“Good travels at a snail's pace….. Those who want to do good are not selfish, they are not in a hurry, they know that to impregnate people with good requires a long time. But evil has wings. To build a house takes time. Its destruction takes none.”- মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, হিন্দ স্বরাজ
এই মুহূর্তে ভারতের এক বিশাল অঞ্চল নাগরিকত্ব সংশোধন বিল প্রসঙ্গে অশান্ত হয়ে উঠেছে। এই প্রথম আমাদের সংসদ সম্ভবতঃ এরকম কোনও আইন প্রণয়ন করল, যার মধ্যে আলাদা করে কয়েকটি ধর্মাবলম্বী মানুষকে সুবিধা দেওয়ার কথা বলা আছে এবং মুসলিমদের সেই আইনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এই আইনের পাশাপাশিই বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠীর এন আর সি নিয়ে বক্তব্য এবং আসামের এন আর সি অভিজ্ঞতা আলোচনায় উঠে আসছে। আমাদের মনে হয়, এই প্রসঙ্গে প্রচলিত নাগরিকত্ব আইন, তার সমস্যার দিকগুলি দেখা দরকার। তেমনিই দেখা দরকার শরণার্থী সমস্যায় বর্তমান সংশোধনীর ভূমিকা কী? এই লেখায় সেই দুটি দিক একটু বোঝার চেষ্টা করলাম, তেমনিই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আলাদা করে কোনও সমস্যা হতে পারে কী না সেই আলোচনাও রইল।
ভারতের নাগরিকত্ব আইন-
ভারত সরকারের ওয়েবসাইটে https://indiancitizenshiponline.nic.in/citizenshipact1.htm লিংকে ১৯৫৫ সালে প্রণীত এই আইনটির ২০০৩ সালের সংশোধিত রূপটি পাওয়া যায়। ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি যখন সংবিধান গৃহীত হয়, সেই মুহূর্তে ভারতীয় ভূখণ্ডের সকল অধিবাসীকে নাগরিক ধরে নিয়ে এই আইনের সূত্রপাত। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পালটায়, ফলে আইনের সংশোধনী দরকার হয় (একথা অস্বীকার করার নয় যে প্রচলিত আইনের সংশোধনী এইসময়েও দরকার ছিল, কিন্তু আমাদের আলোচনা সংশোধনীর চরিত্র নিয়ে)। নাগরিকত্ব আইনে চারভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা বলা আছে, সেগুলি হল-
১) জন্ম-হেতু নাগরিকত্ব- ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাইয়ের আগে এদেশে যাঁরা জন্মেছেন তাঁরা এদেশের নাগরিক। তার পরে জন্মালে ২০০৩-এর সংশোধনী লাগু হওয়ার আগে যাঁরা জন্মেছেন, তাঁদের বাবা-মায়ের একজন এদেশের নাগরিক হলে তবেই তিনি এদেশের নাগরিক। ২০০৩-এর সংশোধনীর পরে জন্মালে বাবা-মায়ের দুজনকেই নাগরিক হতে হবে, অথবা একজন নাগরিক, কিন্তু অন্যজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন, এরূপ হতে হবে।
অর্থাৎ শরণার্থী পরিবারে কেউ ১৯৮৭-র পরে এদেশের মাটিতে জন্মালেও তাঁর নাগরিকত্ব প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে!
২) বংশপরিচয়ে নাগরিকত্ব- যেসব ভারতীয়রা দেশের বাইরে যাচ্ছেন, তাঁদের সন্তানরা যাঁরা দেশের বাইরে জন্মাচ্ছেন জন্যেই মূলতঃ এই ধারাটি। এই ধারার মধ্যে কিছু সমস্যাজনক বিষয় আছে, যা বর্তমান পরিস্থতিতে অত গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে আলোচনার বাইরে থাকল
৩) নথিভুক্ত করণের দ্বারা নাগরিকত্ব- যাঁরা উপরের দুই ধারায় নাগরিকত্ব পেলেন না, তাঁরা একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা ভারতে কাটানোর পর নিজেদের নাগরিক হিসেবে নথিভুক্ত করতে আবেদন জানাতে পারেন। এই ধারায় ভারতবাসীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বিদেশি বা ভারতীয় বংশের (যিনি নিজে বা যাঁর বাবা মা, ১৯৪৭-এর আগে অবিভক্ত ভারতে বা ১৯৪৭এর পরে ভারতভুক্ত হওয়া ভূখণ্ডে জন্মেছেন) বিদেশিরা কয়েকবছর দেশে থাকার পর নাগরিকত্ব পেতে পারেন। শরণার্থীদের এই ধারায় নাগরিকত্ব দেওয়ার উপায় সংশোধনীতে রয়েছে। উল্লেখ্য, এইখানে একজনকে আবেদন করতে হবে যে তিনি সাধারণভাবে নাগরিক নন, এবং বৈধভাবে এই দেশে নির্দিষ্ট কিছু বছর অতিবাহিত করেছেন। বিশেষ ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্কদের এই ধারায় নাগরিকত্ব দেওয়া যায়। কিন্তু, যাঁর নাগরিকত্ব আগে খারিজ হয়েছে তিনি এই ধারার সুবিধা পাবেন না।
৪) ন্যাচারাইজেশন- প্রাপ্তবয়স্ক, বৈধভাবে দেশে আসা বিদেশিরা ন্যাচারালাইজেশনের জন্য আবেদন করতে পারেন, যেই আবেদনের ভিত্তিতে সরকার তাঁকে ন্যাচারাইজেশনের সার্টিফিকেট দেবেন। সেই ন্যাচারাইজেশনের ভিত্তিতে তিনি নাগরিকত্ব পেতে পারেন। এই ধারায় আবেদন করার আগে ভারতে থাকার কোনও পূর্বনির্ধারিত সময়ের কথা বলা নেই।
লক্ষ্যণীয়, তিন এবং চার নম্বর ধারায় বিদেশ থেকে আসা শরণার্থীরা নাগরিকত্ব পেতে পারেন। কিন্তু, তাঁদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে, যেখানে প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা বৈধ ভাবে এদেশে আছেন। এবং আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তাঁদের নাগরিকত্ব গণ্য করা হবে আবেদন মঞ্জুর হওয়ার দিন থেকে।
এর পাশাপাশি দুটো জিনিস উল্লেখ্য- ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তি অনুযায়ী নাগরিকত্ব আইনের যে সংশোধন হয় সেই অনুসারে ১৯৬৬-র ১লা জানুয়ারির আগে বাংলাদেশ থেকে আসামে আসা সমস্ত লোকের ভারতীয় নাগরিকত্ব সিদ্ধ হয়। ১৯৬৬-র পরে যাঁরা আসেন তাঁদের একাংশকে বিদেশি ট্রাইবুনাল হয়ে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হয়। আর, ২৫শে মার্চ ১৯৭১-এর পরে বাংলাদেশ থেকে আসামে আসা মানুষের নাগরিকত্বের সংস্থান হয় না এবং তাঁদেরকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বা বিদেশি বলে ঘোষিত করা হয়। লক্ষ্যণীয়, ২৫শে মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, যার ফলে এককোটির বেশি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আসেন।
নাগরিকত্ব আইনের পাশাপাশি বিদেশি চিহ্নিত করার আইনও দেখা দরকার। ১৯৪৬-এর ব্রিটিশ শাসকদের হাত ধরে আসা আইন অনুসারে একজন যে বিদেশি নয় সেইটা প্রমাণ করার দায়িত্ব সেই ব্যক্তির ছিল। এই আইনের ফলে, সংখ্যালঘুদের নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে (বিশেষতঃ আসামে), ১৯৮৩ সালে ইল্লিগাল মাইগ্রেশন (ডিটারমিনেশন বা ট্রাইবুনাল) বা IMDT আইন প্রচলন হয়। এই আইনে একজনকে বিদেশি হিসেবে অভিযুক্ত করলে তা অপ্রমাণের দায় আর সেই ব্যক্তির থাকল না বরং পুলিশ এবং অভিযোগকারীকে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রমাণ দিতে হতো। বিদেশি আইনের ফলে সাধারণ গরিব মানুষের নির্যাতন অনেকটাই কমাতে সক্ষম হয়েছিল এই IMDT আইনটি। এই আইনের ফলে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোখা যাচ্ছেনা বলে সর্বানন্দ সোনোয়ালের করা একটি মামলার ভিত্তিতে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা আইনটি বাতিল করা হয়। ফলে, একজন যে বিদেশি নন, সেই প্রমাণের দায়িত্ব তাঁর ঘাড়েই পড়ে। অর্থাৎ দেশের যেকোনও মানুষকে নাগরিকত্ব আইনের ধারা অনুযায়ী তথ্য পেশ করতে হতে পারে, বিদেশি হওয়ার অভিযোগ এলে। মুম্বাই হাইকোর্টের একটি রায় অনুযায়ী আধার, ভোটার কার্ড বা রেশন কার্ড এর জন্য পর্যাপ্ত নয়, নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী জন্মের শংসাপত্র, ভারতে বৈধভাবে আসার কাগজ, রেজিস্ট্রেশন, ন্যাচারাইলেজশন ডকুমেন্ট ইত্যাদি লাগবে। IMDT আইন বিলোপের ফলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ‘বাংলাদেশে’ ফেরৎ পাঠানো সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে ২০১২ সালে তদানীন্তন সরকার স্বীকার করে যে এই প্রসঙ্গে ধর্মীয় বা ভাষিক পরিচয়ে চিহ্নিত করণ ভারতের সংবিধানের মূল ধারাকে লঙ্ঘন করবে। (https://www.thehindu.com/news/national/committed-to-deporting-illegal-migrants-but-only-lawfully-centre/article3747019.ece)
এইবার দেখি বর্তমানে প্রবর্তিত নাগরিকত্ব সংশোধনীর বিতর্কিত আইনটি- এই আইনবলে ২০১৪র ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টধর্মালম্বী যাঁরা ভারতে এসেছেন, তাঁদের আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করা হবে না। এবং তাঁরা মূল নাগরিকত্ব আইনের ধারা মেনে নথিভুক্তিকরণ বা ন্যাচারেলাইজেশনের মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এবং এঁদের ভারতে থাকার প্রয়োজনীয় সময়কালেও কিছু হ্রাস করা হল। (http://egazette.nic.in/WriteReadData/2019/214646.pdf)
এই আইন প্রসঙ্গে তিনটি জিনিস লক্ষ্যণীয়, তিনটিই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-
১) ভারতের সীমানায় থাকা তিনটি মুসলিম দেশ থেকে অমুসলিম শরণার্থীদের এই অধিকার দেওয়া হল
২) এতদিন অবধি এঁদের 'অবৈধ অনুপ্রবেশকারী' গণ্য করা হচ্ছিল, যা এখন থেকে রদ করা হল
৩) এঁদেরকে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। আসাম সংশোধনীতে উল্লেখিত ১৯৬৫-র ডিসেম্বরের মতন কোনও একটি ভিত্তিবর্ষ থেকে এঁদের নাগরিকত্ব স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরা হয় না। - এইটা পরবর্তী আলোচনায় আমরা গুরুত্ব দেব।
এইবার আমাদের শরণার্থী সংক্রান্ত আলোচনায় ঢোকা দরকার, যেখানে এই প্রচলিত নাগরিকত্ব আইন, তার গলতাগুলি এবং বর্তমান সংশোধনীর প্রসঙ্গ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে।
ভারতের শরণার্থী সমস্যা-
শরণার্থী সমস্যা যেকোনও রাষ্ট্রের কাছেই অনেকগুলি দিক থেকে বিবেচনার বিষয়। আমরা হালে দেখছি ইউরোপের জাতীয় রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে এই প্রশ্নে যে আফ্রিকার দেশগুলি থেকে আসা শরণার্থী এবং অভিবাসীদের সঙ্গে কীরূপ ব্যবহার করা হবে। মেক্সিকান অভিবাসী নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের অবস্থান ও সেই সংক্রান্ত বিতর্কও স্মর্তব্য। এমন কী বাংলাদেশেও রোহিংগা শরণার্থীদের নিয়ে বিতর্ক চলছে। নাগরিকত্ব আইনের বর্তমান সংশোধনী বা CAAতে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের শরণার্থীদের কথা বললেও সেই দেশগুলির বাইরে তিব্বত (চিন), শ্রীলঙ্কা কিম্বা উগান্ডা থেকেও লক্ষাধিক শরণার্থী বিভিন্ন সময়ে ভারতে এসেছে। শরণার্থী কিম্বা বিদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত, রাষ্ট্রীয় নীতির প্রয়োজন হলেও, এটির মধ্যে সামাজিক উপাদান যথেষ্ট ভাবে কাজ করে। কোনও শরণার্থী বিদেশের মাটিতে কতটা গৃহীত হবে, তা নির্ভর করে বিদেশের সমাজটির উপরও। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, তামিল শরণার্থীদের একাংশের ক্ষেত্রে তামিলনাড়ু বা বাংলাদেশ থেকে আসা উচ্চবর্ণের শরণার্থীদের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ যতটা গ্রহণমূলক মানসিকতা দেখিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালির ক্ষেত্রে আসাম কিমা উত্তর পূর্বের অন্য রাজ্য তা দেখায় নি। ইউরোপের অভিবাসী সমস্যাও, আমরা যদি দেখি, রাষ্ট্রীয় নীতির থেকে বেশি আবর্তিত হচ্ছে সামাজিক সম্মতির প্রশ্ন ঘিরেই। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে সমাজের ভূমিকাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারে না। ১৯৮৫-র আসাম সংশোধনীতে এই স্থানীয় সিদ্ধান্তকে ভারত রাষ্ট্র গুরুত্ব দিয়েছিল, তা দেখাই যাচ্ছে।
পশ্চিম পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে দেশভাগের পরে প্রায় ঝটিকায় জন-বিনিময় হয়েছিল, তার ফলে পাঞ্জাব প্রায় মুসলিমশূন্য আর পাকিস্তান হিন্দু-বিহীন হতে পেরেছিল। এর ফলে দেশভাগের পরবর্তী দশকগুলিতে এই দুই অঞ্চলের মধ্যে শরণার্থী সমস্যা সেভাবে আসে নি। আমাদের সৌভাগ্য যে বাংলায় এই ঝটিকা-জনবিনিময় হয় নি। কারণ, এইটা করতে গিয়ে সেই সময়ে পাকিস্তান ও পাঞ্জাবে বিশাল রক্তক্ষয় হয়েছিল। বিভিন্ন হিসেব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে ২০ লক্ষ অবধি মানুষ মারা গিয়ে থাকতে পারে এই বিনিময়ে। কিন্তু, এই জনবিনিময় না হওয়ায় বাংলায় শরণার্থীদের যাতায়াত অব্যাহত থেকেছে। ১৯৫০ থেকে পাকিস্তান সরকারের বাঙালি বিরোধী নীতির ফলে এবং শেষে ১৯৭১-এ গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য শরণার্থী ভারতে ঢুকতে থাকেন। লক্ষ্য করলে দেখবেন, আসাম সংশোধনীতে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিনটি নাগরিকত্ব না দেওয়ার নিরিখে কতটা গুরুত্ব পেয়েছে!
১৯৫১ সালের সেন্সাস অনুযায়ী ৭২ লক্ষের মতন শরণার্থী দুই পাকিস্তান থেকে ভারতে ঢোকে, ভারত থেকেও প্রায় অনুরূপ সংখ্যায় পাকিস্তানে যায়। কিন্তু এর মধ্যে ২৫ লক্ষ ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা, বরং তুলনায় কম জনঘনত্বের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক বেশি শরণার্থী আসে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আরও ৫০ লক্ষের মতন ১৯৫১-১৯৭১ পর্যায়ে। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আসা এক অব্যাহত প্রক্রিয়া থেকেছে।
লক্ষ্যণীয়, বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের বছরে আনুমানিক এক কোটি শরণার্থী ভারতে আসেন। এঁদের মধ্যে ১৫ লক্ষের কাছাকাছি ছিলেন মুসলিম শরণার্থী। ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে যায় যে যে কারণে তার একটা ছিল এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর চাপ নিতে না পারা। বাংলাদেশে সেইসময় যা হয়েছিল, তাকে আলাদা করে ধর্মীয় নিপীড়ন বলার থেকে বাঙালির জাতিগত হত্যা বলা বেশি সঠিক। কারণ ৩০ লক্ষ নিহতের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম। এছাড়াও খেয়াল করার যে শরণার্থীদের নিয়ে ভারতীয় সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যথেষ্ট প্রবাহিত হয়েছিল এবং সমাজ শরণার্থীদের বিষয়ে সহানুভূতিশীল ছিল। তৎস্বত্ত্বেও নিম্নবর্ণের শরণার্থী (নমঃশূদ্র সহ)-দের অবস্থা যে উচ্চবর্ণের থেকে বেশি খারাপ ছিল, তা মরিচঝাঁপির গণহত্যা ও তার পূর্ব-পশ্চাত দেখলেই বোঝা যাবে। এবং আসামে শরণার্থীদের প্রতি সহানুভূতি কম ছিল। উত্তরপূর্বের অন্যান্য রাজ্যেও প্রতিক্রিয়া মিশ্র ছিল। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষ শরণার্থীদের প্রতি বিরূপ ছিলেন।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা যেহেতু বহুবছর ধরে চলেছে, ভিত্তিবর্ষের নিরিখে অনেকে নাগরিকত্ব না পেলেও, সামাজিক প্রক্রিয়ায় তাঁদের এখানকার বাসিন্দা ছাড়া আর কিছুই এখন ভাবা যায় না। কিন্তু, চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়, নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আইনে এঁদের সুরাহা এতদিন করা হয় নি। সামাজিক প্রক্রিয়া অঞ্চলভেদে পৃথক থাকাতে দেশের অনেক জায়গায় এঁদের হেনস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে, বিশেষতঃ বিদেশি আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়, যার ফলে তিনি যে বিদেশি নন সেটা প্রমাণের দায়িত্ব অভিযুক্তের এবং মুম্বাই হাইকোর্টের রায়, যার ফলে আধার, রেশনকার্ড বা পাসপোর্ট বা ভোটার কার্ডকে আর নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হয় না, প্রভৃতির ফলে এঁদের হেনস্থার সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে গেছে। আসামে এন আর সি তে লক্ষ লক্ষ লোকের নাগরিকত্বের উপরে প্রশ্ন ওঠার পরে এঁদের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলির দিক থেকে আশ্বাসবাণী দেওয়া হলেও বর্তমান সংশোধনীর আগে এঁদের বিশাল অংশকে নাগরিকত্ব দেওয়ার সদর্থক কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। তৎস্বত্ত্বেও, এই বিল অনুযায়ী একটি ভিত্তিবর্ষ ধরে এঁদের নাগরিকত্ব সিদ্ধ করার আইন আসে নি। বরং এঁদের নিজেদের শরণার্থী ঘোষণা করে নাগরিকত্বের আবেদন করতে হবে। ফলে আইন এবং প্রশাসনের আশ্বাসে ভরসা করার জায়গা ছেড়ে এঁরা এখনও বেরোতে পারলেন না।
তুলনায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থী আসার হার অনেকগুণই কম। আফগানিস্তানকে এই সময়ে সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক শরণার্থীর উৎস ধরা হয়, আফগানিস্তান থেকে গত দুইদশকে ৩০ লক্ষের মতন শরণার্থী বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। কিন্তু তার মধ্যে ভারতে এসেছেন কুড়িহাজারের মতন (http://archive.indianexpress.com/news/tough-times-follow-afghan-refugees-fleeing-taliban-to-delhi/1146123)। এই সংখ্যা তিব্বতের শরণার্থীদের থেকে কম তো বটেই, অনেকগুণ কম শ্রীলঙ্কান শরণার্থীদের থেকে। এল টি টিইর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফলে এবং তামিলদের উপর জাতিবিদ্বেষের ফলে শ্রীলঙ্কা থেকে গত কয়েক দশকে লক্ষাধিক তামিল ভারতে এসেছেন, যাঁদের অনেকে এই মুহূর্তে বিভিন্ন ক্যাম্পে জীবন কাটাচ্ছেন এবং মূলধারার ভারতীয় সমাজে পুনর্বাসনের সুযোগ পান নি (http://www.srilankaguardian.org/2009/11/focus-on-sri-lankan-tamil-refugees.html)। এ খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয় যে বর্তমান বিল আফগান শরণার্থীদের নিয়ে বললেও এই বিশাল সংখ্যার তামিল শরণার্থীদের ব্যাপারে বিবেচনা করল না।
নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ২০১৯ - দিশা ও সমস্যা
১) বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার পদ্ধতি আইনে ছিল না। বিশেষতঃ ১৯৭১-এ যে এক কোটির উপর মানুষ ভারতে এসেছিলেন, গত অর্ধশতাব্দীতে তাঁদের নাগরিকত্ব সুরাহা হয় নি। এঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিন্দু, তাঁদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার রাস্তা এই প্রথমবার বেরোল।
২) এঁদের নাগরিকত্ব সরাসরি সিদ্ধ হল না। নিজেদের শরণার্থী ঘোষণা করার পরে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করতে হবে। প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে নিয়ে চলে, বিশেষতঃ স্থানীয় অধিবাসীদের একাংশ তাতে ভাগ নেন। বর্তমান আইনে একাধিক সংঘাতের জায়গা থেকে যাওয়ায় এই প্রক্রিয়া জটিল হওয়ার আশংকা থাকছে। ফলে এই প্রক্রিয়া সংক্রান্ত সরকারি গাইডলাইন, সময়সীমা এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব সিদ্ধ না হলেও এঁদের জীবনযাত্রা ব্যহত না হওয়ার গ্যারান্টি আবশ্যক।
৩) শ্রীলঙ্কা থেকে আসা শরণার্থীদের কথা বিবেচিত হল না। বরং প্রতিবেশী নয়, এমন একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের (আফগানিস্তান) শরণার্থীদের কথা বলা হল। আলাদা করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের অমুসলিম শরণার্থীদের কথা বলা একটা বড়ো সমস্যা এই বিলের। তার অন্য কার্যকারিতে থাকুক বা না থাকুক, এই প্রথম এইভাবে একটি ধর্মের দিকে আঙুল তুলে সরকার আইন প্রণয়ন করছে। এর ফলশ্রুতিতে দেশের মুসলিম সম্প্রদায়, বর্তমান সরকারি প্রক্রিয়াগুলিকে তাদের ধর্মের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনে করতে যেমন পারে, তেমনি মুসলিম দেশগুলির মানুষ সেখানকার অমুসলিমদের প্রতি ভারতের আলাদা ইন্টারেস্ট আছে ভাবতে পারে। উক্ত দেশগুলির বাসিন্দা সংখ্যালঘুদের পক্ষেও এই আইন সুখকর হবে কী না চিন্তার।
এর পাশাপাশি এটাও বলার যে সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম এবং এন আর সি রূপায়ণের আশংকা শ্রীলংকার থেকে আসা তামিল শরণার্থীদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে।
৪) আসাম চুক্তিকে সম্ভবতঃ অমান্য করা হল এই আইনে (https://www.livelaw.in/top-stories/caa-violates-assam-accord-aasu-moves-sc-150785)। আসামের স্থানীয় অধিবাসীদের এক বৃহৎ অংশের চাহিদাকে মান্যতা দিয়া আসাম চুক্তি হয়। এই চুক্তি কিন্তু শুধুমাত্র আইনসভার ব্যাপার নয়। পার্লামেন্ট বা বিধানসভার বাইরে আসামের বাসিন্দাদের প্রতিনিধি হিসেবে আসু-র সঙ্গে ভারত সরকার এই চুক্তি করেছিল। এবং আসামের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে এই চুক্তির মাধ্যমে। ফলে পার্লামেন্টের বাইরে সমাজের যে প্রতিনিধিত্ব তা অস্বীকৃত হল এই আইনে। আসামের বাঙালিবিদ্বেষের পরিমণ্ডলে কেন্দ্রের থেকে এই আইন চাপিয়ে দেওয়ার ফল কী হবে তা নিয়ে আশংকা থাকে। আসাম চুক্তিকে কিম্বা আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর ইচ্ছাকে মান্যতা দিয়ে কীভাবে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়া যায় এবং সামাজিক সুস্থতা বজায় রাখা হয়, তার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা দেখা যায় নি এই পর্যায়ে।
৫) নাগরিকত্বের বিষয়টি যে সব তথ্যের ওপর নির্ভর করছে, তার অনেক কিছুই সাধারণ গরিব মানুষের পক্ষে জোগাড় করা সহজ হবে না। আমাদের দেশে জন্ম নথিভুক্তি বাধ্যতামূলক হয় ১৯৬৯ সালে, কিন্তু ২০০০ সালে রাষ্ট্রসংঘের একটি রিপোর্টে দেখা যায় যে মাত্র ৫৫% জন্ম নথিভুক্ত হয়েছে (http://unstats.un.org/unsd/vitalstatkb/Attachment480.aspx?AttachmentType=1)। এর ফলে নাগরিকত্বের প্রক্রিয়া যত বেশি কাগজ নির্ভর এবং আবেদনের শুনানির ভিত্তিতে হবে গরিব মানুষ তত সমস্যায় পড়বেন। আমরা সকলেই জানি, নাগরিকত্ব সংশোধনের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে এন আর সি প্রক্রিয়া চালু করার কথা হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ লোককে এ আর সি প্রক্রিয়ায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দাগিয়ে দেওয়ার হুমকি বাতাসে ভাসছে।
৬) নাগরিকত্ব নিশ্চিত হলে একজন মানুষ তাঁর যথাযথ অধিকারগুলি পেতে পারেন। এর পাশাপাশি নাগরিকত্বপঞ্জীকরণ বা এন আর সি-র প্রয়োজন মনে করা হচ্ছে দেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বার করে দেওয়ার পথ সুগম করতে। শরণার্থীরা বৈধ কাগজ নিয়ে অন্যদেশে যান না, তাই তাঁদের একাংশকে অবৈধ তকমা থেকে সরাতে এই নাগরিকত্ব সংশোধন আইন। সরকারের দিক থেকে যেহেতু এই আইনের সঙ্গে সঙ্গেই এন আর সি-র কথা আসছে, এইটা বোঝা যাচ্ছে যে অবৈধ অনুপ্রবেশ আটকাতে অনাগরিক দেগে দেওয়ার একটা পদ্ধতি চালু হতে চলেছে। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় বা চিনের তিব্বত আগ্রাসনের সময় ভারত শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে রেখেছিল, সেইটা ব্যতীত বাকি পুরো সময়টা ধরে তো প্রশাসনের তৎপর থাকার কথা অবৈধ অনুপ্রবেশ আটকাতে। অর্থাৎ, অবৈধ অনুপ্রবেশের আসল সূত্র সীমান্তে প্রশাসনিক ব্যর্থতা, কিন্তু সেইটা আটকাতে বিশেষ তৎপরতার কথা এই আলোচনায় আসছে না এ বড় বিস্মুয়ের। সেই প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে লক্ষ লক্ষ লোক, যাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে এই দেশে আশ্রয় নিয়েছেন, এবং দেশটা যখন মানবেতিহাস জুড়ে বিভিন্ন জাতির আশ্রয়শালা হিসেবে খ্যাত, তাঁদের মধ্যে কে কে যুদ্ধের সময় এসেছেন, কে ধর্মীয় নিপীড়নে এসেছেন আর কে একটু ভালো জীবনযাত্রার খোঁজে এসেছেন, এই পার্থক্য করা বাতুলতা ছাড়া আর কী হতে পারে? এ তো সুঁচ বাছতে খড়ের গাদায় আগুন ধরানোর মতন হবে!
সরকারের নিজস্ব রিপোর্টে এই আইনের আশু সুবিধা পাবেন মাত্র ৩০০০০ মানুষ (https://www.firstpost.com/india/how-many-immigrants-will-benefit-from-citizenship-act-25447-hindus-5807-sikhs-55-christians-two-buddhists-and-two-parsis-says-intelligence-bureau-7784581.html), সেখানে শুধু আসামেই এন আর সি তে বাদ পড়েছেন ১৯ লক্ষ লোক। তাই,
এই পদ্ধতিতে অসংখ্য মানুষের অসীম হয়রানি হবে এবং মানুষে মানুষে বিভাজন, স্বার্থ-বিরোধ বেড়ে যাবে। সুতরাং বহু মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আর বিভাজন তৈরি না করে, যাঁরা সমাজের ন্যাচারেলাইজেশনে এই দেশের মানুষ হয়ে গেছেন, তাঁদের ভোটাধিকার কেড়ে, শিবিরবন্দি না করে ভবিষ্যৎ অনুপ্রবেশ রোধে ব্যবস্থা এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে এই বিষয়ে সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরি এবং সেটাই আসল সমাধান।
৭) খুব দরকারি ছিল সেই সমাজগুলি, সেই অঞ্চলগুলির মানুষের মতামত নেওয়া, যাঁরা এঁদের পাশে আছেন থেকেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষকে জায়গা দিয়েছে, এবং এই নাগরিকত্ব আইন, আসাম সংশোধনী, এন আর সি সব কিছুরই লক্ষ যে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষ এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কমই আছে। অথচ ভারতের বাঙালি নাগরিক, যাঁরা এই অনুপ্রবেশের সরাসরি স্টেক-হোল্ডার, তাঁদের মতামত গ্রহণের প্রক্রিয়া নেওয়ার অবকাশ হয় নি। বরং আমরা দেখছি পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, আসাম সহ একাধিক সীমান্ত রাজ্য এই সংশোধনীর বিরোধিতা করছে। সেই বিরোধিতার কারণ বিবিধ, কিন্তু মোট কথা হল মূল স্টেক হোল্ডাররাই সন্তুষ্ট হচ্ছেন না এই সিদ্ধান্তে।
৮) প্রথমেই বলা হয়েছে, শরণার্থী বা অভিবাসীদের সমাজে গ্রহণ করা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া, শুধুমাত্র সরকারি হস্তক্ষেপে সেই প্রক্রিয়া চলতে পারে না। অথচ, বর্তমান আইন সামাজিক দিক থেকে সমস্যাটিকে দেখলই না। বরং সমাজের বিভিন্ন অংশকে পরস্পরবিরোধী স্বার্থে লিপ্ত করে দিল। মুসলিমরা ভাবলেন, এই আইন তাঁদের ধর্মের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ। আসাম ও উত্তরপূর্বের একাংশ ভাবল এই আইন তাঁদের স্বার্থ ও অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে। এবং এও অনস্বীকার্য নয় যে এই আইনে এক বিরাট সংখ্যায় বাঙালির নাগরিকত্ব পাওয়ার দিশা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু, শরণার্থী ও অভিবাসন সমস্যার জটিলতার জন্যে এবং ভারতের বহুভাষিক, বহুধর্মের চরিত্র মেনে এই রকমের সঙ্ঘাত সমাধানের পথকে দুরূহ করে দেবে এই আশংকা হয়। আসামে এন আর সি প্রক্রিয়াতে বিভিন্ন গাফিলতি এবং ত্রুটির কথা ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি। উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া গত পঞ্চাশবছর অবহেলিত হয়েছে একথা যেমন ঠিক, তেমনি এই প্রক্রিয়া যে সরলতর নয় সে কথাও স্বীকার করতে হবে। ফলে যথেষ্ট আলোচনা, সামাজিক সম্মতির দরকার ছিল এই কাজে। বর্তমান শাসক দল তার মুসলিম বিরোধী চরিত্রের জন্য অভিযুক্ত, সেখানে আইনটির সম্পূর্ণরূপে মুসলিম-এক্সক্লুডিং চরিত্র এই সামাজিক সম্মতির উল্টোদিকে দাঁড়ায়।
অর্থাৎ, শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য আইন সংশোধনের জন্য যে আলোচনা, বিবেচনার প্রয়োজন ছিল, যে যে ফ্যাক্টর ধরে ভাবার দরকার ছিল, সেই কাজটি একদমই করা হয় নি। বরং সরকারকে তার এই মেয়াদের শুরুতেই দেখিয়ে দিতে হবে, এই উদ্দেশ্যে অত্যন্ত দ্রুততায় এই আইন পাশ করা হল। তামিলদের কথা বিবেচনা না করা এবং আসাম চুক্তি অগ্রাহ্য করার ঘটনাও এই আলোচনার পরিসরের বাইরে এসে এই অত্যন্ত দ্রুততায় এই আইনের প্রণয়নের ফলেই হল। আমরা দেখছি আলোচনা ও সম্মতিনির্মাণের পদ্ধতি বাদ দিয়ে পার্লামেন্টারি দ্রুততা কীভাবে সারা দেশকে মুহূর্তে অশান্ত করে তুলল। এই দ্রুততার জন্যেই এসে যাচ্ছে এন আর সি করে দেশের অধিবাসীদের একাংশকে চিহ্নিত করার আশংকা, আদালত এবং প্রশাসনের হাতে গরিব মানুষের হয়রানির আশংকা। এবং আরও ভয়ংকর হচ্ছে, এক পক্ষকে আরেকপক্ষের শত্রু বানিয়ে ফেলার সরকারি মদত। আর, সমাজের বিভিন্ন স্তরে আলোচনার সুযোগ দিয়ে, আর কিছুদিন সময় নিয়ে, এন আর সির চোখ রাঙানোর বাইরে এসে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিভিন্ন ভাষা-ধর্ম-জাতি পরিচয়ের শরণার্থীদের জন্য নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের দরকার ছিল। সেই প্রক্রিয়া আরও একটু সময় নিত, সম্ভবত। কিন্তু, দেশের সার্বিক হিতে সেই সময়টুকুর দরকার অবশ্যই ছিল। কারণ ভালো কাজে সময় লাগে।