আফিং-এর ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। মুঘল আমল থেকেই আফিং চাষ ও ব্যবসার পুরো ব্যাপারটাই ভীষণ রকম সরকার নিয়ন্ত্রিত। ক্ষমতার হাতবদলের পর কোম্পানি ও ক্রমে পার্লামেন্ট আফিং চাষের পুরো নিয়ন্ত্রণটা পেয়ে গেলো। ফলে আফিং-এর চাষ কমানোর বদলে তরতর করে বাংলায় আফিম বা পোস্তর চাষ বাড়ে ১৮শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে। এর কিছুদিন পর থেকে আফিং চিনে যেতে শুরু করল। চিনে আফিং-এর আমদানি নিষিদ্ধ ছিল প্রায় ১০০ বছর ধরে যদিও গ্রেট ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় মদতে জলপথে চোরাচালান চলত’ই। চিনের সম্রাট লিন আফিং আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করতে চাইলে ব্রিটিশ গানবোটগুলো আফিং পাচারকারী জাহাজের সাহায্যে এগিয়ে এল। সম্রাট লিনের অপসারণের মধ্যে দিয়ে প্রথম আফিং যুদ্ধ মিটল, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই শুরু হল আফিং-এর দ্বিতীয় যুদ্ধ। পার্লামেন্ট এবারও ব্রিটেনবাসীদের বোঝাল এ আসলে মুক্তবাণিজ্য মুক্ত দুনিয়ার স্বার্থে লড়াই। এই যুদ্ধের ফলে ব্রিটিশরা অনিয়ন্ত্রিত আফিং ব্যবসার অধিকারের পাশাপাশি বন্দর নগরী হংকংও পেয়ে যায়। এইসব ভালো কাজে বাগড়া দেওয়ার দুচারজন সবসময়েই জুটে যায়। ব্রিটেনে গড়ে উঠল The Society for Suppression of the Opium Trade (SSOT)। প্রায় দশবছরের লড়াইয়ের পর এঁরা পার্লামেন্টকে বাধ্য করে ফেলেন আফিং জিনিসটার খুঁটিনাটি রিভিউ করতে। সালটা ১৮৯৩। এইসময়ে একই সঙ্গে গাঁজা-চরস-ভাং বেঙ্গল প্রভিন্সে কী ক্ষতি করছে সেইটা দ্যাখার জন্য পার্লামেন্ট মনস্থ করে।
গাঁজা জিনিসটা সেইসময়ে যেহেতু খুব সস্তার নেশা ছিল, সেটা নিয়ে পার্লামেন্ট আগে খুব মাথা ঘামায় নি। মুঘল আমলেও গাঁজার ওপর কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ বসেনি। তবে ১৭৭০-এ কোম্পানি যখন প্রায় দেউলিয়া হয়ে পার্লামেন্টের দ্বারস্থ হয়, বেল আউট প্যাকেজের পাশাপাশি কোম্পানির থেকে লাভ বাড়ানোর অপশনগুলো পার্লামেন্ট বিচার করে। ১৭৯০ এ ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার গাঁজা-চরস-ভাং-এর ওপর ট্যাক্স বসানো হল। এই ট্যাক্স বসানোর ব্যাপারে পরবর্তীকালে কিছু মজার ঘটনা ঘটেছিল। গাঁজা ভাং-এর ব্যাপক ব্যবহারে কালেক্টররা বুঝে উঠতে পারছিল না কীভাবে ট্যাক্সেশন করলে সবচেয়ে বেশি রেভিনিউ আসে। ফলে কখনো দোকানগুলোকে গুণগত তারতম্যে বিক্রির ওপর ট্যাক্স দিতে হয়, কখনো ট্যাক্সের নিয়ম পালটে দৈনিক ফিক্সড ট্যাক্স করা হয়, কখনো দামের ফারাক না দেখে সব ধরণের গাঁজা ভাং-এর ওপর ওজন অনুযায়ী ট্যাক্স ধরা হয়। ১৭৯০ এর নির্দেশনামায় কালেক্টররা সরাসরি ট্যাক্স নিতেন না, নিজের এলাকায় গাঁজা ভাং চরস বিক্রির থেকে জমিদারদের ট্যাক্স কালেক্ট করতে হত। ১৭৯৩ এ ৩৪ নং রেগুলেশন অনুযায়ী কোম্পানির অধীনস্থ এলাকায় গাঁজা ভাং চরস চাষও ব্যবসা করার জন্য আলাদা করে লাইসেন্স বাধ্যতামূলক হয়। বলাবাহুল্য, লাইসেন্সিং ছিল রেভিনিউ আদায় করার সবচেয়ে সহজ পন্থা। লাইসেন্স পাওয়া এবং রাখার জন্য নিয়মিত ফি দিতেই হত। রেগুলেশনের কারণ হিসেবে সেটা উল্লেখও করা হয় যে লাইসেন্সের মাধ্যমে অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কমবে এবং সরকারের অর্থাগমও সম্ভব হবে। ১৮০০ সালে আরেকটা রেগুলেশন বের হয়, যাতে বলা হয় এগুলোর মধ্যে চরস সবচেয়ে ক্ষতিকারক এবং চরস বানানো বা বিক্রি সম্পূর্ণরূপে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। আর মজার ব্যাপার, ১৮২৪এ আরেক নির্দেশনামায় বলা হয় যে গাঁজা বা অন্যান্য নেশার জিনিসের থেকে মেডিকেলি চরসের কোনো বেশি ক্ষতিকারক প্রভাব নেই, ফলে ব্যান তুলে নেওয়া হল। ১৮৪৯এ বেশি আবগারি শুল্ক আদায়ের জন্য খুচরো গাঁজার ব্যবসার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। এই সময় থেকে পরের কয়েক দশক ট্যাক্স দৈনিক হিসেবে হবে না ওজনের ওপর হবে এই নিয়ে বিভিন্ন আইন আসে। ফলে দ্যাখা যাচ্ছে যে কোম্পানির শাসনের আমলে গাঁজা ভাং-এর ব্যাপারে অর্থাগমের সুযোগ নিয়েই বেশি মাথা ঘামানো হয়েছিল। গাঁজা নিয়ে আফিং-এর মতন ব্যবসার সুযোগ ছিল না। কারণ গাঁজা সস্তা, প্রায় ঘরেই চাষ করে ঘরেই খাওয়া যায়, আর লোকে যেরকম সেরকম ভাবে জোগাড় করে নিতে পারে। সুতরাং চাষ আর পাইকারি ব্যবসাতে ট্যাক্স বসানোই এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় ছিল। একই কারণে খুচরো গাঁজার ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণও করতে চেয়েছিল কোম্পানি।
১৮৬১তে শাসন ক্ষমতা সরাসরি পার্লামেন্টের কাছে যায়। প্রায় সারা ভারত ইংরেজদের অধীনে আসে। এবং সিপাহি বিদ্রোহ-উত্তর যুগে ভারতবাসীদের হাল হকিকত নিয়ে ব্রিটিশদের একটু বেশি চিন্তা করতে হয়। এইসময়ে একটা থিওরি খাড়া হতে থাকে যে ভারতীয় সিপাহিদের গুণগত ডিগ্রেডেশনের জন্য গাঁজার নেশা দায়ী। লোকাল অফিসিয়ালরা বারবার এই নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলতে থাকেন। এর মধ্যে একটা তথ্য খুব জোরদার ভাবে উপরমহলের কাছে যায় যে বেঙ্গল প্রভিন্সের পাগলাগারদগুলো সবই গেঁজেলে ভর্তি (পরে এই তথ্যের অসারতা নিয়ে আলোচনা করা হবে)। অন্যদিকে দুটো সমুদ্র পেরিয়ে আমেরিকায় কোকেন-এর ব্যবহার শুরু হয়। মেক্সিকান এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কোকেনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা তৈরি হয়। অনেকক্ষেত্রেই অপরাধমূলক কাজের পিছনে কোকেনের প্রভাব দেখতে শুরু করেন স্থানীয় আইনরক্ষকরা। এর সমান্তরাল টেনে ভারতেও গাঁজা নিষিদ্ধ করার দাবি উঠতে শুরু করে। বিশেষতঃ সেনাপ্রধানদের দিক থেকে এরকম দাবি আসায় ১৮৭৭এ সরকার একটা স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গঠন করতে বাধ্য হন। টাস্ক ফোর্স বলে গাঁজার ওপর ট্যাক্স যত বেশি সম্ভব বাড়ানো হোক। এবং সেটাই ব্যবহার কমানোর একমাত্র উপায়। এবং প্রতিবারের মতন এবারও বলা হল, ব্র্যাকেটের বাইরেই বলা হল যে, ট্যাক্স বাড়ালে হার ম্যাজেস্টির রোজগারও বাড়বে। যাই হোক, এইসব তর্ক বিতর্ক, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং আফিং ব্যবসা বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আফিং-এর পাশাপাশি গাঁজার ব্যবহার নিয়েও পর্যালোচনা করার ব্যাপারে পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৯৩ সালে গঠিত হয় Indian Hemps Drug Commission বা IHDC। প্রথমে শুধু বেঙ্গল প্রভিন্সের জন্য হলেও, লর্ড কিম্বারলির সুপারিশে IHDC এক বছর ধরে সারাভারতে গাঁজার চাষ, ব্যবহার এবং প্রভাব নিয়ে এক অসাধারণ সমীক্ষা চালায়। সেই সময়ের ভারতের ইতিহাসে এরকম নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ সমীক্ষার আর কোনও নজির নেই এবং সম্ভবত গাঁজার ইতিহাসেও আজ অবধি সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা এটিই।
IHDCর প্রেসিডেন্ট ছিলেন পাঞ্জাবের প্রথম ফিন্যান্স কমিশনার ম্যাকওয়ার্থইয়ং, সেক্রেটারি ছিলেন বেঙ্গল প্রভিন্সের অর্থ ও পৌর উপসচিব মিঃ ম্যাকিন্টোস। এছাড়া আরও ছজন সদস্য ছিলেন যার মধ্যে তিনজন ভারতীয়। বাংলা থেকে ভারতীয় প্রতিনিধি ছিলেন তাহেরপুরের রাজা শশীশিখরেশ্বর রায়। উল্লেখ্য, কমিশনের পুরো মেয়াদে ভারতীয় প্রতিনিধিদের উপস্থতিতিই সবচেয়ে কম ছিল। ৩ অগস্ট ১৮৯৩ থেকে ৬ অগস্ট ১৮৯৪-এর মধ্যে IHDC মোট ১১৯৩ জন সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সাক্ষীদের মধ্যে সিভিল সার্ভেন্ট, মেডিকেল অফিসার, প্রাইভেট প্র্যাক্টিশনার, কবিরাজ, হেকিম, গাঁজা চাষী, ব্যবসায়ী, মিশনারিরা ছিলেন। সাক্ষীদের প্রথমে একটি ৭০টি প্রশ্নের প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়। পরে তাদের প্রায় প্রত্যেককে ক্রস-এক্সামিন করা হয়। যাঁরা প্রশ্নের লিখিত উত্তর দিতে পারেন না তাঁদের বিস্তারিত মৌখিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেজন্য কমিশন ভারতের আটটি প্রভিন্সের ৩০টি শহর এবং বার্মা ঘুরে আসে। কমিশন সাক্ষীদের নিয়ে বিভিন্ন দফায় মোট ৮৬ বার বসে এবং মেয়াদের শেষে সাত খন্ডে ৩২৮১ পাতার একটি রিপোর্ট বার করে।
কমিশনের প্রশ্নগুলির মধ্যে কিছু ছিল এই রকম-
ওপরের সবগুলো প্রশ্ন অত্যাধিক গাঁজা-ভাং এর ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্ত করা হয়।
IHDC প্রায় শতিনেক ইউরোপিয়ান ও দেশীয় ডাক্তার, কবিরাজ, হেকিম, পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বলে লক্ষ্য করে যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লোকে পরিমিত গাঁজা সেবনের সঙ্গে শারীরিক অসুস্থতার সংযোগ দিতে পারছেনা। অনেকে পূর্বধারণা অনুযায়ী গাঁজার ক্ষতিকারক দিকের কথা বলছেন আবার কেউ কেউ ম্যালেরিয়া প্রভৃতি রোগের প্রতিষেধক হিসেবে গাঁজার উপকারিতার কথা বলেছেন। কোনও চিকিৎসকের মতে গাঁজা খাবার পর উপযুক্ত প্রোটিন না খেলে অসুখ হতে পারে। কিন্তু, IHDC সিদ্ধান্তে আসে যেপরিমিত গাঁজার নেশার সঙ্গে শারীরিক অসুস্থতার সাধারণ কোনও সম্পর্ক পাওয়া যায় না।
বেঙ্গল প্রভিন্সের সব পাগলাগারদ গাঁজার নেশাড়ুতে ভর্তি এরকম একটা খবর বিভিন্ন মহলে চালু ছিল। ফলে IHDCর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিভিন্ন অ্যাসাইলাম ও মানসিক রোগের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা। কমিশন আটটি প্রভিন্স ও বাংলার সমস্ত পাগলাগারদে গাঁজার নেশার ইতিহাস আছে এরকম রোগীদের তথ্য পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৯২ সালে সবকটি পাগলাগারদ মিলিয়ে ২৩৪৪ জন রোগী আসেন, যার মধ্যে ২২২ জনের গাঁজার নেশার ইতিহাস পাওয়া যায়। কমিশন এনকোয়ারির পর দেখে যে এর মধ্যে মাত্র ৬১টি কেস-এ গাঁজার নেশার ঘটনা রয়েছে, বাকিগুলিকে নিজস্ব ধ্যানধারণা অনুযায়ী ডাক্তার বা পাগলাগারদ কর্তৃপক্ষ গাঁজার জন্য বলে দাগিয়ে রেখেছেন। এই ৬১ জন রোগীর ২২ জনের কোনও বিশদ তথ্য বা ফাইল পাওয়া যায় না। বাকিদের মধ্যে পাগলামির একমাত্র কারণ গাঁজা খাওয়া নাকি আরও কিছু কারণ আছে সেটা স্পষ্ট করা যায় না। সব মিলিয়ে কমিশন দেখে যে গাঁজার থেকে স্থায়ী পাগলামি হয় এরকম সিদ্ধান্তে আসার মত যথেষ্ট তথ্য নেই। এর পাশাপাশি চিকিৎসকরা বাঁদরের মস্তিষ্কের ওপর গাঁজার প্রভাব দেখার পরীক্ষা করেন। যাতে দেখা যায় দীর্ঘদিনের গাঁজা সেবনের ফলে বাঁদরের ব্রেন-এর গঠন পালটায় না। অনুরূপ পরীক্ষায় অ্যালকোহল ও ধুতুরা বাঁদরের মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি করে দেখা যায়। ফলে গাঁজার থেকে পাগলামি অ্যালিগেশন কমিশন প্রায় বাতিলই করে।
একই ভাবে অপরাধ সংগঠন, চারিত্রিক দোষের ক্ষেত্রেও গাঁজার নির্দিষ্ট ভূমিকা প্রমাণ করা যায় না। কমিশন আরও মন্তব্য করে যে অপরাধমূলক প্রবৃত্তির ক্ষেত্রে গাঁজার প্রভাব সম্ভবত মদের থেকে অনেকটা কম।
চূড়ান্ত রিপোর্টে IHDC জানায় যে স্বল্প বা মধ্যম পরিমাণে নিয়মিত গাঁজা ভাং বা চরস নিলে ব্যক্তির কোনও সিরিয়াস ক্ষতি হয় না। অধিক পরিমাণে নিলে হতে পারে, তবে অত্যন্ত বেশি পরিমাণে যে কোনও জিনিস খেলেই তার ক্ষতিকর দিক দেখা যায়। এই অত্যন্ত বেশি পরিমাণ গাঁজা ভাং যাতে লোকে না নেয়, তার জন্য IHDC একটাই পন্থার সুপারিশ করে, যা প্রায় আগের সমস্ত কমিশন ও টাস্কফোর্স করেছিল- ট্যাক্স বাড়ানোর।
তথ্যসূত্রঃ
গাঁজা নিয়ে দেশ তোলপাড়। তাই এটা আবার তুললাম।