তখন বয়স কত হবে, বড়জোর তিন কি চার। ঠাকুমা-দিদিমাস্থানীয়াদের মধ্যে অনেকে ঠাট্টা করে বলতেন- "আমার বরটিকে দেখছি না তো, কোথায় গেলেন তিনি? আর তো আলাদা থাকা যাচ্ছে না, এবার আমাদের চারটি হাত এক করো তো বাপু।"
আমি রেগেমেগে একশা হয়ে বলতাম- "আমি কিছুতেই বিয়ে করবো না। কাউকে বিয়ে করব না।"
- "কেন এতজন গিন্নির মধ্যে কাউকে মনে ধরছে না?"
- "না। আমাকে একদম এরকম কথা বলবে না বলে দিলাম।"
ছোটোবেলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল পূজা। একদম শিশুকাল থেকে একই বাটিতে দুধ খেয়ে বেড়ে ওঠা বলা চলে। ও কেমন সুন্দর ফ্রক পড়ে, টিপ পড়ে, চুল বেঁধে খেলতে আসতো আমাদের বাড়ি। আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ওঁর জামা দেখতাম। ও বুঝতে পেরে বলতো- "তুই কি মেয়ে নাকি যে ফ্রক পড়বি...!" ততদিনে আমাকে বলে দেওয়া হয়েছিল ও মেয়ে আর আমি ছেলে। একদিন পূজার মতো বসে টয়লেট করতে গিয়ে মায়ের কাছে বকুনি খেলাম।
- বসে টয়লেট করলে কি হয়েছে? পূজা যে ওমন ভাবে করে...!
-পূজা মেয়ে তাই। তুমি ছেলে।
-কেন আমি ছেলে? কেন আমি মেয়ে হলাম না মা...!
-ঠাকুর যাকে যেভাবে তৈরী করেন, সে তো তেমনটাই হবে। এটা তো আমাদের হাতে নেই।
- কেন আমায় ঠাকুর ছেলে করল? কেন আমায় মেয়ে করে পাঠালো না? আচ্ছা মা, তুমি যে বলো মন থেকে ঠাকুরের কাছে চাইলে সব পাওয়া যায়, সত্যিই পাওয়া যায়?
-হ্যাঁ, একেবারে মন থেকে কিছু চাইলে নিশ্চয়ই পাবি... ঘুমো এবার...
কতদিন রাতে ঘুমোনোর সময় বালিশ ভিজিয়ে প্রার্থনা করেছি, ঠাকুর একটিবার আমায় মেয়ে করে দাও। আমায় কেন সবাই ছেলে বলে? আর কিচ্ছু চাই না। কিচ্ছুটি না...। তারপর ভাবতাম যদি কখনো এমন ম্যাজিক হয় যে, ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি একটা মেয়ে হয়ে গেছি। আর কারোর যদি এটা মনে না থাকে যে আমি কখনও ছেলে ছিলাম, তবে কি ভালোই না হবে...! মনে মনে বলতাম- ঘুম থেকে উঠে যেন দেখি এটা একটা খারাপ স্বপ্ন ছিল ঠাকুর। আমি যেন ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে যাই । অবশেষে নাক টানতে টানতে ঘুমিয়ে পড়তাম....
পূজার পুতুলের জন্য কি সুন্দর সুন্দর জামা তৈরি করে দিতেন কাকিমা। আমি মেলা থেকে বাবার কাছ থেকে বায়না করে বড়জোর খেলনাবাটি অবধি ছাড় পেতাম। পুতুল নৈব নৈব চ। ওর পুতুলগুলোকে নিয়ে একটু খেলার জন্য আকুলিত চিত্তে অপেক্ষা করতাম। রোজ গোল বাঁধতো খেলনাবাটি খেলার সময়, কে বর আর কে বউ হবে তার নিয়ে। ছেলেদেরই বর হতে হবে এই চিরকালীন দস্তুর নাকচ করে দিয়ে তর্ক জুড়তাম- "কেন ছেলে হলেই সবসময় বর হতে হবে কেন? আমি কিছুতেই বর হব না।" তারপর সেই ঝগড়া অমীমাংসিত রেখে দু'জনে বড়দি-ছোড়দি হয়ে ভাই-বোনেদের নিয়ে সংসার পাততাম...।
তখন আমরা গামছা দিয়ে লম্বা বিনুনি বাঁধি। একদিন বিকেলে খেলতে এসে পূজা বলল- " জানিস মা বলেছে এবার থেকে আমি চুল বড় করবো"। আমাদের সেই কত দিনের লম্বা চুলের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আনন্দ ওর চোখে-মুখে...! আমার মুখে আঁধার নামল। ক্রমে সেই চুল কানের পাশ দিয়ে নেমে ঘাড় ছাড়িয়ে ওর পিঠ ছুঁলো। আর আমি নানা টালবাহানা করে দিনের পর দিন পিছিয়েও প্রতিমাসে বাবার সাইকেলের সামনের সিটে বসে, কোনোক্রমে কান্না চেপে সেলুনে যেতে বাধ্য হতাম । সেলুনের কাকুকে বাবার কড়া নির্দেশ ছিল- "যতটা পারো একদম ছেঁটে ছোটো করে দাও।" চুল কেটে আসার পর প্রথম কিছুদিন আয়নার সামনে দাঁড়ালেই চোখ ফেটে জল আসত। এই দুঃখের কথা কখনো কাউকে বলা হয়নি। পূজাকেও না।
ঐ সময় থেকে পূজার ফ্রকের সামনের ঝুলও বাড়তে শুরু করল আর হঠাৎই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দুম করে বন্ধ হয়ে গেল আমাদের খেলনা-বাটির সংসার। দুই বাড়ি থেকেই আমাদের গলা জরাজরি করে খেলা নিয়ে টুকটাক ওজর-আপত্তি আসতো বটে। একদিন আমাদের বাড়ি থেকে খেলে ফিরে পূজা ওর মায়ের কাছে দমাদ্দম পিটুনি খেল। তারপর থেকে আমার আশৈশব সহচরীর সাথে বন্ধুত্ব ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে একটা সময়ে একেবারে ছেদ পড়ল।
একসাথে সর্বক্ষণ লুকোচুরি, ছোঁয়াছুঁয়ি, রান্নাবাটি খেলে, গলা জরাজরি করে গান গেয়ে বেড়ে ওঠা দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধুর মধ্যে পার্থক্য একটাই ছিলো, তার হল আমাদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য। এবং একটা বয়সের পর কেবল দুটো শরীর দুরকম বাঁক নেবে বলে দুটি মনকেও কুঠারাঘাতে আলাদা করা হল। এতে পূজার সাময়িক কষ্ট হলেও তার অন্যান্য বান্ধবীদের সখ্যে নিশ্চয়ই এই বিচ্ছেদে প্রলেপ পড়েছিল। একজন বন্ধু বই ওর তো আর কিছু হারায়নি...! কিন্তু আমি, শৈশব না পেরোতেই তলালাম আরোও গহীন একাকীত্বে...।
অন্যরকম হওয়ার যে অব্যক্ত যন্ত্রণাটা নিজের মধ্যে ছিলো, তা বহুগুণ বেড়ে গেল পারিপার্শ্বিক কারণে। ঠাম্মা বলতেন ভগবান মেয়ে তৈরী করতে করতে ভুল করে ছেলে করে ফেলেছেন। এতদিন ঠাট্টার সুরে বলা এই কথাগুলোই শ্লেষ হয়ে আসতে লাগল। হাঁটা-চলা, কথা বলার ভঙ্গিসহ প্রতিটি আচরণে বাবার ধমক ও অন্যদের কৌতুকে, লজ্জায় নিজের সমগ্ৰ অস্তিত্বটা নিয়ে আরো সিঁটিয়ে যেতে থাকলাম।
মা-ঠাম্মার সঙ্গ ছাড়তে চাইতাম না বলে, ঠাম্মা একদিন এক বাড়ি আত্মীয়-স্বজনের সামনে ঝনঝনিয়ে বললেন- "এই এক ম্যাদামারা ছেলে হয়েছে বটে...! সবসময় মেয়েদের গায়ে গায়ে লেগে থাকা স্বভাব কেন? আর বন্ধুগুলোও জোটায় সব মেয়ে, একটাও ছেলে বন্ধু নেই...! যা বাইরে যা..."
এই আঘাতগুলোর তীব্রতা খানিক থিতু হলে মনে একের পর এক দার্শনিক প্রশ্নের উদয় হতো। কোনটা আমি ? আমার মধ্যে যে চেতন সত্ত্বাটা নিজের ইচ্ছে, অনিচ্ছে, ব্যথা, দুঃখ, যন্ত্রণার কথা জানান দিচ্ছে সে? নাকি বাইরে থেকে সবাই মিলে যে কাল্পনিক চরিত্রটাকে প্রতিমুহূর্তে আমার জন্য নির্মাণ করছে সেটা আমি? এই চরিত্রটির সাথে তো আমার কোনো প্রকাশ মেলে না। বরং এর ভারে ন্যুব্জ হতে হতে আমি আমার ভালোলাগা, পছন্দ-অপছন্দ সব অনুভূতিগুলো হারিয়ে ক্রমশ এক জড়বস্তুতে পরিণত হচ্ছি। যে কেবল মরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই বলে বাঁচছে।
এই মা, বাবা, ঠাম্মা, দাদু বলে যে লোকগুলোকে নিজের বলে জানছি, এঁরা কারা? কোনো এক ভাবে এঁদের মাঝে এসে পড়েছি বটে, কিন্তু এঁদের সাথে তো আমার অনতিক্রম্য দূরত্ব। আমায় বোঝা তো দূরস্থান, অনুভব করার সাধ্যও কারোর নেই। সত্যিই কাছের মানুষ কাকে বলে? বসে বসে ভাবতাম হয়তো আমি কোন অভিশাপগ্ৰস্থা অপ্সরা, কোনো দেবতার রোষে এসে পড়েছি এরকম একটা অপরিচিত জায়গায়, অচেনা লোকদের মাঝে। নিশ্চয়ই অনেক দূরে, অন্য কোনো লোকে আমার আসল বাবা-মা, পরিজনেরা হয়তো আমার শাপমুক্তির অপেক্ষা করছেন। তাঁদের কথা মনে করে অঝোরে ঝরতো দু'চোখ। মনে মনে ঠাকুরকে ডাকতাম, "কবে আমার শাপমুক্তি ঘটবে?"
তারপর মানসপটে ভেসে উঠতো অপূর্ব এক দৃশ্য- অবশেষে এসেছে সেই শাপমুক্তির দিন। হঠাৎ করে আমি রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছি অনুপম সুন্দর এক রমনীতে। পিঠ ছাপানো কেশদাম। আমার পোশাক মহাভারত সিরিয়ালের দ্রৌপদীর মতো। সর্বাঙ্গে মহার্ঘ্য মণি-মুক্তো বসানো অপূর্ব সব গয়না। সবাই অবাক হয়ে যাচ্ছে আমায় দেখে। এমন সৌন্দর্য্য কেউ কখ্খনো দেখেনি। ঠাম্মা, বাবা, মা সবাই চমৎকৃত হয়ে ভাবছে- আমাদের ঘরে এ কোন দেবী জন্মেছিলেন, ইস্ কেন আগে বুঝতে পারিনি...! সবাই মুগ্ধ বিষ্ময়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু আমি তো তখন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আমি না চাইলে আমায় কেউ দেখতেও পাবে না। যত তাঁরা এগোচ্ছেন, আমি তত ওপরে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছি। তারপর অনেকটা ওপরে উঠে শেষবারের মত তাঁদের দেখা দিয়ে নির্লিপ্ত চিত্তে তাঁদের সব অজ্ঞানতা ক্ষমা করে, প্রচুর ধন-সম্পদ দিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছি...। তাঁরা ভুল বুঝতে পেরে কেঁদে আকূল হয়ে আমার কাছে একটিবার দর্শন ভিক্ষা করছেন...।
খানিক বাদে মশার কামড়ে দিবাস্বপ্ন ভেঙে, আমার হাফপ্যান্ট, হাতকাটা গেঞ্জি পরিহিত, ছোটো ছোটো করে ছাঁটা চুলের পার্থিব শরীরটা মালুম হতো। তবু ... ক্ষনিকের ঐ সুখস্বপ্নই তো সম্বল। আমার মনোরাজ্যের একান্ত পরিসরটুকুই ছিল আমার নিজেকে প্রকাশের একমাত্র ক্ষেত্র। সকলের চোখ রাঙানির বাইরে যেখানে নিজেকে একেবারে নিজের মতো করে সৃষ্টি করতে কোনো বাধা নেই। স্বাধীনভাবে বিচরণের এক বিস্তির্ণ চারণভূমি। কল্পনাময় এই জগতই আমার শিশুমনকে সেই সময়কার কঠিন-কর্কশ পরিপার্শ্ব থেকে বাঁচিয়ে সঞ্জীবিত রেখেছিল। যা আমায় এখনও প্রতিকূল বাস্তব থেকে আড়াল করে নিরন্তর বাঁচার রসদ যুগিয়ে চলে।
ঈশ্বর আমাদের অনেক সীমা দিয়ে দেন বটে, কিন্তু তাতে আবদ্ধ করে রাখেন না। তিনি তো আপন মনে নিজের খেয়ালে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন সৃষ্টি করে চলেছেন। এই মুহূর্তে যা সৃষ্টি করছেন, পরমুহূর্তেই তা একেবারে উল্টেপাল্টে নতুন সৃষ্টিতে মাতছেন। এই জগতে কোনো একটি জিনিসের অন্যটি হুবহু নকল মেলে না। সবই স্বতন্ত্র, বিশেষ। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকেই নিজের মতো করে প্রকাশ করার অনন্ত সম্ভাবনা ও অগাধ স্বাধীনতা দিয়ে তিনি তৈরী করেন। কেবল নিজের ইচ্ছাধীন করেই সীমাবদ্ধ, সংকীর্ণ রাখেন না।
কিন্তু এত খাপছাড়া নিত্যনতুন সৃষ্টির সমাহারে বেচারা মানবকূল একেবারে থৈ পায় না। নিজেদের ক্ষুদ্র সীমায়, সীমিত বোধের ছাঁচে সবকিছুকে ফেলে তবে নিশ্চিন্ত বোধ করে। এই অজ্ঞান জাতির বোধে এটুকু কুলোয় না যে, একজন মানুষের সঙ্গে অন্যজনের একটা আঙ্গুলের ছাপও যেখানে মেলে না, সেখানে কোনো একজন গোটা মানুষকে বেশীরভাগের মতো করে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা হীন মুর্খামো ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকেই যাঁরা বেঁধে-ছেঁদে ফুল-বাতাসায় নামিয়ে এনে কেবল স্বার্থসিদ্ধির যন্ত্রে পরিণত করেছে, সেখানে তাঁর সামান্য সৃষ্টি আর কত মর্যাদা আশা করতে পারে...! আমরা যাঁরা অন্তরাত্মার আহ্বান শুনে নিয়ম-নিগরের তোয়াক্কা না করে সগর্বে নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিই, তাঁরাই এই মানবসভ্যতার কাছে বেখাপ্পা, অদ্ভুতুড়ে, কিম্ভুতকিমাকার এক মুর্তিমান দ্রীঘাংচু।
অকপট স্বতস্ফূর্ত লেখা!!
খুবই চমৎকার লেখা। প্রকৃতির নিয়মকে কয়েকটা গতে বাঁধা ফর্মুলায় ফেলেই তো ভাবি আমরা, বা চিরকাল সেটাই ভেবে এসেছি, তার বাইরে কত কিছু যে হতে পারে, যেটা আমাদের সীমিত বোধের বাইরে, সেটা ভাবতে পারি না। আমার চেনার সাথে না মিললেই সেটা হয়ে যায় 'প্রকৃতিবিরূদ্ধ'।
Bhishon bhalo laglo.kii sundor jhorjhore lekha.
একি শেষ হল কেন? আরও কিছু কেন লিখলে না?
সাবলীল লেখা। অন্তরাত্মায়, চেতনার গহনে এই পুরুষ শরীরে নারী কে বহন করা, বাইরের লোকজন একে মনে করে প্রকৃতিবিরুদ্ধ। ট্যাগ লাগানো থাকে জন্মমুহূর্ত থেকে। তারপর এই ধাপে ধাপে নারী হয়ে ওঠার থেকেও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে নারীত্বের প্রমাণ দেওয়া। বিষণ্ণ লাগছে।
অন্যরকম একটা ভাবনা।
অসাধারণ
হ্যাঁ
আত্মপ্রকাশ থেকেই তো আসবে আত্মনির্ভরতা , দেশের কাণ্ডারীও আজ তাই বলছেন
সমান্তরাল... ভালো থেকো গান্ধর্বী
অনেক সুন্দর লেখা