“আমারে ছাড়া তো কাউরে বিশ্বাস করে না!” - চোখটা রোদে পড়া বালুর মত চিকচিক করতে থাকে। কিন্তু বাদ বাকী দেহটা ঘামে-ঘাসে লেপ্টে-চেপ্টে একাকার, কিছুক্ষণ পর পর ভাজা পাঁপড়ের মত কিছুটা ফুলে উঠে ফের নেতিয়ে পড়ে।
জগত জ্যোতি। বাবা নিরঞ্জন জ্যোতি। বাবা একজন পুরোহিত ছিলেন। সাথে গান লিখতেন ও করতেন! আর হৃদয়ের কী গভীর থেকে নিংড়ে আনা ছিল সেসব শব্দ, পূজক ও পূজারী - দুজনেরই কাঁপুনি ধরে যেত। সেসব কথা মনে করে বড়রা এখনো চোখ মোছেন কাঁধের গামছাটা দিয়ে, আর মুখস্ত থাকা শ্লোকগুলি আওরান আসমানের দিকে চেয়ে চেয়ে! কিন্তু বালক জগতের চোখটা আসমানের দিকে কখনোই ফেরাতে পারেননি বড়রা। বাবাকে হারানোর আগে থেকেই জগতের চোখ আর মন – দুইই পড়ে থাকতো নীচে; তার চোখ চেয়ে চেয়ে দেখতো আদিগন্ত বিস্তৃত এক পৃথিবী, আর তাকে নাড়িভুঁড়ির মত জড়িয়ে থাকা জমি - নরম, পাতলা, গলা - সব খাবলা খাবলা জমি।
‘এই বয়সে এত ছুটাছুটি না করলে হয় না! একটু বিশ্রাম নিতে পারেন তো!‘ আমিই উঠিয়েছিলাম কথাটা। জগত দাদা এসেছিল আমার অফিসে একটি চেক ভাঙাতে। সে প্রায়ই আসে, আর সোজা ঢুকে পড়ে আমার চেম্বারে। সৌজন্য পর্ব বিনিময়ের সুযোগটুকুও মেলে না, তার আগেই জারি হয়ে যায় হুকুম, ‘ম্যানেজার সাব, এসিডা এট্রু বাড়ায় দেন তো! আর একটা কড়া কইরা কফি বানাইতে কন আফনের পিয়নডারে।‘
এই অফিসটাতে জয়েন করেছি ছ মাস, কিন্তু আর কেউ এত সময় ধরে বসে থাকে না আমার চেম্বারে। প্রথম প্রথম আমি ভদ্র সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ইঙ্গিত, মানে, চোখ-মুখ বা হাত-পায়ের অঙ্গ সঞ্চালনে বোঝাতে চাইতাম। কিন্তু সে ছিল এসব কিছুর ঊর্দ্ধে, সবসময়ই কোন এক ধ্যানের জগতে তার বিচরণ! তার ঐ চোখদুটোতে এমন শক্তি ছিল যে আমি অনেক মূল্যবান কেউ এলেও তাকে সরে যেতে বলতে পারতাম না।
“খায়েগো এ তামাত কত জমি যে কইরা দিছি, তার হিসাব হেরা ক্যান, আমিও তো কইবার পারুম না!’ একটা দীর্ঘ চুমুক দিয়ে চায়ের কাপটা নামাতে নামাতে বলেন তিনি। তার লম্বাটে মুখটা শামুকের খোলের মত নীরব নেমে এলেও গালের ঝিল্লি দুটো বয়সের ভারেই কিনা হাপরের মত নড়তে থাকে বিরতিহীন!
“এবার কত পাখি জমির বায়না করতেছেন?” চেকটা লিখতে লিখতে জিজ্ঞাসা করি আমি। এমন নয় যে জগতদা লিখতে পারেন না, বা, আমায় দিয়ে লেখালে পর চেক পাসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যার একাউন্টে টাকা থাকে, তার চেক পাস সবখানেই হয়; স্বয়ং ঈশ্বর যেন টেলারের আসনে বসে যান তার সন্তানের যেকোন অসন্মান রুখে দিতে। তারপরো কেন এই পরনির্ভরতা, তা আমিও যেমন কোনদিন জিজ্ঞাসা করিনি, জগতদাও মুখ ফুটে বলার প্রয়োজন অনুভব করেননি।
‘ছোড খাঁ বাপের মত না, পুরাই আলাদা কিসিমের। বাপে তো সময় পাইলেই শলা-পরামর্শ করত মাইনসের লগে - তার কাচারি ঘরডায় দরবার চলত ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু আমাগো ছোট খাঁ এক কথার মানুষ। হেদিন বাসায় ডাইকা কইলেন, যত জমি পান, কিনা ফালান। টাকা নিয়া ভাইবেন না।‘ যেন খুব একটা খুশীর সংবাদ দিচ্ছেন এমনি এক স্বরে যখন বলতে থাকেন জগতদা, প্রসারিত ঠোঁটদুটোর উপর রোদের আগুনে তৈরী ফোস্কার আইলগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ে।
“তা জমি খুঁইজা পাইছেন? এই সময়ে এত বিশাল জমি…” আমার লেখা শেষ হলে চেকের পেছনের স্বাক্ষরগুলো দিতে থাকেন তিনি, আর তার আঙুলগুলো প্রবল দাপটে কাঁপতে থাকে।
“কী কয়! ভগবানের দুনিয়ায় জমির কোনদিন অভাব হইতে পারে, স্যার? অভাব তো যাগো পয়সা নাই, তাগো লাইগা!” ছোট খাঁ, মানে, রেজওয়ান খাঁয়ের একাউন্ট থেকে আগেভাগেই অনেকগুলো টাকা ট্রান্সফার করা হয়েছিল জগতদার একাউন্টে। জমির বিক্রেতা খা’দের চেনেন না, জগতদাকে চেনেন, আর বিশ্বাস শুধু তাকেই করেন। জগতদা যেন তাদের কাছে কোন জমির দালাল না, সে একজন মুন্সী, যাকে মান্য করে ক্রয় ও বিক্রয়ের টেবিলে দু’দল মানুষ নিশ্চিন্ত বসে যেতে পারে।
আমি চেকটা পিয়ন ডেকে পাঠিয়ে দেই কাউন্টারে। আর নিজ আসন থেকে উঠতে হবে না তার জন্য কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই হয়ত তিনি গলার স্বরটা একটু নামিয়ে - যেন কেউ শুনতে পেলে ভারী বিপদ হবে – এমন একটা ভঙ্গীতে ঘটনাটা প্রকাশ করেন, “জমি তো আরো তিন মাস আগেই কেনা আছে! মৌখিক বায়না, বুঝলেন! প্রায় ২০০ পার্সেন্ট লাভ, তাও কোন কোন সময় পুরা টাকা না খাডাইলেও চলে! আমাগো মুখের কথাতেই সব কিছু হয়, লিখিত লাগে না!“ ব্রাউন কালারের একটা শার্ট পরা ছিল জগতদা, উপরের দিকের দুটো বোতাম খোল, আর সেখান থেকে উঁকি মারছিল সাদা পশমের জঙ্গল।
বিদেশী বন্ড টাইপের কোন লিখিত চুক্তি সই হয় না এখানে। কোটি কোটি টাকার কেনাবেচা মুখেই হয়েছে - এরকম অনেকগুলো ঘটনার সাক্ষী আমি নিজেই। না চাইলেও তারা আমাকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় তুলবেই; বোধ করি, আমারও জগতদার মত একটা বিশ্বাসের জায়গা তৈরী হয়েছে। এই জগতটা এমন যে ক্রেতা ও বিক্রেতার একে অপরের সাথে কোন দেখাদেখি হয় না। তারা শুধু চেনে জগতদাকে; সিকি শতাংশ বা তারও কম মূল্য দিয়ে বিক্রেতার কাছ থেকে বায়না করে নেন জগতদা, তারপর একটা নির্দিষ্ট সময় পর ছোট খাঁ বা এমনি সব সাহেবরা রেজিস্ট্রি করে নেন। কাগজপত্রে ঝামেলা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা এই এলাকাগুলোতে। কিন্তু জগতদাদা যেন একটা নিরাপদ সাইনবোর্ড, যা দেখে সাহেবরা নির্ভয়ে পথ চলতে পারেন রাশি রাশি জমিতে!
‘আপনি ভিন্ন ধর্মের জেনেও মানুষজন আসে আপনার কাছে..’ মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায় আমার, আর তারপর শংকিত নয়নে অপেক্ষা করতে থাকি একটা কড়া রিয়াকশ্যানের! কিন্তু জগতদা যেন উল্টো আমোদ পেয়ে যান, “আরে স্যার, এইহানেও তো সুবিধা! হেরা এইজন্যই তো আমারে বেশী বিশ্বাস করে স্বজাতির মানুষগুলার থাইকা।“ জগতদার চোখজোড়া বেষ্টন করে ছিল সোনালি ফ্রেমের গ্লাস। তার বুক-পকেটটা খুচরো নোট, ভিজিটিং কার্ড, চিরুনি, রুমাল প্রভৃতির ভারে সামনের দিকে এতটা নুয়ে পড়েছিল, ভেতরের সব কিছু টেবিলের এপার থেকেও চোখে পড়ছিল।
চেক আসতে দেরী হচ্ছিল কাউন্টার থেকে। কিন্তু জগতদার তাতে বিরক্তি বা ক্ষোভ নেই। আরো এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে কি যেন এক চিন্তায় ডুবে যান তিনি। আমার মনে হতে থাকে, কঠিন কোন অঙ্ক চলছে তার মাথায়, কড়ায় গন্ডায় শতকে। বিলম্বের দায় থেকেই কিনা, আমি আলোচনাটার ডালপালা মেলার চেষ্টা করি, ‘আপনার কয় ছেলে-মেয়ে, দাদা?’
“কোন মেয়ে নাই, স্যার। দুইটা ছেলে আছে খালি। বড় ছেলেডা বিএ পাস করছে। টানা দশ বছর বিদাশ কইরা দ্যাশে আইছে দুই সপ্তাহ হইল। অহন ছোডডা যাউনের লাইগা পাগল কইরা ফালাইতেছে।“ মাথার লম্বা টাকটায় হাতটা বুলাতে বুলাতে বললেন জগতদা। তার কণ্ঠে কোন বিরক্তি নেই, বরং কেমন যেন একটা স্বস্তি, একটা অবধারিত পরিণতি খানিক আগেই দেখতে পাওয়ার আনন্দকে নিঃশ্বাসের চাপায় আড়ালের চেষ্টা।
আমি অবাক হই না। বিদাশ করা, আরো লৌকিক অর্থে, দুবাই আর মালয়শিয়া যাওয়া, এখন আর প্রয়োজন না, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে সন্মান, যেন জীবনে অন্তত একবার বিদাশ না করা একটা কলংক, পৌরুষের সাথে আপোষ করার নামান্তর এই এলাকার ছেলেগুলির। তাই দেখা যায়, যে ঘরে দাদা, বাবা, কাকা বিদেশ করেছে, সেই ঘরের এইট ক্লাস পাস করা ছেলেটি যেই নাইনে উঠেছে, ইমিগ্রেশানের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে দিয়েছে।
‘বড় ছেলে কামাই করে কেমন?’ আমি একটা অফিস নোট সই করার ফাঁকে জিজ্ঞাসা করি, আর দূরের গ্রাহকদের লাইনের দিকে উঁকি মারতে থাকি। আজ লোকজন তেমন ছিল না, তবু জগতদার সাথে এতখানি সময় কাটানো আমার অসস্তিকে স্ফীত করে যেতে থাকে।
‘আরে হেইয়া জিগায়েন না, তার কত ইনকাম হে নিজেও কইবার পারবো না! একটা ওয়ার্কশপে কাম করতেছিল, এক শেখের পছন্দ হইয়া গেল, হের ব্যবসা সামলানির পর বছর তিনেক হইল নিজেই ব্যবসা দিছে। মায়েরে চিডিতে বেবাক জানাইত - পরথম পরথম সামলাইতে কষ্ট হইত, ভোর হইতেই না কি কাস্টমারের ঝাঁক নামতো। অহন লোক লইয়া লইছে দ্যাশ থনে, আর দোকানও মাশাল্লা বাইড়া চাইরডা হইছে।“ এক নাগাড়ে কথাগুলি বলে একটু দম নেন জগতদা, আর ময়লা ফতুয়াটার কানাটা সামান্য উঠিয়ে কি যেন দেখতে থাকেন।
‘’তাইলে তো এখন অবসরে যাইতে পারেন পোলার হাতে সংসারের ভার দিয়ে” আমি চট করে জিজ্ঞাসা করে ফেলি কাউন্টার থেকে চোখ না সরিয়েই। আমার পা জোড়া উঠি উঠি করছিল, আর তার সংকেত খুব সম্ভবত পৌঁছে যাচ্ছিল কণ্ঠদেশে। এখন একদম শূন্য হয়ে পড়েছে কাউন্টারটা, আর জগতদা চাইলে ঐখান থেকে সার্ভিস নিয়ে বাসায় চলে যেতে পারেন। কিন্তু চেকটি ফিরে এল আমার রুমে তার আগেই, কাউন্টার থেকে জানানো হল, লেনদেন সীমা অতিক্রম করায় জগতদার কে-ওয়াই-সি, মানে, নো ইউর কাস্টমার আবশ্যক।
‘’ হেইডা তো কতদিন ধইরাই কইতেছে! মায়েরে চিঠি লেখছে, ‘বাবারে অন্য মাইনসের জমির দালালি বন্ধ করতে কও। বাবা যা আয় করে, তার তিন ডবল টাহা আমি পাডামু তার লাইগা।‘ অহনো ডরায় আমারে, তাই মায়েরে লেখে, বুঝছেন স্যার! ছোডকালে দুষ্টুমি করলে হাড়গোর আস্ত রাখতাম না, ছাল তুইলা হালাইতাম! পোলাপাইনের বদমায়েসিরে আমি হারা জীবনেও পাত্তা দেই নাই!“ বলে এমন করে মুখটা খুললেন জগতদা যে, সঙ্গে সঙ্গে একটা আকর্ণ বিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে পড়ে চারধারে।
তাহলে ছেলের অনুরোধটা রাখছেন না কেন – এ কথা আর আমি জিজ্ঞাসা করতে গেলাম না তাকে। কারণ এখন মনে হচ্ছে, মরণের আগ পর্যন্ত এই ব্যবসা ছাড়বেন না তিনি। জমিগুলো যেমন সবসময় এক রকম না – কখনো তৃণের দখলে চলে, কখনো পুড়ে যায়, কখনো ঝুরঝুর করে পড়তে থাকে, আবার, কখনো দুফাঁক হয়ে যায় বুক চিরে, উঁচু পাহাড় হয়… তেমনি জমির ক্রেতা-বিক্রেতার জীবনেও আসে পরিবর্তন, তারাও জলে বা বাতাসে এক সময় প্রস্তর হয়। জমির সাথে যেন তার ক্রেতা-বিক্রেতার একটা সমান্তরল জীবন, যা অন্তহীন ও অনিঃশেষিত। আর জগতদা মনে করেন, পৃথিবীতে তিনিই একমাত্র জমির ব্যবসাটা বোঝেন এবং তিনি না থাকলে ব্যবসাটা যখন আর থাকবেই না, সেক্ষেত্রে মানুষ কী করে জমি কিনবে!
থাক্ বাবা! আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তাকে ঘাটানোর! বরং আমি কেওয়াইসিতে মনযোগ দেই, “আপনার বাড়িতে আর কে কে আছে?”
যেন খুব কঠিন একটা প্রশ্ন করা হয়েছে আর তার উত্তর অনেকটা মনে করে নিয়ে বলতে হবে, ঠিক সেরকম গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটা সময় মোড়ানো কাগজের মত খসখসে আওয়াজটা বেরুলো, “আফনের বউদি, আর পুতের বউ।“
“বলেন কী, কবে বিয়ে করালেন ছেলেকে” আমি আচমকা প্রশ্ন করে ফেলি। আমার ভেতর কৌতূহল ভর করেছিল, না কি, আমোদ যা একটি শ্রেণীর ব্যক্তিগত বিষয়ের বিবরণে চিরকালই অন্য শ্রেণীটির মধ্যে তৈরী হয়, তা এখন আর মনে নেই।
“এইত গেল মাঘের কথা। আফনে তহন আছিলেন না, থাকলে নিশ্চিত দাওয়াত পাইতেন। অনেক বড় অনুষ্ঠান হইছিল। খাঁ সাহেব তো দলবল লইয়া আইছিল! “
“সাংঘাতিক ব্যাপার! এত বড় অতিথি! তো কি খাওয়ালেন খাঁ সাহেবকে?” আবারো! কৌতূহল না কি আমোদ থেকে উৎসরিত হয়েছিল প্রশ্নটা, বলতে পারব না।
“পুলার মায়ে টেবিলভর্তি খাবার সাজায় রাখছিল। পিডাই ছিল দশ পদের …কিন্তু…” বলেই আবার মুখটা খোলেন, আর হাড়মাংসের মধ্য থেকে চিকন রশির মত হাসিটা বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপার হল, খাঁ সাহেব শুধু যে নিজেই হাজি, তা না; তার পূর্বপুরুষরা ছিল নামজাদা পীর। সেই বংশের মানুষদের জগতদার ঘরে ঢোকাই তো যথেষ্ট! বস্তুত জগতদাও টেবিল ভর্তি করে খাবার সাজিয়ে রেখেছিলেন শুধুই সৌজন্যবশত, না হলে তিনিও কি জানতেন না যে খাঁ সাহেবরা ও খাবার ছুঁয়েও দেখবে না!
“ছেলে ও বউ কেমন আছে এখন? বউ তো মনে হয় আপনার ঘর আলো করে রাখছে!” আমি অপ্রীতিকর সড়ক থেকে মোড় ঘোরাতেই প্রশ্নটা করি।
“বউরে নিয়া যাবে এবার বিদাশ। আমি বাঁধা দিতে গেছিলাম, কিন্তু পুলার মায়েই জোর করল, কয় কি, পুলায় আমার অনেক কষ্ট করে বিদেশের মাটিতে! কি খায়, কই ঘুমায়! বউ গেলে জীবনডা ….“ আবার হাসির পারদটা চড়তে শুরু করে তার প্যাঁচানো গহবরটা থেকে!
“আচ্ছা, আপনার সহায় সম্পত্তির কি অবস্থা? জমি-জমা স্থাবর অস্থাবর বিষয় আশয় …” আমি পরিবারকে ছেড়ে এবার সম্পদ-দায়দেনার বিবরনীতে টার্ন নেই। কে-ওয়াই-সির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটা পার্ট।
‘’একটা ঘর আছে, আর কিছু গাছ, আর কিছু নাই কা স্যার।“ বলেই জগতদা জানান তার একটু ফ্রেস হওয়া প্রয়োজন। অনেক ক্ষণ ধরে একটানা বসে আছেন, মুরব্বী মানুষ, আমি ব্যস্তসমস্ত হয়ে তাকে টয়লেট দেখিয়ে দিতে গেলে, তার হাতের আঙুলগুলো নড়েচড়ে উঠল, “না না, আফনের আগেই চেনা আমাগো … আফনে নতুন আইছেন, আর সব তো আছে আগের মতই!“
এ পর্যন্ত করা কেওয়াইসি ফর্মটাতে চোখ বুলাচ্ছিলাম।একটা সূত্র কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না! যিনি সারা জীবন জমির ব্যবসা করলেন, তার কিনা সম্বল বলতে ভিটেমাটিটুকু! নাহ! এ হতে পারে না! লোকটা কিছু লুকোচ্ছে! কোন ঘাপলা নেই তো! আমার নাকটা গোয়েন্দাদের মত খাড়া হয়ে উঠে!
‘আফনেগো অফিসডা আমার বরাবর পছন্দের! সব কিছু ফ্রেস! ক্লিন!” জগতদার কণ্ঠস্বরে ধ্যান ভাঙে আমার! কাহিনির কোনাকাঞ্চিগুলো খুঁড়তে শুরু করে দিয়েছিলাম ইতিমধ্যে!
“আচ্ছা, জগতদা, অনেকে তো বেনামেও সম্পত্তি ….”
“প্রশ্নই উঠে না বেনামে জমি কেনার ….আমার সম্পদ বলতে যা কইছি ঐটুকুই…যে কাউরে জিগাই দেখতে পারেন, স্যার! জমির কোন নেশা নাই আমার, কোন কালেই আছিল না!” আমার মুখ থেকে প্রায় ছোঁ মেরে কথা কেড়ে নেন জগতদা। তার চোখ-মুখ একটু আগে ঝাপ্টা মারা জল ফুটফুট করছিল। আমি সেই জলের দানাগুলোর মাঝ দিয়ে ভাল করে তাকাই। জীবনে এতটা বিস্মিত শেষ কবে হয়েছি মনে পড়ছিল না!
‘স্যার, মনে হয় একটা ভুল করছেন আমার ব্যাপারে! আমার পেশা জমি কেনাবেচা কইরা দেয়া, জমির মালিক হওন না। হেইডা তো খাঁ সাহেবগো পেশা!’ জমির মালিক হওয়া যে একটা পেশা, তা আমার জানা ছিল না আগে! আর জমির ব্যাবসায়ীরা যে জমির মালিক হতে পারে না, তাও অজানা ছিল। আমার মাথাটা যত সময় গড়াচ্ছিল, আরো বেশী করে ঘুলিয়ে যাচ্ছিল।
“তাই বলে, এক আধ ছটাক জমিও করেননি সারা জীবনে!! ধরে নিলাম, আপনের কোন লোভ নাই জমির; কিন্তু মানুষ তো তার বালবাচ্চার জন্য হইলেও কিছু সম্পদ করে!” এক নাগাড়ে কথাগুলো ছেড়ে দেয়ার পর রীতিমত হাঁপাতে লাগলাম আমি। বিষ্ময়ের ঘোরটা তখনো কাটেনি আমার, বরং আরো গহীন পথে নিয়ে ঘোরাচ্ছিল!
“জমির খায়েস যে আমার একদমই আছিল না, তা না, স্যার! রক্তমাংসের মানুষ তো! কিন্তু আমি যদি জমির নেশা করতাম, তাইলে কেউ আমারে আর এতডা বিশ্বাস করত, কন? সারাডা জীবন আমি অনেক মেহনত করছি, তয় আমার পেশাডার ইজ্জত নষ্ট হইতে দেই নাই! হেই লিগা দেহেন, এই বুড়া বয়সেও এট্রু রেস্ট পাই না! সবাই খালি ডাকে! ”
চা চলে এসেছিল; দ্বিতীয় দফা চলছিল। চা দেখেই কিনা, আবার মুখটা ফাঁক করেন জগতদা, সেই অধিবৃত্তাকার গর্ভ থেকে আবার একটি হাসির রেনু ছড়িয়ে পড়ে, আগের থেকেও বেশী বেগে, আর বৃহৎ আকারে!
“আপনার ছেলে যে বিদাশ করল, সে তো আর আপনের মত জমির ব্যবসায়ী না, তাইলে তার তো কোন বাঁধা নাই। সেও কি কিছু জমিটমি করে নাই?” আমার বাক্যগুলো এলোমেলো হচ্ছিল। তবে বিষ্ময়ের গ্রহটা চলে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। আর কোথাও থেকে এসে এক দল ক্ষোভ দলা পাকাচ্ছিল!
এবার জগতদা যেন কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর … কী যেন ভুলে গেছেন, মনে করতে হবে … এমন একটা ভঙ্গিমা ফুটিয়ে তুলতে তুলতে বললেন, “আমি পুলাডারে কইছিলাম, এইডা আমাগো সাথে যায় না! দরকার হইলে ব্যাংকে রাইখা দে, স্বর্ন কিনা রাখ। কিন্তু হেই আবদার করল… এক পাখি জমি নাকি দেখছে সলিমুল্লাগো বাড়ির পাশেই, তার কাছে খবর আছে সত্বরই ছাইড়া দিব। মাথায় আইতেছিল না কিছু। গেছিলাম খাঁ সাহেবের কাছে পরামর্শ ….” এটুকু বলে থেমে গেলেন জগতদা! যেন ভাবছেন আর কিছু বলা ঠিক হবে কিনা! অথবা, বলার দরকারই আছে কিনা!
আমি কিছু বলি না, শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি জগতদার দিকে। কিছুক্ষণ পর তিনি মুখ খুলেন, যেন তিনি চান খাঁ সাহেবদের মত, অন্য সবার মত আমিও তাকে বিশ্বাসের চোখেই দেখি, “ হ, যা কইতেছিলাম খাঁ সাহেবের কাছে গেছিলাম দরবার করতে! তহন উনি জীবিত। তার পায়ের কাছে বইয়া পাড়ছিলাম কথাডা! সব শুইনা খাঁ সাহেব কইলেন, ভাল কইরা বুজা পুলারে!”
আমি চেয়ে থাকি, আগের মতই কোন প্রশ্ন যোগায় না মুখে।
“তিনি কইলেন, এত কষ্টের টাকা খালি খালি নষ্ট করবে ক্যান তোর পোলায়? এই দ্যাশ কি তগো? কিছু একটা হইলেই তো ঘঁটিবাটি নিয়া পলাইতে হইব, এতদিনেও হুঁশ হয় নাই? তয় খালি খালি টাকা-পয়সা নষ্ট করনের কি দরকার?” বলতে বলতে চোখ মুঁদে ফেলেন জগতদা! তার অবয়বে একটা নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ ভাঁজ ফুটে উঠছিল আস্তে আস্তে!
আমি আর সময় নষ্ট না করে চেকটা পাস করে স্লিপটা তার হাতে তুলে দেই। জগতদা হাড়সর্বস্ব শরীরখানা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে গেলে আমি কে-ওয়াই-সি টা নিয়ে বসে যাই। আমাদের একটা রিস্ক গ্রেডিং করতে হয় প্রতিটা হিসাবধারীর। জগতদার হিসাবটিতে এমন অনেক লেনদেন হয় যার সাথে তার সম্পদের হিসেবে বড্ড গরমিল - কারোই বিশ্বাস হবে না এই পরিসংখ্যান। অনেক ভেবেচিন্তে চরম ঝুঁকিপূর্ণ একটি গ্রেড কনফার্ম করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ি আমি। একটানা কেওয়াইসি করতে গিয়ে হাত-পা’র সাথে বাকী দেহটাও অবশ হয়ে পড়েছিল আমার।
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।