, পাত্রী ভালো, তবে বয়সে বেঁটে৷ এই ‘বয়সে বেঁটে’ কথাটা আমাদের বাড়িতে চালু হয়ে গিয়েছিল সেই সময়।
ওই পঁচাশি সাল নাগাদ মেজদি একদিন আমাকে বলল, “রবিবার একটু পরে আড্ডা মারতে বেরোস। তোকে একজনকে দেখাব। পরের রবিবারই আমি প্রথম দেখি তাঁকে৷ খুব রোগা এক বয়স্কা মহিলা। একটা জীর্ণ এবং ময়লা সাদা শাড়ি পরনে৷ মাথা থেকে ঘোমটা পড়ে যায় না তবে ঘোমটা দেবার ধরনটা আমাদের প্রচলিত ধরন নয়। মাথায় একটা ময়লা ঝুড়ি। মেজদি বলল, “এই দ্যাখ, এর কথাই বলছিলাম তোকে। এর নাম সাকিনা। সাকিনা বিবি। গ্রাম থেকে হাঁসের ডিম এনে বিক্রি করে। আমি নিই৷” একগাল হাসলেন সেই মহিলা। ফোকলা৷ কিন্তু কী আন্তরিক ছিল সেই হাসি!! আমায় বললেন খুব মিহি গলায়, “ও মা, তুই আমার এই বুনটার ভাই নাকি? তাহলে তো তুই আমারও ভাই৷”
আমি চিনে ফেললাম সাকিনা বিবিকে৷ বুধবার অফিস যাবার সময় দেখে হত। সেই হতশ্রী ঝুড়ির ভেতর গোটা তিরিশ-চল্লিশটা ডিম নিয়ে আসতেন আমাদের পাড়ায়৷ বিক্রি না হলে মেজদির কাছে রেখে যেতেন আমাদের ফ্রিজে রেখে দেবার জন্য। লেখাই বাহুল্য যে মেজদিকে গুনতে বারণ করতেন। পরে যেদিন আসতেন সেদিন নিয়ে যেতেন সেই ডিমগুলো। সেদিনও গুনতেন না৷ আমাদের বাড়িতে মেজদি ওকে দুটো রুটি আর চা দিত রোজ৷ সেটা খেতে খেতেই মেজদির সাথে গল্প করতেন। বাড়িতে ছেলে আছে দুটো। তিনটে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি শুনতাম মেজদির কাছে।
আমার মেয়েকে দেখে এক ভদ্রলোক, যিনি প্রফেশনাল জ্যোতিষ ছিলেন না কিন্তু মোটামুটি নির্ভুল গণনা করতেন ইচ্ছে হলে, একদিন আমাদের বলেছিলেন এক গরিব মহিলাকে নতুন কাপড় কিনে দিতে। আমাদের মনে হল সাকিনা বিবিকেই দিলে হয়। মেজদিকে বললাম সাকিনাকে জিজ্ঞেস করতে। মেজদি বলল সাকিনা তো আনন্দে কেঁদেই ফেলল তবে ওর একটা শর্ত আছে। শাড়িটা রঙিন দিতে হবে। ওর ছেলের বউ পোয়াতি৷ তাকে দেবে। যেদিন আমাদের মেয়ের হাত দিয়ে শাড়িটা দিলুম, কী হাসি বুড়ির ফোকলা দাঁতে৷ কত আদর করল আমার মেয়েটাকে!!
এর কিছুদিন পরই আমার মেজদির ক্যানসার ধরা পড়ল। থুতনিটা অনেক বড়ো হয়ে নীচের দিকে নেমে এল। মেজদির কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নেই। সেই নিয়েই বাসে শ্যামবাজারে পড়াতে যেত৷ কেউ জিজ্ঞেস করলে বলত, “ক্যান্সার হয়েছে আমার৷” তারা অপ্রস্তুত হতেন৷
প্রথম যেদিন সাকিনা মেজদিকে ওইরকম থুতনি নিয়ে দেখল এবং মেজদির মুখে শুনল যে ওর ক্যানসার হয়েছে সে কী কান্না বুড়ির। শুধু বলে, “ও মা, তাহলে তো তুই বাঁচবি না রে মেয়ে৷” মেজদিই বরং ওকে সান্ত্বনা দিত। এরপরই সাকিনা বিবি এমন একটা কাজ করেছিল যা আমি কোনোদিন ভুলব না। মেজদিকে, যবেই আসত গোটা তিনেক করে ডিম দিত খেতে। পয়সা নিত না। কিছুতেই নিত না৷ বলত, “তোর শরীর খারাপ রে মেয়ে৷ রোজ খাবি একটা করে। দিশি ডিম। উপকার হবে৷” অবাক হতাম। এক হতদরিদ্র গ্রাম্য মহিলা কোন্ মনের জোরে এমন কাজ করতেন!! 
আমার মেজদি খুবই ধর্মপ্রাণা মহিলা ছিলেন৷ সাকিনা বিবি যখন ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিত তখন চুপ করে বসে থাকত মেজদি। আমাদের বাড়িতে শালগ্রাম শিলা আছেন কয়েকশো বছর ধরে৷ মেজদি বড়ো হয়েছেন আমার চেয়েও বেশি ধার্মিক পরিমণ্ডলে৷ তবু সেই সময়গুলোয়, যেদিন আমি বাড়ি থাকতাম, দেখতাম এক উচ্চশিক্ষিত ব্রাহ্মণকন্যা এক অশিক্ষিত গ্রাম্য মুসলিম বৃদ্ধার দোয়া নিচ্ছেন৷ দুজনের কারোরই ধর্ম তাদের এই সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি৷
মেজদি চলে গেলেন মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়েসে৷ পরে এসে সাকিনা বিবির সে কী কান্না!
আর কোনোদিন আমি সাকিনাবিবিকে দেখিনি।
বাংলা গানের চেয়ে এইসব চরিত্রের কথা মনে পড়লে আমার হিন্দি গানের কথা বেশি মনে পড়ে আজকাল। যেমন আজ মনে পড়ছে ‘মুনিমজি’ ছবির একটি গানের কথা। এস ডি বর্মণের সুরে কিশোরকুমার গেয়েছিলেন৷ লিখেছিলেন প্রবাদপ্রতিম কবি শাহির লুধিয়ানভি—
“জীবন কে সফর মেঁ রাহি
মিলতে হ্যায় বিছড় যানে কো
ঔর দে যাতে হ্যায় ইঁয়াদে
তনহাই মেঁ তড়পানে কো।”
সেই তানহাই এর মধ্যেই কখনও এসে পড়েন শচীনবাবু অথবা কখনও এসে পড়েন সাকিনা বিবি।
তখন শক্তিবাবুর কথায় “চক্ষে জল আসে”।
Saoni | 2600:1700:c780:38a0:251e:90d0:9e5a:***:*** | ২৫ জুলাই ২০২০ ১৯:৪৬95507Mon chhuye jaoya ai dharabahik er apekhhay thakbo.
hu | 2607:fcc8:ec45:b800:2960:cc8e:288c:***:*** | ২৫ জুলাই ২০২০ ২১:৫৯95512
গৌতম দত্ত | 103.217.***.*** | ২৫ জুলাই ২০২০ ২২:৩১95514দারুন শুরু বিমোচনদা...আগ্রহ থাকল...
শচীন বাবুর কথা আগেরদিন পড়েছিলাম। আজ পড়লাম সাকিনাবিবির কথা। অপার মুগ্ধতা।
Arnab Das | 2607:fea8:4cdf:9b00:1d16:be7f:b3de:***:*** | ২৯ জুলাই ২০২০ ০২:২১95645পুরানো সেই দিনের কথা
reeta bandyopadhyay | ২৯ জুলাই ২০২০ ১৭:২৪95656চমৎকার শুরু. ..অপেক্ষা করব পরের পর্বের জন্য ।